জ্বলদর্চি

মাটিমাখা মহাপ্রাণ। উনিশ /শুভঙ্কর দাস

মাটিমাখা মহাপ্রাণ। উনিশ
শুভঙ্কর দাস

"ঐ যে চাকা ঘুরছে ঝনঝনি,
বুকের মাঝে শুনছ কি সেই ধ্বনি।
রক্তে তোমার দুলছে না কি প্রাণ
গাইছে না মন মরণজয়ী গান?
আকাঙ্ক্ষা তোর বন্যাবেগের মতো
ছুটছে না কি বিপুল ভবিষ্যতে। "


একটি গাছ,বটগাছ।তার চারিপাশের সিমেন্টের বেদী।ভাঙাচোরা।তাই এদিকে কেউ তেমন বসতে আসে না! বেদীর ওপর বসলে চোখে পড়ে প্রবহমান গঙ্গা।যে নদীর কথা ভারতবর্ষের পুরানে-ইতিহাসে-বিশ্বাসে এমনভাবে জড়িয়ে আছে,যার থেকে ভারতবাসীকে আলাদা করা অসম্ভব। এ যেন সমগ্র ভারতবর্ষের সুবিস্তীর্ণ আয়না।ভারতবাসী অন্তরের পুণ্যপ্রীতিতে সেই সুপ্রাচীন নদী গঙ্গা-আয়নায় নিজের মুখ দেখে,নিজের অন্তরাত্মাকে দেখে।
এই চলে আসছে চিরকাল,সেই রামায়ণ-মহাভারতের কাল থেকে... 
কলকাতায় এসে কুমারচন্দ্র প্রতিদিন গঙ্গায় স্নান করেছেন।তিনি বাসার সকল রকম স্নান করার সুবিধা গ্রহণ করেননি,তাঁর নদীতে স্নান করা একপ্রকার পূজা ছিল।সূর্য প্রণাম তো আছেই,তারপর গঙ্গায় স্নান করার মাধ্যমে তাঁর যেন প্রতিদিন নবজন্ম লাভ হত।
সেই গঙ্গার তীরে বটগাছের নিচে একা বসে আছেন কুমারচন্দ্র। তিনি গঙ্গার প্রতিটি স্রোতের দিকে চেয়ে আছেন,তাঁর মনেও অসংখ্য চিন্তার স্রোত বয়ে যাচ্ছে। 
কিছুটা দূরে বাবুঘাট।
কত লোকজন গাঁ-গঞ্জ থেকে নৌকায় এসে মহানগরীর বুকে পা রাখছে,কত মালপত্র ওঠা-নামা চলছে,মাঝি-মাল্লার হাঁকডাকে একেবারে সরগরম।
এসবই কিছুই কুমারচন্দ্রকে স্পর্শ করছে না! তিনি একটা পথ খুঁজে চলেছেন নানারকম চিন্তা ও নানারকম ঘটনার দৃশ্যপটে।গঙ্গার স্রোতের মতো তাঁর চোখের সামনে এসে পড়ছে...
কলকাতার ওয়েলিংটন স্কোয়ারে চলছে কংগ্রেসের সমাবেশ।শ্রীমতী অ্যানি বেসান্ত এই অধিবেশনের সভানেত্রী।অগণিত মানুষজন, কংগ্রেসকর্মী সেখানে উপস্থিত। কুমারচন্দ্র সেই সভায় মনের তীব্র আগ্রহে উপস্থিত গান্ধিজির কথা শুনবে বলে।
সভামঞ্চে স্থানীয় কোনো অঞ্চলের জমিদার,একজন মহারাজা,একজন প্রাদেশিক নেতা এবং বেশ কয়েকজন বিলেতফেরত ডাক্তার,ব্যারিষ্টার উপস্থিত। প্রত্যেকের চমকদার ও ধোপদুরস্ত পোশাকের পাশে গান্ধিজি একেবারে যেন বেমানান। তিনি সেই সাধারণ খদ্দেরের পোশাক,তাও আবার গরমের জন্য মাঝেমধ্যে তাই খুলে নিজেই বাতাস করছেন।
কুমারচন্দ্র একেবারে সামনে চটে বসে আছেন, চেয়ারের ব্যবস্থা ছিল,তিনি তাতে বসতে আগ্রহী নন।
বক্তব্যের শুরুতে গান্ধিজি নিজের ফতুয়াটি পরে ধীর পায়ে মাইক্রোফোনের দিকে এগিয়ে গেলেন।
যা বললেন,তা কুমারচন্দ্রের মনে গেঁথে গেল,গান্ধিজি বক্তব্য দিলেন হিন্দিতে,যেখানে অন্যান্য প্রতিনিধিরা ইংরেজিতে আগুনের ফুলঝুড়ি ছোটাচ্ছিলেন।সেখানে গান্ধিজির সহজসরল কথা মনের ভেতর ছুঁয়ে যাচ্ছিল। কুমারচন্দ্র কলেজ স্ট্রিট থেকে হিন্দিভাষা শেখার বই কিনেছেন এবং নিজের চেষ্টায় হিন্দি শিখছেন।
তাই তাঁর পক্ষে হিন্দি বোঝা কঠিন নয়।
গান্ধিজি স্বাধীনতার কথা,ইংরেজদের অত্যাচারের কথা, এমনকি বঙ্গভঙ্গ নিয়ে একটি কথা বললেন না,তিনি বোঝালেন,
"দেশের পরিবর্তন আমরা সকলেই চাই,কিন্তু আমাদের বুঝতে হবে নিজেদের পরিবর্তন কীভাবে করা যায়?নিজেদের আচরণে,নিজেদের জীবনযাপনে বিলাসিতার পরাকাষ্ঠা করে শুধু সভামঞ্চে দারিদ্র্যের কথা, দেশবাসীর দুঃখের কথা উচ্চকণ্ঠে বলার জন্য আমি আসিনি,আমাকে ক্ষমা করবেন।আমি এই মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলছি,এটাই আমার সবচেয়ে বড় অপমান,সবচেয়ে বড় পরাধীনতা,যেদিন ঐ ধুলোর মধ্যে, কাদার মধ্যে দাঁড়িয়ে আমার দেশকে চিনব,বুঝব এবং দেশের পাশে থাকব,সেদিন স্বাধীনতার কথা হবে।নিজেরা যদি আচরণে ও কথায় সত্যকে তুলে ধরতে পারি,তাহলে ইংরেজের বিরুদ্ধে আমাদের বক্তব্য দিয়ে দেশবাসীকে জাগাতে হবে না,তারাই নিজেরাই এমন জেগে উঠবে,এই সরকার মাথা হেঁট করে আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে,আমরা কি সেই জাগরণের কষ্ট নিতে রাজি কি? বলুন আপনারা?"

কুমারচন্দ্র অবাক হয়ে গেল।আগে দেশকে জাগাতে হবে,দেশবাসীর পাশে দাঁড়াতে হবে,তবেই দেশ যত কঠোর শাসক বা শাসন হোক মুক্ত হবেই,এমনভাবে এই কথা কখনো শোনেননি!

আবার একটি স্রোত... 

একদিন কলেজ স্ট্রিটে দেখা হয়ে যায় কুমারচন্দ্রের বন্ধু সূর্যকান্ত চক্রবর্তীর সঙ্গে।  সূর্যও কুমারের মতো গাঁ থেকে মহানগরে পড়তে এসেছে। সূর্য অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল,কী রে তুই রৌদ্রে কলেজপাড়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছিস কেন?

বই খুঁজছি উত্তর দিল কুমারচন্দ্র।

কী বই?

ডাক্তারি পড়ার বই

মানে?

আমি ডাক্তারি পড়ব,তাই তার আগে কিছু বই কিনে পড়ে নিতে চাইছি,পারব কি না! 

তারপর?

তারপর বিলেত যাবো,সেখান থেকে এফ আর সি এস পাশ করে ফিরে গাঁয়ে  ফিরে ডাক্তারি করব,তুই তো জানিস, আমাদের গাঁয়ে ডাক্তার বলে যিনি সর্ব রোগের সর্বজ্ঞ, আমরা জানি,তিনি আসলে কবিরাজি চিকিৎসা করেন,এবং সবই অনুমান এবং পড়াশোনা না করেই,তারপর যা আছে,সবই হাতুড়ে,একটাও পাশ করা ডাক্তার গাঁয়ে নেই! সেই অভাব ঘোচাতে হবে

সে তো না হয় হল, কিন্তু এটা কি জানিস,ডাক্তারি পড়তে বা ডাক্তাররি পড়ার বই কিনতে কত টাকা লাগে,আমাদের মতো হতদরিদ্র পরিবারের সন্তানের পক্ষে তার ভারবহন করা কতখানি কঠিন!আমি জেনেছি,তুই প্রাইভেটে ম্যাট্রিক পাশ করেছিস,প্রথম বিভাগে,এটা কম কথা নয়, সত্যি তো নিজে স্কুলে পড়িয়ে, টিউশানি করে, তারপর নিজে পড়ে পাশ করা খুবই কঠিন।কিন্তু ডাক্তার হওয়া আরও কঠিন।

হোক কঠিন,আমি চেষ্টা করব।দৃঢ় কণ্ঠে বললেন কুমারচন্দ্র।

তুই তো বালিগঞ্জে থাকিস,কলেজ স্ট্রিট এলি কীভাবে?

হেঁটে 

বেশ,তুই কী ভাবলি পায়ে হেঁটে গাড়িভাড়ার যে অর্থ বাঁচবে, তাতে ডাক্তারি পড়া সম্ভব!  নারে বন্ধু, তা  ঠিক নয়,ভালো করে খোঁজ নিয়ে জানি জেনেছিরে, আমারও তোর মতো ইচ্ছে ছিল,কিন্তু যখন জানলাম,এখানে ফিজস,থাকা-খাওয়া এবং পড়ার জন্য বইপত্র মিলে বিরাট খরচ, তা বহন করা দুঃসাধ্য! 

কুমারচন্দ্র স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।তারপর মুখে বললেন,আমি তোকে বিশ্বাস করছি,কিন্তু আমাদের মতো গরীবদের কি কোনো উপায় নেই! 

আছে তো,তুই একটা কাজ করে,সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে আই.এস.সি. তে ভর্তি হয়ে যা,ওখানে আমাদের মতো গরীবদের জন্য পড়াশোনা করার জন্য সুবিধা আছে।কিন্তু একটা কথা!

কী?

বালিগঞ্জ থেকে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের বেশ দূরত্ব, যেতে পারবি?

কুমারচন্দ্র এই প্রশ্নের উত্তরে শুধু মৃদু হাসলেন। 

কী রে হাসছিস কেন?

বালিগঞ্জ থেকে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের দূরত্ব মাত্র ছহাজার চারশো পা, আমি নিজে হেঁটে দেখেছি,ওটা আমার কাছে কোনো কষ্ট নয়, বুঝলি!

এবার সূর্যকান্ত অবাক হল।মুখে বলে উঠলেন,তুই একদম বদলাসনি কুমার,তোকে দেখলে আমার অদ্ভুত লাগে,একদিন দেখি,রিপন কলেজ থেকে বেরোচ্ছিস, আমি ভাবলাম,তুই তাহলে সুরেন ব্যানার্জির শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিস! 
এতো ভীড় ছিল,তোর কাছে পৌঁছাতে পারিনি, আমার ডাকও শুনতে পাসনি!

হা,কয়েকবার সুরেন ব্যানার্জির বক্তব্য শুনতে গেছিলাম,এমন জ্বালাময়ী কথা এরকমভাবে কেউ বলতে পারে ভাবতে পারিনি! কী বলছেন জানিস!
"The service of the motherland is the highest form of rligion, it is the truest service of God" 
মাতৃভূমির সেবাই তো পরম ধর্ম,সেই ধর্মের কথা আগে শুনিনি বন্ধু, সূর্য, আমার মতো কত যুবক এইসব কথায় প্রাণিত এবং দেশমাতৃকার সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়ার উদগ্রীব, ভাবতে পারবি না!

তোর মতো মানে!

আমিও তো এই দেশমাতার সেবক,তুইও 

না,আমরা গরীবের সন্তান, এইসব বড়লোকদের জন্য! 

দেশসেবার জন্য ধনী-গরিব কী রে?

তুই তো কংগ্রেস সম্মেলনে যাস,দেখিস কি,একটাও লোক আছে,যিনি উচ্চ ডিগ্রিহীন,যিনি ধনবান নন! একটা লোক দেখাতে পারবি,যিনি গাঁ-গঞ্জ থেকে উঠে এসে মঞ্চে বসে আছেন! কেউ নেই, আমরা কিছুই নই,শুধু মাত্র হাততালি দেওয়া পাবলিক ছাড়া,আমাদের এখন পড়াশোনা করা উচিত!  তাতেই আমাদের সংসারের অভাব মিটবে,আত্মীস্বজন,গাঁয়ের মুখ উজ্জ্বল হবে।বুঝলি,ওসব শুনে, আবেগে চলতে গেলে,একূল- দুকূল সবই যাবে।

পড়াশোনা করব,কিন্তু সেই পড়াশোনা করে যদি নিজের দেশকে নিজের লোকজনদের শাসকদের পায়ের তলায় পিষতে সর্বদা পিষতে দেখি,তাতে বিচলিত হবো না!

নিশ্চিত হবি,তাতে আগে নিজেকে দাঁড় করা,নিজে আগে স্বাবলম্বী হ,তারপর দেশকে স্বাবলম্বী হতে সাহায্যে করবি।ভুলে যাস না,তোর দাদাদের কত স্বপ্ন তোকে নিয়ে, তোর মা তোর সাফল্যের অপেক্ষায় বসে আছে,তুই এসব ভুলিস না কুমার কোনোদিন 

নারে, আমি আমৃত্যু এইসব ভুলতে পারি না,কী যে বলিস,আমি পড়াশোনা করবই,কিন্তু কিছুতেই সামনের পথ পাচ্ছি না!

পাবি,তুই আগে পড়াশোনা শেষ কর

তোর হাতে এটা কী সূর্য 

সূর্যের হাতে ছিল বেশকিছু পুরানো কাগজ।

এগুলো প্রবাসী পত্রিকা, আমার পড়তে ভালো লাগে,এতে অনেক খরব পাই

আমাকে পড়তে দিবি,ঠিক ফেরত দিয়ে দেব

আচ্ছা নে

এইভাবে দুই বন্ধু একে-অপরের বাসায় ফিরে যায়,কিন্তু প্রবাসী পত্রিকায় সেই সময় প্রকাশিত হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের 'গোরা' উপন্যাস। 
তাতে কুমারচন্দ্র একটা পেল এই কথা,যা গোরা বলছে,
" আপনি আমাকে আজ সেই দেবতার মন্ত্র দিন,যিনি হিন্দু মুসলমান খ্রিস্টান ব্রাহ্ম সকলেরই, যাঁর মন্দিরের দ্বার কোনো জাতির কাছে ব্যক্তির ব্যক্তির কাছে কোনোদিন অবরুদ্ধ হয় না,যিনি কেবল হিন্দুর দেবতা নন, যিনি ভারতবর্ষের দেবতা"

এই বোধ কুমারচন্দ্রকে আলোড়িত করে তুলল,সত্যি তো ভারতবর্ষের দেবতা কে? কাদের কথা বলছেন রবীন্দ্রনাথ?  আসলে সেই চিরপুরাতন চিরকালীন সভ্যতার ধারক ও বাহক,সাধারণ মানুষ।হ্যাঁ, তারাই কবির ভারতবর্ষের দেবতা।

সেই দেবতাকে যদি দিনরাত অপমানিত হতে হয়,তাহলে আমরা কীসের জন্য জীবন গঠন করব? কাদের জন্য এগিয়ে যাবো,গাছই যদি না বাঁচে,আমরা কীসের ছায়াতলে বসে ভবিষ্যৎ রচনা করব?

আবার একটা স্রোত চোখের সামনে এসে পড়ল...

সেই খুলনা জেলার কপোতাক্ষ নদীর তীরে এক বৈজ্ঞানিক জন্ম গ্রহণ করেন।সালটা ১৮৬১, অর্থাৎ সেই বছর জন্মগ্রহণ করেন রবীন্দ্রনাথ। বাল্যকাল থেকে এক মুক্তমনা মানুষ হয়ে উঠেছিলেন। তিনি মায়ের রান্নার ভাঁড়ার থেকে সাগু,বার্লি, মিছরি প্রভৃতি পথ্য নিয়ে এনে দরিদ্র মানুষদের দান করতেন।
তারপর পড়াশোনার তীব্র আগ্রহে কলকাতায় আসেন,হেয়ার স্কুলে ভর্তি হন।কিন্তু এমন মারাত্মক আমাশার আক্রমণ, পড়াশোনা সব স্থগিত হয়ে যায়।তিনি খুবই পেটরোগা ছিলেন।মাঝেমধ্যে অসুস্থ হওয়ার জন্য পড়াশোনায় ছেদ পড়ত।তা সত্বেও অদম্য জেদে তিনি পড়াশোনা চালিয়ে যান এবং লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে গিলক্রাইস্ট বৃত্তি লাভ করেন। 
১৮৮২ সালে এডিনবোরা বিশ্ববিদ্যালয়ে বি. এসসি. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং রসায়ন শাস্ত্রে গবেষণা করে ডি.এস. সি. উপাধি লাভ করেন।
দেশে ফিরে এসে ১৮৮৯ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজের রসায়ন বিভাগে অধ্যাপক পদে নিযুক্ত হন।অচিরেই অধ্যাপনার কাজে একাগ্রতা, নিষ্ঠা এবং কর্মদক্ষতার জন্য প্রধান অধ্যাপকের পদে নিযুক্ত হন।
তিনি আবিষ্কার করেন মারকিউরাস নাইট্টাইট। যা সারা বিশ্বের বিজ্ঞান মহলে সাড়া ফেলে দেয়।
এবং তাঁকে মাস্টার অফ নাইট্রাইটস নামে অভিহিত করা হয়। 
তিনি আচার্য,প্রফুল্লচন্দ্র রায়।
তাঁর নাম কলকাতার প্রতিটি লোক জানে। তিনি বাঙালি জাতিকে স্বনির্ভরতার শিক্ষা দিতে চেয়েছিলেন,বার বার ছাত্রদের বলতেন,"ওরে চাকরি করিসনি,কলম পিষে জীবন নষ্ট করিসনি, তোরা ব্যবসা কর। "
নিজেই তাই প্রতিষ্ঠা করলেন একের পর এক প্রতিষ্ঠান, 
এক।বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যাণ্ড ফার্মাসিউটিক্যালস
দুই।ক্যালকাটা পটারি ওয়ার্কস
তিন।বেঙ্গল এনামেল ওয়ার্কস 
চার।ন্যাশানাল ট্যানারি ওয়ার্কস 
পাঁচ। বেঙ্গল স্টিম নেভিগেশন 
ছয়।ইন্ডিয়ান কেমিক্যাল সোসাইটি 

এরকম অসংখ্য প্রতিষ্ঠান।সেই সঙ্গে গবেষণাপত্র লিখেছেন একশো আটটির মতো।ইংরেজি বই লিখেছন গোটা দশেক,বাংলায় গোটা সাতেক।
এসবই জেনে কুমারচন্দ্র নিজেকে প্রফুল্লচন্দ্রের মতো তৈরি করার চেষ্টা করতে চাইলেন।তিনি প্রফুল্লচন্দ্রের আরও জীবনের ঘটনা জেনে একেবারে অভিভূত। 
একবার বিপ্লবী যতীন দাসের শোকসভায় প্রফুল্লচন্দ্র গিয়েছিলেন খালি পায়ে,তিনি এতোখানি কষ্ট ও দুঃখ পেয়েছিলেন।কারণ যতীন দাসকে অতি অত্যচার করার প্রতিবাদে  জেলের ভেতর অনশন করে মৃত্যুবরণ করেন।তিনি বলতেন,"শুধু পরীক্ষা পাশের জন্য পড়াশোনা করলে হবে না,মনুষ্যত্বের পরীক্ষায় পাশ করতে হবে।"
নিজের হাতে চরকা কাটতেন।মাতৃভাষা নিয়ে তাঁর অনুরাগ অসীম,তিনি মাতৃভাষায় বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য একাধিক সম্মেলন করেন।অতি সাধারণ জীবনযাপন করতেন।পোশাক পরিচ্ছদ খুবই সামান্য। বিজ্ঞান কলেজের একটি ছোট্ট ঘর ছিল তাঁহার আহার,পড়াশোনা, বিশ্রাম ও শোয়ার জন্য নির্দিষ্ট করেছিলেন। সে ঘরে কোনো ভালো আসবাব পত্র ছিল না।নিজের পোশাকআশাক নিজেই কেচে ও রোদে শোকাতে দিতেন।
কুমারচন্দ্র অধীর আগ্রহে প্রফুল্লচন্দ্রের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে বারংবার বিজ্ঞান কলেজে গিয়েছেন।কারণ কুমারচন্দ্র শুনেছিলেন,বিজ্ঞানী প্রফুল্লচন্দ্র গরীব মেধাবী ছাত্রদের পড়াশোনার জন্য অর্থ ও বইপত্র দিয়ে সাহায্য করেন।
তাঁর বক্তব্য শোনার জন্য হাপিত্যেশ করে কলেজের মাঠের সম্মেলনে বহু সময় আগে বসে থাকতেন।
একদিন প্রফুল্লচন্দ্রের একটি কথা নাড়িয়ে দিল কুমারচন্দ্রকে, 
দেশের পরাধীনতা ও দেশের মানুষের অপমানিত মুখগুলির কথা উল্লেখ করে তিনি দৃঢ়কণ্ঠে বলে উঠলেন,
"বিজ্ঞান-গবেষণার কাজ বন্ধ থাকতে পারে,কিন্তু দেশের স্বাধীনতার কাজ বন্ধ থাকতে পারে না!

এই কথাটি কুমারচন্দ্রকে এমনভাবে ভাবিয়ে তুলল,তিনি জীবনের পথে কীভাবে চলবেন ভেবে পেলেন না!

কখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে কুমারচন্দ্র বুঝতে পারেননি! বাবুঘাটের ফেরি বন্ধ হয়ে গেছে।সহসা পিঠে একটা হাতের স্পর্শ পেলেন কুমারচন্দ্র।অল্প কেঁপে উঠলেন তিনি।
পিছন ঘুরে দেখলেন,একটি রোগাপাতলা লোক,মুখটা খুব চেনা চেনা লাগছে,কিন্তু নাম মনে করতে পারছেন না!

কী বন্ধু, ভুলে গেলে! একি আপনার অবস্থা, একরকম যোগীর মতো নদীর ধারে কার ধ্যান করছেন? 

কুমার চেনার চেষ্টা করছেন,কিন্তু পারছেন না।

বন্ধু, মুখ দেখেই বুঝেছি, চিনতে পারছেন না,তাহলে এই গানটি শুনুন,

" আমি দশ হাজার প্রাণ যদি পেতাম
তবে ফিরিঙ্গি বণিকের গৌরব-রবি
অতল জলে ডুবিয়ে দিতাম
শোন সব  ভাই স্বদেশী 
হিন্দু মোছলেম ভারতবাসী 
পারি কি না ধরতে অসি
জগতকে তা দেখাইতাম"

কুমার এবার চেঁচিয়ে বললেন,ওহ্ কানাই চক্রবর্তী, কলেজ স্ট্রিটে বইদোকান ছেড়ে এখানে কী হচ্ছে? আর এরকম আগুনে গান আবার বাঁধা হল কেন? 

আমি বাঁধিনি বন্ধু, যে রচেছেন এবং এই সময় বাংলা কাঁপাচ্ছেন,তাঁর নামও গানের মধ্যে আছে, শুনুন 

"কথা শুনে প্রাণ যদি মজে 
সেজে আয় বীর সাজে
দাস মুকুন্দ আছে সেজে
দাঁড়ি পেলে তরী ভাসাইতাম "

ওহ্ চারণকবির লেখা।আমি তো আগেও শুনেছি,একদিন একটি যাত্রা দেখতে গিয়ে,মনে ছিল না!

হ্যাঁ,বন্ধু, এ কি আর কী শুনলে,সেই চারণ কবির যাত্রা আসছে,এই খোদ কলকাতায়, দেখবেন,বলুন তো ব্যবস্থা করতে পারি

অবশ্যই চলুন,কিন্তু বললেন না,এখানে কেন এসেছেন? 

কারণ চারণ কবিকে দেখতে হলে এই নদী পেরিয়ে ওপারে যেতে হবে,মানে চারণের যাত্রা হাওড়ায় হবে,এবং সেটা কালকে 

আচ্ছা, আমি যাবো,অবশ্য যাবো।

অবশ্য কুমাররচন্দ্রের যাওয়া হয়নি,অন্য একটি ব্যক্তিগত কারণে....

ক্রমশ...

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments