জ্বলদর্চি

গ্রামের শহুরে রূপকথা-১৯/ সুরশ্রী ঘোষ সাহা

গ্রামের শহুরে রূপকথা

সুরশ্রী ঘোষ সাহা

ঊনবিংশ পর্ব : আমি নায়ক হব

তখন ক্লাস নাইন। আমার সেজদা একদিন বাড়ি থেকে পালিয়ে গেল। কোথায়? সুদূর আরব সাগরের তীরে মুম্বই নগরীতে। তখন যদিও মুম্বই নাম হয়নি, বোম্বে ছিল। ওর ইচ্ছা ছিল বলিউডের নায়ক হবে। 

 ঘটনাটা যখন ঘটেছিল তখন বাড়িসুদ্ধু সকলের নাওয়া-খাওয়া উঠে গিয়েছিল প্রায়। কিন্তু এখন শুনতে লাগে পুরোটাই গল্প কাহিনি। গ্রামের কথা লিখতে বসে হঠাৎ এই ঘটনাটাও লিখতে ইচ্ছে হল। কারণ, আজ আর কোন গ্রামের ছেলে শুধু বলিউডের নায়ক হবার নেশায় অজানা-অচেনা শহরে পাড়ি দেবে না। কারণ, এই জেনারেশনের গ্রামের ছেলেদের মধ্যেও সেই জ্ঞান - বোধ - সচেতনতা তৈরি হয়ে গিয়েছে অনেকবেশি। অথচ আগে একটা সময় ছিল, যখন শহরের চেয়ে  গ্রামের ছেলেরাই বেশি এই ধরণের কাজ করে বসত, এতটুকু না ভেবে। আমরা হিন্দি সিনেমার অনেক নায়কের জীবনের পিছনের দিকে তাকিয়েও একই ইতিহাস শুনতে পারি, জানতে পারি। স্বয়ং অমিতাভ বচ্চনও নাকি একসময় উত্তর প্রদেশের গ্রাম থেকে পাড়ি দিয়েছিলেন মুম্বই নগরীতে। বাকিটা ইতিহাস... 

 এই সেদিন মধ্য চল্লিশ পেরিয়ে যাওয়া সেজদার কাছেই জানতে চেয়েছিলাম, তোমার হঠাৎ অমন পালিয়ে যাওয়ার খেয়াল হয়েছিল কেন? 

 দাদা বলল, আমাদের গ্রামের এক জামাইবাবু তখন মুম্বইয়ের সোনার দোকানে হীরে কাটার কাজ করত। যখনই ওখান থেকে আসত, রূপালী সিনেমার জগতের অনেক গল্প করত। পথে কত কত হিরো-হিরোইন দেখা যায় ওখানে গেলে... এমন কত সব গল্প।

 একদিন মাথায় কী ভূত চাপল, ভাবলাম, আমিও মুম্বই গিয়ে নায়ক হব। এক জামা কাপড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে সোজা হাওড়া স্টেশন চলে গেলাম। তারপর ওখান থেকে চেপে গেলাম হাওড়া-মুম্বই ট্রেনে। টিকিট কাটিনি। ট্রেনে টিটি ধরতে টিকিট কাটতে বাধ্য হলাম। পকেটে পড়ে রইল, মাত্র উনিশ টাকা। মুম্বই পৌঁছে উনিশ টাকাটাও দুদিনের মধ্যে খেতেই খরচ হয়ে গেল। তাও তখনও জিনিসের মূল্য আরো অনেক কম ছিল। পেটটা যাতে বেশি ভরে থাকে তাই দোকান থেকে ঠোঙায় ছাতু গুলে খেয়ে অনেকখানি জল খেয়ে নিতাম। কিংবা সন্ধ্যাবেলায় পথের ধারে ওখানকার বিখ্যাত পাও-ভাজি খেয়ে পেট ভরাতাম। রাতে কোন গাছ তলায় শুয়ে থাকতাম। কিংবা ফুটপাথের হোটেলের সামনে ঘুরঘুর করতাম। গায়ের জামা ধীরে ধীরে নোংরা হয়ে গেল। কতদিন স্নান করিনি, সাবান মাখিনি, গা দিয়ে গন্ধ বেরুতে শুরু করল। কাউকে চিনি না যে কোথাও যাব। আমাদের গ্রামের সেই জামাইবাবু কোথায় থাকে, তাও জানি না। মনে মনে তাকেই খুঁজে চলতাম। আর সারাদিন পথে পথে ঘুরে বেড়াতাম। যদি দেখা হয়ে যায় সেটা ভেবে। পেটে খিদে তাই 'গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়ার' সৌন্দর্য কিংবা তার বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকা তাজ হোটেলের রূপ আমাকে অবাক করল না। আমি যখন পা ঝুলিয়ে বসে থাকতাম আরব সাগরের তীরে, অমন বিরাট বিরাট ঢেউয়ের ওঠা-পড়ায় কিছুই চমৎকৃত হতাম না। পেটের খিদে এমন জিনিস। বুঝতে পারলাম, হিসেবে গন্ডগোল করে ফেলেছি। টাকা পয়সা, জামা কাপড় না নিয়ে বেরিয়ে খুব ভুল করেছি। তবুও ফিরে যেতে ইচ্ছা করল না। 

 কোনদিনও কোন হিন্দি সিনেমার নায়ককে পথে দেখতেও পেলাম না। জামাইবাবুর কথার সাথে মিলও খুঁজে পেলাম না। খুব রাগ হল। আমার চোদ্দ বছর বয়সের বুদ্ধিতে ধারণা জন্মে ছিল, নায়কের দেখা পেলেই গিয়ে হাতে-পায়ে পড়ব। আমাকে ঠিক ঢুকিয়ে নেবে কোন না কোন রোলে। নায়কের হাতেই তো সবকিছু... 

 একদিন পথে ঘুরতে ঘুরতে দেখা হয়ে গেল গ্রামের সেই জামাইবাবুর সাথে। আসলে সেও আমাকে তখন হন্যে হয়ে খুঁজছে। কারণ, বাপির কাছে তার মুম্বইয়ের ঠিকানা ছিল। আর বাপি তার কাছে টেলিগ্রাম করেছিল। একেই বলে বাবা, যে, ঠিক আইডিয়া করে নিয়েছিল, আমি নির্ঘাত মুম্বই পালিয়েছি। 

 আমাকে খুঁজে পেয়ে জামাইবাবু বাপিকে টেলিগ্রাম করল। আমি বাপির চিঠি পেলাম। হাতে চিঠিটা ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। কেঁদে ফেললাম। কত বড় ভুল কাজ করেছি বুঝতে পেরে অনুতপ্ত হলাম প্রথমবার। জামাইবাবুর সাথে বাড়ি ফিরে এলাম। 

 ওর মুখে এটা শুনতে শুনতে আমার আরেকটা ঘটনা মনে পড়ল। তাই বললাম, কিন্তু তুমি তো ঐ একবারই পালাওনি? দ্বিতীয়টা অত বড় পালানো না হলেও, পালানোই তো। 

 দাদা হাসল। বলল, পালাতে দারুণ মজা আছে, রে। কিন্তু প্রথমবারের ঐ ঊনত্রিশ দিনের জন্য অত বড় পালানোয় বিরাট বড় সাজাও পেয়েছিলাম। আমি যখন মুম্বই পালিয়ে ছিলাম তখন সামনে নাইন থেকে টেনে ওঠার ফাইনাল পরীক্ষা ছিল। আমার পরীক্ষাটা না-দেওয়ার জন্য গোটা বছরটা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। নাইনে আরো একটা বছর পড়তে হয়েছিল। 

 ওর দ্বিতীয়বার পালানোর অভিজ্ঞতাটা আমার স্মৃতি থেকেই লিখি। তখন রাত প্রায় একটা। হঠাৎ দেখি আমাদের চুঁচুড়ার বাড়ির দরজায় কে ধাক্কা দিচ্ছে। আমরা সবাই ভয়ে কাঁটা হয়ে গিয়েছি। ভয় পাওয়ার মোক্ষম কারণ, রাস্তার ধারের পাঁচিলের মাঝের গেটে তখন তালা পড়ে গিয়েছে। সুতরাং যে দরজা পর্যন্ত চলে এসেছে সে যদি মানুষ হয়ে থাকে, তাহলে অবশ্যই পাঁচিল টপকে এসেছে। 

বাবা, ভারি গলায় 'কে' বলে চিৎকার করে উঠল। 

অপরদিক থেকে উত্তর এল, কাকা, আমি ভুলু। 

 দরজা খুলেই বাবা অবাক, চেঁচিয়ে উঠল, তোর তো ট্রেনিং চলছে। তুই এলি কী করে? 

 লালবাজার পুলিশের ট্রেনার উত্তর দিল। একটু ঘুমাতে এসেছি। কাকা, ট্রেনিংয়ে খুব কষ্ট। খাওয়া তো নয়, পেট বোজানো। আর, ঘুম তো নয়, রাত কাটানো। 

 বাবার মায়া হল। বকাঝকা ছেড়ে বলল, ঘরে যা আছে, খেয়ে ঘুমিয়ে পড়। সকালে উঠেই চলে যাস কিন্তু। 

 টানা ছয় মাসের ট্রেনিংয়ের মাঝে, রিস্ক নিয়ে পালিয়ে এসে আবার ভোর রাতের ট্রেনে ফিরে গিয়েছিল সেবার। জেঠুর কাছ থেকে ঘটনাটা আমরা লুকিয়ে রেখেছিলাম। যে রিস্ক ও নিয়েছিল, তাতে ধরা পড়লে হয়ত অত কষ্ট করে পাওয়া সরকারী চাকরিটা টিকত না। 

 গ্রামের মানুষরাই প্রথম তাদের ছেলেদের মিলিটারি ও পুলিশে পাঠিয়েছে। কারণ, তখনও শহরের খুব কম ঘরের ছেলেরা আর্মিতে - ফোর্সে জয়েন করত। আজও যুদ্ধে যত ছেলে যায় কিংবা সিয়াচেনের বরফে বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে যারা দেশকে অতন্দ্র পাহারা দেয়, তাদের সিংহভাগ ছেলেই গ্রাম থেকে আসে। 

 আমার জেঠুর ঘরের ছোটদুটো ছেলেকে জেঠু নির্ভয়ে আর্মিতে পাঠিয়েছিল। ছোটটা আজও সেখানে চাকরি করছে। ওরা যে সমস্ত জায়গায় থেকে ওদের জীবনের অনেকখানি অংশ কাটিয়ে দিয়েছে বা আজও দিচ্ছে, সেখানে অন্য মানুষের পক্ষে থাকা খুব কষ্টকর। তবুও ওরা পেরেছে। হয়ত গ্রামের ছেলে বলেই সফল হয়েছে। 

 শৈশবে যারা রাখাল বালক হয়ে গরু চড়িয়েছে। জমিতে নেমে ধান-গম বুনেছে, তারাই কিশোর বয়স থেকে নির্জন পাহাড়ি ক্যাম্পে প্রকৃতির মাঝে দাঁড়িয়ে দেশের সীমানা রক্ষা করেছে। পিঠে বন্দুক নিয়ে ছুটে বেরিয়েছে দেশের নানা প্রান্তের পোস্টিংয়ে। 

 আমরা সিনেমার নায়ককে যখন অভিনয় করতে দেখি কোন মিলিটারির ভূমিকায়, তার কঠিন লড়াই দেখে কেঁদে ভাসাই। কিন্তু আমরা কয়জন আমাদের ঘরের ভাই-দাদাদের জীবনভর ত্যাগের কথা ভেবে কাঁদি? কাঁদি না। কারণ, ওরা যে রিয়েল। নায়ক নয়। 
                                                                
                                                                             (ক্রমশ...) 

ছবি : লেখিকার মিলিটারি ভাই

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

1 Comments

  1. সত্যি জীবনের নায়কের দিকে আর কে তাকায় .... বরং তারা কি কি পারে নি আর কি কি করে নি সেই কথা দিয়ে তাঁদের ব্যথা দেওয়া হয়.

    ReplyDelete