জ্বলদর্চি

ভেঙে যাচ্ছে যৌথ পরিবার/সূর্যকান্ত মাহাতো

জঙ্গলমহলের জীবন ও প্রকৃতি
পর্ব - ২০
ভেঙে যাচ্ছে যৌথ পরিবার

সূর্যকান্ত মাহাতো

রতন কাকা। গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত পোস্ট মাস্টার। খুবই সাহিত্য প্রেমী  একজন মানুষ। বিকেলে হাঁটতে বেরিয়েছেন। গ্রীষ্মের বিকেলটা খুব সুন্দর হয়। বেশ মিষ্টি একটা বাতাস বইছে। গাছের পাতাগুলো সেই বাতাসে নেচে নেচে উঠছে। সেইসঙ্গে আমার মনটাও। গায়ে মাখছি সেই ফুরফুরে ঠান্ডা বাতাস। হাঁটতে হাঁটতেই কথা বলছিলাম। একথা সেকথার পর জিজ্ঞেস করলাম, কাকা, কী এমন হল যে ছেলে দুটো আলাদা হয়ে গেল? খুব ঝগড়াঝাঁটিও হল শুনলাম। কাকা খুব বিষন্ন হয়ে পড়লেন। বললেন, "ওসব কথা এখন থাক। তার চেয়ে আজকাল জঙ্গলমহল নিয়ে কী সব লিখছিস যেন! সে কথা আগে বল।" 

সংক্ষেপে বললাম সে কথা। কাকার মনটা অন্যদিকে ঘোরাতে তার অভিজ্ঞতা শোনার লোভ চেপে গেল। বললাম, "আজকের দিনে দাঁড়িয়ে তুমি জঙ্গলমহলের কী কী পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছো। একটা সাহিত্য পাঠের আসর বসালে কেমন হয়?"


রতনকাকা অবাক হয়ে বললেন,"সাহিত্য পাঠের আসর? তাও আবার জঙ্গলমহলে! কি যে বলিস না! হাসালি দেখছি! সে স্বর্ণযুগ কি আর আছে! মানুষের এখন সাহিত্য পড়ার সময় কোথায়! হ্যাঁ। তবে আগে হত। প্রায় গ্রামেই বসত সাহিত্য পাঠের আসর। রামায়ণ, মহাভারত, চন্ডীদাসের কৃষ্ণকীর্তন, মঙ্গলকাব্য  সুর করে করে পড়া হত। বিদ্যুতের আলো ছিল না। লন্ঠন কিংবা হ্যারিকেনের নিয়ন আলোয় পড়া হত। হলুদ আলো। বয়স্করা সব গোল হয়ে বসতেন। ছোটরাও মাঝে মাঝে বসত। তবে পড়ার সময় কোনও কিছুই ওরা বুঝত না। যেটুকু বুঝত ওই আলোচনা কালে। পড়তে পড়তে সকলের মনেই জেগে উঠত বিস্ময়। কতসব প্রশ্ন। হত তর্ক বিতর্ক। ওসবের আর এখন চল নেই। শহরগুলোতেই এখন সাহিত্য পাঠের আসর বসে।  গল্প ও কবিতা পাঠ হয় সেখানে।"

আমরা নাকি বন-মানুষ থেকে মানুষ হয়েছি। একটু একটু করে। গুটি গুটি পায়ে। সভ্যতা ও বিবর্তনের মধ্য দিয়ে। সেই আমরাই এখন ধীরে ধীরে মানুষ থেকে যন্ত্র হয়ে উঠছি। যন্ত্রই তো! আমাদের স্বাভাবিক আবেগগুলোকে এখন জোর করে চেপে রাখি। একটা খোপের মধ্যে যেন ঠেলে ঢুকিয়ে দিয়েছি। ছোট ছোট খুশি আর মুহূর্তগুলোকে উপভোগ করতে ভুলে যাচ্ছি। কেবলই ছুটে চলেছি আর ছুটে চলেছি। পরোপকার, নিঃস্বার্থ ব্যবহার, সহানুভূতি, ভ্রাতৃপ্রেম, প্রাণ খোলা হাসি এসব তো কবে কবেই ভুলে যাচ্ছি। 


একান্নবর্তী পরিবারগুলো ক্রমশ ভেঙে যাচ্ছে। একেবারেই ছোট হয়ে পড়ছে। ছোট পরিবার সুখী পরিবার। এটাই এখন মূলমন্ত্র। তারপরেও কি আমরা সুখী? কোথায় সুখ, আর কিসে সুখ তার কি কোনও নির্দিষ্ট ফর্মুলা হয়? না হতে পারে! সুখকে কোনও সীমারেখায় ধরা যায় না বলেই তো  সে মরীচিকার পিছনে দিন রাত ছুটে চলেছি। এই যে ছোট হচ্ছি, এভাবে ছোট হতে হতে আমরা তো একরকম বিচ্ছিন্নও হয়ে পড়ছি! সেইসঙ্গে ভাঙছে আমাদের সম্পর্কগুলোও। 'একান্ন' থেকে ধীরে ধীরে কখন যেন 'একা' হয়ে উঠছি। এখন আর বলি না, "আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি।"

রামায়ণ, মহাভারত পড়া মানুষগুলোই এখন ভুলে যাচ্ছে ভ্রাতৃপ্রেম। ভ্রাতৃবধূরাও এখন পরস্পরের চোখের বালি। পরস্পর কোলে পিঠে মানুষ হওয়া ভাইয়েরা এখন পরস্পর দু চোখের বিষ। দুটো চুম্বকের মতো কেবলই দূরে দূরে সরে যাচ্ছে। তাই রতন কাকা ঠিকই বলেন, ওসব আদর্শ এখন নাকি আর চলে না। এই যে ভাইয়েরা আলাদা হয়ে যাচ্ছে, এতে ভাইদের মন কি কেঁদে উঠে না একবারও? একবারও কি মনটা ওদের হু হু করে না? অবশ্যই করে। তাহলে? ওই যে তখন আমরা যন্ত্র হয়ে উঠি। আবেগের মুখটা তখন ছিপি দিয়ে এঁটে দিই।

তাই তো মোবাইলে পরোপকারের ভিডিও দেখলে, অন্যের কষ্ট দেখলে মনটা আমাদের ভিজে যায়। তার মানে কী! আমাদের মনটাও তো চাই পরোপকার করি। পাশে থাকি। কিন্তু যন্ত্রের হাতটা তখন শরীরের হাতটাকে একরকম টেনে ধরে। আমাদের অজান্তেই।ইচ্ছাটাকেই কেমন যেন মেরে ফেলে। আর তখন আমরা এড়িয়ে যাই।

জঙ্গলমহলে যৌথ পরিবার এখন নেই বললেই চলে। নামমাত্র আছে। দু ভাইও এখন পরস্পরের থেকে আলাদা হয়ে উঠছে। একই বাড়ির মাঝখানে একটা বেমানান দেওয়াল গড়ে উঠছে। নয় তো অন্যত্র বাড়ি করে সরে যাচ্ছে। নীতি গল্পে পড়া "একতায় বল", এখন অচল। সকলেই ভুলে যাচ্ছে ওসব। হয়তো ভাবছে, পরস্পর মিলেমিশে যখন থাকতেই পারছি না, কী হবে ওসব নীতিকথায়? এর চেয়ে আলাদা হয়ে যাওয়ায় বরং ভালো। কিন্তু ভালো হয় কি? কী জানি! হয় তো হয়। হয় তো বা হয়ও না। তবে যৌথ পরিবারগুলো যে সকলকে এখন আর বেঁধে রাখতে পারছে না এটাও সত্যি। না হলে এভাবে ভেঙে পড়ত না। যেমন আগে এই গ্রামে মাত্র তিরিশটি পরিবারের বাড়ি ছিল। ভাইয়েরা আলাদা হতে হতে এখন সেখানে সত্তরটির ওপর বাড়ি হয়ে উঠেছে। আমরা ক্রমশ ছোট হচ্ছি।আর গ্রামগুলো ততই আকারে ও আয়তনে বড় হচ্ছে। 

এই যে আমরা পৃথক হয়ে পড়ছি একে অপরের কাছ থেকে। বিষয় সম্পত্তিই কি এর একমাত্র কারণ হয়ে উঠছে? তা বোধহয় নয়। কারণ এখানকার মানুষের বিরাট কিছু বিষয় আশয় যে আছে, তাও নয়। তাছাড়া প্রান্তিক গ্রামগুলোতে বিষয় সম্পত্তিহীন ভাইয়েরাও তো পরস্পরের থেকে আলাদা হয়ে পড়ছে। তাহলে? আসলে বিষয় আশয় তো আছেই। সেইসঙ্গে ভাইয়েদের মধ্যে নানা বিষয়ে মতান্তর থেকে মনান্তর হচ্ছে। সেখান থেকেও অনেকে আলাদা হয়ে পড়ছে। কখনও কখনও ইগোর লড়াইটাও মাঝখানের দেওয়াল হয়ে উঠছে। ভিন্ন পরিবার ও পরিবেশ থেকে আসা ভ্রাতৃ-বধূরাও এখন পরস্পর মানিয়ে নিতে চাইছে না।  পারিবারিক আদর্শ, মূল্যবোধ, ত্যাগ স্বীকারের সদিচ্ছা হয় তো মিলিয়ে রাখতে পারত। কিন্তু তেমন সদিচ্ছা আর এখন কেউ দেখাতে চাইছে না। কোনও পরিবারে এক ভাই একটু বাড়তি রোজগার করলে তো অন্যজন একটু হলেও হীনম্মন্যতায় ভুগে। ধীরে ধীরে সেটাই কখন যেন ক্ষোভের জন্ম দিয়ে ফেলে। অনেক সময় সেটাও একটা কারণ হয়ে উঠে। তাছাড়া সমালোচনা সহ্য করার ক্ষমতা এখনকার স্বামী স্ত্রীদের মধ্যে বড়ই অভাব। সেটাও অনেকসময় একটা কারণ হয়ে উঠে।

তবে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হল স্বাধীনতার স্বাদ। এবং এটাকেই বিশেষ কারণ হিসাবে মনে করা হচ্ছে। প্রতিটি দম্পতিই এখন নিজেদের মতো করে স্বাধীন থাকতে চাইছে। পরিবারের কর্তা, শ্বশুরমশাই, বড় দাদা কিংবা যেই হন তাদের অধীনে কিংবা অনুশাসনে থাকতে এখন আর কেউ পছন্দ করছে না। তাই নিজেদের মতো করে স্বাধীনভাবে থাকাটাকেই সকলে গুরুত্ব দিচ্ছে।একান্নবর্তী পরিবারের কর্তার মতো রাশভারী 'কর্তা' বলে তাই এখন আর কেউ নেই। সেই অনুশাসনও নেই। উঠে যাচ্ছে যৌথ পরিবারের নিয়ম কানুন। পারিবারিক আদর্শ, সামাজিকতা, শিক্ষা-দীক্ষার তাতে কী হল। ওসব ভাবার এখন সময় নেই।

মানসিকতারও আমূল বদল ঘটেছে। "সম্মান" জিনিসটা কেমন করে যেন উবে যাচ্ছে। মন থেকে কাউকে শ্রদ্ধা ও ভক্তি ভাবটা যেন হারিয়ে পড়ছে। পাড়ার বয়োজ্যেষ্ঠ রুচিশীল শিক্ষিত মানুষকে দেখামাত্র একটা শ্রদ্ধা ও সম্ভ্রমবোধ জেগে উঠত। তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর সাহস থাকত না। এখন ওসবের বালাই নেই। মাস্টারমশাই দের দেখলেই মাথা ঝুঁকে পড়ত। এখন সেসব আর দেখা যায় না। কেউ কাউকে তেমন একটা সমীহও করে চলে বলে তো মনে হয় না। সকলেই সমান। এমনই একটা বেপরোয়া ভাব এসেছে। ছোট থেকে বড় সবার মধ্যেই। তবে হ্যাঁ, একটা পরিবর্তন এসেছে। আজকাল সম্মানটা টাকার উপর বসে পড়েছে। গ্রামের যার অনেক টাকা, গাড়ি বাড়ি করেছে। সে বরং সম্মান আদায় করে নিচ্ছে। মানসিকতায় সে নিরক্ষরের সমান হলেও। এমন দৃষ্টান্ত আমি চোখের সামনে অনেক দেখেছি।

এখন দেখনদারী ব্যাপারটাকেই বেশি করে গুরুত্ব দেওয়া হয়। চলনে, বলনে, খাদ্যে, পানীয়ে সবকিছুতেই চাকচিক্য হতেই হবে। তবেই সবকিছু আসান। ওটাই এখন ব্যক্তিত্ব প্রকাশের একমাত্র মাপকাঠি। তাই তো গ্রামাঞ্চলেও এখন আধুনিক সেলুন ও বিউটি পার্লারের ছড়াছড়ি। পোশাক আসাকের সঙ্গে মাথার চুলেরও আজকাল কতরকম স্টাইল দেখা যাচ্ছে। কিশোরদের চুল কাটার নতুন ধরন এসেছে। জঙ্গলমহলের কিশোরদের এখন এটাই নতুন ফ্যাশন। গুটকা প্রিয়তা অসম্ভব রকমের। ঘর বাড়ি, রাস্তা ঘাট, স্কুল কলেজ, দোকান বাজারের গায়ে লাল থুতুর ছিটেগুলোই তার বড় প্রমাণ। এদিকে বন্ধ হয়ে পড়ছে গ্রামীণ গ্রন্থাগার বা লাইব্রেরীগুলো। পাঠকের অভাবে ধুঁকছে কেবলই। একটু একটু করে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বই পড়ার অভ্যাস। আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে উঠছি আমরা। আর নিজেরাও একটু একটু করে সকলের অজান্তে "যন্ত্র" হয়ে পড়ছি। কী আর করা যাবে। সময়ের গতিপথে ভেসে চলাটাই তো আমাদের নিয়তি। 

সেইসঙ্গে বদলে গেছে জঙ্গলমহলের মানুষের চিন্তা ও চেতনাও। একটা সময় অলৌকিকতা ও  অন্ধবিশ্বাসের জালে ঢাকা পড়েছিল জঙ্গলমহল। এখন সেই জাল ক্রমশ ছিন্ন হচ্ছে। যুক্তিবাদ, পাল্টা প্রশ্ন, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি, প্রচলিত প্রথায় অবিশ্বাস জন্ম নিচ্ছে। শাল মহুলের চোরা ফাঁক দিয়েই সেগুলো হু হু করে ঢুকে পড়ছে। দখিনা বাতাসের মতোই। রামায়ণ ও মহাভারতের অলৌকিক কাহিনীকে এখন কেউ সরল মনে স্বীকার করছে না। বরং প্রশ্ন তুলছে। অবিশ্বাস করছে। এটা কীভাবে সম্ভব। ওটা কী করে হল। ইত্যাদি। ইত্যাদি। সেটাই বা কম কিসের।

তারপরেও অনেক বেশি ভালো থাকতে গিয়ে আমাদের সত্তাটাকে আমরা হারিয়ে ফেলেছি না তো!

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments