জ্বলদর্চি

দূরদেশের লোকগল্প—ইউক্রেন /নেকড়ের নেকনজর /চিন্ময় দাশ

দূরদেশের লোকগল্প—ইউক্রেন 

চিন্ময় দাশ
 
নেকড়ের নেকনজর 

(কেবল ইউক্রেন নয়, রাশিয়া এলাকার সমস্ত দেশেই, রাজাকে বলা হোত – জার। রাজকুমাররা হোল জারেভিচ, আর রাজকুমারিরা--  । তবে, এই গল্পে আমরা রাজা, রাজকুমার আর রাজকুমারিই বলব তাদের। যেমনটা আমরা এ দেশে বলে থাকি।)
একটা নাসপাতি গাছ ছিল এক রাজার। তবে, যাকে বলে, ঐ নামেই থাকা। কোন দিন একটাও নাসপাতি জোটেনি রাজার কপালে। জুটবে কী করে? গাছে ফুল আসে। ফলও ধরে। পুরুষ্টুও হয় ফলগুলো। তার পরে? কোথায় যে গায়েব হয়ে যায় ফলগুলো, বোঝাই যায় না। একেবারে ভোজবাজির মত ব্যাপার একেবারে। দিনের পর দিন—একই অবস্থা। 

এভাবে কতদিন আর সহ্য করা যায়? রাজার মেজাজ গেল বিগড়ে। মন্ত্রীকে ডেকে, ধমক দিয়ে বললেন—হ্যাঁহে, তুমি আছোটা কী করতে? একটা গাছের ফল কোথায় মিলিয়ে যাচ্ছে। সন্ধান করতে পারো না! 
মন্ত্রী বলল—যাবে আর কোথায়? এ তো আর যাদুমন্ত্র নয়। কেউ না কেউ চুরি করছে। সেনাপতিকে ব্লুন, ধরে আনবে। কোতওয়াল দিয়ে মুণ্ডু কেটে নিন হতভাগার।
ধবধবে সাদা রঙের পাকা আর লম্বা দাড়ি রাজার মুখে। সেই দাড়ি উপর-নীচ বার কয়েক নেড়ে, রাজা বলল—ঠিক বলেছ। পাহারাদারকে ডাকি তাহলে।
মন্ত্রী বলল—দাঁড়ান, দাঁড়ান। অন্য একটা কথা বলি বরং। 
রাজা বলল—আবার কী কথা?
--রাজকুমাররা বড় হয়েছে। মন্ত্রী বলল—দু’দিন বাদে রাজ্যের ভার নিতে হবে তাদের। এই সুযোগে রাজকুমারদের বুদ্ধি একটু যাচাই করে নিলে, ভালো হয় না?  
কথাটা বেশ মনে ধরল রাজার। তিন ছেলে তাঁর। বড় রাজকুমারকে ডেকে রাজা বলল—গাছের নাসপাতি চুরি হয়ে যাচ্ছে। আজ রাতে তুমি যাবে পাহারায়, চোর ধরে আনবে। দু’দিন বাদে, রাজ্যের ভার নিতে হবে তোমাকে। দেখি, কেমন পারঙ্গম হয়েছ। 

ভালো করে সন্ধ্যা না হতেই, বড় রাজকুমার গিয়ে হাজির হোল বাগানে। বাতাস বইছে ফুরফুর করে। গাছে গাছে পাখিদের কলকাকলি। নির্জন এলাকা। আলস্য এসে গেল রাজকুমারের। সাথে খাবার ছিল তার। খাওয়া-দাওয়া সেরে নেওয়া যাক, তারপর পাহারা দেওয়া যাবে-- এই ভেবে, খাবারের পুঁটলি খুলেছে, অমনি কোথা থেকে একটা ইঁদুর সামনে এসে হাজির। 
--দু’-চারটে দানা আমাকে দেবে, রাজকুমার? ভারি খিদে পেয়েছে। ছেলেটা চোখ তুলে একবার চাইল ইঁদুরটার দিকে। তার পর হাতের এক ঝটকায় পাঁচ হাত দূরে ছিটকে ফেলে দিল বেচারাকে।

রাজকুমার বলে কথা। খাবার পেটে পড়তেই, গা ম্যাজম্যাজ। একটু গড়িয়ে নেওয়া যাক—ভেবে, গাছের তলাতেই গা এলিয়ে দিল রাজকুমার। সাথে সাথেই ঘুম নেমে এলো দু’চোখে। 
সকালের রোদ লেগে, চোখ খুলল যখন, সব ভোঁ-ভোঁ। একটা নাসপাতিও গাছে নাই। 
রাজামশাই রেগে কাঁই। এবার মেজো ছেলেকে পাঠালেন। অবস্থা একই। ইঁদুরকে তাড়িয়ে দেওয়া, খাওয়া আর ঘুমিয়ে পড়া। সকাল বেলায় দেখা গেল, গাছে নাসপাতি নাই।
রাজা পড়লেন মহা ভাবনায়। একটা সামান্য নাসপাতি চোর ধরতে পারে না ছেলেরা! রাজ্য চালাবে কী করে তাহলে? 
 রাজার ছোট ছেলেটি একটু বোকাসোকা। নাম— মিশকো। নেহাতই সাধাসিধে, সরল মানুষ। চালাক চতুর নয় তেমন। তাকে পাঠিয়ে লাভ হবে না কিছুই।
কিন্তু সেই ছেলে নিজে এসে রাজাকে বলল—বাবা, অনুমতি করুন। আমি যাবো পাহারায়। 
ডুবন্ত মানুষ খড়কুটো পেলেও ধরে। রাজামশাই অনুমতি দিলেন। সামান্য খাবার নিয়ে, মিসকো এসে হাজির হোল গাছের তলায়। সন্ধ্যা নামলে, একটু আগুন জ্বেলে, মাংস সেঁকতে লাগলো ছেলেটা। 

তখনই গুটি গুটি পায়ে ইঁদুর এসে হাজির—রাজকুমার, এক টুকরো রুটি দেবে আমাকে? 
--একটুখানি বসো এখানে। মাংসটা সেঁকে নিই। শুধু রুটি দিই কী করে তোমাকে? গলা মোলায়েম করে জবাব দিল মিশকো।
রুটি আর মাংস দু’জনে খেলো ভাগ করে। যেন কত দিনের বন্ধু তারা দু’জনে। ইঁদুর বলল—তুমি ভারি ভালো মানুষ। ঠিক আছে, এখন ঘুমিয়ে পড়ো। নাসপাতির ভাবনা তোমাকে ভাবতে হবে না। সব জানি আমি। মাঝরাতে এসে জাগিয়ে দেব তোমাকে। প্রতিদিন একটা সোনালি পাখি আসে সোনার বাক্স নিয়ে। নাসপাতি তুলে নিয়ে যায়। চুপিসাড়ে গিয়ে পাখিটাকে ধরতে হবে তোমাকে। পাখি কিন্তু ভারি চালাক। বোকাসোকা নয় মোটেই।

মাঝরাতে খুটখুট করে ইঁদুর এসে, জাগিয়ে তুলল মিশকোকে। গাছের ডালে সত্যিই একটা পাখি। কী সুন্দর সোনালি ডানা। দুই ডালের খাঁজে একটা বাক্স রেখেছে। একটা একটা করে নাসপাতি তুলে, তাতে ভরে রাখছে। 
ভারি সন্তর্পনে গাছে উঠে, পাখির পিছনে পৌঁছে গেল মিশকো। পাখিটাও সাড়া পেয়ে গিয়েছে। উড়ে পালাতে যাবে, হাত বাড়িয়ে খপ করে পাখির লেজটাই ধরে ফেলতে পারল মিশকো। পারা গেল না। ছিটকে উঠে, পালালো পাখি। একগোছা পালক কেবল রয়ে গেল মিশকোর হাতে। অগত্যা নাসপাতির ঝুড়ি আর এক গোছা পালক নিয়েই প্রাসাদে ফিরে এলো মিসকো। 
সকালে মিশকোর ডাক পড়ল দরবারে—কিছু হদিশ করতে পেরেছ? 
মিসকো বলল—পেরেছি। কিন্তু পুরোটা সফল হতে পারিনি। পাখিটার লেজের এই একগোছা পালক আর ফলের ঝুড়িটাই কেবল দখল করতে পেরেছি। আশা করছি, আর চুরি হবে না গাছের নাসপাতি। 
সব দেখে আর আর শুনে, দরবার শুদ্ধ সবাই তারিফ করতে লাগল মিশকোর। রাজামশাই আস্তাবল থেকে দুটো ঘোড়া বের করে, বড় আর মেজো দুই রাজকুমারকে ধরিয়ে দিয়ে বললেন – যতো সব অকম্মার ধাড়ি। ছোট একটা কাজও করতে পারো না ভালো করে। বেরিয়ে যাও আমার রাজ্য থেকে। 
কী আর করে? ঘোড়ায় চেপে বেরিয়ে গেল দুজনে। 
আর একটা ঘোড়া এনে, মিশকো চেপে বসল যখন, সবাই হইহই করে উঠল—আরে আরে, তুমি চললে কোথায়? 
--কোন কাজই আধখানা করে ফেলে রাখতে নাই। এর শেষ দেখে ঘরে ফিরব আমি। মিশকো বলল—আমি চললাম সোনালি পাখিটার খোঁজে।
        *             *            * 
কত দূর চলতে চলতে একটা সরাইখানায় এসে থামল মিশকো, একটু জিরিয়ে নেবে বলে। সেখানে চোখে পড়ল, বড় আর মেজো রাজকুমার এলাহি খানাপিনা করছে বসে বসে। সেদিকে নজর না দিয়ে, নিজের রুটি আর জল খেয়ে, আবার ঘোড়ায় চেপে বসল সে। 
চলতে চলতে একটা চৌমাথায় এসে পড়ল মিশকো। একটা চ্যাটালো পাথরে লেখা—সামনের রাস্তায় গেলে, ধ্বংস হয়ে যাবে তুমি। বামে গেলে কোন দিন আর ফিরে আসবে না। ডাইনে গেলে, নেকড়ে বাঘ ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবে তোমাকে। 

  মিশকো দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগল, কী করব? ফিরে যাবো, না কি মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়াবো? লড়বো নিজের সাধ্য মতো? 
শেষমেশ ডাইনের পথটাই বেছে নিল মিশকো। মনে ভাবল, নেকড়ের সাথে লড়ে পারা যাবে কি?। নইলে, ঘোড়াটাকেই নাহয় দিয়ে দেব নেকড়েকে। তখন  নিশ্চয় আমাকে রেহাই দেবে সে। 

  ডাইনের পথ ধরে কত দূর চলবার পর, একটা উঁচু পাহাড়ের মাথায় এসে হাজির হল ছেলেটা। অমনি একটা গর্জন কানে এল তার। চোখের পলক না ফেলতে দেখল, একটা দশাসই নেকড়ে তেড়ে আসছে তার দিকে। ঘোড়া থেকে লাফিয়ে নেমে পড়ল মিশকো। 
চেঁচিয়ে বলল— শোন বাপু! আমাকে মেরো না। আমার ঘোড়াটাই দিয়ে দিচ্ছি তোমাকে। পেট ভরে খাও। 
নেকড়ে ভারি খুশি এ কথা শুনে। তারিয়ে তারিয়ে পেট ভরে খেলো রাজকুমারের ঘোড়াটাকে। তারপর দু’-তিনটে ঢেকুর তুলে, তাকালো রাজকুমারের  দিকে। বলল—তা, তুমি কে বাপু? এখানে কেন? চলেছই বা কোথায়? 
মিশকো সব কথা খুলে বলল নেকড়েকে। আমি বাবাকে কথা দিয়ে এসেছি, নাসপাতি চোর সেই সোনালি পাখিকে খুঁজ়ে বার করব। তবে বাড়ি ফিরে যাবো।  
--সে পাখির কাছে পৌঁছানো তো অনেক লম্বা পথ হে, তোমার সাধ্যে কুলোবে না। 
--দেখা যাক। পারি কি না। আমি যে কথা দিয়ে এসেছি, পাখি নিয়েই বাড়ি ফিরব। তার আগে নয়।
নেকড়ে বলল—তোমার ঘোড়া তো এখন আমার পেটে। তুমি যাবে কী করে এতো দূরের পথ? ঠিক আছে, আমার পিঠে চেপে বসো। এগিয়ে দিচ্ছি তোমাকে।
অনেক দূর পাড়ি দিয়ে, ভিন্ন এক রাজার রাজ্যে এসে থমল নেকড়ে। সামনে একটা বন। তার সামনে রাজপ্রাসাদ। নেকড়ে বলল—রাজকুমার, তিন বার আমার লেজে হাত বুলিয়ে নাও। তোমার শরীর অদৃশ্য হয়ে যাবে তাতে। নিরাপদে প্রাসাদের দেউড়ি পেরিয়ে যাবে তুমি। প্রাসাদের এক কোনে একটা গোয়ালঘর পাবে, সেখানে সোনার খাঁচায় রাখা আছে পাখিটা। বের করে নিয়ে চলে আসবে। কেউ দেখতে পাবে না তোমাকে। 

  মিশকো এগোতে যাবে, নেকড়ে বলল—তবে বাপু, ভুলেও খাঁচাটা ছুঁয়ো না যেন। তখন কিন্তু ধরা পড়ে যাবে তুমি।
সত্যি সত্যিই দেউড়ির পাহারাদাররা দেখতেই পেল না মিশকোকে। গোয়ালঘরে গিয়ে পাখির দেখা পাওয়া গেল। পাখি বের করে চলে আসবে, তখন মিশকোর মনে হোল, আহা, কী সুন্দর খাঁচাটা। না নিয়ে যেতে পারি, একবার ছুঁতে না পারলে চলবে কী করে। 
যেমন ভাবা, তেমন কাজ। যেই না হাত দিয়ে ছুঁয়েছে, অমনি বিকট একটা আওয়াজ । যে যেখানে ছিল দৌড়ে এসে ধরে ফেলল মিশকোকে।
রাজার সামনে হাজির করা হোল মিশকোকে। রাজা জানতে চাইল—তুমি কে হে? এখানে এলে কেন>
মিশকো বিশদ করে রাজাকে শোনালো তার সব কথা। রাজা বলল—আমার পাশের রাজ্যের রাজার একটা সোনার ঘোড়া আছে। সেটা যদি এনে দিতে পারো, মুক্তি দিয়ে দেব তোমাকে। 

মিশকো ফিরে এল নেকড়ের কাছে। নেকড়ে বলল—তোমাকে আমি সাবধান করে দিয়েছিলাম, খাঁচায় হাত না দিতে। কপাল ভালো, মেরে ফেলেনি তোমাকে। যাকগে, চলো পাশের রাজ্যে যাই।
আর এক রাজার প্রাসাদের সামনে এসে হাজির হোল দুজনে। নেকড়ে আবারও সাবধান করে দিল মিশকোকে—এবারেও পাহারাদাররা দেখতে পাবে না তোমাকে, সোজা আস্তাবলে পৌঁছে সোনার ঘোড়া দেখতে পাবে। নিয়ে চলে এসো। কিন্তু ঘোড়ার লাগামে হাত দিও না যেন। ধরা পড়ে যাবে। 
পাহারাদারদের মাঝখান দিয়েই ভেতরে চলে গেল মিসকো। কারও চোখেই পড়ল না। আস্তাবলের আগড় খুলতেই, আহা কী সুন্দর তেজিয়ান এক সোনার ঘোড়া। ঘোড়ার মুখে এমনই জেল্লাদার লাগাম পরানো, চোখ বুজে থাকা যায় না। যেই না লাগামটায় হাত ছুঁইয়েছে, অমনি কানফাটানো এক আওয়াজ। পাহারাদাররা এসে হাজির। পাকড়াও করে রাজার সামনে নিয়ে হাজির করল রাজকুমারকে।

  রাজার চোখ মুখ লাল—তোমার সাহস তো কম নয়। আমার ঘোড়া চুরি করতে এসেছ তুমি! শূলে চড়াব তোমাকে। চুরি করতে আসার মজা বুঝিয়ে ছাড়ব।
চোখ দুটো থেকে যেন আগুন ঝরে পড়ছে রাজার। ভয়ে থর থর করে কাঁপছে মিশকো। তোতলাতে তোতলাতে কোন রকমে পুরো ব্যাপারটা খুলে বলল রাজাকে।
একটু ঠাণ্ডা হোল রাজা। বলল—ঠিক আছে। একটা সূযোগ দিচ্ছি। শুনেছি, কোন এক দেশে এক সুন্দরী রাজকন্যা আছে। মাথাভরা সোনালি চুল তার। তাকে এনে দিতে পারো যদি, শূলে চড়া থেকে রেহাই পেয়ে যাবে।

আবার নেকড়ের কাছে ফিরে এলো মিশকো। নেকড়া বলল—আবারও আমার কথা অমান্য করেছ তুমি। ফিরে যে এসেছ, অনেক সৌভাগ্য বলতে হবে। যাকগে, চলো রাজকন্যার দেশে যাই। 
আবার নেকড়ের পিঠে চড়ে বসল মিশকো। আবার সাঁই সাঁই দৌড় শুরু হোল নেকড়ের। কতক্ষণ দৌড়ে, অনেক দূরের এক দেশে পৌঁছলো দুজনে।
মিশকোকে পিঠ থেকে নামিয়ে, নেকড়ে বলল—এইখানে অপেক্ষা করো তুমি। এবার আমি যাবো। তোমাকে ভরসা করা যাচ্ছে না। আবার ভুল করবে। আবার ধরা পড়বে। এবার আর আমি বাঁচাতে পারবো না তোমাকে। 
রাজকুমারি তখন বাগানে বেড়াচ্ছে। কতকগুলো সেপাই রয়েছে পাহারায়। নেকড়ে ঘাপটি মেরে বসে রইল। পাহারাদারগুলো যখন খাবার ঘরে ঢুকল গিয়ে, এক লাফে বাগানে ঢুকে পড়ল নেকড়ে। রাজকুমারিকে পিঠে চাপিয়ে দৌড়।

ফটকের কাছে এসে, মিসকোকেও পিঠে তুলে নিল নেকড়ে। কিন্তু ততক্ষণে সব জেনে গেছে সে দেশের রাজা। বারো-পাওয়ালা একটা ড্রাগনের পিঠে চেপে তাড়া করে আসছে সে। আগুনের হলকা বেরুচ্ছে ড্রাগনটার নাক-মুখ থেকে। 
মিশকো চেঁচিয়ে বলল— আগুনের তাত লাগছে, পিঠ পুড়ে যাচ্ছে আমার।
নেকড়ে বলল— আমার লেজ থেকে চুল ছিঁড়ে নাও একটা। পেছন দিকে ছুঁড়ে দাও। তবে খবরদার, পিছন ফিরে চেও না যেন। পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। 
নেকড়া যেমনটি বলল, তার লেজ থেকে একটা চুল ছিঁড়ে নিয়ে পেছনে ছুঁড়ে দিতেই, কী অবাক কাণ্ড! এক লহমায় একটা লোহার প্রাচীর গজিয়ে উঠল তাদের পিছনে। সেটাকে টপকে আসা সাধ্যে কুলোল না পিছনে তাড়া করে আসা রাজার। 

  আরও অনেক সময় ধরে দৌড় চলল তিন জনের। অবশেষে প্রথম যেখানে নেকড়ের সাথে দেখা হয়েছিল মিসকোর, সেই পাহাড়ে পৌঁছে দৌড় থামল তাদের। 
মিশকো আর রাজকুমারীকে পিঠ থেকে নামিয়ে, নেকড়ে বলল— এখানে একটু অপেক্ষা করো দুজনে। আমি আসছি। 
নেকড়ে ফিরে এলো খানিক বাদেই। সাথে সোনালি পালকের পাখি আর একটা সোনার ঘোড়া। মিশকোর হাতে সেগুলো তুলে দিয়ে বলল—নাও বন্ধু! এসব নিয়ে নিজের দেশে ফিরে যাও। তবে, সাবধান, পথে ঘুমিয়ে পড়ো না যেন। একেবারে কর্পূরের মত উবে, হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে তাহলে। 
নেকড়েকে বিদায় জানিয়ে, ঘোড়ায় চেপে বসল মিশকো। হাতে সোনার পাখি। পিছনে রাজকুমারি। কত দূর দৌড়ে, এক বার দৌড় থামাল দুজনে। অনেক ধকল গেছে। একটু জিরিয়ে নেওয়া দরকার। 
শরীর যেন আর বইছে না। ঘোড়া থেকে নেমে, গা এলিয়ে দিল। সাথে সাথেই ঘুম জড়িয়ে এল দুচোখে। দুজনেরই।

  খানিক বাদে এক অদ্ভুত জীব এসে উপস্থিত হোল সেখানে। মাথাটা এক্কেবারে শেয়ালের মতো। সব দেখে, ভারি মজা লাগল তার। গরম নিশ্বাস ফেলে মিসকো আর তার ঘোড়াকে পাথর বানিয়ে দিল। তার পর মনের আনন্দে সোনার পাখি আর রাজকুমারিকে নিয়ে সরে পড়ল সেখান থেকে। 
ঘরে ফিরে, তার একটাই চেষ্টা, রাজকুমারিকে বিয়ে করা। দিনের পর দিন যেতে লাগল। কত জোর। কত জবরদস্তি। কিন্তু ফল কিছুই হোল না। রাজকুমারির এক পণ, মরতে হয় সেও ভালো। এমন ধূর্তকে বিয়ে করব না।
           *             *            * 
এদিকে হোল কী, অনেক দিন পেরিয়ে গেছে। মিশকোর জন্য নেকড়ের ভারি মন খারাপ। ছেলেটা যে দেশে পৌঁছোয়নি, সে খবর তার  কানে এসেছে। গেল কোথায় তাহলে। যা ভুলো মন, যা ভালো মানুষ! বড়সড় কোন বিপদ হয়নি তো ছেলেটার।
সে তো আসলে নেকড়েদের রাজা। সমস্ত নেকড়ের একটা জমায়েত ডাকল সে। দূর দূর বন পাহাড় নদী ঝরণা—যেখানে যত নেকড়ে ছিল,  সবাই এসে হাজির হয়েছে জমায়েতে।

  সবাইকে জানতে চাওয়া হোল, মিশকোর খবর কেউ কিছু জানে কি না। কেউ কোন সংবাদ দিতে পারল না। শেষে একটা খোঁড়া নেকড়ে বলল—আসবার পথে এক জায়গায় পাথরের একটা মানুষ আর একটা ঘোড়া দেখে এলাম আমি। 
নেকড়ের বুঝতে কিছু বাকি রইল না। অনেক ভেবে বলল—সঞ্জীবনী জলের সন্ধান জানো কেউ? 
কেউ কিছু বলতে পারল না। খোঁড়া নেকড়েটাই বলল—আমি জানি। দুর্গন্ধ-বনের ভিতরে, গা-ঘেঁষাঘেঁষি দুটো পাহাড় আছে। তাদের মাঝখানে একটা ঝরণায় আছে সেই জল। পাহাড় দুটো সারা ক্ষণ মাথা ঠোকাঠুকি করে নিজেদের মধ্যে। তবে, কেবল দুপুরবেলাটাতেই একটু জিরোয় তারা। তখনই সেখানে ঢুকে পড়া যায়। 
নেকড়ে রাজার হুকুমে, খোঁড়া নেকড়ে সেখানে গিয়ে ঝরণার জল এনে দিল। সেই জল ছিটিয়ে দিতে, প্রাণ ফিরে এলো পাথর দুটোতে। জেগে উঠল মিশকো আর তার ঘোড়া।

--তাহলে, রাজকুমার! মনে আছে, তোমাকে আমি সাবধান করে দিয়েছিলাম। তুমি আবার আমার কথা অমান্য করেছ। তাতে সোনার পাখি আর রাজকুমারিকে হারিয়েছ তুমি। জীবনটাও গিয়েছিল তোমার। নেকড়ে বলল—যা হয়ে গেছে, তা নিয়ে খেদ করে লাভ নেই। এখন যা বলছি, শোন। সামনের পথ ধরে এগোও। এক বুড়ির দেখা পাবে। সে-ই তোমাকে জানিয়ে দেবে তোমার কী করণীয়। 
কত দূর পথ পাড়ি দিয়ে থুত্থুরে এক বুড়ির সামনে এসে হাজির হোল মিশকো। নাই নাই করে শ’-পাঁচেক বছর বয়স হবে বুড়ির। মিশকোকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত ভালো করে জরীপ করল বুড়ি। জানতে চাইল-- কিসের খোঁজে এখানে এসেছ, বাছা?
এক দুই করে নিজের সব কথা বলে গেল মিশকো। জিজ্ঞেস করল—দয়া করে আমাকে বলবে, সোনার পাখি আর রাজকুমারিকে ফিরে পাবো কীভাবে।
--কপালে থাকলে ফিরে পাবে। তবে, বলতে পারছি না, তুমি জীবন্ত ফিরে আসতে পারবে কি না। কুকুরের মুখওয়ালা একটা দৈত্য আটকে রেখেছে তাদের। আগুনের হলকা বেরোয় তার নিশ্বাসে। তাতে পাঁচশ’ হাত দূরের সবকিছু পুড়ে খাক হয়ে যায়। 
মিশকো জানতে চাইল—তাহলে? উপায় নাই কিছু? 
--নাগো, ভালোমানুষ। আছে একটা উপায়। বলে দিচ্ছি তোমাকে। ভেতরে যাও। তোমাকে দেখেই তেড়ে আসবে দৈত্যটা। ঘাবড়ে যেও না। বুড়ি বলে চলল—সামনেই একটা বীচ গাছ দেখতে পাবে তুমি। তার শেকড়ের নীচে ছোট একটা লাঠি পোঁতা আছে। সেটাই দৈত্যটার প্রাণভোমরা। চটপট করে লাঠিটা খুঁড়ে বের করে, ভেঙ্গে দু’টুকরো করে ফেলবে। তোমার সামনেই ছটফট করতে করতে মারা পড়বে দৈত্যটা।
বুড়ি যেমনটি বলেছিল, হুবহু তেমনটাই ঘটল। দৈত্যটা তেড়ে আসছিল। শেকড়ের তলায় সামান্য খুঁড়তেই লাঠিটা হাতে উঠে এলো মিশকোর। সেটা ভেঙ্গে ফেলতেই, দৈত্য চিতপটাং। ছটফট করে মিসকোর সামনেই মারা পড়ল হা-পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে। 
কিন্তু রাজকুমারিকে দেখে, চোখ কপালে উঠে গেল মিসকোর। কোথায় সেই সুন্দরী রাজকন্যা। কঙ্কালসার চেহারা হয়েছে তার। চেনাই যায় না।
 কী আর করা যায়! সোনার পাখি আর রাজকুমারিকে তুলে নিয়ে, ঘোড়া ছুটিয়ে দিল মিশকো । 
নিজেদের রাজ্যে এসে পৌঁছালো মিশকো। সেই সরাইখানায় হাজির হোল সে। যাবার সময় নিজের দুই দাদাকে খানাপিনা করতে দেখে গিয়েছিল এখানে। এখনও দেখতে পেল তাদের। তবে, এখন তাদের ভারি দুরবস্থা। পেট চালাবার জন্য, এঁটো বাসনপত্র ধোয়া, ঘরদোর মোছার কাজ করছে দু’জনে। হাতে সোনার পাখি, একজন রাজকুমারী নিয়ে ঘোড়া হাঁকিয়ে মিশকো সরাইখানায় এসে হাজির হোল যখন, ছেলে দুটোও দেখেছে তাকে। চিনতেও পেরেছে। লজ্জায় ভাইয়ের সামনে না এসে, তারা আড়াল করে রাখল নিজেদের।
দু’জনে পরামর্শ করতে লাগল—কী করা যায় এখন? মেজ ছেলেটা যেমন কুঁড়ে, তেমনি শয়তান। সে বলল—এতে ভাবাভাবির কী আছে? প্রায় তিন মাস হতে চলল, বাবা বের করে দিয়েছে আমাদের। অনেক ঝকমারি হয়েছে, আর একদিনও নয়। এই দুর্দশার জীবন, আজই শেষ করে দিতে হবে। 

বড় ভাই বলল—সে নাহয় বুঝলাম। কিন্তু হবে কী করে?
--অতি সহজ কাজ। মিশকোকে খুন করে ফেলব রাতের বেলা। তারপর সব কিছু নিয়ে রাজবাড়িতে ফিরে যাব। কেল্লা ফতে। হয়রাণির দিন শেষ। 
বড়ভাই এতটা নিষ্ঠুর হতে দোনামনা করতে লাগল। শেষে অনেক ভেবে, রাতের বেলা মিশকো র সামনে হাজির হোল দুজনে। 
শাঁসালো খদ্দের দেখে, মিশকোকে আলাদা ঘর দিয়েছে সরাইখানার মালিক। সেই ঘরে ঢুকে পড়ল দুই ভাই। অনেক ধকলের পর, বিশ্রাম নিচ্ছিল মিশকো। গভীর ঘুম তার দুচোখে। কোমরের ছোরা বালিশের পাশে খুলে রাখা। মেজ ভাই ঘরে ঢুকে, প্রথমে তলোয়ারটা হাতে তুলে নিল। ঘুম জড়ানো চোখ খুলে, মিশকো তাকিয়ে দেখল, বুকের ওপর একটা তলোয়ার তাক করে আছে তার নিজেরই দুই দাদা। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল সে। মাথায় কিছু ঢুকছে না।

বড় ভাই এক ধমক দিয়ে বলল—বাবার কাছে গিয়ে কেরামতি দেখাবার সাধ হয়েছে তোর? দূর হ এখান থেকে। বেঁচে থাকতে চাস যদি, আজ থেকে দু’বছর রাজ্যের মাটিতে পা দিবি না। ভালোয় ভালোয় কেটে পড় এখান থেকে। তখন পাশের বিছানায় চোখ বন্ধ করে পড়ে আছে রাজকুমারি। ভয়ে কাঁপছে থরথর করে। পাখিটা রাখা ছিল ঘরের এক কোণে। সেও দেখছে আর শুনছে সব।

সেই মাঝরাতেই সরাইখানা ছেড়ে বেরিয়ে যেতে হল মিশকোকে। আবার অজানার উদ্দেশ্যে তার যাত্রা। 
বড় আর মেজো—দু’ভাইয়ের তো আনন্দ ধরে না। সোনার লাগাম দেওয়া ঘোড়া, সোনালি পালকের পাখি আর আস্ত এক রাজকন্যা, যার মাথায় এক ঢাল সোনালি চুল কোমর ছাপিয়ে নীচে নেমেছে—সব হস্তগত করে, তারা নিজেদের রাজধানিতে ফিরে এল। 
        *             *            * 
এত কিছু পেয়ে রাজামশাই তো ভারি খুশি। সাদরে গ্রহণ করলেন দুই ছেলেকে। রাজকুমারিকেও রাখা হোল বেশ আদরযত্ন করে। আলাদা একটা মহল দেওয়া হোল সেই মেয়েকে। 
এবার বিবাদ শুরু হোল বড় আর মেজো দুই ভাইয়ের মধ্যে। দু’জনেরই মনে ধরেছে রাজকুমারিকে। দু’জনেই তাকে বিয়ে করতে চায়। এ বিবাদের নিষ্পত্তি হবে কী করে। মাথায় হাত দিয়ে বসলেন রাজামশাই। 
মীমাংসা করে দিল রাজকুমারিই। সে বেঁকে বসল—এদের কাউকেই সে বিয়ে করবে না। শুধু তাই নয়। দু’বছর না কাটলে, বিয়েই করবে না সে। রাজা আর কী করেন? সেটাই মেনে নিলেন। শান্ত হয়ে গেল সব। 
দিন যায়। রাজার মনে বেশ আনন্দ। নাসপাতি গাছের ফল আর চুরি হয় না। দুই পারঙ্গম পুত্র ফিরে পেয়েছেন। এমন একখানা ঘোড়া পেয়েছেন। আর, এমন আশ্চর্য এক পাখি। তাঁর আর কীসের দুঃখ! কেবল একটাই যা খামতি, ছোট ছেলে মিশকোই যা ঘরে ফেরেনি।
অবশ্য তা নিয়ে তেমন কিছু এসে যায়নি রাজামশাইর। এমন বোকাসোকা, অকর্মন্য একজন ঘরে না ফিরলে, রাজারই বা কী এসে গেল? রাজ্যেরই বা কী ক্ষতি তাতে? 
সব কিছু সুন্দরভাবে চলছে। সবাই খুশি। কেবল মন ভালো নাই রাজকুমারির। দিন দিন আবার শুকিয়ে শীর্ণ হচ্ছে তার শরীর। কেব্ল পথের দিকে চেয়ে বসে থাকে। আর দিন গোণে, কবে দু’বছর পার হবে। কবে মিশকো ঘরে ফিরে আসবে। 
        *             *            * 
দু’বছর বড় কম সময় নয়। দেখতে দেখতে তাও কবে কেটে গেল, মাথায় নেই কারও। দিন গোণা শেষ হোল রাজকুমারির। উৎসুক চোখে রাজপ্রাসাদের ফটকের দিকে চেয়ে বসে রইল সে।

দিন কয়েক বাদেই ফিরে এলো মিশকো। উলুঝুলু পোশাক। ধুলো-ময়লায় জটপাকানো একমাথা চুল। শরীর শুকনো। সারা গায়ে খড়ি ফোটা। চিনে ওঠা দায়। 
ফটক দিয়ে ঢুকতে গেল যেই, পাহারাদার তো এই মারে সেই মারে। কিছুতেই যেতে দেবে না ভেতরে।
রাজকুমারি দৌড়ে বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে। বাঁধ ভাঙা জলের স্রোতের মর তার দৌড়। জড়িয়ে ধরল মিশকোকে। ভিতরে নিয়ে এলো তাকে, যেন ধুলোখেলার শেষে, মা এসে তার সন্তানকে কোলে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। 
হইহই রইরই সারা প্রাসাদ জুড়ে। সবাই এসে জড়ো হচ্ছে ছোট রাজকুমারের সামনে। বড় আর মেজো রাজকুমার এসে পড়বার আগেই, সোজা রাজার কাছে মিশকোকে নিয়ে গিয়ে হাজির হোল রাজকুমারি। 
রজা তো অবাক। এমন অবস্থা হোল কী করে ছেলেটার। মিশকো বলল—জলজ্যান্ত অপরাধ। জোয়াচুরি, লোক ঠকানো। আমি কিছু বলব না আপনাকে। রাজকুমারিই বলুক সব কথা। কিংবা ঐ পাখিকেই জানতে চাওয়া হোক। 

মন্ত্রীমশাই বরাবর এই ছোট রাজকুমার, মানে মিশকোকে, মনে মনে ভারি পছন্দ করে। মন্ত্রী আগ বাড়িয়ে বলল—এক কাজ করা যাক, রাজামশাই। দরবার ডেকে দিন এখুনি। সবাই আসুক, সবাই শুনুক। সবাই মিলে বিচার করুক, ঠিক কী হয়েছিল।
দরবার বসল। ভরা দরবার। মন্ত্রী-শান্ত্রী, উজির-নাজির, লোক-লস্কর কেউ বাকি নাই সেদিন। সবাই এসে জড়ো হয়েছে। 

 রাজা বললেন—শোন গো, মেয়ে। তোমার বয়ানের উপর বিচার হবে। একটিও অসত্য কথা বোল না যেন। আগে, তোমার পরিচয় দাও। তার পর, যা জানো, সব বলো এই ভরা দরবারে। অকপটেই বলো। নির্ভয়ে।
রাজকুমারি নিজে দৈত্যের হাত থেকে উদ্ধার হতে পেরেছে মিশকোর জন্য। পরে মিশকোর সব কথা শুনেছে সে, মিশকোর মুখেই শুনেছে সেসব। এক এক করে গড়গড় করে বলে যেতে লাগল সব। বলল—পাহারা দিতে গিয়ে আপনার দুজন ছেলে তো পাখিটার কথা জানতেই পারেনি। জেনেছিল ছোট রাজকুমার। পাখির পালক আর নাসপাতি ভরে সোনার ঝুড়িও এনেছিল সাথে করে, প্রমাণ হিসাবে। আজ বড় দুজন সেই পাখি নিয়ে হাজির হোল কোথা থেকে? আমাকেই বা তারা পেলো কী করে? কোথায় পেলো তারা সোনার লাগাম দেওয়া ঘোড়াটাকে? বার বার মৃত্যুর মুখ পর্যন্ত গিয়ে, পাখি ধরে এনেছিল আপনার ছোট ছেলেই।
গোটা দরবার চুপ। একটিও  কথা নাই কারও মুখে। কিন্তু মন্ত্রী রাজার কানে কানে বলল—বেশ বোঝা যাচ্ছে, এ মেয়ে পছন্দ করে মিশকোকে। এ জন্যই সে বিয়ে করেনি আজ দু'বছর। ও ছোট রাজকুমারের দিকে টেনে কথা বলতেও পারে।

 রাজা গম্ভীর। উপর নীচ মাথা নেড়ে, বলল—হুঁ, সেটা সম্ভব। কিন্তু অন্য উপায় কী আছে?
মন্ত্রী বলল—কেন, উপায় তো হাতের সামনে। পাখি, সোনার পাখি তো আছে এখানে। সে নিশ্চয় মিশকোর হয়ে কিছু বলতে যাবে না। মিশকো তার লেজ ছিঁড়ে দিয়েছিল। ফলের ঝুড়ি কেড়ে এনেছিল। সব শেষে, বন্দী করে নিয়ে চলে এসেছে তাকে। সে কেন টেনে কথা বলবে?
রাজা বললেন—তুমি থামো এবার, মেয়ে। পাখি কী বলে, সেটা শুনতে চাই। 
পাখি যেন মুখিয়েই ছিল। সে বলল—রাজামশাই, আপনার দুই বড়  রাজকুমার অতি ধুরন্ধর। নরাধম একেবারে। নিজের ভাইয়ের বুকে তলোয়ার বসাতে গিয়েছিল। এই রাজকুমারি বন্দী ছিল এক দৈত্যের গুহায়। সে গুহার হদিশ জানে ওরা? দেখেছে কোন দিন? আর জানবেই বা কী করে? ওরা তো পেট চালাবার জন্য, চাকর হয়ে ছিল একটা সরাইখানায়। সব কাজ সেরে, ছোট রাজকুমার ফিরে এলো যখন, মেরে ফেলবার ভয় দেখিয়ে সব হস্তগত করেছে। ভাগ্যি ভালো, মেরে না ফেলে, দু’বছরের নির্বাসন দিয়েছিল রাজকুমারকে। নইলে সবই গোপনে থেকে যেত। এই রাজকুমারি যা বলেছে, সব সত্যি। একটি বর্ণও মিথ্যে নয়। 
তার পর? তার পর আর কী হবে? যা হবার তাই হোল। নিজের ছেলে বলে, রাজামশাই প্রাণে মেরে ফেললেন না বড় দুটিকে। দুটো গাধা এনে, তার উপর উলটো মুখ করে বসিয়ে, গোটা রাজধানিতে ঘোরানো হোল বড় আর মেজো রাজকুমারকে। তার পর? সে রাজ্যের সীমানায় ছিল একটা নদী। … নাম সেটার। নদী পার করে, তাড়িয়ে দেওয়া হল দুজনকে। 
আর যা যা হয়েছিল, সে অতি এলাহি ব্যাপার। কতটুকু আর বলা যাবে? মিশকোর সাথে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল রাজকুমারির। রাজামশাই সিংহাসন ছেড়ে দিয়েছিল। মিশকো হয়েছিল দেশের রাজা। ম্যারাপ বাঁধা হয়েছিল রাজপ্রাসাদের সামনের বিশাল মাঠে। রাজ্যশুদ্ধ লোক সাত দিন ধরে ভোজ খেয়েছিল সেখানে। এলাহি খানাপিনা। 

 পাখিটাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পাখি বলল—কী হবে গিয়ে? এখানে মিশকোর মতো একজন ভালো মানুষ রাজা আছে। আর আছে একটা ফলন্ত নাসপাতি গাছ। এখানে থেকে যাওয়াই ভালো। 
পাখি আর ঘোড়া। ঘোড়া আর রাজকুমারী। রাজকুমারী আর পাখি। তিনজনকেই পেয়েছে মিশকো। পাবে না কেন? সে নিজেই যে সোনার টুকরো ছেলে। 
কিন্তু আর একটা জিনিষ পেয়েছিল মিশকো। সেটার কথা কেউ বলেনি। না রাজকুমারি, না পাখি, না মিশকো নিজে। কিন্তু আমরা জানি। সেটা হোল—নেকড়ের নেক নজর। নেকড়েটার ভালোবাসা না পেলে, আজ কোথায় থাকতো মিশকো আর কোথায় থাকতো তার রাজা হওয়া। এত সবের মধ্যে, নেকড়ের কথাটা ভুলে মেরে দেওয়া অতি ভুল কাজ। সেজন্যই, গল্পের নামেই আমরা আটকে দিয়েছি নেকড়েকে। ভুল হয়েছে?

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments