জ্বলদর্চি

অশোক মহান্তীর কবিতা : জীবন ভাঙা পথে ঈশ্বরের গান-১০/দিলীপ মহান্তী

অশোক মহান্তীর কবিতা : জীবন ভাঙা পথে ঈশ্বরের গান

দিলীপ মহান্তী

পর্ব- ১০

অশোক মহান্তীর কবিতায় বার বার উঠে আসে অনন্ত  জীবন প্রবাহের কথা। এক অনন্ত মহাকালের কথা। যেকোনো বড় কবির কবিতায় এক বিশেষ দর্শন থাকে । যার আলোকে তিনি জগৎ ও জীবনকে বুঝে নিতে চান। ব্যক্ত করেন। এই দর্শন ভাবনা না থাকলে কবিতা শিল্পের বিচারে উত্তীর্ণ হয়না। কালজয়ীও হয় না।  মহাকালের কথা বলতে চান বলেই সময়ের ক্ষত তার সুদূরপ্রসারী অভিঘাত রেখে যায় চেতনায়। অমোঘ মৃত্যুর কথাও ফিরে ফিরে আসে। আরো আলো, আরো প্রেম ও আরো দিব্যচেতনার কাছে নিজেকে প্রস্ফুটিত করতে চান। প্রকৃতি ডাকে। কেউ দূরে চলে যায়। মানুষে মানুষে ব্যবধান আছে জেনেও প্রাচীন সভ্যতার জন্য আমাদের হৃদয় কেঁদে ওঠে। পরস্পর বৈপরীত্য নিয়েই ক্ষুধা ও ঐশ্বর্য ছিল, প্রেম ও হিংসা ছিল, মানুষ ও পশু পাশাপাশি বসবাস করত। সেকাল আর একালের তুলনা চলে আসে। এই জ্বলে ওঠা সময় কথা বলে। ভোগের কথা। 

‘বুঝেছি এ পৃথিবীতে আমার সন্তান তার এতকিছু প্রয়োজন ছিল।
বুঝেছি এ পৃথিবীর চারপাশে যে – অমোঘ রহস্যময়তা তার পেছনে
ধাবিত হওয়া ছাড়া তার কোনো মুক্তি নেই।‘ (আলোক শিশির)

       এই বিবৃতি আমাদের আরো একবার নিয়ে যায় উপনিষদের জগতে। নিয়ে যায় প্রশ্ন উপনিষদের প্রথম প্রশ্ন সেই জগৎ সৃষ্টির কারণে। সেখানে এরকম ব্যাখ্যা পাওয়া যায়ঃ ‘ আদিত্যকে যে প্রাণ বা ভোক্তা বলা হয়েছে তার কারণ আদিত্যই প্রাণের উৎস, সূর্য উদিত হলেই বিশ্বের সবকিছু প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে, আর সূর্য অস্ত গেলেই সমস্ত প্রাণী নিদ্রিত হয়। আদিত্য বা প্রাণই ভোক্তা, রয়ি বা জড়ই ভোগ্য। প্রাণবান বস্তুরই ভোগশক্তি আছে, জড়ের ভোগ-ক্ষমতা নাই। জড় সর্বদাই ভোগ্য। উভয়ই সর্বাত্মক বলেই প্রত্যেক সৃষ্ট পদার্থই একদিকে ভোক্তা , অপরদিকে ভোগ্য।‘ 

      এই উপনিষদে জীবের অর্থাৎ মানুষের পরিণতি বা মুক্তির কথাও বলা আছেঃ ‘ যাঁদের মধ্যে কুটিলতা, মিথ্যাতে অনুরাগ  এবং মিথ্যাচরণ, মায়া (অজ্ঞানজনিত মোহ ও আসক্তি) নেই তাঁরাই সেই বিমল ব্রহ্মলোক (দেবযানরূপ সূর্যলোক) অর্থাৎ তাঁরাই সেই বিশুদ্ধ ব্রহ্মলোকে পৌঁছান।‘ একেই অশোক মহান্তী বলতে চেয়েছেন আলোক শিশির। তিনিও আলোক শিশিরে যেতে চান।

       যে কোনো তত্ত্বজিজ্ঞাসুর মনে এই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে এই অনন্ত মহাকাশজুড়ে কোটি কোটি গ্রহ-নক্ষত্রের সমাবেশ এবং পৃথিবীর কোলজুড়ে যে অজস্র প্রাণের প্রবাহ চলছে, সেইসঙ্গে দিনরাত্রি ঋতু পরিবর্তন জন্ম-মৃত্যুর রহস্য নিয়ে মহাবিশ্ব সচল এর মধ্যে আসল কোনো উদ্দেশ্য আছে? অশোক মহান্তীর কবিতা ধারাবাহিকভাবে মনোযোগ সহকারে পড়লে আমরা গভীরভাবে এক প্রবল দর্শনভাবনায় নিমজ্জিত হই। যার উৎস উপনিষদ। সেখানে মহাবিশ্বের এই রহস্যর কথা আছে। সেই জগৎকে তিনি নিজের মতো করে অনুশীলন করেছেন । প্রকাশ করেছেন। তাঁর কবিতা ঠিক মতো বুঝতে হলে, তাঁর কবিতার সুবিচার করতে হলে উপনিষদকে বাদ দিয়ে কখনোই সম্ভব নয়।

       উপনিষদের কথাকে শ্রী অরবিন্দ তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ দি লাইফ ডিভাইন’-এ ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলতে চেয়েছেন:  মহাবিশ্বের মধ্যে একটি বিশেষ উদ্দেশ্য কাজ করে যাচ্ছে এবং তা সৃষ্টি প্রবাহকে তার দিকে অগ্রসর করে দিচ্ছে। এই মূল সত্তার স্বরূপকে কখনো তিনি বলেছেন সচ্চিদানন্দস্বরূপ আর কখনো বলেছেন মূল স্থাণু সত্তার বিকাশধর্মীরূপ। এটি স্থান কালে বিধৃত এবং গতিশীল সত্তা; যা একটি উদ্দেশ্যকে অবলম্বন করে বিকশিত হয়। জড় বিশ্বকে অবলম্বন করেই প্রাণের বিকাশ এবং মানব মনের বিকাশ। 

      উপনিষদের ঋষিদের বক্তব্য অনুযায়ী জানা যায়, সমগ্র সৃষ্টির মধ্যে একটি অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্যর কার্যকারিতা আছে। এই উদ্দেশ্য হল আনন্দ আস্বাদন।

     বেদান্ত দর্শন গড়ে উঠেছিল প্রাচীন উপনিষদগুলিকে নির্ভর করেই। সেখানে দুটি মত পাওয়া যায় – এক মতে, ঈশ্বরের আলাদা কোনো অস্তিত্ব নেই, তিনি বিশ্বের সঙ্গে একীভূত। অন্য মতে, ঈশ্বরের আলাদা অস্তিত্ব আছে এবং ভক্তির পথ ধরে তাঁর সঙ্গে  সম্বন্ধ স্থাপন করা যায়। প্রথম মতের প্রবর্তক শঙ্করাচার্য আর দ্বিতীয় মত গড়ে উঠেছে রামানুজ, বল্লভাচার্য ,নিম্বার্ক, বলদেব, মধ্বাচার্য প্রমুখের ভাষ্যে।

  অশোক মহান্তীর কবিতায় আধ্যাত্মিকতা অনেক সময়ই কবিতার ভাবে ও রূপে প্রকাশিত। আমরা দেখে আসছি ধারাবাহিকভাবে তিনি ঈশ্বরকে খুঁজেছেন এই মহাবিশ্বের সর্বত্রই। বলা যেতে পারে তাঁর ঈশ্বর সম্বন্ধীয় চেতনা কবিতার রূপ ধরে চিরস্থায়ীভাবে লেখা হয়ে আছে। সঙ্গে আছে জীবনের অতৃপ্তি ও বিষাদ।জন্ম ও মৃত্যুকে নিয়ে অনন্ত জিজ্ঞাসা। আছে জীবনের ক্ষোভ ওআগুনের,  জল ও আকাশের স্বরলিপি। সে সবও ঈশ্বরভাবনার আলোয় আলোকিত। কিন্তু আবার অনেক সময় ঈশ্বরকে নিয়ে দ্বিধায় আছেন। ঐতিহ্য ও আধুনিকতার দ্বন্দ্বে যুক্তিশীল মন যাচাই করে নিতে চেয়েছে পৃথিবীর অন্তর্নিহিত অদৃশ্য শক্তিকে। তাঁকে স্বীকারও করতে পারেন নি, আবার অস্বীকারও করতে পারেন নি। জড়ের মধ্যে খুঁজেছেন ঈশ্বরকেঃ

১. ‘ঈশ্বর আছেন, তাঁকে পাওয়া যায়’ এরকম বিশ্বাসের বল
    এ-যুগে কারোরই নেই।
    অথচ কত না ঠান্ডা, ক্ষণস্থায়ী, অদ্ভুত বিশ্বাস এসে জড়িয়েছে
     লতার মতন, আমাদের মনের সমস্ত কালো- গুহামুখগুলি।

    কীভাবে যে বলি: কিছু নেই,- কিছু আছে , কিছু-থাকা স্বাভাবিক,
    থাকার দরকার ছিল।
    
   ‘সে নেই’ এমন বললে, যে রকম মিথ্যা বলা হয়,- ‘সে আছে’ এ বাক্যটিও
    তেমনি মিথ্যুক-সত্যে বেড়ে ওঠে ঘাসের মতন – পরিকীর্ণ করে আছে
    মানুষের মেধা-শক্তি-আলো, বিপন্ন করেছে মুক্ত-শ্রমের পাথর।

   পাথরও মানুষ হয়ে পড়ে থাকে পথে, মানুষ পাথর হয়ে ঢেকে থাকে
   লতাগুল্মময়, প্রকৃতির মাঝখানে।

   তবু, পাথরের কোনো মন নেই…
   তবু, মানুষের কোনো মন নেই…
   তবু, প্রকৃতির কোনো মন নেই… এরকম অবাধ্য সংশয়
   হয়তো তোমাকে আরও অন্ধকারে নিয়ে যেতে-যেতে
    বলতে পারে- ‘এখানে তাকাও।‘

    যেখানে তাকাবে , সেই মাটিতেই, সৃষ্টির নির্যাস হয়ে জেগে আছে
    জল।
    যেখানে তাকাবে, সেই মাটিতেই, দৃষ্টির আগুন হয়ে জেগে আছে
    আলো।

    আলো আর জলের জীবন।
    হয়তো রামকৃষ্ণ যাকে অনায়াসে বলতে পারতেন – 
    ‘জড়-নারায়ণ’।
       ( জড়েশ্বর : ঘাস রঙয়ের আকাশ )

২.‘চলো, বর্ষার ভেতর দিয়ে যাই।
    অন্ধমাঠ পার হলে অণিমার বাড়ি ভাঙা মন্দিরের ঠিক কিছুটা পেছনে।

      মাঠ পার হতে যদি পড়ে যাই, যদি আরও জোরে বৃষ্টি হয়
      আমরা দাঁড়াব সেই তেঁতুলগাছের নীচে, সেখানেই অণিমার বাবা
     শেষবার শুয়েছেন। তারপর বৃষ্টি, গান, কান্না ও চিৎকার
      এসব কিছুই তাঁর জানা নেই।

      তিনি, সকালের আলো ঠেলে, বিকেলের আলো ঠেলে
      সূর্যাস্তের আগে আগে সেই যে গেছেন, তারপর
      অণিমাও ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠেছিল।

     সেসব কান্নার শব্দ বস্তুবিশ্ব মনেও রাখেনি।
     তাঁর সেই পরামুখ, তার ছবি আছে কি কোথাও ?

    জগতের সমস্ত উজ্জ্বল-স্বপ্ন ফেলে রেখে কোথায় গেলেন তিনি?
    পদার্থবিদ্যার ছাত্রী অণিমাও এই প্রশ্ন বহুবার নিজেকে করেছে।

    আজ  বর্ষার ভেতর যদি একটি কুসুম ফোটে দেখতে পাই
     আমি তবে ইস্কুলে যাব না।
    আমি তবে গাছের গভীরে গিয়ে গাছ হব
     মৃত্যুর ভেতরে মৃত্যু, জীবনের ভেতরে জীবন

    আমি শূন্যতার মধ্যে খুঁজে পেতে চাই সেই মাটি
    যে মাটি ধ্বংসের পরও অনন্ত উজ্জ্বল হয়ে বাঁচে।
    অনন্ত উজ্জ্বল মাটি পুড়েও যা পোড়েনি কখনও।‘
          (মাটিঃ অতিবর্তী জাগো)

৩ ‘একদিন , সমস্ত আগুন নিভে জল হয়ে যাবে
    একদিন, জলের গভীর থেকে উঠে আসবে হলকা আগুনের

    তারপর।
    বোধের বিরুদ্ধে সেইসব পার হয়ে যেখানে পৌঁছাবে তার
     মনুষ্যত্ব, ঘৃণা, সেইসব পার হয়ে যেখানে পৌঁছাবে তার
     সামনে বা পিছনে কোনো রাস্তা খোলা নেই।
     তোমার অতল প্রেম মিশে যাবে শূন্যে, অন্ধকারে
     তোমার অদম্য ইচ্ছা পরাভূত হতে হতে কঠিন পাহাড় হবে, আর
     এইসব মধ্যবিত্ত আলাপচারিতা থেকে জন্ম নেমে তুষ্টির জগৎ
     যাতে অপরিমাণের কোনো বর্ণগন্ধ নেই।

    দূরে স্তূপীকৃত মেঘ। বৃষ্টিহীন। পাণ্ডুর গর্জন।
    পাশে দিনলিপি। হিসেবনিকেশ।
    এক নিঃসঙ্গ অভ্যাস এসে ঘিরে ধরবে বাকি পরমায়ু।‘
         ( মধ্যবিত্ত বিষাদঃ অতিবর্তী জাগো )

 একটি মৃত্যুকে কেন্দ্র করে বিশ্বাস ফিরে পাওয়ার কাহিনী। যিনি সকালের আলো ঠেলে, বিকেলের আলো ঠেলে সূর্যাস্তের আগে চলে গিয়েছেন আর ফিরে আসেননি। শুধু কান্না দিয়ে গেছেন। সে কান্নার শব্দ এই বস্তু বিশ্ব মনে রাখেনি। কখনো মনে রাখে না। জগতের সমস্ত উজ্জ্বল স্বপ্ন ফেলে রেখে তিনি কোথায় চলে গেছেন এই প্রশ্ন সকলের। কিন্তু বর্ষার পৃথিবী তার সৃষ্টির মধ্যে অন্য ইঙ্গিত দিচ্ছে। সেই সৃষ্টি নতুন সৃষ্টির প্রেরণা হচ্ছে। জীবনের ভেতর জীবন গেঁথে দিচ্ছে। মৃত্যুর ভেতর মৃত্যু। সমস্ত শূন্যতার ভেতর জেগে উঠছে মাটি। মাটির মধ্যে বাঁচার আশ্বাস ও বিশ্বাস।

১ ‘কে তুমি যে আমাকে পোড়াবে? মৃত্যুর অতীত-পর্বে
    আমি নিজে ধ্বংস হয়ে যাব।

   সংক্রান্ত, তোমার বোধে কেউ আছে, যারা মানুষের মতো গান গায়
   কবিতা রচনা করে, সুখ-দুঃখ বোঝে, কখনও নিজের মুখে
   ছড়ায় কুয়াশা?

   জীবত্ব বোঝো না, তাই চিরকাল কলুর বলদ হয়ে আছো।

   আমি আরও পঁচিশ বসন্ত থাকব এখানেই।
   এই বাংলায়। এই ঝাড়গ্রামে। ঘোড়াধরা স্কুলমাঠে
   নিজের বাড়িতে, আমার শিশুর সঙ্গে, আমার যে বিবাহিতা-বউ
   তার সাথে।

   সংক্রান্ত, তোমার সঙ্গে আমার বিরোধ কিছু নেই। তবু...

   আমার কবিতা থেকে যে শ্রান্তি মিশেছে এই পৃথিবীর ঘাসে
   আমি তাতে লেগে আছি।
   যে-বোধে উদ্গত হয় চারাগাছ, আমি তাতে ক্লান্তি ঢেলে
   কবিতার ফুল ফুটিয়েছি।
  এ ফুল ছেঁড়ার দায় আমারতো নেই। আমারই নির্জন ব্যক্তিগত অনুরোধ
  আমারই নিজের ক্ষয়ে যাওয়া।
  তুমি কে, যে আমাকে লুকোবে?

  ছায়ায় অদৃশ্য হাত, ফিরে যাও, আজ কোনো কথা নেই আর।‘
    ( মৃত্যু-সংলাপঃ অতবর্তী জাগো )
বিশ্বের মূল সত্তা উপনিষদে ব্রহ্ম বা অক্ষর বা আত্মা বা ভূমা হিসেবে বর্ণিত হয়েছেন। তৈত্তিরীয় উপনিষদে আচার্য শিষ্যকে উপদেশ দিচ্ছেন বংশধারা অব্যাহত রাখতে। ব্রহ্মচর্যাশ্রম থেকে সংসার আশ্রমে প্রবেশ করার পরামর্শ দিচ্ছেন। সেখানে বিবাহ করে বংশধারাকে সচল রাখতে হবে। এখানেও সৃষ্টি। এখানেও শিল্প।

  অদ্বৈত অবস্থায় ব্রহ্ম একান্তই নিঃসঙ্গ। এই নিঃসঙ্গ অবস্থাই যেন সৃষ্টির প্রেরণা। অমূর্ত, অসঙ্গ, নিশ্চল, স্থাণুরূপ পছন্দ নয় বলেই ব্রহ্ম বিশ্ব সৃষ্টি করে তাতে রূপান্তরিত হলেন। এই কথাটি ঐতরেয় উপনিষদ,  ছান্দোগ্য উপনিষদ, বৃহদারণ্যক উপনিষদ, তৈত্তিরীয় উপনিষদ প্রভৃতি বিভিন্ন উপনিষদে বিভিন্ন ভাবে বলা হয়েছে। উপনিষদের ধারণায় রসের বা আনন্দের আকর্ষণেই এই নিরবচ্ছিন্ন সৃষ্টিধারা প্রবহমান। তাতে যেমন জন্ম আছে তেমনি মৃত্যু আছে আর এসব নিয়ে রসানুভূতি আছে। সেই কারণে অখন্ড দৃষ্টিতে বিশ্বরূপে প্রকট রূপ বা ব্রহ্মের মূর্তরূপ তার রসরূপ বা আনন্দরূপ।

  বৃহদারণ্যকে আছে এই রসের উপলব্ধির জন্য ‘আদিতে একক সত্তা অবস্থায় ব্রহ্ম তাঁর একাকিত্ব উপভোগ করলেন না। তিনি বহু ও বিচিত্র রূপে প্রকট হলেন। একাকী থেকে আনন্দ পেলেন না বলে দ্বিতীয়কে চাইলেন।' বৃহদারণ্যকে এও আছে যে: এজন্যই বিশ্বে দ্বৈত সঙ্গীতের ধারা ছড়িয়ে পড়ল। তখন মানুষের মনের সামনে পৃথিবীর সুন্দর রূপটি ফুটে উঠল।  এই পৃথিবী সকল প্রাণীর কাছে মধুস্বরূপ এবং এই পৃথিবী র কাছে সকল প্রাণী মধুস্বরূপ।

  তৈত্তিরীয় উপনিষদে আছে  ‘তিনি রসস্বরূপ। তিনি রসলাভ করে আনন্দিত হন। এই আনন্দ হল শিল্পরসিকের আনন্দ। আকাশ আনন্দের আধার বলেই সবাই প্রাণধারণ বা জীবনধারণ করে। প্রকট বিশ্বের ভেতর দিয়েই তিনি আনন্দ আস্বাদন করেন।‘ ওই একই উপনিষদে একই কথা একটু অন্য ভাবে আছে ‘ব্রহ্মই আনন্দ। আনন্দ থেকেই এই জীবসকল জন্মগ্রহণ করে। জন্মগ্রহণ করে আনন্দের জন্যই জীবনধারণ করে। মৃত্যুর পর আনন্দেই প্রতিগমন করে এবং আনন্দে প্রবেশ করে।‘

  অশোক মহান্তীর কবিতায় সৃষ্টির যন্ত্রণা ভাষা পেয়েছে আনন্দের ঝর্ণাধারায়। ঈশ্বরের সৃষ্টি বিশ্ব যেভাবে ঈশ্বরের আনন্দের প্রকাশ । যেভাবে আকাশ ও আকাশের আধার অক্ষর। যেভাবে একই ব্রহ্ম বিভিন্ন রূপ ধারণ করে বিভিন্ন বস্তুর মধ্যে যোগসূত্র হিসাবে প্রচ্ছন্নভাবে বর্তমান। যেভাবে একই শক্তি বিশ্বে বহুরূপে প্রকাশিত অনেকটা সেইভাবেই মহাবিশ্ব আকাশ আলোক পুরুষ প্রকৃতি জন্ম মৃত্যু আর প্রবহমান জীবন নদীর স্রোত ছুটে চলেছে কবিতার অক্ষরে :


               ৪.
২ ‘কবিতাই শেষকথা। এ-সৃষ্টি ও জড়ের কবিতা ছাড়া কিছু নয়।
    দ্যাখো উর্ধ্বমুখ পাহাড়ের চূড়াটি কী গভীর সুন্দর
    অনন্ত মৌনের মতো বসে আছে। গায়ে কোটি- বসন্তের
    গাছ ও পাথর। লক্ষ লক্ষ পাললিক ঢেউ। এখানে
    সমুদ্র ছিল কোনো একদিন। কোনো একদিন সেই সমুদ্রের জলে 
    তিমি ও হাঙর ছিল। আজ ফসিলের স্তূপ বুকে নিয়ে 
    ওই উচ্চ নীরব পাহাড় অনন্ত পাথর হয়ে বসে আছে।
   তুমি আদিম সৃষ্টির ঢেউ, কাকে খোঁজো এই সন্ধেবেলা?
                        ৫.
   দেখলাম সমুদ্রসদৃশ ওই বুকে হাত রেখে চলে গেছে চাঁদ
    চাঁদের নরম আলো। তুমি একদিন , বসন্তের ডালে ডালে
    ফুটিয়েছ ফুলের কোরক, হেমন্তে ধানের শিষে মধু, তারপর
     শীতার্ত পৌষের মাসে লেপকাঁথা মুড়ি দেওয়া ম্লান বাংলার
    অজস্র মায়ের মতো পরিশুদ্ধ হাতে ছড়িয়ে দিয়েছ যত ফুল…
    স্তবকে স্তবকে সেই ফুল ঝরে হয়েছে আলোক, আলোকের মহাজ্ঞান।
                         ১২.
   স্মৃতিও কি ধুয়ে দেবে জল? স্মৃতি ম্লান, স্মৃতি পুরাতন
   স্মৃতি অভঙ্গ ভঙ্গু্‌র, স্মৃতি অত্যন্ত গর্হিত, স্মৃতি দীপ্র অনির্বাণ
     সকলই কি ধুয়ে যাবে জলে?
   জল যদি মৃত্যূ হয়, মৃত্যুর পরেও আমি জলের কল্লোল
   জল যদি জন্ম হয়, জন্মের পরই আমি তার বুকে নৌকা ভাসিয়েছি
    জল যদি রুদ্ধ হয়, আমি তার অনিবার্য কূপ
    জল যদি স্রোত হয়, আমি তার আবর্ত নিবিড়
    কিন্তু যদি জল হয় প্রেম?
    আমি মহাকাশ জুড়ে বিন্দু বিন্দু হিম হয়ে যাব।
         (রঞ্জনার একরাত্রিঃ আলোক শিশির)

                  ( ক্রমশ )

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments