জ্বলদর্চি

পদ্মপাতায় শিমুল-২২/সীমা ব্যানার্জ্জী-রায়

পদ্মপাতায় শিমুল-২২

সীমা ব্যানার্জ্জী-রায়

সরলতার জন্য জীবনে অনেক ঠকেছি। কোনও কথা গোপন রাখতে পারতাম না। এখনও পারি না। যা হোত সকলের সামনে বলে দিতাম। আমার এই স্বভাবের জন্য কেউ সতর্ক করলে কি বলতাম জানো? বলতাম, “কি করব কিছু যে লুকিয়ে রাখতে পারি না।”

ম্যান্ডেভিলির বাড়িতে কাজের মেয়েটা বলত “একথালা ভাত হজম করতে পারো আর কিছু কথা হজম করতে পারো না?” খুব ভালোবাসত মেয়েটা। নাম শঙ্করী তো একেবারে শঙ্করী।

ওর মুখেই শুনেছিলাম ফ্ল্যাটের দারোয়ানের উদ্দেশ্যে, “ এমন তোর পেটে হাত ঢুকিয়ে মারব যে, গিয়ে পড়বি ট্রাম লাইনের মধ্যে।” আবার কখনো কারুর ওপর রাগ হলে বলত, “ আমাকে চিনিস না তো, মা কালীর ভোগে চড়িয়ে দেব।” আমি তো কখনও এসব শুনি নি। আমাকে সে বলত সব গল্প, হাসলে বলত আমাকে ওরা চেনে না তো ছোটদি। আমারই বয়সী ছিল। তবে বড্ড ভালোবাসত আমাকে। আমার কোনো ভালো শাড়ি ওকে দিলে বলত, “আমাকে দেখো ইস্মিতা(স্মিতা) পাতিলের মতন লাগবে।” ওদের ও ইচ্ছে হয় সাজগোজ করতে। অনেকে তা মানতে অপারক।

আমরা গেলে কত কাঁদল তাই তো দেবরজী বলল, “নিয়ে চলো আমাদের বাড়ি।” ওর বাড়িতে গিয়ে কি খুশি। আমাদের স্যুটকেস গোছানোর সময় সমানে কাঁদছিল। “এটা নি ছোটদি-এটা নিয়ে নি-আমাকে খুব সুন্দর দেখাবে বলো?”

বলেছিলাম, “হ্যাঁ! নে তোর যেটা ভালো লাগে নে।”

শিমুল দেখল পলাশ ঢুলছে। আমি খুব গল্পের বই পড়তে ভালোবাসতাম। অবশ্য-ই হিন্দি, ইংলিশ সব বই। জব্বল্পুরে তো আর বাংলা বই পাওয়া যেত না। গলার স্বর নীচু করে পলাশ কে একটু নাড়িয়ে দিল। বলল, "একটা কথা বলেই ফেলি, আমাকে বটির অনেক বন্ধু গল্পের বই দেবার নাম করে, সেই বইয়ের ফাঁকে প্রেমপত্র ভরে দিত। একদিন কোনরকমে চুপচাপ থেকে পরদিন গল্পের ছলে বলে ফেলতাম। অবস্থা দেখো। আর সবাই হেসে উঠত। বাড়িতে সবাই জেনে যেত। এদিকে বাড়িতে বাইরের কেউ এলেই কিন্তু আমাকে ত্রিসীমানায় দেখতে পাওয়া যেত না। এত লজ্জা ছিল আমার। দাদার বন্ধুদের সামনে, অথবা বৌদিদের ভাই, কিম্বা জামাইবাবুর আত্মীয়স্বজনদের সামনে আমি? নৈব নৈব চ...

বৌদিদের ভাইরা বা দিদিদের দেওরেরা বলত- “ধ্যুস! আজকালকার দিনে আবার এরকম মেয়ে দেখা যায় নাকি? তোমরাই ওকে স্পয়েল করছ আদর দিয়ে দিয়ে। দেখো এর জন্যে পরে ওকে ভুগতে না হয়! মিশতে দাও সবার সাথে। তবে তো মানুষজন সম্পর্কে জানতে পারবে। সবার সাথে মিশলে ওর আড়ষ্ঠতাও কেটে যাবে।”

কিন্তু কোথাও একটা কাঁটার মতো এই অভিভাবকত্বের আইনটা থেকেই গিয়েছিল। আর আইন মানেই জীবনের কোনও না কোনও পদক্ষেপে হোঁচট খাওয়ার ... পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার খবরদারির সম্ভাবনা।

আঠারোর গন্ডি পার হবার আগেই আত্মীয় স্বজনদের আবার খবরদারী নোটিস। “বিয়ে দিয়ে দাও এই বোনটার। শেষে বোনকে ঘরে আটকে রাখতে পারবে না।” কথায় আছে না- “যার বিয়ে তার খোঁজ নেই/পাড়া পড়শির ঘুম নেই।” আমার কিন্তু সম্পূর্ণ আবেগ ছিল শুধু মোমবাতির আলোর মত... একেবারে ভদ্র হিম।

বিয়ের কথা শুনেই মনে হতে লাগল যদি মনের মতো পুরুষটিকে না পাই? যদি তাঁর সঙ্গে মনের মিল না হয়ে ওঠে? তা হলে কি আমি মা হতে পারব না? প্রকৃতি আমার শরীরে সৃষ্টির যে অনবদ্য ক্ষমতা দিয়েছে, তার অনুভূতি থেকে বঞ্চিত থেকে যাব?

কারও প্রেমিকা বা স্ত্রী হওয়ার স্বপ্নের থেকেও ছোটবেলা থেকে কারও মা হওয়ার স্বপ্ন ছিল প্রবল। একদম মনের মত করে মানুষ করব আমার গর্ভের ঔরষকে। মা কে ছোটবেলায় হারিয়েছি বলেই হয়ত এই উদ্ভুটে স্বপ্ন দেখতাম। স্বপ্নের সমুদ্র সে কি ভয়ঙ্কর, ঢেউহীন, শব্দহীন, তা কি আর তখন জানতাম? দিবারাত্রি তাই উত্তর খুঁজতে লাগলাম।

আমার বিশ্বাস ছিল, স্বামী-স্ত্রীর জীবন এমন একটা জিনিস যা একবার সেলাই করে দিলে সাতজন্মে আর খুলবে না, ছিঁড়বে না। কিছু পাওয়ার ক্ষেত্রে সিদ্ধান্তের প্রশ্ন ওঠে না। কারণ সেখানে বাছাবাছির কোনও সুযোগ নেই। এই কথাকটা বলে শিমুল একটু দম নিল।

ন'দাদা তখন আমেরিকায় ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত। বটি, সেজদা আমেরিকায় যাবার জন্য তৈরী হচ্ছে। সবার ইচ্ছে আদরের ছোট্ট বোনের আমেরিকায় বিয়ে দেবে। ছেলেদের যা যা ডিমান্ড থাকে সব তো শিমুল-এর আছে। কিন্তু ভগবানের মার-দুনিয়ার বাড়। মিথ্যে হবে কেন? আমি কিন্তু মনে প্রাণে বিশ্বাস করি তা।

তড়িঘড়ি 'বিঙ্গো' করে ফেলল কলকাতার নামকরা চ্যাটার্জ্জী পরিবারের আত্মীয়দের সেরা ছেলেটাই। ছেলেটা আসানসোলের এক বনেদী বাড়ির ছেলে।

আমি তখন ক্লাশ নাইন। সেবারেই বিয়ে ঠিক হয়ে গেল বটির এক বন্ধু হিমান্তর সাথে। পুজোর ছুটিতে বাবার সাথে আমি আর আমার ছোট ভাই ঝাড়গ্রাম থেকে জব্বলপুর আসছি। বটি তখন বি.ই. কলেজের ছাত্র। ওর সাথে কিছু বন্ধুও এসেছিল হাওড়া স্টেশনে। তাদের মধ্যে হিমান্তও ছিল।

একটু বড় হবার পর থেকেই দাদারা আমাকে সব সময় জিজ্ঞেস করত ... “কি রকম ছেলে পছন্দ রে তোর।”

ন'দাদা আমেরিকা থেকে এসে হাসতে হাসতে বলল, “ তোর যদি কাউকে ভালো লাগে, আমাকে বলিস। তবে ডাক্তার, ইঞ্জিনীয়ার ছাড়া করিস না আবার।”

এই কথা শুনে কি লজ্জা তখন। যা সবার পছন্দ থাকে আমারও ঠিক তেমনি। লম্বা, ইঞ্জিনীয়ার, স্মার্ট হতে হবে, চোখে চশমা থাকবে। তবে বলতে পারি নি। কি যে এত লজ্জা ছিল কে জানে? সত্যি আজও ভাবলে অবাক হতে হয়।

– “তাহলে আমি পারফেক্ট তোমার পছন্দের, তাই না?”- অম্লান হাসল শিমুল।

--জানি না। তখন তো অমিতাভ, রাজেশ খান্না আর ঋষি কাপুরের যুগ... হেসে বলল শিমুল।বয়সের সুতো জীবনের লাটাই থেকে পাক খেয়ে খেয়ে খুলতে খুলতে কতদূর যায়? সব তো পর পর এসে হাজির হয় চোখের সামনে । সে কি অদ্ভুত ঘূর্ণিপাক রে বাবা!

এই দেখো! অনেকক্ষণ ধরে হাল্কা বৃষ্টির পর আবার জোর বৃষ্টি শুরু হল তো। ভারী বৃষ্টির চাদরে ঢাকা পড়ে সর্বত্র কালো হয়ে গেছে। চেয়ারের দুলুনি আর একটুখানি বাড়িয়ে দিয়েছিল শিমুল। কালো কোঁকড়ানো চুলের কয়েকটি গুচ্ছ ওর কপাল আর গালের ওপর নাচছিল।

উইংসে এসেছে তখন এক রাজার কুমার। হিমান্ত মুখার্জ্জী। সে তখন দুর্গাপুর স্টীল প্ল্যান্টে জুনিয়র ইঞ্জিনীয়ার। আমি অবশ্য সেকথা জানতাম না। বটি ইঞ্জিনীয়ারিং পাশ করার পর আসানসোলের বার্নপুর স্টীল প্ল্যান্ট-এ চাকরী পেলে সেখানে হিমান্তর সাথে আলাপ হয়। আলাপ থেকে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। প্রত্যেক ছুটিতে আসানসোলের রেলের কোয়ার্টারে হিমান্তদের বাড়িতে ওর যাওয়া ও থাকা। এক সাথে সিগারেট খাওয়ার বন্ধু। আসানসোলের আপকার গার্ডেনস-এ থাকত হিমান্তর ছোট মাসি। বটিকে ভাল লেগে যায় ওনার। যেমন সবার হয়, আমারও হয়েছিল ঠিক তেমনি।

বটির আরেক বন্ধু ছিল মুকুট সেনগুপ্ত। আমাদের বাড়ির গ্রুপ ছবি দেখে মুকুট আর হিমান্তর মাসি। মুকুটরাও তিন ভাই ছিল। আশ্চর্য কি বলো তো? হিমান্তরা ও মুকুটরাও তিনভাই আর সবার বড়। মুকুট তখন বটিকে বলে বিয়ের জন্য তার মা কে বলতে। আর হিমান্তর মাসিও বলে একই কথা।

--হ্যাঁ! বটি বলেছিল সেই গল্প। আর বটির বন্ধু রাঁচির অমিত মুখার্জ্জী-র কথাও বলেছিল।তোমাকে দেখে ওরও খুব ভালো লেগেছিল। যাকে মেরে ফেলল নকশাল-রা। খুবই দুঃখের সেই ঘটনা।

বটি ছুটিতে জব্বলপুরে এসে বাড়ীর সবাইকে জানায়। তারা তো হিমান্তকেই সিলেক্ট করে কারণ সে ব্রাহ্মণ। অদ্ভুত ভাবে এগিয়ে চলে বিয়ের কথাবার্তা। আমি তার বিন্দুমাত্রও টের পাই নি । বিশ্বাস করো। হিমান্ত কলকাতা ইউনির্সিটিতে বি.টেক করে এম. টেক করেছে। ওর ছোট ভাই আরকিওলজি আর মেজ ভাই ইংলিশে অনার্স পড়ছে। ওর বোনের অবশ্য তখন বিয়ে হয়ে গিয়েছে। বোনাই বেশ নামকরা ছেলে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত ছেলে অরিত্রি চ্যাটার্জ্জী।

--হুম।।জানি। পলাশ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল বড় করে। ওকেও তো মেরে ফেলেছিল মানে ছাদ থেকে ধাক্কা দিয়েছিল মনে হয়।

বিয়ের আগে প্রত্যেকবার পুজোর সময় আমার জন্যে নতুন জামা কাপড় আসত হিমান্তদের বাড়ি থেকে। আমি কিন্তু তখনও কিছু জানি না।

একবার দিদিয়া আর বড়বৌদিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “কারা পাঠায় আমাকে এসব জামাকাপড়? আর আমাকেই বা কেন পাঠায়? কই তোমাদের জন্যে তো পাঠায় না!”

বড় বৌদি বললেন, “যারা পাঠান... তাদের আসলে তোকে খুব ভাল লেগেছে, এই ব্যাপার। আর কিছু না।”

আমি কিন্তু তাতে খুশি হই নি। জিজ্ঞেস করেছিলাম, "কেমন লোক ওনারা যে শুধু আমাকেই ভাল লাগল আর তোমাদের ভালো লাগে নি! আমাকে তো দেখেনও নি ওনারা।” দেখতাম সবার মুখে মুচকি হাসি।

--ওনারা তোর বটির মুখে সব শুনেছে্ন। তারপর বাবা মারা গেছেন শুনে পাঠিয়েছেন।-দিদিয়া বলল।

ন'দাদা তখন আমেরিকায়। জানতে পেরে বিয়ের সিদ্ধান্তে বেঁকে বসল। কিন্তু লাভ হল না। দিদিয়ার খুব পছন্দ হয়ে গিয়েছিল হিমান্তকে। দিদিয়া আমাকে সন্তান স্নেহে বড় করেছেন। কাজেই দিদিয়ার পছন্দের ছেলের সঙ্গেই আমার বিয়ে হবে।

বিয়ে অবশ্য তক্ষুনি হল না, তবে পাকা কথা হয়ে রইল। এ সবের কিছুই জানি না। বিয়ের আগে হঠাৎ করে জন্মদিনেও আমার জন্যে নতুন জামা কাপড় আসতে থাকে হিমান্তদের বাড়ি থেকে। সেপ্টেম্বর মাস তো। সাধারণতঃ পুজোর সময় হয়। আমি কিন্তু তখনও নভিস।

হাইয়ার সেকেন্ডারি প্রথম বিভাগে পাশ করলাম। প্রিয় সাবজেক্ট বায়োলজিতে অনার্স নিয়ে জব্বলপুরে বি. এস. সি পড়ছি।

এদিকে আমি জব্বলপুরে আর হিমান্ত কলকাতায়। হিমান্তর ইচ্ছে হলেও আমাদের দেখা হবার উপায় ছিল না। তখন তো আর মোবিল ছিল না। মাঝে মাঝে সুগন্ধী চিঠি আসত। ফাইনালি দেখা হল একেবারে বিয়ের পিঁড়িতে। অবশ্য দু-তিনবার হিমান্ত এসেছিল বটির সাথে আরো দুজন বন্ধুকে নিয়ে। কিন্তু আমাদের যা বাড়ি। দেখা হওয়া নৈব নৈব চ...কাজেই একেবারে শুভদৃষ্টিতে দেখা। বলতে বাধা নেই, ভালোই লেগেছিল দেখে।

বিয়ে ঠিক হয়েছিল ফাল্গুনমাসে। বিয়ের আগে বারাণসী থেকে পন্ডিত ব্যক্তিদের দিয়ে দুজনের ঠিকুজি কুষ্ঠী বিচার করানো হয়েছে। পন্ডিত বলেছিলেন, “ওরা রাজযোটক।”

তাই কোনোদিক দিয়ে আর কোনও দ্বিধা ছিল না।

তারপর দুই বাড়িতেই তোড়জোড়। হিমান্তরা খোদ বারাণসী থেকে বেনারসী তৈরী করিয়ে আনিয়েছিল। আর এদিকে আমার বিয়ের শাড়ি আর গয়না ছাড়া বাকি সব এল আমেরিকা থেকে। বিসমিল্লা খাঁ এর সানাই টানাই বেজে বিয়ে হল বেশ রাজষিক ভাবে। তবে হিমান্ত বলেছিল, “যতক্ষণ না পোস্ট গ্রাজুয়েট হয়, ততক্ষণ বিয়ের পরও পড়াশুনা চালিয়ে যেতে হবে। এই একটাই ডিমান্ড শুধু আমার। আর আমরা কিছু চাই না।”

হঠাৎ দিদিয়া, সেজদা আর বড় ভাইঝি গেছিল আসানসোলে। শুভদিন দেখে ছেলে আশীর্বাদ হয়ে গেল। আমাদের বিয়ের আগে মেয়ে আশীর্বাদ করা হয় না।

কেন যদি প্রশ্ন করো... আমার বড় পিসির একমাত্র মেয়ে বিয়ের আশীর্বাদের পর পরই মারা যায়।

এদিকে জব্বলপুরে আশীর্বাদের দিন বৌদি আমার বান্ধবীদের ডেকে পাঠালেন। সেদিন তাদের বেশ ভাল ভাল খাবার খাওয়ানো হয়েছিল। তারাও অবাক।

কেবলমাত্র একজন জানত আমার হবু বরের সেদিন আশীর্ব্বাদ হচ্ছে আসানসোল-এ। সে আর কেউ নয়, আমাদের পাশের বাড়ির প্রিয় পাঞ্জাবী বান্ধবী পপ্পি।


(চলবে)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments