জ্বলদর্চি

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা-২৫/প্রীতম সেনগুপ্ত

পর্ব ২৫
শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা

প্রীতম সেনগুপ্ত

স্বামী তুরীয়ানন্দ

 “বালব্রহ্মচারী, যতী, নিত্য সদাচারী,/ ব্রহ্মতেজে উদ্ভাসিত বদন-মণ্ডল।/ রামকৃষ্ণ সঙ্ঘমাঝে তারকা উজ্জ্বল,/ তুরীয় আনন্দরূপী-গীতা মূর্তিমতী।/ --গঠিল শরীর দিয়ে-- স্বামী উক্তি হেন।/ সন্ন্যাসীর বেশে ভবে যাপিলে জীবন;/ শাস্ত্রজ্ঞ-ব্রহ্মজ্ঞ-ভক্ত, তিতিক্ষা অসীম/ দেখাইলে খলরোগ ধরি দেহ ছলে।।/ হে দেব! কতই কথা জাগিতেছে মনে/ পবিত্র-চরিত্র তব করিয়ে স্মরণ।/ কোটি কোটি প্রণতি মম তোমার চরণে।/ সাশ্রু-অর্ঘ্য লহ এই ভুলিও না দীনে।।”
 যে সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীকে নিয়ে স্বামী বিবেকানন্দের গৃহীশিষ্য শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তীর এই ছন্দোময় লেখনী, তিনি শ্রীরামকৃষ্ণের আর এক সন্ন্যাসী সন্তান স্বামী তুরীয়ানন্দ (হরি মহারাজ)। প্রাক-সন্ন্যাস জীবনে তাঁর নাম ছিল হরিনাথ চট্টোপাধ্যায়। স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর অতি প্রিয় এই গুরুভ্রাতা সম্বন্ধে একটি চিঠিতে লিখছেন,“হরির বিচিত্র ত্যাগ, স্থিরবুদ্ধি ও তিতিক্ষা আমি যখনই মনে করি তখনই নতুন বল পাই।” মার্কিন মুলুকের পশ্চিমাংশে বেদান্ত প্রচার প্রভূত সাফল্য লাভের পর স্বামীজী ওই অংশের কার্যভার স্বামী তুরীয়নন্দের হাতে তুলে দেবেন এমন সিদ্ধান্ত নেন। এই বিষয়ে সেখানকার ভক্তজনের কাছে বলেছিলেন--“এরপর তোমাদের কাছে আমি এমন একজন গুরুভাইকে পাঠাব, যার মধ্যে কি করে আমার বাক্যগুলিকে জীবনে পরিণত করতে হয় তা দেখতে পাবে।”

 তুরীয়ানন্দজী স্বামীজীর (বিবেকানন্দ) তুলনায় বয়সে কয়েকদিন বড় ছিলেন। ১৮৬৩ সালের ৩ জানুয়ারি কলকাতার বাগবাজারে এক ধর্মপ্রাণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে মাতৃহারা হন। বারো বছর বয়সে বাবাকে হারান! তাঁর দুই জ্যেষ্ঠভ্রাতা হরিনাথকে খুব ভালোবাসতেন। বড় বৌদি হরিনাথকে মাতৃস্নেহে মানুষ করেন। তিনি স্কুলে এনট্রান্স ক্লাস পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলেন। ন'বছর বয়সে তাঁর উপনয়ন হয় এবং সংস্কারবশত অতি অল্প বয়স থেকেই ব্রহ্মচারীর সংযমপূর্ণ জীবনযাপন অনুসরণ করতেন। খুব ভালোভাবে সংস্কৃত শেখেন এবং বিভিন্ন শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। বালক বয়স থেকে শঙ্করাচার্যের গ্রন্থসমূহ পাঠ করতেন। শঙ্করের অনুভূতি --আমি আত্মা,আমি শরীর নই--তাঁর মনে ভীষণভাবে প্রভাব ফেলে। গীতায় জীবন্মুক্তের লক্ষণ পাঠ করে অনুপ্রেরণা লাভ করেন। চাইতেন তেমনই হতে। আত্মানুভূতিই হয়ে ওঠে তাঁর জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য।

 শাস্ত্রে কথিত আছে, আন্তরিক ঈশ্বরাকাঙ্ক্ষীকে পথ প্রদর্শনের জন্য নিশ্চিতভাবে গুরু বা পথপ্রদর্শকের আবির্ভাব ঘটে। হরিনাথও অপ্রত্যাশিতভাবে তাঁর পথপ্রদর্শকের দেখা পেয়েছিলেন বাল্যকালে, মাত্র তেরো বছর বয়সে। অবশ্য তখন তিনি জানতেন না যে এই মহাপুরুষই তাঁর গুরু হবেন এবং পরবর্তী জীবনে তাঁকে ধ্রুবতারা করেই জীবন প্রবাহিত  হবে! তিনি শুনেছিলেন প্রতিবেশীর বাড়িতে এক পরমহংস আসছেন। নিতান্তই কৌতূহলী হয়ে পরমহংসকে দেখতে গেলেন। বলা বাহুল্য এই পরমহংসই ছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। হরিনাথ সেখানে (সঙ্গে ছিলেন বাল্যবন্ধু গঙ্গাধর, পরবর্তীকালে স্বামী অখণ্ডানন্দ, রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনে‌র তৃতীয় সঙ্ঘগুরু) একটি গাড়ি থেকে এক বলিষ্ঠ ব্যক্তি (শ্রীরামকৃষ্ণদেবের ভাগ্নে হৃদয়) অপর একজন সংজ্ঞাহীন ও অত্যন্ত কৃশ ব্যক্তিকে নামাচ্ছেন। দ্বিতীয় ব্যক্তির মুখমণ্ডল ও সমগ্র অঙ্গের ভাব শাস্ত্রবর্ণিত শুকদেবের মতো। ধরাধরি করে তাঁকে উপরে নিয়ে গেলে তিনি সংজ্ঞালাভের পর ‘যশোদা নাচাত তোরে বলে নীলমণি’ প্রভৃতি গান করলেন, সঙ্গে সঙ্গে বহু ঈশ্বরপ্রসঙ্গ করলেন। এর দু-তিন বছর পর ( ১৮৭৯ বা ১৮৮০ সাল) হরিনাথের দক্ষিণেশ্বরে গমনাগমন শুরু হয়। আকুমার ব্রহ্মচারী হরিনাথ একদিন ঠাকুরকে জিজ্ঞাসা করলেন, “মশাই, কামটা একেবারে যায় কি করে?” ঠাকুর উত্তর দিলেন,“যাবে কেন রে? মোড় ফিরিয়ে দে না!” উত্তর শুনে বিস্মিত হলেন হরিনাথ। এতদিন ব্রহ্মচারী হিসেবে নারীজাতিকে ঘৃণা দৃষ্টিতেই দেখতেন। মাতৃসমা জ্যেষ্ঠা ভ্রাতৃবধূর হাতে আহার গ্রহণ করতেও সঙ্কুচিত বোধ করতেন। বালিকাদের নৈকট্য তাঁর কাছে অসহ্য ছিল। বলতেন--“উঃ আমি তোদের হাওয়া সহ্য করতে পারি না।” ঠাকুর একথা শুনে তাঁকে রীতিমতো ভর্ৎসনা করে বলেন,“তুই বোকার মতো কথা বলছিস। নারীমূর্তিদের অবজ্ঞার চোখে দেখার কারণ কি? তারা জগন্মাতার মানবী মূর্তি। তাদের মায়ের মতো দেখবি ও শ্রদ্ধা করবি। তাদের প্রভাব হতে মুক্ত হবার এই হচ্ছে উপায়। তা না যতই তাদের অবজ্ঞা করবি ততই তাঁদের ফাঁদে পড়বি।”(শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তমালিকা-স্বামী গম্ভীরানন্দ)

 দক্ষিণেশ্বরে যাতায়াতের সূত্রে নরেন্দ্রনাথের সঙ্গে হরিনাথের পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও বন্ধুতার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। একদিন হেঁটে বরানগরের পথে ফিরবার সময় নরেন্দ্রনাথ হরিনাথকে বললেন,“ঠাকুরের সম্পর্কে কিছু বল।” হরিনাথ বললেন,“কি আর বলব?” এই কথা বলে তিনি শিবমহিম্ন স্তোত্রের--“অসিতগিরিসমং স্যৎ কজ্জ্বলং সিন্দ্ধুপাত্রে...” ইত্যাদি শ্লোকটি আবৃত্তি করলেন। নরেন্দ্রনাথও নানা কথা বলতে বলতে বললেন--“ওঁর কথা আর কি বলব? আমাকে যদি বল, তিনি এল-ও-ভি-ই (Love) personified (মূর্তিমান প্রেম)।” পরবর্তী সময়ে তুরিয়ানন্দজীকে জনৈক সন্ন্যাসী প্রশ্ন করেছিলেন--“মহারাজ, শুনেছি, ঠাকুর নিজে নানারূপে সাধন করেছিলেন এবং তিনি নানারূপ সাধনপথের উপদেশ দিয়েছিলেন, কিন্তু আপনাদের নিকট ধ্যানজপের উপদেশ ছাড়া অন্য কোনও সাধনপন্থার কথা আমরা শুনতে পাই না। ধ্যানের অবস্থা লাভ করবার উপায়স্বরূপ আপনাকে শ্রীশ্রীঠাকুর যেরূপ উপদে‌শ দিয়েছিলেন তা বলুন।” এর উত্তরে তুরীয়ানন্দজী বলেন--“ঠাকু্র কাউকে কাউকে বিভিন্ন সাধনপথ নির্দেশ করেছিলেন সত্য, কিন্তু আমাকে তিনি কেবল ধ্যানজপেরই উপদেশ দিয়েছিলেন। তবে গভীর রাত্রে (মধ্যরাত্রে) উলঙ্গ হয়ে ধ্যান করতে বলেছিলেন। ঠাকুরের একটি বিশেষত্ব ছিল, তিনি উপদেশ দিয়েই ক্ষান্ত হতেন না, বিশেষ লক্ষ্য রাখতেন, শিষ্য উপদেশ অনুযায়ী চলছে কিনা। ঐরূপ উপদেশ দেবার পরই একদিন জিজ্ঞাসা করলেন,‘কি রে, ন্যাংটা হয়ে ধ্যান করিস তো?’ ‘আজ্ঞা হাঁ’। ‘কেমন বোধ হয়?’--’মহাশয় যেন সমস্ত বন্ধন চলে গেছে।’ ‘হাঁ, ঐরূপ করবি। খুব উপকার পাবি।’ আর একদিন তিনি আমায় বলেছিলেন,‘মন মুখ এক করাই হচ্ছে সাধন।’ আমি তখন খুব শঙ্করের বেদান্তচর্চা করছি। আমায় তিনি (ঠাকুর) বললেন, ‘ওরে জগৎ মিথ্যা মুখে বললে কি হবে? ঐ নরেন ও কথা বলতে পারে। ও যদি জগৎ মিথ্যা বলে, জগৎটা অমনি মিথ্যা হয়ে যায়। ও যদি বলে, কাঁটা গাছ নাই, কাঁটা গাছ নাই হয়ে যায়। কিন্তু তোরা কাঁটায় হাত দে তো? কাঁটা অমনি প্যাঁট করে ফুটবে।” (স্বামী তুরীয়ানন্দের স্মৃতিকথা, সঙ্কলক ও সম্পাদক-- স্বামী চেতনানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয়)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments