জ্বলদর্চি

দয়ারাম দাস (মধ্যযুগের কবি)/ ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব - ২
দয়ারাম দাস ( মধ্যযুগের কবি ), কিশোরচক, ভোগপুর

ভাস্করব্রত পতি


"অবধানে গুণ পর নিবেদি তাহার পর / বিনন্দ রাখালের ভাগ্যবান / গোঠে মাঠে মড়াচীড়ে কেবল লক্ষ্মীর বরে / পর্বতে পাহাড়ে পাকে ধান।। / আড়াই দিবসের ধান মউরপতা আগিরমান / আছাড়মনি কজর নিমাই / গন্ধতুলসী গয়াবলি মুক্তাগিরি আধারকুলি / মাথা নয়াইয়া দিল তাই।। / কর্ণকচুর গবরমতী বু  আন লীলাবতী / বুয়ানদাড়ের কি কব ব্যাখান। / মটাহারা বাশমোনি মাগুরবিচ কলমিড়কি / কর্পূরশালি কোলীমিলতা ধান।। / আধারমানিক বেতনাড়ি লক্ষ্মীকাজল হীরাকার / সাজনে নুপূর। / সমুদ্রফেনা হাতপাঞ্জর কপুরশালিকা পুঞ্জর / কাশসালি কল্যাণকেশুর।। / রাখালিয়া ভাগ্যবান পৰ্ব্বতে পাকিল ধান / গোছে মাঠে ময়াইর প্রায়। / পাকে ধান্য নানা জাতি কতো হীরা লীলামতি / মুকুতা গাথেনি প্রায়।”
            (সূত্র: লক্ষ্মীচরিত্র, সম্পাদনা - শ্যামল বেরা)

  'লক্ষ্মীর কৃপালাভ' আসলে পরিশ্রমের ফলে প্রাপ্ত ফসলকেই বলা যায়। আর সেই ‘কৃপা’তেই বিনন্দ ফলিয়েছে কত রকমের ধান। মধ্যযুগের কবি দয়ারাম দাসের ‘বিনন্দ রাখালের পালা’ তথা ‘লক্ষ্মীচরিত্র' কাব্যের একটি অংশ এটি। সমাজ জীবনের দুঃখ, কষ্ট, বেদনার নানা অনুষঙ্গ উঠে এসেছে এখানে। গ্রামীণ জীবনের দৈনন্দিন ক্রিয়াকর্ম ধান বপন, ধান কাটা, ঝাড়াই, মড়াইতে তোলা ইত্যাদি প্রতিভাত রয়েছে। এখানে রাজা এবং বিনন্দ দু’টি প্রতীকী চরিত্র মাত্র। পরিশ্রম করলে অনাবাদি জমিও আবাদি হয়ে ওঠে তা বোঝাতে বিনন্দ চরিত্রের অবতারণা। 

  আলোচিত কবি দয়ারাম দাস অবশ্য তেমন সুপরিচিত কবি নন। প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস নিয়ে যাঁরা একটু আলোচনা করে থাকেন তাঁদের কাছে মোটেই অপরিচিত নাম নয়। কিন্তু আপামর মানুষজনের কাছে তেমন সমাদৃত নন এই কবি। অনেকটা বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গিয়েছে মেদিনীপুরের বুকে জন্মগ্রহণ করা এই মধ্যযুগীয় কবির নাম।

   বর্তমান পূর্ব মেদিনীপুর জেলার কোলাঘাট থানার ভোগপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের কিশোরচকই কবি দয়ারাম দাসের বাড়ি। এই কিশোরচক গ্রাম পুঁথিপত্রের গ্রাম। বিশিষ্ট লোকসংস্কৃতিবিদ, গবেষক এবং শিক্ষক ড. শ্যামল বেরা এই কিশোরচক গ্রামে এসে মানুষজনকে কবি সম্পর্কে প্রথম আগ্রহী করে তুলেছিলেন। কবির জন্মস্থান খুঁজে পেয়েছিলেন --

“কাশীজোড়া মকান 
রাজা তার সুন্দরনারাণ
সভা হৈত্যে ধর্ম্ম নরপতি 
হৈ অ্যা তার প্রতিষ্ঠিত দয়ারাম রচে গীত 
কিশোরচকে যাহার বসতি।"

  সেটা ১৯৯৫ সালের কথা। কিশোরচক গ্রামে গিয়ে খুঁজে পেয়েছিলেন কবির জন্মভিটা। এখন সেখানে গঠিত হয়েছে— ‘কবি দয়ারাম চর্চা ও স্মৃতিরক্ষা কমিটি’। সেই বর্ণনা দিতে গিয়ে ড. শ্যামল বেরা লিখেছেন— “বছর পনেরো আগে এক সমীক্ষার কাজে কিশোরচকে গিয়েছিলাম। সঙ্গ দিয়েছিলেন কিশোরচকের শ্রদ্ধেয় বিজয়কৃষ্ণ সামন্ত মহাশয়। দয়ারাম সম্পর্কে প্রচলিত কয়েক ছত্ৰ শুনিয়েছিলেন। কাশীজোড়ার রাজা কবিকে যখন ভূমিদান করেছিলেন, তখন তিনি বলেছিলেন— 'আষাঢ় মাসে ভূমিদান/পৌষ মাসে পাব/দয়ারাম যে গান করে/ এখন নগদ কিছু পাব’–এই রকম নানা কথায় উপস্থিত হয়েছিলাম কবির ভিটায়। কবির স্মৃতি বলতে কিছু নেই। সেখানে বাস করে বেরা পরিবার। মৃত্যুঞ্জয় বেরা, দিনমজুর। তিনি লোক পরম্পরায় শুনেছিলেন দয়ারামের কথা। তাই অতিকষ্টে নিজেই তাঁর একটা স্মৃতিমন্দির করেছিলেন। সম্প্রতি মৃত্যুঞ্জয় বেরা প্রয়াত হয়েছেন। তাঁর পরিবারের লোকজন নিত্য সে মন্দিরে শ্রদ্ধা জানান।”

  একসময় আমাদের মেদিনীপুর জেলা ছিল ওড়িশার অধীনে। ফলে এই জেলায় ওড়িয়া সংস্কৃতির প্রভাব প্রকট। ১৭৫১-তে মেদিনীপুর পশ্চিমবাংলার অন্তর্ভুক্ত হয়। তারও অনেক আগে যখন বাংলায় সুলতানী শাসন, তখন বাংলার মসনদে ছিলেন সুবেদার দায়ুদ আলি খাঁন। তাঁরই সেনাপতি কালাপাহাড়। তিনি ছিলেন প্রচণ্ড হিন্দুবিদ্বেষী। তাঁর লক্ষ্য ছিল পুরীর জগন্নাথ মন্দির ধ্বংস করা। কিন্তু সেই বাসনায় ছেদ টানতে পুরীর রাজা পাঠান গঙ্গানারায়ণ সিংহকে। তিনি সফল হন। তারই পুরস্কার স্বরূপ পুরীর রাজা ওই গঙ্গানারায়ণকে ‘রায়’ উপাধি সহ সীমান্তবর্তী কাশীজোড়া পরগণার জায়গিরদার করে দেন। সেটা ছিল ১৫৭৩ সাল। শুরু হল কাশীজোড়া রাজবংশের পত্তন। শ্বাপদসঙ্কুল, জঙ্গলাকীর্ণ কাশীজোড়ার প্রথম রাজা হিসেবে কাঁসাই নদীর পাড়ে চাঁপাডালিতে কাছারি বাড়ি বানালেন তিনি। সেই রাজবংশের বংশলতিকা টা এরকম --- গঙ্গানারায়ণ সিংহ (১৫৭৩–১৫৮৬) > যামিনীভানুনারায়ণ রায় (১৫৮৬–১৬২৪) > প্রতাপনারায়ণ রায় (১৬২৪–১৬৬০) > হরিনারায়ণ রায় (১৬৬০–১৬৬৯) > লক্ষ্মীনারায়ণ রায় (১৬৬৯–১৬৯২) > দর্পনারায়ণ রায় (১৬৯২–১৭২০) > জিতনারায়ণ রায় (১৭২০–১৭৪৪) > নরনারায়ণ রায় (১৭৪৪–১৭৫৬) > রাজনারায়ণ রায় (১৭৫৬–১৭৭০) > সুন্দরনারায়ণ রায় (১৭৭০–১৮০৬) > বাসন্তী নারায়ণ রায় (১৮০৬–১৮৩৩) > লক্ষ্মীনারায়ণ রায় (১৮৩৩–১৮৫৩)

   সুদূর ওড়িশা থেকে যে রাজ পরিবারের পূর্বসুরি এই প্রত্যন্ত এলাকায় জায়গির স্থাপন করেছিলেন তাঁরা কেবল নিজেদের ধনসম্পদের পরিমাণ বৃদ্ধি করেননি। এখানকার সাহিত্য সংস্কৃতিকে পৃষ্ঠপোষকতায় ভরিয়েছিলেন তাঁরা। দয়ারাম দাসদের মতো কবিরা সেই রাজানুগ্রহেরই ফসল।

   সে সময় এই রাজবংশের পৃষ্ঠপোষকতায় কবি দয়ারাম দাস ছাড়াও নিত্যানন্দ চক্রবর্তী, বলরাম চক্রবর্তী, মুরলীধর দাস প্রমুখ কবিগণের সাহিত্যকীর্তি প্রকাশিত হয়েছিল। কবি নিত্যানন্দের ভদ্রাসন কোলাঘাটের কানাইচক গ্রামে। তিনি লিখেছিলেন 'কালিকামঙ্গল’ এবং মুরলিধর দাস লিখেছিলেন 'সুবচনীর পাঁচালি'। আর কবি দয়ারাম দাস লিখেছিলেন— ‘সারদামঙ্গল', জগন্নাথ বন্দনা’, ‘লক্ষ্মীচরিত্র’, ‘পঞ্চানন্দের গীত’, ‘দক্ষিণ রায়ের গীত’, ‘রায়মঙ্গল” ‘শীতলামঙ্গল’ ইত্যাদি পুঁথিগুলি। এইসব প্রাচীন পুঁথি অবশ্য বিভিন্ন সংগ্রাহকের জিম্মায় কিছু কিছু থাকলেও বেশিরভাগই নষ্ট হয়ে গেছে অব্যবহারের ফলে। অযত্ন আর অজ্ঞানতার দরুণ বহু ব্যক্তি পুঁথিগুলির গুরুত্ব বুঝতে পারেননি। গবেষক ড. শ্যামল বেরার সংগ্রহে কবি দয়ারাম দাসের বেশ কয়েকটি দুর্মূল্য পুঁথি রয়েছে। কবি দয়ারাম দাস যে কাশীজোড়া রাজবংশের রাজাদের অনুপ্রেরণায় তাঁর কাব্যসাধনা করেছেন তার উল্লেখ একাধিকবার পাওয়া গিয়েছে। মূলত নরনারায়ণ রায়, রাজনারায়ণ রায়, সুন্দরনারায়ণ রায় এবং লক্ষ্মীনারায়ণ রায়ের নাম মিলেছে কবির কাব্যে।

  একস্থানে তিনি লিখেছেন— “সর্বোত্তম ইন্দ্রজিত / বৃন্দাবন বিরাজিত /জগন্নাথ যাহার তনয়। / তাহার পুণ্যের ফলে / অবতীর্ণ মহীতলে / দয়ারাম রচে রসময়।' এখানে অবশ্য দয়ারাম দাসের রচনায় তাঁর বাবার নাম হিসেবে জগন্নাথের খোঁজ মেলে। আশুতোষ ভট্টাচার্য দয়ারামের বাবার নাম হিসাবে 'জগন্নাথ' উল্লেখ করলেও ড. শ্যামল বেরা উল্লেখ করেছেন প্রসাদ দাসের নাম। 'সারদামঙ্গল' লিখতে গিয়ে কবিই বলেছেন — ‘দয়ারাম দাস গান / সারদা মাতার নাম / বিরচিল প্রসাদ নন্দন'।

   কিন্তু কবি দয়ারাম দাস কাশীজোড়া রাজবংশের কোন রাজার আমলে ছিলেন এ নিয়ে বিতর্ক এবং মতান্তর রয়েছে। তবে এটুকু বলা যেতে পারে, কবির রচনায় চারজন রাজার নাম খুঁজে পেলেও প্রত্যেকের তিনি সভাকবি ছিলেন, এ তথ্য মেনে নেওয়া যায় না। কেন-না নরনারায়ণ রায় (১৭৪৪-১৭৫৬) থেকে লক্ষ্মীনারায়ণ রায় (১৮৩৩-১৮৫৩) পর্যন্ত প্রায় ১০৯ বছরের রাজত্বকালের সন্ধান মেলে। একজনের পক্ষে সেই সময়কালে সভাকবি থাকা অসম্ভব। গবেষক ড. শ্যামল বেরা একটি পুঁথির বিবরণ উল্লেখ করে মত প্রকাশ করেছেন যে ‘পুঁথিটির লিপিকাল ১০৮৮ সাল। এটিকে মল্লাব্দ হিসেবে ধরলে হয় ১৭৮২ খ্রিস্টাব্দ। আমাদের ধারণা, কবি রাজা সুন্দরনারায়ণের সমসাময়িক কালের।

   কিন্তু ‘ইতিহাস ও সংস্কৃতি’ পত্রিকায় ড. প্রণব রায় লিখেছেন— ‘কবির কাল ঠিক জানতে পারা না গেলেও তিনি কাশীজোড়ার রাজা সম্ভবত রাজনারায়ণের সভাসদ ছিলেন তা অনুমান করা যায়। অনুমান ঠিক হলে তিনি কবি নিত্যানন্দের সমসাময়িক হবেন। অবশ্য দয়ারামের কাব্যের ভাষা রচনাভঙ্গি লক্ষ্য করলে তাঁকে আঠারো শতকের কবি বলেই মনে হয়।’ সেখানে ত্রিপুরা বসু ‘দক্ষিণ রাঢ় উড়িষ্যা সীমান্তের প্রাচীন কবি ও কাব্য’ পুস্তিকাতে মন্তব্য করেছেন ‘দেবী সরস্বতীর মহিমামূলক দয়ারামের সারদাচরিত্রের রচনাকাল না জানা গেলেও কবির এ কাব্যখানি শীতলামঙ্গল রচয়িতা নিত্যানন্দের পরবর্তীকালের রচনা।' আবার ‘বঙ্গসাহিত্যে মেদিনীপুর’-এ যোগেশচন্দ্র বসু রাজা নরনারায়ণ রায় (১৭৪৪-১৭৫৬) কে কবি দয়ারাম দাসের আশ্রয়দাতা হিসেবে মত প্রকাশ করেছেন। বিশিষ্ট লোকসংস্কৃতিবিদ আশুতোষ ভট্টাচার্যের 'বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস' - এ পাই— 'সারদামঙ্গল বা সারদা চরিত্রের কবি দয়ারামের সময় সম্পর্কে কিছুই জানিতে পারা যায়না। কাব্য মধ্যে তিনি নিজের যে পরিচয় দিয়েছেন, তাহা অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত এবং অসম্পূর্ণ। তিনি লিখিয়াছেন, তাঁহার প্রপিতামহের নাম রামেন্দ্রজিৎ, পিতামহ পরীক্ষিত এবং পিতার নাম জগন্নাথ। ... স্থানীয় জমিদারের অনুগ্রহে তিনি সেই (কিশোরচক) গ্রামে বসতি স্থাপন করেন ... তাঁহার ভাষা ও রচনাভঙ্গি দেখিয়া মনে হয় তিনি খ্রিষ্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগেই বর্তমান ছিলেন।” গবেষক ড. শ্যামল বেরা মন্তব্য করেছেন— ‘যোগেশচন্দ্র বসু ও অধ্যাপক ড. প্রণব রায় যদি দয়ারামের পুঁথিতে যথাক্রমে নরনারায়ণের নাম দেখে থাকেন, তবে দয়ারামের কাব্য সাধনার ইতিহাসকে একটি দীর্ঘ কালপরিধিতে গ্রহণ করতে হয়। এই ব্যপ্তি নিতান্ত অসম্ভব না হলেও প্রমাণ সাপেক্ষ। কবি দয়ারাম দাস তাঁর ‘লক্ষ্মীচরিত্র’ পুঁথিতে লিখেছেন— ‘কাশীজোড়া মহাস্থান নরনারায়ণ / ধন্য হে ধার্মিক নরপতি / হইয়া তাহার পৃতষ্ঠী / কিসরচৌকে তাহার বসতি।' আবার অন্য একটি পুঁথির ভনিতাতে পাই -- ‘কাশীজোড়া মহাস্থান / মহারাজ সুন্দরনারায়ণ / ধন্য হে ধার্মিক নরপতি / হইয়া তাহার পৃত / দআরাম রচে গীত / কিশোরচকে জাহার বসতি।' কবির রচনায় পাই— ‘কাশীজোড়া মহাস্থান / মহারাজা পুণ্যবান / ধন্য যে ধাৰ্ম্মিক যশোধাম। / হই তার প্রতিষ্ঠিত / দয়ারাম রচে গীত / সারদা চরিত্র উপাখ্যান।'

   প্রথমে উল্লিখিত ‘লক্ষ্মীচরিত্র' বা 'বিনন্দ রাখালের পালা'টিতে ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের (১১৭৬ বঙ্গাব্দ) পটভূমিতে সাধারণ মানুষের অবস্থান ও কৃষিকাজের বিবরণ লিখিত হয়েছে। সেখানে ‘শীতলামঙ্গল’ শীতলা দেবীর পূজা প্রচার ও তাঁর মহিমাগাথা প্রচারিত হয়েছে। আগেই উল্লেখ করেছি ব্যাঘ্র দেবতার প্রসঙ্গযুক্ত ‘রায়মঙ্গল’-এর কথা। পঞ্চানন্দ তথা পাঁচু ঠাকুরের প্রসঙ্গ এসেছে ‘পঞ্চানন্দের গীত’-এ। ড. শ্যামল বেরা লিখেছেন— “দয়ারামের কাব্যের বিশিষ্টতা হল— তিনি তাঁর কাব্য প্রণয়কালে নিজের সময় ও সমাজকে এড়িয়ে যাননি। ফলে কাব্যগুলিতে তৎকালীন সমাজ জীবনের ছবি পাওয়া যায়।”

   কবির লেখা ‘সারদামঙ্গল' কাব্যটি রূপকথামূলক। এখানে বিবৃত হয়েছে সুবাহু রাজার পুত্র লক্ষধরের কাহিনি। এটি ‘সারদা চরিত্র' বা ‘ধুলাকুটার পালা’ নামেও পরিচিত। ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ'-এ দয়ারাম দাসের লেখা ‘সারদামঙ্গল’-এর একটি পুঁথি সংগৃহীত আছে। ড. তমোনাশচন্দ্র দাশগুপ্ত ‘প্রাচীন বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস’-এ লিখেছেন— “বাঙ্গালা দেশে অন্যান্য দেবদেবীর ন্যায় সরস্বতী দেবীরও ভক্তের অভাব ছিল না। সুতরাং এই দেবীর নামে রচিত মঙ্গলকাব্যও পাওয়া যায়। সরস্বতী দেবীর নামে স্তুতিবাচক মঙ্গলকাব্যের নাম সারদামঙ্গল।”

   কবির ‘সারদামঙ্গল’ সম্পর্কে তমোনাশচন্দ্র দাশগুপ্ত মন্তব্য করেছেন— “First of all, the poem emphasises the need of education and on this point the value given to education verges on a prolific and exaggerated importance. It is said that the king preferred that his son should be killed before his eyes that remain illiterate as a permament eye sore to him.” কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ‘সারদামঙ্গল’ পুঁথিটি সংরক্ষিত রয়েছে। ড. শ্যামল বেরা তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘দ্বিজ হরিদেব আর্কাইভ’-এ কবি দয়ারাম দাসের অসংখ্য পুঁথি সংগ্রহ করেছেন গ্রামে ঘুরে ঘুরে। 

    আবার, 'রায়মঙ্গল' কাব্যে কবি লিখেছেন -- ‘রাজাকে বিদায় করি / ডাকে আপনার নারি / নায়গ বলে কহি গো তোমায় / আমার আদেশ সন / যতেক অঙ্গনা আন / কর আগের হিত মঙ্গল।' এটি ব্যাঘ্র দেবতাকে নিয়ে লেখা। কবির লেখা ‘শীতলামঙ্গল’-এ শীতলাদেবীর মহিমা প্রচার ও পূজা কাহিনির কথা রয়েছে। ‘পঞ্চানন্দের গীত’-এ ব্যক্ত হয়েছে পঞ্চানন্দের মহিমার কথা। পৌরাণিক কাহিনির আদলে এই রচনাগুলি আসলে সেই সময়কার মানুষজনের সমাজ জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দলিল। স্বাভাবিকভাবেই দয়ারাম দাসের কাব্য নিয়ে আলোচনার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। বাংলা সাহিত্যের প্রাঙ্গনে কবি দয়ারাম দাসের যে অবদান ছিল তা আজকের বোদ্ধারা মেনে নিয়েছেন।

    কাশীজোড়া পরগণার ঐতিহ্য আজ আর নেই। এই পরগনার অন্তর্ভুক্ত ৭ টি থানা এলাকায় মোট ৬২০ টি মৌজা। এই বিশাল এলাকার মধ্যে যে কয়জন কবি সমাদর পেয়ে থাকার যোগ্য তাঁদের মধ্যে কবি দয়ারাম দাস একজন। আজ থেকে বহু বছর আগে যে মানুষটি মেদিনীপুরের বুকে বসে সাহিত্য চর্চা করে গিয়েছেন নীরবে নিভৃতে, সেই সাহিত্যচর্চা আজ সাহিত্যরসিকদের কাছে গবেষণার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজ তাই কবি দয়ারাম দাস 'মেদিনীপুরের মানুষ রতন' হিসেবে শ্রদ্ধার আসনে থাকবেনই।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

2 Comments

  1. পরিশ্রমী লেখক , গবেষক শ্যামল বেরা কে অভিনন্দন।

    ReplyDelete
  2. পরিশ্রমী লেখক , গবেষক শ্যামল বেরা কে অভিনন্দন।

    ReplyDelete