জ্বলদর্চি

যেতে যেতে পথে-১৯/রোশেনারা খান

যেতে যেতে পথে
রোশেনারা খান
পর্ব ১৯

কল্যাণীতে ট্রেনিং নেওয়ার সময় ওনার সঙ্গে অনেকের পরিচয় হয়। এঁদের মধ্যে নজরুল ইসলাম ছিলেন অন্যতম। নজরুল ইসলাম আই পি এস হওয়ার পূর্বে ডব্লিউ বি সি এস অফিসার ছিলেন। তাই তাঁরও তখন কল্যাণীতে ট্রেনিং চলছিল। ট্রেনিং চলা কালে ট্রেনিং এর অংশ হিসেবে ১ মাসের জন্য পাঞ্জাব যেতে হল। পাঞ্জাব থেকে উনি অনেক বকুল-বাবলির জন্য শীতের পোশাক, দুখানা কম্বল, এক কেজি উল,আরো অনেককিছু নিয়ে এসেছিলেআ। কিন্তু সব ধরনের সেলাই জানলেও আমার উল  বোনা শেখা হয়নি। গ্রামে শেখানোর কেউ ছিলনা। ছোট ঠাকুমার মেজমেয়ে বাবার চাকুরি সুত্রে বিভিন্ন জায়গায় থেকে ছিলেন, সেই জন্য উলবোনা শেখার সুযোগ পেয়েছিলেন। আমাকে  শিখিয়ে দেবেন বলেছিলেন। একদিন দেখিয়ে দিয়ে পরদিন না করে দিলেল। যাইহোক কিছুটা উল আমার এক দেওর মেদিনীপুরে  সোয়েটার বুনতে দিল। বাকি উল রেখে দিলাম।

      কল্যাণীতে থাকা কালে ১৯৭৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পশ্চিমবঙ্গে ভয়ংকর বন্যা হয়। ১৫০০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। শুধু কলকাতায় ৯৪৪.৭মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছিল। কলকাতার পথে গাড়ির বদলে নৌকো নামাতে  হয়েছিল। সড়কপথ, রেলপথ, সবই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছল। আশ্রয়হীন  মানুষের জল ও খাদ্যের জন্য সে কী হাহাকার! প্রচুর গবাদি পশুরও মৃত্যু হয়েছিল। কল্যাণীতে ওনাদের রুমে জল ঢুকে গেলে, দরকারি জিনিসপত্র স্যুটকেশে  ভরে রুমের ব্যাঙ্কে তুলে দিয়ে উনি বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েছিলেন।সঙ্গে ছেলের জন্য এক কৌট আমূল দুধ।জানিনা কীভাবে জোগাড় করেছিলেন। সকালে রওনা দিয়ে জলপথে সন্ধ্যায় বাড়ি এসে পৌঁছেছিলেন। প্রায় ১৫দিন সূর্যের মুখ দেখা যায়নি । বাচ্চার কাঁথা-কাপড় শুকচ্ছে না। রান্নার পর উনুনের ওপর ঝুড়ি উল্টে রেখে তার ওপর কাঁথা বিছিয়ে উল্টে পাল্টে শুকনো করতাম। সেই কাঠও যখন ফুরিয়ে এলো, শাশুড়িমা তখন খড়েরচাল থেকে বাঁশ-বাতা ভেঙ্গে উনুনে দিতে লাগলেন।

     উনি সরকারি আবাসন পেয়েছিলেন, কিন্তু কল্যাণী চলে আসার কারণে তখন নিতে পারেননি। তাই ট্রেনিং শেষ হওয়ার পর, বালুরঘাট ফিরে গিয়ে বাড়ি খোঁজা শুরু করেন। মুসলিমকে কেউই বাড়িভাড়া দিতে চান নি। অনেক কষ্টে  খাদিমপুরে একটি অ্যাসবেস্টসের ছাউনি দেওয়া দু’কামরার বাড়ি ভাড়া নিয়ে আমাদের নিতে এলেন। আমি ছেলেমেয়ে নিয়ে কয়েকদিন আগেই বাবা মায়ের সঙ্গে দেখা করে এসেছি। আসার সময় মা আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, আমাকে লেখাটা শিখিয়ে দিলি না? আমি তোকে চিঠি লিখব কি করে? মা মাসিরা কেউ স্কুলে পড়ার সুযোগ পাননি, বাড়িতে দাদাদের পড়া শুনে বাংলা পড়তেই শিখেছিলেন, লেখা শেখা হয়নি।

      জুলাইয়ের ১৫ তারিখে বহুকাঙ্খিত এক নতুন জীবনের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিলাম। রওনা হওয়ার সময় শাশুড়িমাকে জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদলাম। স্বপ্ন যাই থাকনা কেন, গত কয়েকবছরে একটা বন্ধন তো নিজের অজান্তেই তৈরি হয়ে গেছে। এবাড়ির সবাই তো আমার আপনজন। আমার অপছন্দ এখানকার পরিবেশ,  ভাষা,জীবনযাত্রা ধর্মান্ধতা ইত্যাদি। একটা কথা মনে পড়ে গেল। শাশুড়িমা খুবই  সাধাসিধে নির্লোভ মানুষ ছিলেন। তিনি রীতিমত যৌতুক দিয়ে চার মেয়ের বিয়ে দিলেও ছেলেদের বিয়েতে তাঁর কোনো দাবি ছিলনা। মেজননদ আমারই বয়সী। গায়ের রং কালো বলে কেউ পছন্দ করছিল না। একদিন মেজননদকে পাত্রপক্ষ দেখতে এলে, এক আত্মীয়া শাশুড়িমাকে বলেন, আসমা(শাশুড়ি মায়ের নাম), তোর বড়বৌকে দেখিয়ে দেনা। শাশুড়িমা সঙ্গে সঙ্গে বলেন, আমার মেয়ের বিয়ে না হয় না হবে। আমি এমন পাপকাজ করতে পারব না।

    খড়গপুর থেকে ট্রেনে হাওড়া চলেছি। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে  থাকতে থাকতে  মায়ের অসহায় মুখখানি ভেসে উঠছে। ভেসে উঠছে আমার ফেলে আসা সংসার জীবনের কথা, আমার স্কুল জীবনের, শৈশবের কথা। বকুল কোলে ঘুমচ্ছিল, হঠাৎ কেঁদে উঠতে সম্বিৎ ফেরে। ওকে শান্ত করার চেষ্টা করি। হাওড়া  পৌঁছাতে আর বেশি দেরি নেই। হাওড়া থেকে কালকা মেল ধরতে হবে। মালদায় নেমে ওখান থেকে বাসে বালুরঘট। ট্রেনে রিজার্ভেশন করা আছে। সঙ্গে রতন নামে একটি মেয়েকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বকুলের জন্য। ট্রেনের সময় রাতে। হাওড়া পর্যন্ত সঙ্গে এসেছে পিসতুতো ভাশুরের ছেলে বাহারাম। স্টেশনে মালপত্র আর দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে বসে আছি। একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ দেখি বকুল মা ভেবে এক ভদ্রমহিলার পেছন পেছন যাচ্ছে। দৌড়ে গিয়ে বাহারাম ধরে নিয়ে আসে। আর একটু সময় অন্যমনস্ক থাকলে কি যে হত! 

    প্রচণ্ড গরমে দুটি শিশুকে নিয়ে নাজেহাল অবস্থায় বালুরঘাট পৌঁছালাম।সব থেকে বেশি কষ্ট হল বাসে মালদা থেকে বালুরঘাট আসা। বাড়ির মালিক পয়সার জন্য ভাড়া দিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু মুসলিমদের সম্বন্ধে ধারণা যে খুব খারাপ তা প্রথম দিকের ব্যবহার দেখেই মনে হল। সেসব অভিজ্ঞতা আর লিখছি না। 
 বাড়িঅয়ালা তাঁর স্ত্রী, এক ছেলে, এক বিধবা মেয়ে ও নাতনিকে নিয়ে থাকেন।  আর একজন ভাড়াটিয়া স্ত্রী ছেলেকে নিয়ে আমাদের উল্টো দিকে থাকতেন।মাঝখানে উঠোন। বাড়িওয়ালার বাড়িতে যে হিন্দু বৌটি কাজ করত, আমারও কাজ করে দিত। কিছুদিনের মধ্যেই আমাদের সম্বন্ধে ওঁদের ধারণা পালটালেও আমরা বাড়ি পালটাতে বাধ্য হলাম। তার কারণ আমাদের আলাদা সাবমিটার ছিলনা। তাই বাড়িওয়ালা অফিস থেকে ফিরে যদি দেখতেন আমাদের ঘরে ফ্যান চলছে সঙ্গে সঙ্গে মেনসুইচ অফ করে দিতেন। বকুল খুব মোটাসোটা ছিল, ফ্যান বন্ধ হয়ে গেলেই কাঁদতে শুরু করত। তাই খান সাহেব পদমর্যাদার প্রভাব খাটিয়ে ‘কোয়াপারেটিভ ইঞ্জিনিয়ারিং সোসাইটি’র ছেলেদের সাহায্যে সাহেব কাছারির বাজারের কাছে একটি ভাল পাড়ায় বাড়ি পাওয়া গেল। খাদিমপুরে অতসী নামে একটি অল্পবয়সি মেয়ে আমাদের বাড়ি খুব আসত। বাবলিকে নিয়ে যেত। নতুন পাড়ায় অবশ্য এক এক করে চারপাশের সবার সঙ্গে পরিচয় হয়ে গেল, একটা সুন্দর সম্পর্কও তৈরি হল।

    আগেই বলেছি আমি অন্যান্য সেলাই এ পারদর্শী হলেও উল বুনতে জানতাম না। আগের বাসায় থাকা কালে পাশের বাড়ির একজনকে লাল হলুদ উল দিয়েছিলাম বাবলির জন্য ফ্রক বুনতে। উনি মজুরি নিয়ে বুনতেন। আমাদের এই বাড়ির অর্ধেক অংশে তুষারদা ও ছায়াবউদি দুই মেয়েকে নিয়ে থাকতেন, দুজনেই স্বাস্থ্য বিভাগে চাকরি করতেন। বাবলির উলের ফ্ররকটি দেখে বললেন,তুমি এত টাকা মজুরি দিয়ে কেন বোনাচ্ছ? তুমি নিজে বুনলেই পারো। ও তো রং মেলাতেও পারেনি। তখন আমি পরম উৎসাহে ছেলে বকুলের জন্য উল বোনা শুরু করি। ছায়াবৌদি বাড়িতে থাকলে দেখিয়ে দেন,না হলে আমাদের উল্টো দিকের বাড়ির মায়াদি দেখিয়ে দেন।

    আমাদের বাড়িওয়ালার নাম ভালবাসা বোস। বাড়ি ভাড়া দিয়েই সংসার চলে। একমাত্র সন্তান(ছেলে)মালদাতে পড়াশোনা করে। ওনার বাড়িগুলি বাংলো  ডিজাইনের। বড় একখানা মাঠের তিনদিকের তিনখানা বাড়ির  একটাতে আমরা আর ছায়াবউদিরা থাকতাম, মাঝখানের বাড়িটিতে বাড়িওয়ালা থাকতেন। আমাদের অপর প্রান্তে মায়াদিরা স্বামী-স্ত্রী, শ্বশুর-শাশুড়ি, এক ছেলেকে নিয়ে থাকতেন। বড়ছেলে ইঞ্জিনিয়ার, বোম্বেতে থাকেন। একমাত্র মেয়ে শিবানী স্টেটব্যঙ্কে চাকরি করেন। খুব ভাল নাটক করেন। সম্প্রতি এই শহরের এক গ্রামসেবককে ভালবেসে বিয়ে করেছেন। মায়াদিদের জামাই পছন্দ হয়নি। তাঁর মেয়ের যোগ্য জামাই হয়নি। কিন্তু কিছু বলার উপায় ছিল না।মায়াদির স্বামী দিলিপদা কোনো বড় কোম্পানিতে চাকরি করতেন বলে শুনেছি। কী এক কারণে সে চাকরি চলে যায়, মেয়ের  দেওয়া টাকায় বেশ কষ্টেই সংসার চলে। বড়ছেলে কোন দায়িত্ব পালন করেনা।

    পেছনের দিকে ভালবাসা বোসের আরও কয়েটা মাটিরবাড়ি ভাড়া দেওয়া ছিল। এই ভাড়াটিয়াদের নিয়েই একটা পাড়া। পেছনে অনেকখানি জায়গাজুড়ে আম-কাঠালের গাছ ছিল। আমের মত কাঁঠালও গাছ থেকে পেকে পড়ত। ভালই ছিলাম। এখানে এসে অনেক কিছুই শিখলাম। কুল,জলপাইয়ের আচার বানানো, বাঙ্গাল রান্না আর সোয়েটার বোনা। ছায়াবউদিদের আমাদের উঠোন দিয়ে কু্যোতলা যেতে হত। একদিন আমাকে সব্জির খোসার সঙ্গে কপিরডাটা ফেলে দিতে দেখে বললেন, বেবি এগুলো তোমরা খাওনা? মাথা নেড়ে না বলাতে, বললেন, ফেলোনো, আমাকে  দিয়ে দিও। সত্যিই সামান্য এটা সেটা দিয়ে কী দারুণ রান্না করেন বাঙ্গালরা! একমাত্র মায়াদি ঘটি বাড়ির মেয়ে ছিলেন। বাপেরবাড়ি কৃষ্ণনগরে। একদিন কথা প্রসঙ্গে বললেন, জানো, আমার বাবা এখনে কচুরলতি রান্না করতে দেখে বলেছিলেন, এগুলো মানুষে খায়? আমাদের ওখানে এগুলো শুয়োরে খায়। এখানে হাটের মত সপ্তাহে একদিন মণিমেলা নামে একটা মেলা হয়, শুধু মহিলারা বেচাকেনা করেন। মহিলাদের ঘর-গেরস্থালির বিভিন্ন জিনিস, মাটির পুতুল, কুল(ওরা বলত বৈর) ইত্যাদি বিক্রি হত। মাঝে মাঝে ‘সন্ধ্যা’ সিনেমা হলে সিনেমা দেখতে যেতাম। অফিসের আর্দালি স্বপনের কাছে বকুলকে রেখে আমরা দুজনে সিনেমা যেতাম, তবে তা কদাচিৎ। বেশিরভাগ সময় পাড়ার বউদিদের সঙ্গেই যেতাম। একবার অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘হাটে বাজারে’ যাত্রা দেখতে গিয়ে এক কাণ্ড হয়েছিল। যত বার উনি মঞ্চে উঠে ডায়লগ বলার চেষ্টা করেন,কিছুই শোনা যায় না। কারণ মাইক ফেল। শেষপর্যন্ত যাত্রা না দেখেই বাড়ি ফিরতে হয়। 

     এখনে খুব ঘটা করে সন্তোষী পুজো হত। শুক্রবারে কেউ টক খেতনা। দুর্গাপুজোর দশমীর দিন আত্রেয়ী নদীর পাড়ে মেলা বসত। এখনো নিশ্চয় বসে। এই নদীতে খুব রাইখোর মাছ পাওয়া যেত। একই মাছ, কিন্তু নাম সব আলাদা। মৌরলাকে মোয়ামাছ, ল্যাঠামাছকে সাটিমাছ, আরও নাম আছে, কিন্তু মনে পড়ছে না। একগণ্ডাকে (চার)হালি বা হালা বলে। উনুনকে আঁখা, ঘুঁটেকে  ঘসি, সরুকে চিকন,ইত্যাদি। ছেলেমেয়েও এখানে  যাবা, খাবা বলতে শুরু করে। বকুল তো  এপাড়ায় আসার পর কথা বলতে শেখে।
                                 ( ক্রমশ)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments