জ্বলদর্চি

যেতে যেতে পথে--২১/রোশেনারা খান

যেতে যেতে পথে
রোশেনারা খান
পর্ব ২১

সপরিবারে গ্রামের বাড়িতে ফিরে এসে কয়েকদিন পর তমলুকের অফিসে জয়েন করতে গিয়ে খান সাহেব জানতে পারলেন ওনার নতুন করে বদলির অর্ডার হয়েছে দিঘার পাশে রামনগরে। তমলুকে যিনি আছেন তাঁর অবসর নেওয়ার সময় হয়ে  আসেছে। আর এই বয়সে তাঁকে যেন বদলি না করা হয়। এই কথা জানিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে তিনি আবেদন জানিয়েছিলেন। তাই আগের অর্ডার বাতিল হয়েছে। উনি রামনগরের বালিসাই ব্লকে জয়েন করলেন। তারপর শুরু করলেন বাড়ি খোঁজা। যদিও এই বছরের মাঝখানে ছেলেমেয়েকে স্কুলে ভর্তি করা  যাবেনা, কিন্তু ওনাকে তো থাকতে হবে?

    অফিসের এক স্টাফ একটি বাড়ির খোঁজ দিলেন। এদেশে মুসলিমদের বাড়ি পাওয়ার  সমস্যা সর্বত্র। বাড়িটি জুনপুট রাস্তার ধারে, মালিকের নাম সম্ভবত সত্যেন রায়। পেশায় চিকিৎসক। আপাতত এনার বাড়িটা ভাড়া নিয়ে উনি আমাদের নিতে এলেন। সেই সময় বড়দা এসেছিল আমাদের সঙ্গে দেখা করতে। বড়দাও আমাদের সঙ্গে কাঁথি এল। বাড়ি দেখে আমার মন ভেঙ্গে গেল, বাড়ির ভেতরে স্পেস অনেকটাই, কিন্তু গাছ-পাতাই অন্ধকার। ঝোপঝাড়ে ভর্তি বাগান,  পরিষ্কার করতে লোক লাগায় না চুরির ভয়ে। আমাদের বারান্দার সামনে আঙ্গুরলতা রোদ-আলো কিছুই ঢুকতে দেয় না। মশা, পিঁপড়ে ভর্তি। আর বড় বড় গো সাপ চারিদিকে ছুটে বেড়াচ্ছে। আবার বাড়ি খোঁজা  শুরু হল।
        খান সাহেব একদিন অফিস থেকে ফিরে বললেন দিঘাতে বাংলা সিনেমার শুটিং হচ্ছে। আমি যাওয়ার বায়না ধরলাম। এক রবিবার ছেলেমেয়ে নিয়ে দুজনে বেরিয়ে পড়লাম। এখানে আসার আগেই শুনেছিলাম, আমার পিসতুতো জামাইবাবু, আনারকলিদির বর দিঘা থানার ওসি হয়ে এসেছেন। তাই আমরা দেখা  করতে গেলাম। থানার পাশেই কোয়ার্টার, দিদি আমাদের দেখে ছাড়তে চাইল না। জামাইবাবুকে (মাহফুজ রহমান) খবর পাঠালে, জামাইবাবু এসে বললেন, আজ  তোমাদের যাওয়া হবেনা। আমরা শুটিং দেখতে এসেছি শুনে সঙ্গে সঙ্গে ইউনিটের ম্যানেজারকে ফোন করে বললেন, আমার শ্যালিকা শুটিং দেখতে এসেছে, আপনাদের কোথায় শুটিং হচ্ছে? অপর প্রান্ত থেকে উত্তর এল, স্যার নিউদিঘায় শুটিং হবে, আমরা গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি।

      আমি জামাইবাবুকেও সঙ্গে যেতে বললাম, শ্যালিকার কথা ফেলা যায়না যে, তা সবাই জানেন। উনি সিভিল ড্রেসে মোটর বাইকে আমাদের গাড়ির সঙ্গে রওনা দিলেন। সমুদ্রের বালিয়াড়িতে বাখারির বেড়া দিয়ে ঘেরা, মাথার ওপরেও বাখারির ছাউনি দেওয়া একটি ঘরে আমাদের বসতে বলা হল। ভেতরে দেখলাম একজন চেনা অভিনেত্রীসহ কয়েকজন মহিলা বসে চনাচুর মুড়ি খাচ্ছেন। আমাদেরও খেতে বললেন, ধন্যবাদ জানিয়ে না করলাম।
      ‘সোনার বাংলা’ সিনেমার শুটিং চলছে। সিনেমার নায়ক ও নায়িকা হলেন বিশ্বজিৎ ও মহুয়া। অনুপকুমার, লিলি চক্রবর্তী, সান্ত্বনা বসু ও স্থানীয় একটি বাচ্চা মেয়ে অভিনয় করছে। প্রচুর মানুষ শুটিং দেখতে এসেছে। একটি কিডন্যাপের দৃশ্যের শুটিং হচ্ছিল। সবাই এগিয়ে চলে আসছে দেখে জামাইবাবু তাদের সরাতে লাগলেন। বিশাল চেহারা, চাপা গায়ের রং, ৬ ফিটের মত লম্বা চেহারা দেখে হঠাৎ পরিচালক জামাইবাবুকে একটা দৃশ্যে অভিনয় করার অনুরোধ করলেন। উনি রাজি হচ্ছিলেন না। পরিচালক বললেন, কোনো ডাইলগ নেই, শুধু কিডন্যাপারের সঙ্গে থাকবেন। শেষপর্যন্ত জামাইবাবু রাজি হলেন এবং অভিনয়ও করলেন। আমি আর আনারকলিদি খুব হাসাহাসি করলাম, থানার ওসি হয়ে কিনা কিডন্যাপারের  রোল? ফেরার সময় অনুপকুমার ও আমাদের এক গাড়িতেই পৌঁছে দেওয়া হল।। বিকেলে আবার গেছলাম শুটিং দেখতে। কিভাবে এক্সিডেন্টের দৃশ্য স্যুট করা হয় দেখলাম। পরদিন বাড়ি ফিরে এলাম।

    ইতিমধ্যে আমরা বাড়ি বদল করেছি। কাঁথির প্রভাতকুমার কলেজের পেছন দিকে ‘ধনদীঘি’ নামে একটি পাড়ায়। ওই দিকটাই শুধু উঁচুনিচু বালিয়াড়ি। তাই  পাহাড়ি অঞ্চলের মত বাড়িগুলো উঁচুনিচু জমিতে। মাটি নেই, শুধুই বালি। এইখানে একটি নতুনবাড়ি তে শিফট করলাম। একটা রুম,কিন্তু বেশ বড়, পেছনে কোনও বাড়ি নেই। আলো বাতাসেরও অভাআব নেই। পাশে একটি মুসলিম পরিবার  থাকেন। তিনিই খান সাহেবকে এই বাড়ির খোঁজ দিয়েছিলেন। এই বাড়িতে আসার পর খাট, আলমারি, আলনা, সোফাসেট, ড্রেসিং টেবিল ইত্যাদি এক এক করে কেনা হতে থাকল। প্রথম প্রথম পাশের ফ্যামিলির সঙ্গে সম্পর্ক বেশ ভাল ছিল, তারপর কেন জানিনা আমাদের ঈর্ষা করতে শুরু করলেন। একটা পর্যায়ে এসে প্রায় দিনই  কাজের মেয়ের সাথে অকারণে ঝগড়া করতে শুরু করতেন। আশেপাশে মেলামেশা করার মত কেউ নেই। বাড়ি পাওয়াও মুশকিল। বালুরঘাটে প্রথম যে বাড়িতে ভাড়া ছিলাম তিনি আমাকে একদিন বলেছিলেন, বৌমা, তুমিতো মাঝে মধ্যা সিঁদুর পর দেখি। তুমি যদি রোজ সকালে স্নান সেরে সিঁথিতে একটু সিঁদুর লাগিয়ে নাও, আমাদের খুব ভাল হয়। কেউ বুঝতে পারবেনা আমরা  মুসলমানকে বাড়িভাড়া দিয়েছি। কিন্তু আমি পরতাম সখে, নিজের পরিচয় গোপন করার জন্য নয়। তাই ওনাকে কিছু বললাল না। সিঁদুর পরায় ছেড়ে দিয়েছিলাম। এখানেও দেখে কেউ বুঝতে পারেনা, নাম বললেই বুঝে যাচ্ছেন আমরা মুসলমান।তার পরেই কোন না কোন বাহানা করে বাড়ি ভাড়া দিতে অস্বীকার করছেন। কেউ বলছেন, আমাদের বাড়িতে নিষিদ্ধ মাংস খাওয়া চলবেনা, ইত্যাদি ইত্যাদি।

        এদিকে খান সাহেব একা একাই সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি এ চাকরি করবেন না। আবার হয়ত উত্তরবঙ্গে বদলি করে দেবে। তার চেয়ে মল্লভুম গ্রামীণ ব্যাঙ্কে চাকরি নিলে মেদিনীপুর, বাঁকুড়া ও পুরুলিয়ার বাইরে যেতে হবে না, মাইনেটাও বেশি। যেই ভাবা সেই কাজ। ব্যাঙ্কের বিজ্ঞাপন দেখে পরীক্ষা দিলেন, ম্যানেজারের পোষ্টে চাকরিও পেয়ে গেলেন। পোস্টিং পেলেন জুনপুটে। নতুন ব্রাঞ্চ, এখনো উদ্বোধন হয়নি, প্রস্তুতি চলছে। আমাদের এখন কোথাও যেতে হবেনা,  কাঁথিতেই থাকতে হবে। ওই ব্রাঞ্চের ক্লার্ক সুভাষের জামাইবাবু(সুনিল মাইতি) আর  ভাগ্না(দেবাশীষ) খুবই পরোপকারী ছিলেন। দুজনেই পোস্ট অফিসে কাজ করতেন। সুনিলদা আঠিলাগুড়িতে একটি বাড়ি ঠিক করে দিলেন। ভাড়া ২০৫ টাকা। পাশেই ল্যান্ডলর্ড থাকেন সপরিবারে।বাড়িটা খুব একটা পছন্দ না হলেও পাড়াটি খুবই ভাল, শিক্ষিত মানুষের বাস। শিক্ষক, অধ্যাপকের সংখ্যা বেশি। ডাক্তার, অফিসারও রয়েছেন। আমাদের ল্যান্ডলর্ড কৃষি বিভাগের অফিসার। 

      আমাদের বাড়ির একটা বাড়ি পরেই ‘কনটাই নার্সারি স্কুল’। আমিই ভাইবোনকে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করে এলাম। মেয়েকে তৃতীয় শ্রেণিতে, ছেলেকে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি করলাম।। প্রাইভেট স্কুল,তাই প্রথম কয়েকদিন বকুলকে দিদির কাছে বসতে দিয়েছিল। একদিন ওদের স্কুলে ছাড়তে গিয়ে দেখি এক মা ক্লাসরুমের  বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। মা চলে গেলে ছেলে(অর্পণ) কান্না জুড়ে দেয়। বকুল সেদিনই নিজের ক্লাসে বসেছে। দুজনে বেশ ভাব হয়ে যায়। আর মাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হত না।

      বাবলির সঙ্গে আত্রেয়ী মাইতি নামে পাশের বাড়ির একটি মেয়ে পড়ত, ডাক নাম নাচন। ওরা ব্রাহ্ম, তাই অনেক উদার। মস্ত এরিয়া জুড়ে ওদের বাড়ি।  বাড়ির পাশেই রয়েছে হ্যাচারি ও মুরগির খাবার তৈরির কারখানা। একটা পুকুরও ছিল। প্রচুর লোক ঘরের বাইরের কাজ করত, সব সময়ের জন্য একজন ইলেক্ট্রিশিয়ান ছিলেন। এদের ভাইবোনের জন্য ওই বাড়ির দরজা সব সময় খোলা। পরে আলাপ হতে মাসিমার(নাচনের ঠাকুমা মনীষা মাইতি)থেকে জেনেছি, ওনার  বড়ছেলে গ্রামের বাড়িতে থাকেন, মাথার সামান্য সমস্যা রয়েছে। মেজ আর সেজ ছেলে আর দুই মেয়ে কলকাতায় থাকেন। ছোটছেলে চাতক আর বৌমা হিমানী (নাচনের বাবা ও মা) এখানে থেকে ব্যবসা সামলান।

        খান সাহেব এক মাসের ট্রেনিং এ পুনে গেলেন, ভীষণ মনখারাপ।  মনীষা মাসিমা বাবলিকে বললান, মাকে ডেকে নিয়ে আই, টিভিতে সিনেমা দেখলে মন ভাল হবে। নাচন, বাবলি, পাশের বাড়ির প্রফেসরের মেয়ে কেয়া, সবাই মিলে জোর করে আমাকে নিয়ে গেল। ইতিমধ্যে নাচনের বাবা মায়ের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। দুজনে দেখতেও যেমন সুন্দর ছিলেন, ব্যবহারও তেমন। এই পরিবারটির সঙ্গে আলাপ হয়ে গল্পের বইয়ের খনি পেয়ে গেলাম। তখন পাড়ায় ২/১টী বাড়িতে টিভি ছিল। ভাল ছবি আসত না। অ্যাণ্টিনা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ছবি নিয়ে আসার চেষ্টা হত। তখন ন্যাশনাল(হিন্দি)ও ডিডি বাংলা, এই দুটি চ্যানেল ছিল। ডিডি বাংলা শুধু সন্ধ্যার সময় দেখা যেত। তবে ন্যাশনালে খুব ভাল ভাল অনুষ্ঠান ও সিরিয়াল হত।
                                                                                      ক্রমশ

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments