জ্বলদর্চি

মাটিমাখা মহাপ্রাণ। কুড়ি/শুভঙ্কর দাস

মাটিমাখা মহাপ্রাণ। কুড়ি

শুভঙ্কর দাস 

"দূরদেশী সেই রাখাল ছেলে 
আমার বাটে বটের ছায়ায় সারা বেলা গেল খেলে
গাইল কী গান সেই তা জানে,সুর বাজে তার আমার প্রাণে
বলো দেখি তোমরা কি তার কথার কিছু আভাস পেলে?"

বাসায় ফিরে কুমারচন্দ্র বাড়ি থেকে একটি চিঠি পেলেন। তাতে মায়ের অসুস্থতার কথা জানতে পেরে মুহূর্তে সব কাজ ছেড়ে  গৃহের দিকে রওনা হলেন।সুদীর্ঘদিন পরে আবার তাঁর প্রাণপ্রিয় ভিটেমাটি বাসুদেবপুর গ্রামে চললেন।
নৌকা করে সোজা চলে এলেন কুকড়াহাটি, তারপর সেখান থেকে গরুর গাড়ি করে সুতাহাটা।
সেখান থেকে হাঁটাপথে বাসুদেবপুর গ্রাম।মাঠ পেরিয়ে গেলে সবচেয়ে সুবিধা। এই সময় মাঠের ধান সব কাটা হয়ে গেছে।আল ধরে হেঁটে গেলে নবশ্যামলদূর্বাদল পায়ে পায়ে জড়িয়ে যায় আনন্দে, তারপর দিগন্তবিস্তারী মাঠের শেষসীমানায় পরিষ্কার আকাশ এবং বহুদূরের ছায়াময় গাছগাছালির সুদৃশ্য রেখা মনকে কেমন খুশিতে ভরিয়ে দেয়।যেন কোথাও কোনো দুঃখ নেই, কষ্ট নেই, কোনো আন্দোলনের উষ্ণ হস্তসঞ্চালন নেই, সবই যেন শান্ত সুন্দর এক মনোহর জীবন। মাঠ বরাবর হেঁটে যাওয়ার সময় কুমারচন্দ্র আপন মনে আবৃত্তি করে উঠলেন,

"সীমার মাঝে, অসীম তুমি
বাজাও আপন সুর
আমার মধ্যে তোমার প্রকাশ 
তাই এত মধুর।
কত বর্ণে কত গন্ধে
কত গানে কত ছন্দে
অপরূপ,তোমার রূপের লীলায়
জাগে হৃদয়পুর।"

গীতাঞ্জলির কবিতাটি বলার পর কুমারচন্দ্র 'হৃদয়পুর' শব্দটা বার কয়েক উচ্চারণ করলেন।তারপর নিজের গ্রামের নাম বাসুদেবপুর বার কয়েক উচ্চারণ করলেন,বেশ,তাহলে প্রাণপ্রিয় এই বাসুদেবপুর গ্রামকেই হৃদয়পুর করবেন তিনি একদিন।এখানেই তাঁর মা থাকেন। কুমারচন্দ্র সেই ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছেন, তাঁর মা কোনোদিন তেমন কোনো অসুখে পড়েননি! সবসময়ই কোনো না কোনো কাজের মধ্যে নিজেকে নিয়োজিত রাখতেন।সংসারের হাজার সমস্যা ও ঝামেলার মধ্যে বার-ব্রত এবং উপোস করার কোনোবারেই ফাঁক যেত না!
অবশ্য তাতে কোনোদিন অসুস্থ হয়ে পড়েননি! কিন্তু এবার কী হল?
সহসা মায়ের কথা হতে অতি দ্রুত হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলেন।
যখন গৃহে পৌঁছালেন,তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে।মাটির বারান্দায় মা শুয়ে আছেন,হাতটায় ব্যাণ্ডেজ জড়ানো। কুমারচন্দ্র ছুটে গিয়ে মায়ের পায়ের কাছে বসলেন।

মা, হাতে কী হল? কুমারচন্দ্রের মুখচোখে বিষাদ।

কুমার,বাবা,এতদূর থেকে এলি,একটু বিশ্রাম নে, আমি একেবারে ঠিকই আছি। তোকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল,তাই তোর দাদাকে চিঠি লিখতে বলেছিলাম,আসলে আমার তেমন কিছুই হয়নি!

বলেই লক্ষ্মীদেবী হাঁপিয়ে উঠলেন।তাঁর জলতেষ্টা পেয়েছে।কুমারচন্দ্র রান্নাঘর থেকে জলের পাত্র এনে জল খাওয়ালো।

কিন্তু কী করে হল এমন?

ও কিছু নয় বাবা,পুকুরঘাটে অন্ধকার ছিল,ঠিক মতো দেখতে পাইনি,সিঁড়ি কীসের ওপর পা পড়তেই পিছলে যাই,তখন একটু হাতে লেগে যায়,কিছুই হয়নি

কিন্তু তোমার গা যে গরম! জ্বর আছে তো!

সারাক্ষণ এখানে বসে আছি তো,একটু রোদ লেগেছে যা, আহ্ তোর দিদিটা গেল কোথায়, জলটল দেয়নি ছেলেটাকে

কেন? এই রোদের মধ্যে ঘরের মধ্যে শোওনি কেন?

সহসা দরজা থেকে একটা আওয়াজ পাওয়া গেল। তুই এসেই যা দেখছিস,তা শুধু আজকে নয়, এ জিনিস চলছে তোকে চিঠি লেখার পর থেকেই,মা কারও কথা শোনে না,শুধু বলে ওঠে,আমার কুমার কলকাতা থেকে আসবে,এসেই যেন কাউকে দেখতে পায়,তাই তিনি বারান্দায় অপেক্ষা করছেন,করেই চলেছেন,তুই ভাগ্যিস এলি,না হলে এই অপেক্ষা কতদিন চলত তা একমাত্র শ্রীহরিই জানেন!

কথাগুলো একসঙ্গে বলে উঠলেন কুমারচন্দ্রের দিদি।কৃত্রিমভাবে মুখে রাগ দেখিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে গেল।

কুমারচন্দ্র মৃদুস্বরে বলে উঠলেন,এরকম কেন করছ মা,এতে শরীর তো আরও খারাপ হবে।

নারে, তোর দিদি,একটু বাড়িয়ে বলছে,ওর মাথার ঠিক নেই। 

সহসা রান্নাঘর থেকে মুখ বাড়িয়ে বলে উঠলেন,হা,হা,মুই বাড়িয়ে বলছি,মোর তো মাথার ঠিক নেই! মুই এ সংসারের কে? জোর বলতে কী আছে আর! তুই পড়াশোনা জানা, তোর কথা মা শুনবে,মুই তো মুখ্যুসখ্যু মানুষ!

একি কথা দিদি! না, না, তা নয়

হা,হা,তাই,তোর তো মায়ের কাছে থাকার জো নেই, কিন্তু যার আছে,সে বাপের বাড়িতে, তোর পড়াশোনা করা বউ থাকলে নিশ্চয় কথা শুনত! 

কুমারচন্দ্র একটু মাথা নিচু করলেন।

কী সব বকছিস? খুকু,চুপ কর, এক রত্তি মেয়ে, একটু বাপের ঘরে থেকে পড়াশোনা শিখুক না, তোর কী অসুবিধা! 

মোর অসুবিধা কারে বোঝাব! তোমার সংসারের হাল ধার লোককে তো শিখিয়ে পড়িয়ে নিতে নাকি!

সব শিখে যাবে, তোকে চিন্তা করতে হবে না,তুই ভাইকে,খেতে দে,মুখটা একেবারে শুকিয়ে গেছে!
যা রোদ বাইরে! 

কিন্তু একজনের মুখ দেখে তো মনে হচ্ছে, প্রচণ্ড চিন্তায় মুখ ভার,তা কি শুধু রোদের জন্য কি!বলেই দিদি কুমারের মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠল

তুই এবার থাম দিকিনি,ভাইকে কিছু খেতে দে,না বল আমি উঠে দিচ্ছি...

কুমারচন্দ্র মায়ের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলেন,তারপর চোখের জল মুছে,বলে উঠলেন, এবার তো আমি এসে গেছি মা,চলো ঘরের ভেতরে চলো

নারে, থাক,রোদটায় পড়ে গেছে,একটু এখানে বসি,বলেই উঠে বসলেন লক্ষ্মীদেবী। তুই একটু হাতমুখ ধুয়ে নে, জিরিয়ে নে, পরে কথা বলছি,ও রে খুকু, মা,ভাইকে একটু খেতে দে,মুড়ি দে,আর সুতাহাটা বাজারের লাল বাতাসা দিস,দেবেন এনেছে,ভাই এসে খাবে বলে।

কুমারচন্দ্র হাতে করে কলকাতা থেকে আপেল ও বেদানা এনেছিল,তাই দিদিকে দিয়ে বললেন,মা একটু কেটে দাও,দিদি,খুব মিষ্টি, একেবারে বালিগঞ্জ বাজার থেকে কিনেছি।

আচ্ছা, খাব খন, তার আগে তুই পুকুরঘাটে যা

হ্যাঁ, মা এই যাই

কিছুক্ষণ পরে দেবেন ঝড়ের মতো ঘরে ঢুকলেন।প্রথমে কুমারচন্দ্রকে লক্ষ্য করেননি,তিনি বারান্দার দিকে এগিয়ে গিয়ে ধপ করে বসে পড়লেন,গামছায় মুখ মুছলেন এবং আপন মনে বলতে লাগলেন,এখন এখানে যদি কুমার থাকত, তাহলে খুব ভালো হত, শিবেশকাকার সঙ্গে ভারি অন্যায় হচ্ছে, একটু পরে শীতলাতলায় বিচার বসবে।আমি যে কী করব ভেবে পাচ্ছি না!
এই শিবেশকাকা বাবার মৃত্যুর পর কত উপকার না আমাদের করেছেন,তার কী অবস্থা! 

কী অবস্থা দাদা?

কুমারচন্দ্রের গলা পেয়ে প্রায় চমকে উঠলেন দেবেন।ওরে বাপরে্ তুই এসে পড়েছিস,মাকে আর দিদিকে দেখতে পেলাম,তোকে একটুুও দেখিনি ভাই,কখন এলি? কী ভাবে এলি?চিঠিটি ঠিকঠাক পেয়েছিলি তো? 

আরে থাম বাবা থাম,তাকে একটু খেতে দে,গলায় মুড়ি লেগে যাবে যে,তোর প্রশ্নের শেষ নেই!  হাসিমুখে বলে উঠলেন লক্ষ্মীদেবী। 

এই তো মায়ের কণ্ঠে একবারে জোর ফিরে এসেছে, কুমারের আসার আগে পর্যন্ত তো গলা দিয়ে এমন জোর শুনিনি! বুঝলাম,এইবার তুমি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবে। বলে উঠলেন দেবেন।

দোর, মুই অসুস্থ ছিলাম কবে? তোরা একটু বেশি বাড়িয়ে বলিস! একটু হাতখান চাপে মচকেছে,তাই এতো ঠেল! 

আচ্ছা, বুঝেছি মা,তুমি তো আমাদের শক্তিরূপিনী, তোমার কাছে এই সামান্য অসুখবিসুখ কিছুই নয়, এখন চলো ভেতরে চলো,বিছানায় শোবে। এই কথা বলে কুমারচন্দ্র মাকে ঘরের ভেতর শুইয়ে নতুন করে আবার হাতের ব্যাণ্ডেজ বেঁধে দিলেন।
তারপর বেরিয়ে এসে দাদা দেবেনের কাছে যা শুনলেন,তা হল,শিবেশ হলেন ভাগচাষী,এককালে নিজের জমিজমা ছিল,কিন্তু জমিদারের কাছে টাকা ঋণের পরিশোধে সেই জমিজমা চলে যায়,তখন সেই নিজের জমিতে নিজেই হয়ে যায় ভাগচাষী। তাতেও তার নাকি ঋণ শোধ হয়নি।তখন জমিদার শিবেশের তিনটি কন্যার দ্বিতীয়টিকে পছন্দ করেছেন। তার বয়স এই মাসে ১৫ বছর,সে আবার পড়াশোনায় খুব ভালো,মোদের গাঁয়ে তো মেয়েদের পড়ার জন্য কোনো পাঠশালা নেই!  পাশের গ্রামে মামার বাড়িতে থেকে পাঠশালায় যেত! সে এখন বিয়ে করতে চায় না,এই নিয়ে বিরোধ। 

আশ্চর্য ব্যাপার,এইরকম মেয়ে গাঁয়ে দেশে আছে? অবাক হলেন কুমারচন্দ্র। কোনো অসুবিধা নেই, আমি ওকে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে পড়াশোনার ব্যবস্থা করতে পারি।

সে তো জানি,কিন্তু এখানেই ঘটনা শেষ নয়,বিয়েটা কার সঙ্গে হবে জানিস?

কেন? জমিদারের কোনো পুত্রের সঙ্গে বুঝি!

না,রে, জমিদার নিজেই বিয়ে করতে চায়,তার বয়স এখন সত্তরের কাছাকাছি, তাই ভেবে দেখ,এই হচ্ছে ঋণশোধ করার উপায়!

কী অন্যায়! গাঁয়ের লোকজন কী বলে? মোড়লমশাই কী ভাবছেন, সেসব জানার তো দরকার ,তার আগে বিচার সভায় যাওয়া উচিত, চলো দাদা,এরা এখনও কোন্ যুগে পড়ে আছে?
এটা কি মধ্যযুগ?

চল ভাই,সত্যযুগ তো নয় এটা নিশ্চিত। 

বলেই দেবেন ও কুমারচন্দ্র শীতলাতলার উদ্দেশ্য বেরিয়ে থমকে দাঁড়ালো দিদির কথা শুনে,

সবকিছু বাইরে দেখে বিচার করিস না! ঝামেলায় জড়ানো আগে সবসময় মনে রাখা উচিত, সেই সমস্যার সমাধানে আমার কতখানি শক্তি আছে! সাহস তো কাজে এগিয়ে নিয়ে যাবে কিন্তু সমস্যার সমাধানে পৌঁছে দেবে না,এই সব মোদের গাঁ-দেশে স্বাভাবিক, মানুষকে তো ভালো কথা শোনানারো আগে,এটা যে ভালো কথা সেটা বোঝানোর লোক কোথায়? 
বলেই কুমারচন্দ্রের দিদি রান্নাঘরে ঢুকে গেল।

কথাগুলো কুমারচন্দ্রের বুকে গেঁথে গেল।সত্যি তো, ভালো কথা শুধু বললেই হবে না,তার আগে ভালো কথাটি যে ভালো তা বোঝাতে হবে।

কী রে থমকে দাঁড়িয়ে থাকবি? যাবি না!

হ্যাঁ,দাদা চলো,আচ্ছা,দাদা,এই জমিদারের নাম কী?

কালিকিঙ্কর সামন্ত, মহিষাদলের রাজবাড়ির সঙ্গে ওঠাবসা আছে।

আচ্ছা, চলো

শীতলাতলা। এখানে প্রতিটি বছর শয়ালগাজন বসে।একটি বৃহৎ অশ্বত্থ গাছের চারিপাশে মাটি দিয়ে বেদি করা নির্মিত। অনেকদিন আগে পুজোর জন্য আলপনা আঁকা হয়েছিল,সেইসবের রেখা লক্ষ্য করা যায়, তার ওপর বেশকিছু অংশ ফুটিফাটা। তার সামনে প্রশস্ত জমি। জমি পেরিয়ে মাটি-কাঠ দিয়ে তৈরি মন্দির।গাছটির নিচে  বিচারসভা বসে। বৃক্ষের নিচে একপাশে গাঁয়ের মানুষের জমায়েত।বেদির ওপর মাদুরে মোড়ল বসে আছেন,হাতে হুঁকো ধরা।তার পাশে বেশ কয়েকজন বয়স্ক মানুষ। বেদীর সামনে হাতজোড় করে দণ্ডায়মান শিবেশ। তার কাছেই একটি এগারো-বারো বছরের ছেলে আহত পাখির মতো কাঁপছে। তার খালি গা,নিচের ধুতিটা একটু ছেঁড়া। 
বয়স্ক মোড়ল চারিপাশে তাকিয়ে নিয়ে বলে উঠলেন,শিবেশ, তোর জন্য এ-ই গাঁ তো আর জমিদারের সঙ্গে বিবাদে যাবে না,তুই একরকম জেদ ধরে থাকিস না,আমার কথা শোন,তুই মেয়ের বিয়ে দিয়ে দে,আগের দিনে হলে জমিদারের লেঠেল এসে ঘরবাড়ি ভেঙে আগুন দিত,ঘরের মেয়েকে তুলে নিয়ে যেত,কারও কিছু করার থাকত না,এখন তো দিনকাল বদলেছে,জমিদার নিজে থেকে প্রস্তাব দিয়েছেন, এতো শুভ লক্ষণ। তাই না! এতটা বলে কেশে উঠলেন। 

পাশের একজন টাকমাথা লোক গলার জোর তুলে বলে উঠল,এসব অনাসৃষ্টি কেউ শুনেছে! জমিদারের ওপর কথা,তার ওপর শিবেশের মেয়েটিও যাই বলো বলিহারি, ওহ্ হো পড়াশোনা করে একেবারে মেয়ে বিদ্যেসাগর হবে,যতসব মাথা গরমের ফল,কাকে বলে,একজন্য মেয়েদের পড়াশোনা করা উচিত নয়!

শিবেশ বলে উঠলেন,আসলে মেয়েটি একটু অন্য রকম, বিয়ে থায় মন নেই, আমি বুঝিয়েছি,তার ওপর এই মা-হরানো ছেলেটার প্রতি একটু মায়া...

শেষ করার আগেই সেই টাকমাথা লোকটি উত্তেজিত হয়ে বলল,ও তো মুসলমান, ওর সঙ্গে তোর মেয়ে ভাই পাতায় কী করে?

আসলে ছেলেটি ও তার মা আমাদের গৃহে আশ্রয় নিয়েছিল,তবে একবারে অপরিচিত কেউ নয়, কোথা থেকে এসেছে জানি তো,আমার শ্বশুরবাড়ির দিকের লোক,আমার মেয়ের সঙ্গে ছেলেটির খুব ভাব, কলেরায় ওর বাপ মারা যায়,সে রাজমিস্ত্রীর কাজ করত, অসুখ সারাতে গিয়ে ঘটিবাটি সব দেনা হয়ে যায়,পথে নেমে আসে। তখন আমার বাড়িতে এসে ওঠে।কিন্তু কী বলব,কয়েকদিন পরে ওর মা ওকে রেখে কোথায় যে চলে গেল,তারপর খুঁজে পাইনি! তাই ছেলেটি আর কোথায় যাবে? আছে,ওর মা ফিরে এলেই,তার হাতে তুলে দেব

হ্যাঁ,ওর মা এলে ফিরিয়ে দেব,শিবেশের গলার স্বর বিকৃত করে সেই টাকমাথা লোকটি বলে উঠল,ওর মা তো একবারের মহারানী,রাজ্য সামলাতে গেছে,ফিরে এসে রাজপুত্রকে নিয়ে যাবে,যতসব বাড়াবাড়ির এক শেষ.. কেন যে জন্ম দেয়!যত ছোটোলোক সব.. 

আহ্ তুই বাপু একটু চুপ কর না,আমাকে বলতে দে,বলেই বেশকিছুটা ধোঁয়া ছাড়লেন মোড়ল,তারপর গলা খাঁকারি দিয়ে পক্বভ্রু তুলে বললেন,তা বাপু, শিবেশ,এই গাঁয়ের মানুষজন এই সব ভালো চোখে দেখছে না,ছেলেটিকে খুব তাড়াতাড়ি ওদের পাড়ায় দিয়ে এসো,সেখানেই থাক,সবচেয়ে বড় কথা এসব শুনেও জমিদারবাবু আমাকে নিজে থেকে জানিয়েছেন,তাঁর এরপরেও বিয়েতে কোনো অসুবিধা নেই, এটাই সবচেয়ে বড় কথা। তাঁর উদারতার কথা ভাবো।আসলে বেজাতের ছেলে তো! 

কুমারচন্দ্র সামনে আসেননি, তিনি ভীড়ের মধ্যে মিশে ছিলেন। লক্ষ্য করলেন,প্রায় কেউ শিবেশকাকার এই মুসলমানের ছেলেকে আশ্রয় দেওয়াটা সমর্থন করছে না,বরং একটা বিরক্তিসূচক ঘৃণাতেই ব্যাপারটিকে ধামাচাপা দিতে চাইছে,আর অত অল্পবয়সী মেয়ের কেন অত বয়স্ক লোকের সঙ্গে বিবাহ হচ্ছে, তা যেন কোনো বিষয়ই নয়, বরং জমিদার কত বড় মনের মানুষ এটাই সবার আশ্চর্যের বিষয়।
কালিকিঙ্কর সাহসী মানুষ।বহুবিবাহকে আইনকে বুড়োআঙুল দেখিয়ে যথারীতি চারটি বিয়ে করেছেন।প্রথম তিনজন স্ত্রী মৃত।শেষজন উন্মাদ,তাই তাঁর সংসারে দুঃখের শেষ নেই, সর্বমোট সন্তান সংখ্যা বারোজন, বড়পুত্রের পুত্রের বয়সী শিবেশের মেয়ের সমবয়সী। কিন্তু তা সত্ত্বেও এইসব হিসেব কারও চোখে পড়ে না। এতে বড় জমিদার বাড়ির প্রধান গিন্নী হতে যাচ্ছে, এটাই গাঁয়ের লোকদের কাছে রূপকথার মতো।কেউ কেউ আবার মুখ বেঁকিয়ে বলে ওঠে,শিবেশের মেয়েটা অতি সুন্দরী বলেই এই রকম ভাগ্য, তাকে দেখো বাপ-বেটি মিলে লাথি মারার জন্য মুখিয়ে আছে।মা নেই তো,তাই এমন অনাসৃষ্টি, ওর বাপ তো নির্লজ্জ, দেখো গে,হয়তো মুসলমানী মাগিটার সঙ্গে কোনো আনছান আছে! না হলে,যার মা পালিয়ে যায়,সেই ছেলের জন্য দরদ উথলে উঠেছে!  ছোঃ 

শিবেশ,তোর মেয়ে আসেনি কেন?বার বার বলে দেওয়া সত্ত্বেও,  টাকমাথা লোকটি দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলে উঠল।

সেই ছোট ছেলেটি সহসা মুখ তুলে উত্তর দিল,দিদির জ্বর, শুয়ে আছে।কেন এখানে আসবে!

আবার হারামজাদা, হিন্দুর মেয়েকে দিদি বলছিস, তবেরে তুই কথা বলিস কী করে? বলেই টাকমাথা লোকটি পায়ের জুতো খুলে ছোট ছেলেটিকে মারতে এগিয়ে গেল,গাঁয়ের সকলে চুপচাপ দেখছিল,শিবেশ হাতজোড় করে বলে উঠল,ও সত্যি বলেছে,ওর দোষ নেই। ওকে মারবেন না!
আগেই দুবার চড় মেরেছেন!

না,শাস্তি দিতেই হবে,ও কেন এখানে কথা বলবে,বলেই টাকমাথা লোকটি সহসা থমকে গেল! তার হাতের জুতো হাতেই থাকল।
তার দৃষ্টি ছোট ছেলেটির পেছনে দাঁড়ানো লোকটির দিকে,তার চোখের দিকে একবার তাকাতেই সে স্থরিব হয়ে গেছে।এই দৃষ্টি সাধারণ গাঁদেশের নয়, এর শক্তি অনেক, অন্যরকম।
শিবেশ যেন জোর পেল।তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে কুমারচন্দ্র। 
টাকমাথা লোকটি সুড়সুড় করে পিছিয়ে মোড়লের পাশে গিয়ে বসল।
সুদীর্ঘকাল মোড়লগিরি করে এসেছেন বৃদ্ধ মোড়ল, তিনি প্রতিরোধের ভাষা তো তুচ্ছ, সামান্য টিকের আগুনের আঁচ অনুধাবন করতে পারেন,তিনি সঙ্গে সঙ্গে হুঁকোটা পাশে রেখে গলার স্বর নমনীয় করে বলে উঠলেন,এই গাঁয়ের ওপর কোনোদিন কোনোকিছু চাপিয়ে দিইনি,সবসময় ভালো চেয়েছি,আজকেও আমি কিছুই বলব না,এই তো ঠাকুরদাসের ব্যাটা এখানে উপস্থিত আছে,কত ভালো লোক ছিলেন ঠাকুরদাস ,আমার স্নেহভাজন ছিল,সেও পর্যন্ত আমাকে শ্রদ্ধাভক্তি করত,তাই বলছি,স্রোতের বিরুদ্ধে লড়াই করে অকারণে গা ব্যথা করার দরকার নেই, এই ছেলেটি কি শিবেশ রাখতে পারবে? তোমরা বলো?

প্রায় সকলকেই সমস্বরে চিৎকার করে 'না' বলল।

তখন কুমারচন্দ্র বলে উঠলেন,ঠিক আছে, আমি এই ছেলেটিকে কলকাতায় নিয়ে চলে যাব,সেখানে পড়াশোনা করবে,তাহলে কোনো সমস্যা নেই। 
বৃদ্ধ মোড়লটি চতুরস্য চতুর। তিনি মৃদু হেসে বললেন,তাহলে তো কোনো অসুবিধা নেই, সামনের মাসে ভালো দিন দেখে বিয়েটা সম্পন্ন হবে,মনে রেখো তোমরা, এবার শীতলাগাজনে বড় যাত্রাদল আনবেন,কথা দিয়েছেন জমিদার মশাই,তারপর সারা গ্রামের প্রসাদ ভক্ষণ,খিচুড়ি নয়, একেবারে অন্নভোগ।  এ কি কম কথা!
বলেই দাঁড়ির মধ্যে কাশিটা গোপন করলেন এবং সেই সঙ্গে নিজের একটা বন্দকী ভালো চাষের জমি ফিরে পাবেন জমিদারের কাছ থেকে সেটাও।

কিন্তু ওর বাপের তো ইচ্ছে নেই, মোড়লমশাই,এটি একটু বিচার করুন,বললেন কুমারচন্দ্র। 

সে কি, কে বলল,শিবেশ তো রাজি,তার মেয়েটি শুনলাম অরাজি,তা তার বয়স কম, সংসারের ভালোমন্দ কী বোঝে? মাথার ওপর জমিদার বলেছেন,সেটাই শেষ কথা।

কিন্তু দেশে তো আইন আছে,এইভাবে জোর করে বিয়ে... বলা শেষ হল না,তার আগেই মোড়ল গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন,বাবা,ঠাকুরদাসের পো,ঐসব আইনফাইন সব কলকেতায় আছে বাবা,এখানে এইসব কেউ জানে না,মানে না,এখানে জমিদারই সব,তিনি মাথার আইন।মাথায় বসে সব দেখেন।

সে কি! শীতলাতলায় বসে মাথার ওপর ভগবানকে ভুলে গেলেন!

তখন সেই টাকমাথা লোকটি লাফিয়ে উঠল,গাঁদেশে জমিদারই ভগবান,বুঝলে,তারপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠল,তোদের সকলে বলছি,সহসা দু'পাতা কলকাতায় ইংরিজি পড়ে কোনো লাভ হবে না,এই জমিদারী আইন কানুন মোরা পালছি,মোদের ছেলে,তার ছেলে,তার ছেলে,তার ছেলে মানবে,এর কোনো পরিবর্তন কোনোদিন হবে না,এই বলে রাখলাম।
বলার সময় হাতটা এমনভাবে উঁচুনিচু করল,সকলেই খানিকটা হেসে নিল।
এবং কথাগুলো সোল্লাসে সমর্থন করল।

সেই সুযোগে সভা ভেঙে দিলেন বৃদ্ধ মোড়ল। সবাই আসন্ন একটা বড় ভোজ এবং একটা নাম করা যাত্রাপালা দেখার খুশিতে এই বিচারসভা থেকে বিদায় নিল।এবং কোনোরূপ অন্যায় বা অসুবিধা তাদের আর চক্ষু ও কর্ণগোচর করানো সম্ভব নয়।
মোড়ল ধীর পায়ে লাঠি হাতে বেদি থেকে নেমে এসে শিবেশের কাছে দাঁড়ালেন। মৃদুস্বরে অথচ দৃঢ়তার সঙ্গে বলে উঠলেন,এইসবের জন্য বিচার ডাকার কোনো দরকার ছিল, তুই এরকম করিস না,মেয়েটাকে বোঝা,আমাদের আমলে এক একটা লোক কুড়িতিরিশটা বিয়ে করত,বিদ্যেসাগরের আইন করার পরেও,তারপর এখন কি একঘরে কথা কি ভালো?  কেন অকারণে জীবনে ঝঞ্ঝাট আনবি!
তারপর কুমারচন্দ্রের দিকে তাকিয়ে বললেন,ঠাকুরদাস বলত,তার পুত্র একদিন পড়াশোনা করে বড় হবে,তাই সত্যি হোক,কিন্তু বাবা, বড় হওয়ার মানে তো গাঁয়ের লোকজনের বিরুদ্ধে যাওয়া নয়, সেটা মনে রাখতে হবে।

বলেই চলে গেলেন,তার পাশে সাঙ্গোপাঙ্গ দল আরও কিছু বলতে বলতে এগিয়ে গেল।
শিবেশ মাথায় হাত রেখে মাটিতে বসে পড়ল। সেই ছেলেটি সহসা তীরবিদ্ধ হরিণের মতো ছুটে কোথাও চলে গেল!
দেবেন কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলেন,তিনি শিবেশকাকার পাশে বসে গায়ে হাত রেখে বললেন,একটা কিছু ব্যবস্থা হবে।এতো চিন্তা করছ কেন? দরকার হলে আমরা পুলিশে জানাব,কী বলিস কুমার?

কুমারচন্দ্র স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে রইলেন। তাঁর মনে হল কোথায় কলকাতা আর কোথায় তাঁর নিজের গ্রাম বাসুদেবপুর, সেখানে ইংরেজি পুলিশ,প্রত্যক্ষ শাসন,কংগ্রেস, অধিবেশন,দেশাত্মবোধক গান,দক্ষিণ আফ্রিকা,গান্ধিজি,রবীন্দ্রনাথ, গীতাঞ্জলি, গোরা উপন্যাস, শিক্ষা দীক্ষা, এমন কি বঙ্গভঙ্গের প্রতিরোধে দেশের স্বাধীনতার আলোচনা এসবই কোনোকিছুই এখানে, এই বাসুদেবপুর গাঁয়েদেশে পৌঁছায়নি! আলোর এলকণাও এখানে তো আসেই না,বরং কলকাতার কেনো কথা এখানে হাস্যকর,রূপকথার গল্পের মতো অলীক এবং পুরানো সংবাদপত্রের ছাপানো অক্ষরের মতো মলিন।
কুমারচন্দ্র আরও ভাবলেন,তাঁর দিদির কথা,কী আশ্চর্য, একজন গাঁয়ের মেয়ে,তার কী বোধশক্তি, ভালো কাজ করার আগে ভালো কাজটা আসলে কী, তাই সকলকে বোঝাতে হবে।

তিনি হনহন করে সেই স্থান পরিত্যাগ করে চলে গেলেন।দেবেন অবাক হয়ে গেলেন,আরে কী হল ভাই,কী হল? কোথায় যাচ্ছিস? থানা তো সেই সুতাহাটায়,একা কী করে যাবি,ভাই দাঁড়া।

কুমারচন্দ্রের চোখ জল। তিনি যেন কোনো কথাই শুনতে পাচ্ছিলেন না!
কুমারচন্দ্র সোজা হাঁটতে হাঁটতে সেই মাঠের কাছে চলে গেলেন, যেখানে তিনি ছোটবেলায় গরু চরাতেন,সেই বাবলা গাছটি এখনও আছে,শুধু তার আশেপাশে আগাছা জমে গেছে বেশি। সেদিকে কোনো ভ্রূক্ষেপ না করে সেখানেই বসে পড়লেন। এক অদ্ভুত চিন্তা তাঁকে কুরে কুরে খাচ্ছিল,কী হবে এই পড়াশোনা করে,যা করে এইসব অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে দিচ্ছে না! না,এই তাঁর জন্মস্থান,অথচ এখানে কত অন্ধকার, কত ভেদবিচার,কত দারিদ্র্য, কত অসহায়তা! কলকাতা থেকে কী এমন দূরত্ব মেদিনীপুরের,একদিনে যাতায়াত করা যায়! অথচ অন্ধকারের দূরত্ব যেন হাজার হাজার দিনের...  
কুমারচন্দ্র কিছুতেই শিবেশকাকার মেয়ের এই চরম দুর্গতি মেনে নিতে পারছিলেন না! আমাদের দেশের মেয়েদের কি কোনোদিন মুক্তি হবে না,তার মনে হয়, কালিকিঙ্করের বাড়িতে গিয়ে তাঁকে বোঝাতে,তাঁর মুখোমুখি সত্যিটা তুলে ধরতে,কিন্তু সত্যি কোনো কি লাভ হবে?
সবই তো চোখ খুলে ঘুমোচ্ছে! 
দিগন্তের গাছগাছালির মধ্যে সূর্য কখন ডুবে গেল,কুমারচন্দ্র বুঝতেই পারলেন না! অন্ধকারের মধ্যে বসে রইলেন।
সহসা পিঠে হাতের স্পর্শ পেয়ে কুমারচন্দ্র চমকে উঠলেন।
বড়দিদি।হাতে লণ্ঠন। 
তুই এখানে বসে আছিস,আর মা তোর জন্য উতলা হয়ে আবার বারান্দায় এসে বসেছে,তোকে খুঁজছে,কী যে করিস,কলকাতায় থাকলেও যা,এখানেও তাই

ওহ্ অন্ধকার হয়ে নেমে গেছে

হ্যাঁরে,এতেই তো মায়ের আরও বেশি চিন্তা, অন্ধকারে তুই আবার কোথাও চলে গেলি! চল চল 

এই কি অন্ধকার দিদি, আজ যা অন্ধকার শীতলাতলায় দেখলাম...

ওহ্ কিছু নয় ভাই,মান্ধাতার আমল থেকে চলে আসছে,কত দেখছি,শুনছি

সত্যি, কী হবে? কোনো কি পরিবর্তন হবে না!

এইসব পরিবর্তন-টরিবর্তন বুঝি না, শুধু একটা জিনিস দ্যাখ,এই যে আঁধার নামল,এ কিন্তু পেরোতে হলে সেই সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে,রাতারাতি চটজলদি কিছুই করতে পারবি না! তাই না!

হ্যাঁ,তাই

আরও, এসব হচ্ছে ভগবানের হাতে,শ্রীকৃষ্ণের হাতে,তিনিই নিয়ম মেনে চলেন,মোরা তো তুচ্ছ মানুষ,ভেবে দেখ,আগে নিজে পরিবর্তন হতে হবে,তবে না সমাজ,আগে তুই এই অন্ধকার পাড়ি দে,অবশ্য ক'জন পারে এই অন্ধকার পাড়ি দিতে! তারপর তো সকালের সূর্যের গল্প শোনাবি! তাই না ভাই

কুমারচন্দ্র অবাক। কী কঠিন সত্যি, কত সহজ করে বলে দিল তার দিদি,লণ্ঠনের আলোয় মুখের একপাশ আলোকিত, তিনি দিদির মুখের দিকে চেয়ে শ্রদ্ধায় অবনত হয়ে গেল

কী সব তোকে বলছি,তুই কত পড়াশোনা করা লোক, আমি সামান্য মূর্খ মেয়েমানুষ, সত্যি মোর মাথা গরম হয়েছে, আক্কেল নেই একবারে!

না, দিদি,আমি বুঝেছি,বলেই সেই মাঠের মধ্যে কুমারচন্দ্র দাঁড়িয়ে পড়ল, তারপর দিদির পা ছুঁয়ে প্রমাণ করল।

দিদি হালকা সরে গিয়ে বলে উঠলেন, কী করছিস রে,তোদের কলকেতেয়ায় এইসব শেখায়,যেখানে সেখানে যাতে-তাকে গড় করাতে! বলেই হেসে উঠলেন...

পাঁচ-ছয় দিন পরে।
লক্ষ্মীদেবী সুস্থ হয়ে উঠেছেন।হাতের ব্যাণ্ডেজও খুলে ফেলা হয়েছে। নিজের হাতে সব কাজকর্ম করছেন।কুমারচন্দ্র কলকাতা যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন,সেই সময় প্রধান শিক্ষক ক্ষীরোদচন্দ্র এলেন বাড়িতে।

এই যে কুমার,তোমার সঙ্গে দেখা করব বলে এতটা পথ হেঁটে এলাম

আসুন স্যর 

স্যর! তুমি তো আমাকে মাস্টারমশাই বলতে,তাই বলে ডেকো 

ওহ্ হ্যাঁ,মাস্টারমশাই, আমি কি আপনার কথা ভুলতে পারি,নিজে শিক্ষকতার জীবনে আপনার কথাই মনে রাখি!

বেশ বেশ,তা বি এস সি কোথায় পড়ছ?

সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে

বাহ্ কোন ইয়ার

এটাই লাস্ট ইয়ার, এবছর পরীক্ষা দিয়েই গ্রাজুয়েট হয়ে যাবো

দারুণ, এই গ্রামে এর চেয়ে বড় খবর আর হতে পারে,এতোটা বয়স হল,তবুও এইসব খবর যখন শুনি,মনটা আনন্দে ভরে ওঠে

আগেরগুলোর রেজাল্ট কেমন?ফাস্ট ক্লাস হবে তো?

হ্যাঁ,সেই চেষ্টায় আছি,আচার্যের মতো গবেষণা করব,নিজেই পাশ করার পর তাঁর কাছে চলে যাবো ভাবছি

আচার্য? 

আজ্ঞে,আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র, বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক। 

আরিস বাস, তাঁর দর্শন পেয়েছো নাকি?

হ্যাঁ,তাঁর ক্লাস করেছি,বক্তব্য শুনেছি, জানেন মাস্টারমশাই,তিনি নিজের হাতে চরকা কাটেন,সেই সুতোতে পোশাক তৈরি করে পরেন,কী সাধারণ জীবনযাপন,অথচ ইংরেজ রাজসরকার পর্যন্ত সমীহ করে চলেন

আহ্, এসব শুনলে মনে হয়, কুমার, রূপকথার গল্প সত্যি হচ্ছে, ক্ষীরোদচন্দ্র চোখের ওপর হাত বোলালেন।
তারপর কুমারচন্দ্রের মাথায় হাত রেখে বললেন,তুমি গ্রাজুয়েট হয়ে ফিরে এসো,আমি ঐ শীতলাতলায় সংবর্ধনা দেব,নিজের বাগানের গাঁদাফুলের মালা পরিয়ে দিয়ে... 
শুধু পাশ করে এসো.. 

শীতলাতলা শুনে কুমারচন্দ্র কেমন উদাস হয়ে গেল।শিবেশকাকার কথা মনে পড়ল। সেই মুসলমান ছেলেটিকে তিনি কলকাতায় পড়াশোনার জন্য নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সে সেদিনের পর এমনভাবে নিখোঁজ হল,তাকে কোথাও পাওয়া গেল না! কুমারচন্দ্র নিজেই খুঁজতে খুঁজতে সুতাহাটা পর্যন্ত গিয়েছিলেন,তারপর শিবেশকাকার মেয়েটি সেই যে জ্বরে পড়ল,তারপর সারার কোনো নামগন্ধ নেই, একবারে বিছানার সঙ্গে মিশে গেছে, তাকে চেনাই যায় না! জ্বরের মধ্যে সবসময় ভুলভাল বকছে,একবার তো জ্বর গায়ে মুসলিম ছেলেটির নাম ধরে চিৎকার করতে করতে উঠোনের কাছে পড়ে মাথা ফাটিয়ে ফেলে।কুমারচন্দ্র বার বার ছুটে গেছেন,তার শয্যার পাশে বসে থেকেছেন। ডাক্তার ডেকে এনেছেন,যা টাকাপয়সা লাগবে,সবই দিয়েছেন,কিন্তু মেয়েটির কোনো উন্নতি নেই। 


কুমারচন্দ্র এবার কলকাতায় ফিরবেন। সবকিছু বাঁধাছাঁদা করে বেরিয়ে পড়লেন।তাঁর খুব ইচ্ছে ছিল,এবার হয়তো আবদুল ফকিরের সঙ্গে দেখা হবে,কিন্তু তার কোনো সাক্ষাৎ হল না!
কিন্তু কুমারচন্দ্রের শুধু ইচ্ছে পূরণ হল না,তা নয়, আরও একজনেরও মনের সুগভীর ইচ্ছে অপূরিত থাকল!

যেদিন কুমারচন্দ্র বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে কলকাতামুখী নৌকা ধরলেন,তার ঠিক ঘন্টা তিনেক পর একটা গরুর গাড়ি কুমারচন্দ্রের গৃহের সামনে থামল।তা থেকে নামলেন চারুশীলাদেবী,

 তাঁর বয়স তখন অষ্টাদশ। 

ক্রমশ...

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments