ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা -৮৩
সম্পাদকীয়,
মৃত্যু উপত্যকায় কোয়োটের সঙ্গে সাক্ষাৎ মলয় জেঠুদের। জেঠুদের গাড়ি দেখেও ভয় পায়নি। ভেবে দেখ কী সাহস? ঠিক অমিয় দাদার তোলা প্রচ্ছদের ছবির শালিখদুটোর মতো। দুটিতে ঝগড়া করে ডালের দুদিকে সরে বসে আছে। অমিয় দাদার ক্যামেরা দেখেও ভয় পায়নি! শালিখদুটো নিশ্চয়ই জিনিয়া আর পোলোর মতো সবসময় ঝগড়া করে। জিনিয়া আর পোলো কে? শুধু এটুকুই বলব ওরা পৃথা আর প্রমীতের মতো দু ভাই বোন। বাকিটা জানতে হলে পড়তে হবে তোমাদের বন্ধু শতভিষার গল্প। আরে ঝগড়া আর খেলা ছাড়া এখন কাজটাই বা কি? গ্রীষ্মের ছুটি পড়ে গেছে স্কুলে। গনাইএর মতো দুষ্টুমি করছো কি? অনেকে বেড়াতে যাবে জানি। গনাইদের বাড়িতে মামারা এসেছে। কে গনাই? ঐযে শুভশ্রী আন্টির গল্পের একটা চরিত্র। ওদিকে মিতা পিসি একটা ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে ছড়া লিখেছে সে চায়ের দোকানে কাজ করে কিন্তু পড়াশুনা করতে খুব খুব আগ্রহী। এসো আমরা এদের একটু সুযোগ করে দিই। এতে তো সমাজের ভাল হবে। সমাজের ভালোর জন্য অনেকেই ভাল ভাল কাজ করেন। এমন একজন মানুষ রাজা রামমোহন রায়। তাঁকে নিয়ে লিখেছেন পীযূষ প্রতিহার। উনি সতীদাহ প্রথা রদ করেছিলেন। এই সতী দাহ দিয়ে আজ আমাদের জয়াবতীর গল্প শুরু করেছেন তৃষ্ণা আন্টি। জ্যান্ত মেয়েকে আগুনে পুড়িয়ে মারার ইতিহাস খুব পুরোনো নয়। জানতে চাইলে ইতিহাস পড়ো। জানার কোনো শেষ নেই। জানতে গেলে পড়তে তো হবেই। স্কুল ছুটি থাকলেও পড়তে হবে। কেমন? - মৌসুমী ঘোষ।
ধারাবাহিক উপন্যাস
জয়াবতীর জয়যাত্রা
পঞ্চদশ পর্ব
তৃষ্ণা বসাক
১৯
‘সতী! চল তো দেখি? মেয়েমানুষকে জিয়ন্ত পুড়িয়ে মারবে? এই পানু, এই পুণ্যি তোরা মুখে শব্দ করতে পারবি খুব জোরে ‘হর হর মহাদেব হর হর মহাদেব’। বলে সে নিজেই এত জোরে বলে ওঠে ‘হর হর মহাদেব’ যে পিলে চমকে ওঠে ওদের।
পুণ্যি ভয়ে ভয়ে বলে ‘ এ আবার কী সব বলছিস রে? ডাকাতরা তো হারে রে রে রে রে বলতে বলতে আসে।’
জয়াবতী মহা ক্ষেপে গিয়ে বলে ‘যা জানিস নে, তা নিয়ে কতা বলতে আসিস কেন? এ কি তোর পাড়াগাঁয়ের ডাকাত পেয়েচিস? এ হচ্ছে মারাঠি বর্গীর দল। তারা ‘হর হর মহাদেব’ বলেই আসে। আর তোকে বলি পুণ্যি, যখন একটা ভালো কাজে বেরিয়েচিস, সর্দার যা বলে চুপ করে মেনে নিবি, কাজ সারা হয়ে গেলে প্রাণে যত সাধ আশ মিটিয়ে প্রশ্ন করবি’
পুণ্যি অবাক হয়ে বলে ‘সর্দারটা আবার কে? তাছাড়া আমরা কি ডাকাতদল খুলেছি যে সর্দার থাকবে’
এর উত্তরে জয়াবতী দাঁতে দাঁত চেপে বলে ‘কই, পানু তো তোর মতো তক্ক করছে না, কেমন লক্ষ্মী ছেলের মতো বসে আছে?’
‘বসবে না তো কি? সে তো মুচ্ছো গেচে!’
পুণ্যির এই কথায় চমকে পেছনে তাকিয়ে জয়াবতী দেখল, মুচ্ছো না গেলেও পানুর মুখ ভয়ে সাদা হয়ে গেছে, সে কোনরকমে পুণ্যির কোমর জড়িয়ে বসে আছে। ভারি বিপদ, হাত পা ছেড়ে যদি ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়ে হাত পা ভাঙ্গে তো তারা আর সেনমশাইয়ের কাছে মুখ দেখাতে পারবে না সে।
আপদটা শেষ মুহূর্তে এসে জুটে সবাইকে ডোবাবে দেখছি। অন্য সময় হলে জয়াবতী ওকে দুটো কড়া কথা শুনিয়ে দিত। কিন্তু তার এখন মাথার মধ্যে অন্য চিন্তা খেলে গেল। সর্দার যখন সেজেছে, তখন দলের সবাইকে রক্ষা করা তার কাজ। যুদ্ধের সময়, সামনে যখন শত্রু, তখন নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করলে, ক্ষতি বই লাভ নেই। সে ফিসফিস করে নরম গলায় পানুকে বলল ‘এই পানু, চোখ চা, তোর ভয় কি? আমরা আচি তো। তবে কিনা তোর সেথোরা যদি শোনে, আমি আর পুণ্যি যুদ্ধু করেচি আর তুই মুচ্ছো গেছিলি, তবে তোকে তো তারা দুয়ো দেবে, বল তুই?’
দশটা গালাগালের থেকে এই একটা মিষ্টি কথায় আশ্চর্য কাজ হল! পানুর কান দুটো ঝাঁঝাঁ করে উঠল লজ্জায় অপমানে, বন্ধুদের কাছ থেকে দুয়ো শোনার চেয়ে যুদ্ধু করতে গিয়ে মরাও ভালো। দুটো মেয়েমানুষের কাছে হেরে যাবে সে? সে না পুরুষমানুষ! যেমনি ভাবা, অমনি তার ভয় কোথায় চলে গেল! শরীরের রক্ত গরম হয়ে উঠল। পুণ্যির কোমর ছেড়ে সোজা হয়ে বসে সে বলল ‘হর হর মহাদেব! হর হর মহাদেব!’
জয়াবতী বলল ‘এই তো চাই, চল তো দেখি আমরা থাকতে কেমন মেয়েমানুষকে জীয়ন্ত পুড়িয়ে মারে!’
কতগুলো বাবলা আর আশশেওড়ার ঝোপ পার হয়ে ওরা একেবারে নদীর ধারে চলে এল। দুপুরের পড়ে আসা রোদে নদীর কি চমৎকার শোভা! কিন্তু সেসব দেখবে কি? ওরা যা দেখল, তাতে ওদের আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেল।
নদীর ধারেই শ্মশান, এ গ্রাম শুধু না, পাশাপাশি গাঁয়ের মড়াও এখানে পুড়তে আসে। আজ সেখানে কয়েকটা লোক জোরে ঢাকঢোল বাজাচ্ছে, চিতার ওপর একটা থুত্থুড়ে বুড়ো শোয়ানো, আর একটা বড়জোর দশ এগারো বছরের মেয়ে, পরনে লাল বেনারসী, গলায় জবাফুলের মালা, মাথায় সিঁদুরের কৌটোটাই উপুড় করে দেওয়া হয়েছে, মেয়েটাকে ধরে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে চিতার দিকে। পুণ্যি ফিসফিস করে বলল ‘মেয়েটা নিজের ইচ্ছেয় মরতে যাচ্ছে রে, দেখ কোন বাধা দিচ্ছে না। সতী হওয়া বড় পুণ্যের কাজ রে গঙ্গাজল, বাধা দিস না।’
‘পুণ্যের কাজ! ওকে আপিম খাইয়ে রেকেচে বুজতে পারচিস না। শোন হাতের লাঠিটা তুলে শূন্যে ঘোরাতে থাক, আর খুব জোরে জোরে বল ‘হর হর মহাদেব’
ওরা একটা বাবলা গাছের আড়াল থেকে দেখছিল। মুহূর্তের মধ্যে ওদের ঘোড়া একদম সতীর সামনে এসে পড়ল। সবাই হাঁইমাই করে উঠল ‘ওরে বর্গী এসেচে রে, পালা পালা’
এরপর আর কী! সতী মেয়েটকে তুলে ওরা জোরে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল বাড়ির দিকে। বাড়িতে নিশ্চয় অনেক বকুনি অপেক্ষা করছে তাদের জন্যে।পুণ্যি বলল ‘কপালে কী যে আছে কে জানে রে গঙ্গাজল। একে তো ঘোড়া নিয়ে বেরিয়েছি, তার ওপর এই মেয়েটাকে নে যাচ্ছি’
‘অত না বকে মেয়েটাকে ধরে থাক শক্ত করে। দেকছিস তো মুচ্ছো গেছে। আর দেক পানু, দেক পুণ্যি, নদীর ওপর দে কেমন পাখি উড়ে যাচ্ছে। আকাশে উড়তে কী আনন্দ তাই না রে? আমরা মাঝে মাঝে একেনে বেড়াতে আসব, আর এই নতুন সইকেও আনব’
‘কী বলে ডাকব ওকে?
‘আমি জয়াবতী, তুই পুণ্যবতী আর ওর নাম থাক পেরজাপতি। ওকে কেউ ধরতে পারবে নে, ও কেবল উড়ে উড়ে বেড়াবে!’ ( ক্রমশ )
একটু যদি...
মিতা ঘোষ
ছোট্ট একটা মেয়ে
পাড়ার চায়ের দোকান থেকে
কাগজ পড়ত চেয়ে।
বড্ডো গরীব জানেন মশাই
পেট ভরে না খেয়ে।
সে পড়তে ভালোবাসে।
পাড়ার লোকে টিটকারি দেয়
হা হা করে হাসে।
বলে-
লোকের বাড়ি কাজ ধরগে
স্বপ্নতে না ভেসে।
ইস্,
সাহস কতো মেয়ের!
পায়না জামা, বই-পেন্সিল
কারোর কাছেই চেয়ে।
চা-ওলাটা কখন সখন
মারতে আসে ধেয়ে।
বলে-
কাগজ পড়িস পরে।
ওসব গুলো আছে কেবল
কাস্টমারের তরে।
শুকনো মুখে যায় ফিরে মেয়ে
ফুটপাথেরই ঘরে।
ওই দোকানে এসে।
একটি বাবু রোজ সকালে
চা খান বসে বসে।
মেয়ের পড়ার আগ্ৰহটি
খেয়াল করেন শেষে।
বাবু
বলেন, ওরে মেয়ে
পড়াশোনা করতে কি চাস
আমার ঘরে গিয়ে?
আমিই তোকে রোজ পড়াব
পড়িস খেয়ে দেয়ে।
মেয়ে,
বাবুর বাড়ি গেল
পড়ার শেষে বাবুর সাথে
একথালা ভাত খেল।
গিন্নি খুশি, বিন পয়সায়
কাজের মেয়ে পেল।
বাবু করেন রাগ
কাজ করতে আসিস নাকি?
যাহ্, এখনই ভাগ!
নীরব মেয়ে, কেবল স্লেটে
কাটতে থাকে দাগ।
সেই মেয়েটি আজ
বছর বিশেক পরে দেখো
মাথায় পরে তাজ।
বাবু, মায়ের মেয়ে হয়েই
করছে দেশের কাজ।
তোদেরকেও বলি
একটু যদি সাহস করে
এদের ঠেলে তুলি।
কে জানে কোন কয়লা মাঝে
হীরের ঝলক পেলি!
সবাই মিলে একটু যদি
করি দেশের কাজ
নইলে মিথ্যে মানুষ জন্ম
ব্যর্থ সবই আজ।
সামার ভেকেশন
শুভশ্রী সাহা
গনা মানে গনাই, মাথা গরম করে পাড়ায় বেরিয়ে পড়ল এই ভর বেলাতে। তার আগে ঝাঁকা নাকা করে প্রায় নাকে খত দিইয়েছে তার মা,কী অপমান! মালতী পিসি এমনকি তার দলের দিদাটা পর্যন্ত মায়ের সঙ্গে আজ! দিদাকে তো সে দেখেই নেবে, একশো বছরের রেডিও, দশ বছরের পুরোনো মোবাইলটা, হ্যানা ত্যানা সারাতে বলুক না দেখি একবার! আর কাকে কী বলবে আসার কথা দিদার, সঙ্গে চালিয়াত মামাটা আর তার মোটকা ছেলেটাও সঙ্গে হাজির। শিলচর থেকে সোজা এই মালদায়। গরমের ছুটি কোথায় আনন্দ করে খেলে বেড়াবে তা নয়, মামার ফাই ফরমাজ খেটে মরতে হচ্ছে তাকে। তার ভাইটাও একজন, বোঁদা পাব্লিক, মায়ের ল্যাজ ধরে ঘুরে বেড়ায় আর একটুতেই নাকে কাঁদে। এটা একটা সামার ভ্যাকেশন হলো! বাবা দিব্যি নিয়ে যাচ্ছিল বেড়াতে, উফফফফ সব এসে কিনা জুটলো।
বল্লু এসে হাজির হলো তার কাছে। ল্যাজ নাড়ছে ঘন ঘন,
--কী চাই কী তোর! বাড়িতে যা, মা দেবে তোকে
বল্লুর বাড়ি যাবার নাম না করে দু পা তুলে দিল ওর কোমরে!
-- বল্লুম তো ওই বাড়িতে যাওয়া মানেই অপমান বুঝলি! মামা এসেছে ধামা বাজাতে,
দেখছিস তো খালি গব গব করে গিলছে আর জ্বালিয়ে মারছে!
-- ভোউ ভৌ করে বল্লু উত্তর দিয়ে বলল,সে আর বলতে, একটা লেগপিস হলেও মা আমায় দেয়। কাল মেটে দিয়েছে, আমি মেটে খাই বল তো! ভৌ ভৌ!
তা বল্লু তাদের বাড়ির ছেলে, হক আছে বইকি!
বল্লু নিজের ভাগের লেগ পিসের শোক সামলাতে না পেরে গনার পাশের দু হাতের উপর মুখ রেখে শুয়ে পড়ল।
সত্যি! মামার গুস্টি আসার পর থেকেই তাদের দিন টা খারাপ যাচ্ছে। এই সময় সে আর বড়দা মিলে চারবার সবেদাবাগান চোষে ফেলত! মা এবার ডাকুক, বল্লু সোনাবাবা আমার, উত্তরই দেবে না সে। উফফফ ওই পাগলাটা আসছে! বকিয়ে মারবে এবার! বল্লু চোখ বুজিয়ে নিল!
-- কি র্যা! এত তাতবেলাতে রকে বসে আছিস যে! পাগলা নাকি তুই! হারু তার ছিরকুটে দাঁত বের করল।
হারুটা পাগলা মাগলা পুরো,তাদের এমনিতেই বাড়িটা বড়, তায় বাগান ওলা। আর সঙ্গের আমবাগানটা মেলা বড়! সেই বাগান মাগান পরিস্কার করে হারু। তার থেকে সামান্য বড়। কিন্তু হেব্বি স্পিনার। উড়ন্ত তুবড়ির মতো বল গিয়ে ধাঁ করে উইকেটে পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু ওই, লেভেলের পাগল বলে বিল্টুরা রাগ করে খেলায় নেয় না!
-- কী র্যা, পড়ালেকা মাথায় তুলেছিস নাকি! তোর কাঁদুনে ভাইটাকে দেখেছিস! সারাদিন পড়ে যাচ্ছে। ও মাইরি কাকার মতো ডাক্তার হবে। তুই মাইরি কম্পাউন্ডার ছিপি খুলে জল মেশাবি, হি হি!
কথা শেষ হতে না হতেই ঘুষি লাগাল গনা, কিছুটা লাগল, হাতে। পুরো লাগলে রোগা পটকা হারুর কপালে দুঃখ ছিল। হারু বসে পড়ল থেবড়ে আর বল্লু খ্যাঁ খ্যাঁ করে তেড়ে গেল। তা গনার তাতে ঘন্টা সে উবু হয়ে বসে বিস্তর দাঁত বার করে হাসতে লাগল। তারপরেই বলল তোর এই লেড়িটাকে না একদিন ও পাড়ার কালুর সঙ্গে ভিড়িয়ে দেব, দেখিস কী বাটাম খায়!
গনা কিছু বলার আগেই ওর মুখের কাছে ধেয়ে গেল বল্লু, পরিস্কার শুনতে পেল বল্লু বলছে,
মুক সামলে কতা বল পাগলা, মাংস তুলে চড়চড়ি করে দেব! আমাকে চমকাচ্ছিস! তাও ওই ভুষি মালটার জন্য! জানিস আমার মা আমাকে কী কী খাওয়ায়! ছাল বাগলা তুলে ডুগডুগি বাজাব কালুর! চমকাবি না, একেনেই আচি, ডাক তোর কালি ধলি কে আচে!
এক নাগাড়ে ওর মুখের সামনে ভৌ ভৌ করছে বল্লু। হারু মাথা চুলকে নিয়ে বলল ব্যাটা টের পেল কী করে ওকে বলছি! নে বাপ তুই থাম এবার।
গনা রাগের মধ্যেও হেসে ফেলল, আরে ও সব বোঝে, তোর চে বেশি ব্রেন!
হুম! তা তুই একেনে ভিরকুটি মুখ করে বসে কেন, তোর সেই কাপ্টেন বন্দু কই! ব্যাটা ব্যাট ধরতে পারে না ওপেনার হইচে!
বলতে বলতেই দেখা গেল বিল্টু আর সতে পা চালিয়ে আসছে। বিল্টুকে দেখেই কাটার তাল করছিল হারু। বিল্টুর কিছু থাক বা না থাক দুরমুষে রাগ আছে খানিকটে, আগে কষিয়ে দেয় ঘা কতক পরে কথা। হারু মুখে কুলুপ দিল।
কিরে! খেলতে যাচ্ছিস না ক দিন! প্রাক্টিস করতে হবে না! হ্যাবলারা তো আদাজল খেয়ে লেগে পড়েছে!
বিলটু ঝাঁঝ মেরে বলল কথাটা। তা সত্যি, গনা ফাস্ট বোলার, ধুপধাপ বল ফুটিয়ে দেয়। আজ ক দিন হলো বেকায়দায় আছে সে পাকা মামাটার জ্বালায়। কে জানে এবার জ্যাটতুতো খুড়তুতো সব দলে দলে তাদের বাড়ি চলে আসবে।
উফফফ, এই গরমের দিনে সবেদা বাগান শংকর নার্সারির বাগান তারা কী রাখত!
সতে চিল্লে উঠল, চল চল আজ বিকেলেই সব নামিয়ে দিই!
সতে উত্তেজিত জনতা, আম না আঁটি না ভেবেই কাজ করে ফেলে!
থাম তো! আমি কী ইচ্ছা করে বাড়ি বসে আছি! কী মনে হয় তোদের, আরে মায়ের জাঠতুতো ভাই না কী কচু এসেছে, বে কায়দার লোক রে ভাই, কী শাসন, নয় ফাই ফরমাস খাটিয়ে যাচ্ছে। মা তাকে একেবারে মাছ মাংস লুচি মিষ্টি পোলাও গেলাচ্ছে। বেরোতেই দিচ্ছে না। অঙ্ক কষিয়ে মারছে।
বল্লুর একটু ঝিমুনি মত এসেছিল, মাছ মাংসের কথা উঠতেই তার সেই মেটের কথা মনে পড়ে গেল। সেও বলে উঠল,আমায় মা মেটে দিয়েছে রে বিল্টে! আমি কি মেটে খাই! বেড়ালে খায়। ইসস কী মাটি মাটি গন্ন!
একটু দূরেই দত্তদের আদুরে হুলো বেলি করবী গাছের ছায়ায় শুয়ে ঘুমাচ্ছিল। হট্টগোল শুনে তার ঘুম এমনিতেই ভেঙে গেছিল আগেই।
সে বল্লুর দিকে চোখ মোটা মোটা করে তাকাল।
এই খবরদার মিচে কতা বলবিনা! বেড়াল কবে থে মেটে খায় র্যা! এ মা ছিঃ! ওই সব ছাগলে খায়।
কাঁঠাল পাতা চুবুচ্ছিল একমনে মুঙলি, সে এবার মুখ ফিরিয়ে বলল,
খামোখা আমাদের জড়াচ্ছিস কেন রে বেলি!
আমরা শাক পাতা খেইয়ে থাকি, তোদের মত মাছ মাংস গিলি নে! বেহায়া চোর কোথাকার!
মুখ সামনে কতা বল, ব্যাটা ছাগল!
বেলি মুখ ঘুরিয়ে নিলেও নাক দিয়ে ফোঁস ফোঁস করতে লাগল।
বিল্টে কিছু বুঝল না সে শুধু শুনল বল্লু ভৌ ভৌ করছে, ম্যাও ম্যাও করছে বেলিটা আর ছাগল টা ব্যা ব্যা!
আ খেল যা! এই কুকুর বেড়াল গুলো চিল্লে মরছে কেন! উফফফ এমন গরমের দিনে আমার শুধু খিদে পায় রে গনা!
এবার, সতে, বিল্টু গনা তিনজনেই তীব্র দৃষ্টিতে তাকাল হারুর দিকে!
রাক্ষস কোথাকার, এখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা চলছে, খাই খাই করে মরছে!
--- যা না আমাদের বাড়ি, তোর খাবার তো বাঁধা। গনা উদাসীন স্বরে বলল, আজ লুচি পায়েস করেছিল, মুখেও দিই নি!
হারু উত্তেজিত হয়ে উঠে বসল। তার ফাটা প্যান্ট দেখে বল্লু হেসে উঠল।
তুই কী রে গনা, লুচি হলো গে ঠাকুরদের খাবার দাবার, তুই ফেলে রাখলি! বলি তুই কী বোকা না বলদ! ওই জন্যে অঙ্কে ফেল মারিস।
সবাই জানে হারু পাগলার মুখের ট্যাক্সো নেই। যা পারে বলে দেয়! ওর বাবা বলে ওই নাকি প্রকৃত মেধাবী ছাত্র! অবশ্য কথা নেই বার্তা নেই টক টক করে অঙ্ক কষে দেয়। কে জানে ওকে তো গনার পুরো ভূত লাগে। আদাড়ে বাদাড়ে চষে বেড়ায়। ভয় ডরের নাম নেই। গনার ও ভয় ভীতি কম। তাই জন্যেই হারুটা ওর পিছে পিছেই থাকে। কিন্তু মুখে সে বললে,
-- যা না তুই গেল গে! কে মানা করেছে!
-- আহা, চটিস কেন, তোর তাহলে মামা কে নিয়েই যত সমস্যা! তাই তো!
-- এক নম্বরের চালিয়াত চন্দর! সবজান্তা!
-- আই এবারে আমাকে নিবি রে তোদের ম্যাচে!
সতে শিউরে উঠল শুনে! বিল্টু তেড়ে এলো।
কিন্তু গনা ভাবল কী,ক্রিকেট কী ফুটবল পাগলা হারু চ্যাম্পিয়ন! তার তো এই অবস্থা!ওকে ব্যাক আপে রাখলে ম্যাচে তাত বেড়ে যাবে। ওর মনের ভাব বুঝেই চেঁচিয়ে উঠল সতে!
খবরদার না, মনে আছে ওর জন্য কচি পাতা সঙ্ঘের সঙ্গে কী হাতাহাতি হলো! পাঁচন কাকা না থাকলে সেদিন---
থামতো! তোর পাঁচন কাকা! ওই পচাটাই তো ঠেঙ্গাড়ে মোষটাকে ছেড়ে দিয়েছিল ইচ্ছাকরে!
আমার ফ্রি কিক টা না আটকালে এই কিশোর দল জিন্দাবাদ!
-- কীরে গনা ভুল বলেছি? কাকু কিন্তু তোকে বলেছিল! আমি শুনে নিয়েছিইইই, হি হি
-- ব্যাটা এক নম্বরের স্যায়না পাগল! গনা চটে উঠল।
বল্লু ভৌ ভৌ করে বলল,আমিও দেখেছিরে বড়দা, ঝ্যাঁটা চালাতে চালাতে শুনছিল হারু পাগলাটা! কিন্তু আমাকে সেদিন একটা ঘুষ দিয়েছিল বলে চুপ করে ছিলুম!
-- গনা তাজ্জব হয়ে বল্লুর দিকে তাকাল। বিশ্বাসঘাতক! --- স্যাট করে অমনি বল্লু ভল্ট মেরে পেছনে ঘুরে গেল ল্যাজ ম্যাজ নিয়ে।
--- সত্যি রে! পাঁচন কাকাটা সেম সাইড খেলেছে ! গনা?
সতের ভুষি ভরা মাথা, তাই বড়দের কথা সাত পাঁচ হয়ে যাবে ভেবে গনা বলল,
উফফফ ছাড় না! মোষ টা এলে কী হত বল তো! কী হয়েছে কচিপাতা সঙ্ঘ জিতেছে তো!
-- ঠিক হ্যায় আগলি বার দেখেঙ্গে! বিল্টু বলে উঠল।
তাদের এই জায়গাটা মালদার ইংলিশবাজারে। কিছুটা গঞ্জের ভাব থাকলেও সম্পন্ন এবং শিক্ষিত লোকের বাস। কিন্তু এখনো এখানে বেশ শান্ত ধীর স্থির পরিবেশ। এ পাড়া ও পাড়া, খেলাধুলা , উৎসব আনন্দ, গায়ে গা লাগিয়ে কবে থেকেই রয়ে গেছে।
--এই তো! আই, বড় খোকা, তুই এখানে, আর মা বাবা, ভাই দিদা সবাই বসে আছে না খেয়ে! তুই কীরে রে,কত বেলা হলো খেয়াল আছে!
---উফফফ, আবার মালতি পিসি এসে হাজির। এবার ধরে বেঁধে নিয়ে যাবে ঠিক! কিন্তু সে এবার যাবে না, ক্লাস এইটে পড়ে, বাচ্ছা পেয়েছে নাকি! তার মান সম্মান নেই!
আমার খিদে নেই পিসি। তুমি যাও!
-- বলি কী হচ্ছে টা কী, সকাল থেকে না খেয়ে পিত্তি পড়বে না! চলো সোনা, কষা খাসি করিচি তোমার জন্য! এই বল্লু! তুই একেনে পড়ে পড়ে কী কচ্চিস র্যা ! দাদা, বউদি খুঁজে মচ্চে! চল! আজ তোর চানের দিন না! পালিয়ে বেড়াচ্ছিস হতভাগা, বজ্জাত কুকুর একটা।
-- খবরদার কুকুর বলবে না! উফফফ বুড়িটার সব মনে থাকে! ভৌ ভৌ করে উঠল বল্লু, কিন্তু মালতীকে সে বিলক্ষণ চেনে, এই বুড়িটার হাত থেকে তাদের তিন ভাইয়ের রক্ষা নেই! কানচাপাটি খাবার ভয়ে উঠে দাঁড়াল সুড় সুড় করে।
হারু চোখ মটকাল গনার দিকে। গনার মনে পড়ে গেল।
-- মালতী পিসি হারু আজ আমাদের সঙ্গে ভাত খাবে কিন্তু!
ইসসস মাগো! চ্যান করিস তুই! পাগলা একটা!
হারু দমে গেল একদম।
সবাইকে চান করিয়ে বেড়াচ্ছে বজ্জাত বুড়িটা! বল্লু উউউউ করল। চানের কথা শুনেই বল্লুর মাথা গরম হয়।
গনা বাড়ি ঢুকতেই সবার আগে এল মামার মোটকা ছেলেটা। ওকে দেখেই গনার ওর ফুলো ফুলো গালে চড়াতে ইচ্ছা করল।
-- ওমা - বড্ডা, , টুই কোটায় টিলি রে! আমরা টেমন চুষে চুষে আম টেইচি। হি হি!
-- উফফফফ, গনা মনে মনে বলল, গিলেই মর রাক্ষস কোথাকার।
--- জানিস বড্ডা পিসি না বিটেলে মোহন ভোগ বানাবে! হি হি টী মজা বল!
-- আহ নান্টু! সব সময় খাবার চিন্তা কেন! আজ তোর বড়দাকে আমি বীজগণিতের ইজি মেথড কটা শিখিয়ে দেব! আর ভুল হবেই না। ছিঃ একশোয় তিরিশ! একটা নম্বর হলো!
বাড়ির নাম খারাপ করে দিচ্ছিস তো!
তোমরা দুজন খেলতে গেলে যাও। বড়দা যাবে না। মামা বেরিয়ে এসেই ফতোয়া জারি করে দিলো।
--- বীজগণিত? এমন বিকেলে মহানন্দাবাঁধের উপরে কী দাপাদাপি হয় তাদের। আজ বিকেলে প্রাকটিস না! গনার গলার কাছে কান্না গুড়্গুড়িয়ে চলে এলো সত্যি সত্যি!
খাবার সময় হারু কিছু একটা বলতে গেছিল মনে হয়,
-- জ্যাঠামি করিস না, ফাঁকিবাজ ছেলে! এটা বাগান পরিস্কার করা হয়েছে বুঝি! ছ্যাঃ শোন বিকেলে তুই জল দিয়ে উঠোন পরিস্কার করবি বুঝলি! একপাত্তর ভাত তো এক কথায় পেটের ভিতর সেঁদিয়ে দিলি! সচক্ষে দেখলাম!
হারুরা গরীব হলেও সম্মান জ্ঞান প্রচন্ড। মা ধরে বেঁধে ওকে খাওয়ায়। মামা এ কথা বলতেই হারুর মুখটা ছোট্ট হয়ে গেল একেবারে। মা লজ্জায় মুখ নিচু করে নিলেন আর বাবা রাগ করে দরজা বন্ধ করলেন ঘরের। গনা বাবাকে জানে, নেহাত মায়ের দাদা, নইলে বাবা ঘাড় ধরে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিত, খাওয়ার খোঁটা দিলে। তাদের বাড়িতে এমনিই প্রায় দিন এ ও এসে খায়। বাবার বলাই আছে, অর্থ রোজগার প্রয়োজনের জন্য, জমানো বা বিলাস কিছুর জন্যই নয়। তার বাবা সরকারি ডাক্তার, আবার চেম্বার করেন, কিন্তু সাহায্য করেন তার থেকেও বেশি।
বল্লু চান করে এসে জুলজুল করে এদিক ওদিক দেখছিল। চান করার সময় তার মাথা বনবন করে। করার পর চোখে নাকি ঝাপসা দেখে। মা ওকে দেখে এগিয়ে আসতেই বল্লু কোলে পা তুলে দিয়ে চেটে দিল মাকে। গনা জলন্ত চোখে বল্লুর দিকে তাকাল। --- বিশ্বাস ঘাতক ! এ নাকি সন্ন্যাসী হয়ে যাবে গনার সঙ্গে! কিন্তু কী বলবে, বল্লুটা বড্ড মার ন্যাওটা! তার উপর সবার ছোট। মাত্র পাঁচ বছর বয়েস। ছ্যাঃ! ছেলেরা এমন হলে হয়!
হারু হাতে জলের বালতি তুলে নিতেই মা এসে হাত ধরলেন হারুর।
--বাবা, তুই বাড়ি যা এখন, তোর ঠাকুমা খুঁজবেন।
বল্লু ঝাপসা চোখেই মাটন খেতে খেতে দেখল হারু মোটেই বাড়ি গেল না। একটা মাটির হাড়ি নিয়ে ভেতরের বাগানটার দিকে চলে গেল।
--- দাদা,---- কাঁদো কাঁদো মুখ নিয়ে তকাই এসে গনার ঘরে ঢুকল। চোখের দড়ি বাঁধা চশমা ঘেমে ভেপে সে অস্থির।
--- কী হয়েছে রে! ভোঁদা হলেও তার ভাই তো। এই বলদা, ল্যাবা মেধাবী ভাইটাকে গনা খুব আগলে রাখে।
আমার জ্যামিতির বাক্স, প্যাস্টেল রঙের বাক্স সব নিয়ে নিয়েছে ওই মোটা ছেলেটা! তকাই ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠল।
এত সাহস! দাঁড়া দেখাচ্ছি মজা। গনা চেঁচিয়ে উঠল।
ওই, ওই আসছে ব্যাটা টা! বল্লু মেঝেয় বসে ছিল । পায়ের আওয়াজ শুনেই ভৌ ভৌ করে উঠল।
বড্ডা! টুমি আমাটে সাইকেল চড়াবে গো! মুখ বাড়ালো নান্টু!
গনার ইচ্ছা হলো ঘাড় ধরে ঘরে ঢুকিয়ে নিয়ে দমাদ্দম ঘা কতক দিয়ে দেয়! বালির বস্তা! কিন্তু বাবা মা জানলে---
-- এই তুই ভাইয়ের রঙ পেন্সিল নিয়েছিল কেন রে!
-- আমি টো নিই নি ডাডা, টকাই ডিয়েছে।
-- একদম মিথ্যা বলবি না, ওই রঙগুলো বাবা কলকাতা থেকে এনে দিয়েছিল, তোকে দেব কেন! তকাই কেঁদে উঠল।
-+ ঠিক কতা, ছোদ্দা কেন তোকে দেবে রে! হাতি একটা! দূর হ তো আমাদের বাড়ি থেকে! উফফফ একটু ছুটির দিনে তিনভাই একসঙ্গে থাকব , তার উপায় নেই দেখি! বল্লু ভৌ ভৌ করে উঠল।
-- এই টুকুরটাকে না আমার টুব ভয় করে রে ডাডা।
টেমন যেন গুন্ডা মোটো।
এ কথা শুনেই তড়াক করে গা ঝাড়া দিয়ে বল্লু উঠে পড়ল। বল্লুর গা ঝাড়ার কায়দা ভালো করেই গনা জানে। কেলেঙ্কারির একশেষ! সে খপ করে বল্লুর বকলস ধরে নিল।
এসময়ে বিকেলবেলাটা ভারি সুন্দর হয় শহর ঘেষা গঞ্জে। সূর্য নেমে এসে মহানন্দা ছুঁই ছুঁই। ব্রিজের উলটো পাড়ে জেলেদের সার সার ঘর। খুব নিঁচু নিঁচু। সন্ধ্যায় জেলেরা ঘরে ফেরে। মাটির উনুনে ভাত ফোটে গবগব করে। জেলেদের নৌকায় চুরি করা কাছিম থাকে। গনারা কতদিন দেখেছে। রাতে বেশি দামে বাজার রোডের বাজারে লুকিয়ে বিক্রি করে। এসব কথা মনে পড়তেই গনার মন খারাপ হয়েগেল। ছ্যাঃ সে এখন বীজগণিত কষচে! ছুঁড়ে দিল পেন , ছিটকে পড়ল বাইরে।
---- কীরে অঙ্ক মিলছে না? জানলায় হারুর মুখ ঝুলছে!
--- দাবড়ানি দিতে গিয়ে থমকে গেল সে। ওমা হারুর হাতে বালতি আর ঝ্যাঁটা! মাইরি মামা টা কী জিনিস একখান! হারুকেও ছাড়েনি! উফফফ। দাবড়ানির বদলে গনা হেসে ফেলল
-- তুই ও ফেঁসেছিস! বদলে হারু বলল, দে দে
অঙ্কগুলো করে দিই!
--- পাগলা! ক্লাস এইটের বীজগণিত রে!
-- থাম তো! ওই তো তোদের পশুপতি মাস্টর অঙ্কের! নাইনের দে না তাও , করে দিচ্ছি।
-- আচ্ছা! তা তোর মাস্টার কে!
-- হি হি হি, কাকা যার কাচে অঙ্ক কষে ডাক্তার হয়েচে! বুজলি! ঈশ্বর জগদাপতি সাহা!
-- পাগলা কোথাকার! সে কবে মরে ভূত হয়ে গেছে! তোকে অঙ্ক করাচ্ছে!
জবাবে হারু রহস্যময় হাসি হেসে খাতা নিয়ে উধাও হল।
বল্লুর মন মেজাজ বিগড়ে আছে খুব। বাবা আর মা একটু দরকারে বেরিয়েছে কী বেরোয়নি, মালতি পিসিকে দিয়ে মামাটা ওকে বেল্ট পরিয়ে আটকালে! মানুষের কাজ হল এটা! তুই না মামা আমাদের! মালতি বুড়ি তুই পাল্লি এমন শত্রুতা কত্তে! ছিঃ! এই বিকেলে ওরা তিনভাই আমবাগানে কত্ত খেলা করে! বল্লুর চোখ দিয়ে জল পড়ে যাচ্ছিল প্রায়! একটু আগে বেলি যে বেলি সেও আওয়াজ দিয়ে গেল-- কীরে বল্লা খুব যে লাট খাচ্ছিলি পাড়ার হিরো হয়ে, কেমন হলো তো! ধুর সেদিন সমন্যাস নিলেই ঠিক ছিল! আ মর! পাগলাটা আবার খাতাপত্তর নিয়ে এদিকেই আসচে! বল্লু পেছন ফিরে বসল।
-- হি হি হি! কীরে পাগলা, মামা ব্যাটন দিয়েচে তো! হলো!
-- তুই পাগলা! তোর চোদ্দ গুষ্টি পাগলা! বল্লু মুখে কিছু বলল না। কীই বা বলবে! মামাটা আর মান সম্মান রাখল না কিছু!
সন্ধ্যা হবার পর মা বাবা সবাই যখন এলো, তখন তাকে দেখে মা হা হা করে ছুটে এলো।
-- একী বল্লুকে আটকেছে কে! মালতিদি!
মালতি পিসির তখন রান্নাঘরে মামার জন্য চিকেন পকোড়া, মালপোয়া করতে ঘেমে নেয়ে অস্থির।
মালতি পিসি এসে মামার কথা কী যেন ফুসফুস করে বলতেই মা গম্ভীর হয়ে গেলেন।
দিদাটা পর্যন্ত বলল, বেচুটার কী আক্কেল জ্ঞান নেই গা! বিকেলবেলায় বাচ্ছাদুটোকে আটকে রেখেছে! বলিহারি!
--চুপ করো মা, তোমার জামাই দেখতে পেলে রক্ষা নেই। বল্লু আমাদের ছেলে ও ঘরে বারান্দায় থাকে, বাইরে রেখেছে, তাও বেঁধে! মা গলা নামিয়ে বললেন। ইসস!
বল্লুকে ছেড়ে দিলেও বল্লু বারান্দায় উঠল না। সে মান করে চাতালে শুয়ে রইলে। সেকী ফ্যাকলা নাকি! আসুক বাবা এসে দেখুক সেকী কষ্টে আচে!
বাবা খাবার টেবিলে বসে শুধু একটা কথাই বললেন, জোর করে ধরে বেঁধে পড়াশোনা কেন, মানসিক বিকাশও কী হয় দাদা!
মা আর মামীমা তার ফুলো ফুলো মুখ নিচু করলেও, মামা বলে উঠল,দেখো সুবিকাশ, ছেলে পুরে মেরে ধরে বেঁদেই মানুষ করতে হয় বুঝলে ভায়া!
বাবা খুব বিরক্ত হয়ে প্রায় অর্ধেক খেয়েই উঠে গেলেন।
খাওয়া দাওয়ার পর সে রাতে সবাই যখন শুতে গেছে যেই অমনি মামাদের ঘর থেকে তারস্বরে নান্টুর চিৎকার আর হাউ মাউ কান্না শুনতে পেল গনা।
ছুটে যেতেই দেখে, বাবা মাও কী হয়েছে কী হয়েছে বলতে বলতে প্রায় দৌড়ে আসছেন। এদিকে মামাদের ঘরে প্রলঙ্কর সুরে নানাবিধ কান্না ভেসে আসছে।
বল্লু রাতে বারান্দার সোফাতে শোয়। গ্রীল দেওয়া, তবু সে বাইরের দিকের আওয়াজ ভেবে ভৌ করতেই মনে হলো, বাইরে কই! এতো ভেতরের আওয়াজ।
ভেবেই সে দরজা আঁচড়াতে শুরু করল। বাবার গলা না! বড়দাও আচে সঙ্গে! কে যেন খুলে দিল তাকে। মালতি পিসি মনে হয়। বল্লু ঘরের মধ্যে দৌড়ে যেতেই দেখল,নান্টু হাতি তারস্বরে চেঁচাচ্ছে তার সারা পিঠে দাগড়া দাগড়া দাগ। লাল হয়ে ফুলে উঠেহে পুরো পিঠ টা।
গনা দেখে থ! বাবা বললেন জায়েন্ট পিঁপড়ে, এমন পিঁপড়ে কিন্তু জঙ্গলে থাকে। এখানে ঘরে দোরে আসবে কী করে!
মামী ফুলো গাল আরো ফুলিয়ে হাপুস নয়নে কাঁদছিল কোনো ক্রমে বলে উঠল, নান্টু ভুল করে মামার গেঞ্জি পরে ফেলেছিল আর তারপরেই এই কান্ড!
মালতী পিসি এগিয়ে এসে বললে অসম্ভব! আমি গেঞ্জি কাচি,কেউ বলতে পারবে একটা সুতো লেগে থাকে! ঠাকুরের কিড়া বউদি!
গনা জানে এই পিঁপড়ে সবেদা বাগানে আছে। ঘেষ ঘেষ জঙ্গল সাপে ভরা। তারা ওদিকে ঘেসেই না! কিন্তু এখানে---
ওমা বল্লু ল্যাজ নাড়িয়েই চলেছে। কাছে যেতেই ওই ভুক শব্দ টা শুনে ও তাকাল।
ভৌ----উউউউউ, পরিস্কার শুনল বলছে, ঠিক হয়েছে সান্তারা খেয়েচে হাতিটা!
গনা ভুরু কুঁচকে বল্লুর দিকে তাকাল! বল্লুটা কিছু জানে মনে হচ্ছে! স্পাই!
বাবা মা দিদা সবাই মিলেই শুশ্রূষা করে চলল। তবে বাবা বললেন, কমে গেলে ভালো নয়ত ইঞ্জেকশন দিতে হবে। মনে হল হাসিটা চাপলেন যেন।
-- ওওঅঅ পিটে গো , আমি ইঞ্জেটশান ডিলেই মরে ডাবো গোওও ওও!
-- নান্টু ডুকরে কেঁদে উঠল। মামীর জলন্ত চোখ দেখে মামার বুদ্ধি ফুরিয়ে গেছে খালের জলে।
গনার মনে হল বলে, কেন বাপু লোককে তো গাধা গোরু ছাড়া ভাবো না! এবার কী!
তকাইটা নান্টুর কাছেই বসে আছে। মার মুখে ভয় বিরক্তি সব মেশানো।
দিদা বলল, ডাক্তারের বাড়ি আছিস বেচু, অত ভয় পাস নি।
-- যতই বলুন কাকিমা এই সব খুনে পোকা মাকড় আমাদের শহরে নেই বাবা!
-- হ্যাঁ জায়গা বদল হলে আবহাওয়াও তো বদল হয়, তাই ওর যদি এফেক্ট বেশি হয়, তাহলে কাল নয় আমাদের হসপিটালে ক দিন--
বাবার কথা শেষ হলোনা ডুকরে উঠল মামা নিজেই--
সুবিকাশ, যেমন করে হোক কাল সুস্থ করে দাও। আমি পরশুর টিকিট কাটি, যা হবার ওকেনেই হোক।
-- সেই ভালো, সেই ভালো রে বেচু। তুই তো একেবারে শিলচরে ফিরবি, আমাকে নয় পরে জামাই গিয়ে পৌঁছে দিয়ে আসবে, বর্ধমানে। দিদা হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন যেন।
গনা পরিস্কার দেখতে পেল বাবা আর বল্লু হাসছে। এমনকি মা ও----
আজ দুদিন হলো মামারা চলে গেছে একেবারে তাদের বাড়ি শিলচর।
তিনভাই জমিয়ে খাচ্চে আর খেলচে ক দিন। বাড়িতে সবার খুশি খুশি ভাব। তাদের ম্যাচের আর বেশি দেরি নেই।
-- কীরে পাগলারা! কী খবর তোদের, হাসিমুখ নিয়ে হাঁড়িমাথা নিয়ে গেট খুলে ঢুকল হারু। বল্লু হাসল, আজ একটুও বিরক্ত হল না সে।
গনা ব্যাট ফেলে দৌড়ে গিয়ে বলল,
মামা নিকাল গয়ি, হারুয়া!
হারুটা খ্যাঁক খ্যাঁক করে গা জ্বালানো হাসি হেসে বলল, না গিয়ে করবে কী! দ্যাখ গে তোর হাতি ভাইটা এখনো চুলকে মরছে!
গনা চমকে গেল! চুলকে মরছে! ব্যাটা তুই কী করে জানলি রে!
হি হি হি-_হা হা হা হা ------- প্রবল ভৌতিক হাসি দিল হারু পাগলা।
বল্লু বলে উঠল ভোউউউউউউ,
আমি জানি, আমি দেকিচি রে বদ্দা, পাগলাটা মাটির হাড়ি নিয়ে---
কথা শেষ হলো না, গনা তীব্র চোখে তাকাল -- বিশ্বাসঘাতক!
-- তাহলে ক্রিকেট ম্যাচের কী করবি গনা!
গনা, বল্লু আর ভাই তিনজনে মিলেই হাসলো,
গনা বলল-- ওক্কে! ডান! ফুল এন্ড ফাইনাল!!
উপলব্ধি
শতভিষা মিশ্র
নবম শ্রেণী, জ্ঞানদীপ বিদ্যাপীঠ, পশ্চিম মেদিনীপুর
নীল নীল চোখ, সোনালী রঙের চুল, পিঙ্ক রঙের ড্রেস পরা একটি পুতুল _____ পাপা জিনিয়াকে ওটা আজ গিফ্ট করেছেন কিন্তু ওর অবস্থা এখন ভালো নয়। জিনিয়া আর পোলো ওকে নিয়ে টানাটানি করছে। জিনিয়া ও পোলো দুই ভাই বোন। আসলে জিনিয়ার কোন জিনিস পছন্দ হলে ও কাউকে দিতে চায় না। মাম্মাম চলে আসায় পুতুলটা কোনোমতে বেঁচে গেল। মাম্মাম ওদের কান মলে দিয়ে বললেন "সবকিছু নিয়েই টানাটানি করবি তোরা। চলে আয় টিফিন করে নে। আমরা তো মেলায় যাব। " ওরা দুজনে খুব খুশি হল। জিনিয়া টিফিন করে নিয়ে রুমে ঢুকতে যাবে এমন সময় দেখে ওদের কাজের আন্টির মেয়ে রাহি একদৃষ্টে জিনিয়ার পুতুলটার দিকে চেয়ে আছে। জিনিয়া জিজ্ঞেস করল, " রাহি পুতুলটা খুব সুন্দর তাই না?" রাহি উত্তর দিল না। জিনিয়া দেখল রাহির চোখের কোনে জল চিকচিক করছে। সন্ধেবেলা একটি নীল রঙের ফ্রক পরে পুতুলটা সঙ্গে নিয়ে মাম্মাম আর পোলোর সাথে মেলা দেখতে বেরোলো। বেরোনোর সময় দেখল রাহি তাদের দিকে তাকিয়ে আছে । জিনিয়ার মনে হল রাহির পুতুলটা ভালো লেগেছে। ভাবল তার উচিত পুতুলটা রাহিকে দিয়ে দেওয়া। রাহির বাবা নেই। জিনিয়াকে তার পাপা এমন অনেক পুতুল কিনে দিতে পারবে। মেলাতে কিছুই কিনল না সে। শুধু ভাবল সে কি করবে। আগামী কাল ফ্রেন্ডশিপ ডে। সে ঠিক করল ফ্রেন্ডশিপ ডে এর গিফ্ট হিসেবে পুতুলটা রাহিকে দেবে। লাল রঙের গিফট পেপারে পুতুলটাকে প্যাক করে তার ওপরে লিখল "টু মাই ডিয়ার রাহি" আর নিচে লিখল "ফ্রম জিনিয়া"।পরের দিন স্কুল যাওয়ার সময় সে গিফট টা রাহিকে দিয়ে বলল " হ্যাপি ফ্রেন্ডশিপ ডে রাহি ! " রাহি পেপার খুলে দেখে সেই পিঙ্ক রঙের পুতুল যেটা জিনিয়া পোলো কেও দিতে চায়নি। রাহি খুব খুশি হল কিন্তু নিতে চাইল না বলল যে এটা জিনিয়ার অত্যন্ত প্রিয় জিনিস কিছুতেই সে এটা নিতে পারে না।জিনিয়া বলল যে সে এটা হাসি মুখে মন থেকে রাহিকে গিফট করছে।ওর মনে কোনো কষ্ট হচ্ছে না।পুতুলটা পেয়ে রাহির চোখে খুশির জল চলে এল।জিনিয়াও এই প্রথম কাউকে নিজের পছন্দের জিনিসটা দিয়ে এতটা আনন্দ পেল।
ধারাবাহিক ভ্রমণ
মৃত্য উপত্যকার গহ্বরে
পর্ব ২
মলয় সরকার
হ্যাঁ, যা বলছিলাম, দেখা হল এখানকার এক অধিবাসীর সঙ্গে, সে হল এক কোয়োটে। ভয় ডর নেই, আমাদের গাড়ীর কাছেই এসেছে। আমাদের গাড়ীও থামল, তাকে ভাল করে দেখার জন্য। এরা বেশীর ভাগই রাত্রে এবং খুব ভোরের দিকটা বের হয়, কারণ দিনের বেলা এত গরম পড়ে তখন এদের পক্ষে ঘোরা মুস্কিল, তাছাড়া এদের যা খাদ্য সেই সব পশুরাও রাতচরা প্রাণী, তাই তাদের ধরা যাবে না। ইনি বোধ হয় সারা রাতে কিছুই পান নি, তাই দিনের শুরুর বেলাতেও ঘুরছিলেন খাওয়ার আশায়। চোখ দেখে মনে হল ক্ষুধার্ত, বেশ মায়া হল। আমাদের গাড়ীটা বেশ কয়েকবার শুঁকে, আমাদের দিকে জানালার বাইরে থেকে তাকিয়ে রইল সতৃষ্ণ নয়নে। মেয়ে বলল, ওকে কিছু খেতে দিলে হয় না? কিন্তু এখানকার কঠোর নিয়ম, কোন বন্য জন্তুকে কিছু খাবার দেওয়া যাবে না। তা ছাড়া, আমরা দিলেই যে ও খাবে তারও তো কোন মানে নেই। যেহেতু আমরা ছিলাম গাড়ীর মধ্যে, ওকে এত কাছে দেখেও ভয় কিন্তু আদৌ লাগছিল না।শেষে কোন খাবার না পেয়ে, বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে হতাশ হয়ে ও বেচারা ধীরে ধীরে চলে গেল মুখটা নীচু করে কোন খরগোস কি ছোট পাখী- টাখীর আশায়। আমরাও রওনা হলাম গন্তব্যের দিকে।
এখানে দেখতে হলে সকাল সকালই এখানে পৌঁছে যাওয়া ভাল। তার কারণ, শীতের সময় বেলা ছোট, সময় কম হবে. তা ছাড়া বেশি শীত পড়লে ঘোরা বেড়ানোর বেশ অসুবিধা। আমরাও পৌঁছে গেলাম মোটামুটি সকাল সকালই, বেলা দশটা সাড়ে দশটা নাগাদ। এখানে একটা খুব ভাল ব্যাপার আছে, যা আমি অনেক জায়গায় দেখিনি, আমাদের দেশে তো নয়ই। অথচ এগুলো থাকলে যে কোন দেখার জায়গা ঘোরার পক্ষে দর্শকদের খুব সুবিধা হয়। তা হল, বেশির ভাগ জায়গাতেই থাকে, ‘ভিজিটর সেন্টার’।কোন জায়গা দেখতে শুরু করার আগে এসব সেন্টারে ঢোকা খুব জরুরী। এখানে পাওয়া যায় , জায়গাটার ঘোরার ম্যাপ, কি কি পাওয়া যায়, তার বিভিন্ন তথ্যাদি, কি কি দেখার আছে এবং জায়গাটার সম্পূর্ণ ভূগোল ইতিহাস ইত্যাদি। বাথরুমের এবং অল্পস্বল্প চা জল খাওয়ার ব্যবস্থাও থাকে এখানে।
এখানে যে ভিজিটর সেন্টার আছে, তার নাম ‘ফার্ণেস ক্রীক ভিজিটর সেন্টার’। এখানে অন্যান্য সব কিছুর সাথে আছে একটি ছোট অডিটোরিয়ামে ২০ মিনিটের একটি সিনেমা যা ডেথ ভ্যালির সম্বন্ধে নানা তথ্য দিয়ে তৈরী।এটি দেখতে ভালই লাগে। প্রতি ৩০ মিনিট অন্তর এটি দেখানো হয়।অনেক অজানা জিনিস জানা হয়। এটি কিন্তু বিনা পয়সায় দেখানো হয়। আমরা যেতেই রেঞ্জার বললেন , কোথা থেকে এসেছেন? আমরা বললাম, ইণ্ডিয়া থেকে। উনি শুনে চোখটা তুলে ভ্রুভঙ্গী করে একটু পরিচিত জায়গা হলে যেমন মানুষের মনে হয়, তেমন ভাব করলেন। আমরা আশ্চর্য হয়ে তাঁর দিকে তাকাতেই, উনি বললেন, আমার মেয়ে একজন ইণ্ডিয়ানকে বিয়ে করেছে। আমার জামাই তাহলে ইণ্ডিয়ান। সেজন্য আপনারা আমার জামাইয়ের দেশের মানুষ। কাজেই আত্মীয়। বেশ খাতির করে , সুন্দর করে কথা বলছিলেন উনি। ওনার জামাই একজন ইঞ্জিনীয়ার, মেয়েও তাই। আমরা ভাবলাম, এই ভাবেই এক দেশের সাথে এক দেশ, এক জাতির সাথে আর এক জাতি আত্মীয়তার সূত্রে বাঁধা পড়ে।সেই অর্থে, আমরা সারা পৃথিবীই এক বৃহৎ পরিবার। নয় কি?
যাই হোক, উনি বললেন, একটু বসুন, এক্ষুনি ছবি দেখানো হবে। একটা কথা বলা হয় নি, এই সমস্ত দর্শনীয় জায়গা গুলো আমেরিকার এক একটি ন্যাশনাল বা স্টেট পার্কের অধীনে, এবং সেগুলি দেখতে গেলে অবশ্যই আগে দর্শনী দিয়ে তবেই ঢুকতে হয়। তার পরে আর পয়সা লাগে না।এই ডেথ ভ্যালিও সেরকম একটি ন্যাশনাল পার্ক। আমাদের আগে থেকে ঢোকার জন্য পয়সা দেওয়াই ছিল। কাজেই সমস্যা হল না।
যে অডিটোরিয়ামটিতে সিনেমা বা ছবিটি দেখানো হবে, তা যথেষ্ট সুন্দর,আমাদের যে কোন মাল্টিপ্লেক্স সিনেমা হলকে হার মানিয়ে দিতে পারে।শুধু এটির সিটের সংখ্যা কম এই যা। প্রায় জনা চল্লিশ মানুষ বসতেই পারেন, সিট বা স্ক্রীন খুবই ভাল।
এখানে ঢুকে আমরা তথ্যচিত্রটি দেখে অনেক কিছু জানতে পারলাম। আমাদের সঙ্গে ঐ শো’য়ে ছিলেন আর মাত্র ছ’ জন মানুষ। সেটি শেষ হতেই আমরা বেরিয়ে এলাম। বেরোনোর মুখে রেঞ্জার ভদ্রলোক আমাদের সাথে করমর্দন করে বললেন, ভাল করে ঘুরুন, তবে খুব সাবধান, ডেভিল’স গলফ কোর্সে বেশি হাঁটবেন না, এক্সিডেন্ট হতে পারে। তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে এলাম। এই ডেভিল’স গলফ কোর্স কি পরে বলছি। বিদেশে এরকম আন্তরিকতা আমি আগে অনেক পেয়েছি, তবে তখন ভীষণ ভাল লাগে। তাই আমার স্বদেশ বা বিদেশ যে কোন জায়গার মানুষকেই নিজের দেশের মানুষ বলে মনে হয়। তখন মনে হয়, আসলে মানুষ বা তার চরিত্র এবং ব্যবহারটিই বড় কথা এবং সেটিই মানুষের বড় পরিচয়। মুখের কথা বলার ভাষাটা কখনওই সবচেয়ে বড় কথা নয়। সেটি তো ভিন্ন ভিন্ন মানুষের ভিন্ন ভিন্ন।
এর পর আমরা গিয়ে পৌঁছালাম আসল লক্ষ্যে, যেটি পৃথিবীর এক আশ্চর্য্য জায়গা। যেখানে লেখা আছে, যে, সেই জায়গাটিই পৃথিবীর মধ্যে সব থেকে নীচু জায়গা এবং তা সমুদ্রতল থেকে ২৮২ ফুট বা ৮৫.৬ মিটার নীচে।আমার মেয়ে তো এটি দেখে লাফিয়ে উঠল। বলল, তাহলে আমরা আমাদের ওখানের মাটির নীচে প্রায় ২৫-৩০ তলা বাড়ীর যা উচ্চতা ততটা নীচে এসেছি!! বললাম, হ্যাঁ প্রায় তাই।
এখানে একটি কথা বলার আছে, তা হল, তোমাদের জানা আছে কি জানি না যে, কোন জায়গার স্থলভূমির উচ্চতা মাপা হয় সমুদ্রতল থেকে। যেহেতু জলের একটা স্বাভাবিক ধর্ম হচ্ছে, সমস্ত জল সবসময় এক উচ্চতায় থাকতে চেষ্টা করে, অতএব সারা পৃথিবীর সমস্ত সমুদ্রজলের গড় উচ্চতাই যেঁ কোন জায়গার উচ্চতা মাপার মাপকাঠি এবং তাকেই নিম্নতম উচ্চতা বা শূন্য উচ্চতা ধরা হয়।তোমরা কেউ লক্ষ্য করেছ কি জানি না, যে কোন রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে, স্টেশনের নাম লেখা বোর্ডে নীচে এই তথ্যটি লেখা থাকে।এছাড়াও অনেক জায়গায় থাকে। কোন জায়গার উচ্চতা সম্পর্কে বলা হয় সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এত উঁচু।
তা, সেই সমুদ্রতল থেকেও এই জায়গাটা ২৮২ ফুট নীচু।কোন জায়গা উঁচু বা নীচু হওয়ার নানা ভৌগোলিক কারণ থাকে।আমি এখানে অত তথ্যে যাচ্ছি না, তোমাদের খারাপ লাগবে। পরে পড়াশোনা করে জেনে নিও।শুধু বলি, এই জায়গাটা নীচু হওয়ার কারণ হচ্ছে, কোন এক সময় পৃথিবীর উপরিতলের জমি ওলটপালটের ফলে সরে গিয়ে জায়গাটা নীচু হয়ে গেছে। অবশ্য কোথাও থেকে যদি এখানে সমুদ্রজল ঢোকার ব্যবস্থা থাকত, তাহলে এটাও চলে যেত সমুদ্রের নীচে। চারিদিকে পাহাড় থাকার ফলে সে সুযোগও নেই।
চারিদিকে তাকিয়ে দেখি বেশ কিছু মানুষ আশেপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন আশ্চর্য হওয়ার মত মুখ করে। অনেকেই আবার ছবি তোলায় ব্যস্ত।দেখে মোটামুটি বোঝা যাচ্ছে, সবাই এই সব জিনিস দেখে বেশ আশ্চর্য এবং খুশী হয়ে গেছেন।
( ক্রমশ)
স্মরণীয়
(রাজা রামমোহন রায়)
কলমে - পীযূষ প্রতিহার
বাংলার নবজাগরণের কথা বললেই যাঁর কথা সর্বাগ্রে স্মরণে আসে তিনি হলেন রাজা রামমোহন রায়। ১৭৭২ সালের ২২মে তিনি হুগলি জেলার রাধানগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ছিল রামকান্ত রায় এবং মাতার নাম ছিল তারিনী দেবী। গ্রামের পাঠশালায় প্রাথমিক শিক্ষালাভ করেন তিনি। মাত্র পনেরো-ষোলো বছর বয়সেই তিনি গৃহত্যাগ করেন এবং ভারতের নানা জায়গায় ভ্রমণ করেন। এই সময় তিনি কিছুকাল কাশীত ও পাটনায় ছিলেন। পাটনায় একটি মাদ্রাসায় কিছুদিন আরবী ও ফারসি শিখেছিলেন। কাশীতে শিখেছিলেন সংস্কৃত। তিনি নেপালেও গিয়েছিলেন। এই সময় নন্দকুমার বিদ্যালঙ্কারের (পরবর্তী সময়ে যিনি হরিহরানন্দ তীর্থস্বামী কুলাবধূত হয়েছিলেন) সান্নিধ্যে সংস্কৃত ভাষায় ও বেদান্ত দর্শনে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এই নন্দকুমারই রামমোহনের ব্রাহ্ম উপাসনালয় প্রতিষ্ঠায় প্রধান সহযোগী ছিলেন। পরে তিনি ইংরেজি, গ্রিক ও হিব্রু ভাষায় যথেষ্ট দক্ষতা অর্জন করেছিলেন।
বহুদিন গৃহত্যাগী থাকার পর ১৭৯৬ সালে কলকাতায় ফিরে মহাজনের কাজ শুরু করেন রামমোহন রায়। পরে ১৮০৩-১৪ পর্যন্ত তিনি ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে কর্মচারী হিসেবে কাজ করেন। রংপুরে থাকাকালীন কালেক্টর জন ডিগবি নামে একজন ইংরেজ অফিসারের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল তাঁর। এই ডিগবি সাহেবের কাছে পাশ্চাত্য সভ্যতার দর্শন, সংস্কৃতি ও শিক্ষা সম্পর্কে কৌতুহলী হয়ে ওঠেন।
হিন্দু ধর্মের মধ্যে নিয়ত বাড়তে থাকা কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস থেকে মুক্ত একেশ্বরবাদী একটি স্বাধীন সমাজ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন তিনি। এই উদ্দেশ্যে উনবিংশ শতাব্দীর কুড়ির দশকে কলকাতার কিছু সমমনস্ক ব্যক্তিকে নিয়ে ব্রহ্ম উপাসনামূলক আত্মীয়সভা গড়ে তোলেন। এই আত্মীয়সভা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের সহায়তায় ১৮২৮ সালে ব্রাহ্মসমাজ নামে আত্মপ্রকাশ করে।
ভারতীয় হিন্দু সমাজে মধ্যযুগে যে কয়েকটি কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস মূলক প্রথা চালু ছিল তার মধ্যে অন্যতম নৃশংস প্রথা হল সতীদাহ। বেদান্ত বাখ্যার মাধ্যমে রামমোহন বারবার যখন এই প্রথার বিরুদ্ধে যুক্তি দিয়েও অসফল হচ্ছিলেন তখন তিনি ব্রিটিশ সরকারের কাছে আইন প্রণয়নের আবেদন জানান। তাঁর আবেদন, দরবার এবং ব্যাপক সতীদাহ বিরোধী প্রচার ও আন্দোলনের ফলে ১৮২৯ সালে গভর্ণর জেনারেল লর্ড বেন্টিং এর সহায়তায় সরকার আইন করে সতীদাহ নিষিদ্ধ করে। এরপরও সমাজের সতীদাহ সমর্থনকারী গোঁড়া একটি অংশ বারবার এই আইন রদ করার দাবি জানাচ্ছিলেন। তখন ১৮৩০ সালে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের আর্থিক সহায়তায় রামমোহন রায় ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সামনে সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে যৌক্তিক বক্তব্য পেশ করার উদ্দেশ্যে বিলেত যাত্রা করেন।
রামমোহন রায় শুধুমাত্র ধর্ম বা সমাজ সংস্কারক ছিলেন না, প্রথম জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটিয়েছিলেন। তিনি যুক্তির সাহায্যে নানা কুসংস্কার খণ্ডনের চেষ্টা করেছিলেন। শুধু সমাজ সংস্কারক হিসেবে নয় ভারতবাসীকে আধুনিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছেন। ভারতবাসীর অধিকার সম্পর্কে সচেতন করেছেন। এমনকি ভারতের প্রথম রাজনৈতিক চেতনার বিকাশও হয়েছিল তাঁরই প্রচেষ্টায়। ইংরেজ শাসনকে মেনে নিয়েই তিনি সেই শাসনের আপত্তিকর দিকগুলো সম্পর্কে নির্মম সমালোচনা করতেন তাঁর সংবাদপত্রে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে নানা ধরনের বিপ্লব(ফরাসি বিপ্লব) যেভাবে মানুষকে মুক্তি এনে দিয়েছে তা তুলে ধরতেন। তিনিই প্রথম ভারতীয় যিনি ভারতের বিচার বিভাগকে শাসন বিভাগ থেকে পৃথক করতে চেয়েছিলেন এবং 'রিফর্ম বিল' এনেছিলেন। বহুবিবাহ ও বর্ণভেদ প্রথার বিরুদ্ধে সদা সোচ্চার ছিলেন তিনি। নারী ও পুরুষের সমানাধিকার এবং বিষয় সম্পত্তিতে নারীদের উত্তরাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেও লড়াই করেছিলেন তিনি।
তাঁর প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ ফার্সী ভাষায় লেখা 'তুহফাতুল মুহাহহিদিন'(১৮০৪), যার মুখবন্ধ ছিল আরবী ভাষায়। এই গ্রন্থে তাঁর একেশ্বরবাদী দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশিত হয়। ১৮১৫-১৯ কলকাতায় থাকাকালীন বেদান্ত সূত্র ও তার সমর্থক উপনিষদ গুলি বাংলায় অনুবাদ করে প্রচার করতে থাকেন। এই সময় একে একে প্রকাশিত হয় বেদান্ত গ্রন্থ, বেদান্ত সার, কেনোপনিষদ, ইশোপনিষদ, কঠোপনিষদ, মাণ্ডুক্যোপনিষদ ও মুণ্ডকোপনিষদ। তিনি মূর্তিপূজা, কোনোরকম ধর্মীয় গোঁড়ামি, কুসংস্কার ও আচার-বিচারের বিরোধী ছিলেন। তিনি সুফী দর্শনের ব্যাপারে উৎসাহী ছিলেন। তিনি চাইতেন হিন্দু, খ্রীষ্ট ও ইসলাম ধর্মের মূল সত্যকে উপলব্ধি করতে। জীবনের শেষ দিকে তিনি প্রায় পাঁচটি সংবাদপত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৮২১ এ তিনি 'সংবাদ কৌমুদী' নামে একটি পত্রিকা বের করেন, এটি ছিল পুরোপুরি বাঙালি পরিচালিত প্রথম বাংলা সংবাদপত্র। পরের বছরই তিনি 'মিরাত-উল-আকবর' নামে একটি ফার্সী ভাষার পত্রিকায়ও বের করেন।
১৮৩৩খ্রীষ্টাব্দে ইংল্যান্ডের ব্রিস্টলে থাকাকালীন মেনিনজাইটিস রোগে আক্রান্ত হন এবং আটদিন জ্বরে ভুগে ২৭সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।
পাঠপ্রতিক্রিয়া
(জ্বলদর্চি ছোটোবেলা ৮২ পড়ে দোলনচাঁপা তিওয়ারী যা লিখলেন)
"জ্বলদর্চি" ছোটবেলা বিশেষ সংখ্যা ৮২ পাঠ প্রতিক্রিয়া দিতে গিয়ে দেখলাম, সম্পাদক মহাশয়া মৌসুমী দি (মৌসুমী ঘোষ) সম্পাদকীয়তেই এক সুন্দর প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন।
পত্রিকাটির প্রথমে প্রচ্ছদে পুরুলিয়ার সুদীপ পাত্র মহাশয়ের তোলা ছবিটি অসাধারণ। প্রকৃতির দুই অলংকার প্রচ্ছদ টিকে অলংকৃত করে তুলেছে।
নিয়মিতভাবে ধারাবাহিক উপন্যাস তৃষ্ণা বসাকের লেখা "জয়াবতীর জয়যাত্রা" তো থাকছেই ,সেখানে দেখি কিভাবে জয়াবতী ঘোড়ার লাগাম ধরে বসেছে বা গ্রামের মানুষের দুপুরের জীবন যাত্রার ছবি ফুটে উঠেছে, সেই সঙ্গে সামাজিক কু প্রথার কথা উঠে আসে।
তথাগত বাবুর কবিতা "যুদ্ধ চর্চাতে" বর্তমানে দু দেশের যুদ্ধের কথা উঠে এসেছে। সত্যি মানুষ ভালোবাসা, ভালো কথা, ভুলে যায় কেন জানিনা।
গৌরাঙ্গ দাসের লেখা "রঙ্গন ও গঙ্গা ফড়িং" আমাদের মনকে যেন রাঙ্গিয়ে তুললো।
তুলি দাস তার আঁকা ছবিতে যেন মনের রং মিশিয়ে দিয়েছে।
অনন্যা মৈত্রের লেখা "ভালোবাসার ঘর" থেকে বলতে পারি সত্যিই এই পৃথিবীতে "পরিচয়ের একটুখানি দ্বীপ" সেখানে আমাদের ভালোবাসার মধ্যে থাকতেই হবে। তবেই তো পৃথিবীর সুন্দর হয়ে উঠবে।
নতুন একটি ধারাবাহিক ভ্রমণ কাহিনী শুরু হয়েছে মলয় সরকারের লেখা "মৃত্যু উপত্যকার গহ্বর", নামের মধ্যেই বেশ এক ভয় ভয় ভাব। এখানে লাস ভেগাসের প্রকৃতি ও আবহাওয়ার কথা বলা হয়েছে।
এরপর তো আছে আমাদের সকলের প্রণম্য কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের কথা । পীযূষ প্রতিহার তার দৃষ্টিভঙ্গিতে সংক্ষেপে তুলে ধরেছেন রবীন্দ্রনাথের জীবন কাহিনী, যা বার বার পড়লেও মনে হয় যেন এখনও ওনার সম্পর্কে অনেক কিছুই জানতে বাকি আছে।
যাই হোক এককথায় শুধু ছোটদের কেন বড়দের জন্যও এক অনবদ্য পত্রিকা, বড়রাও রস আস্বাদন করতে পারবেন।
আরও পড়ুন
0 Comments