জ্বলদর্চি

প্রথম মহিলা বাঙালি-বৈজ্ঞানিক ড: অসীমা চট্টোপাধ্যায় ― ০৭/পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

বিজ্ঞানের অন্তরালে বিজ্ঞানী ।। পর্ব ― ৬২


প্রথম মহিলা বাঙালি-বৈজ্ঞানিক ড: অসীমা চট্টোপাধ্যায় ― ০৭

পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

(১)
'ধর, ধর, ধর'―ধরবার বস্তুটির ঝাঁপিয়ে পড়ল গোটা দুই-তিনজন লোক।
'আরে! ওদিকটায়।' আবার 'ধর, ধর'― পেছন থেকে সমবেত চিৎকার। সে এক হুলস্থুল কাণ্ড!
আগন্তুক কিংকর্তব্যবিমূঢ়। তখন বিকেল গড়িয়ে সবে সন্ধ্যে। প্রায় অন্ধকার মেসের ঘরগুলো। ততোধিক অপরিচ্ছন্ন। অতিথি আগন্তুককে মেসে নিজের ঘরে বসিয়ে রেখে রান্নাঘরে চলে গেলেন ড. বরদানন্দ চট্টোপাধ্যায়। অতিথি আপ্যায়নের ব্যবস্থা করতে। রান্নাঘরে পৌঁছাতেই যত্তসব বিপত্তি! নধর সাইজের একটি মূষিক সেসময় রান্নাঘরে চরকি কাটছিল। শ্রীগনেশের মতোই তাঁর বাহনেরও হৃষ্টপুষ্ট চেহারা। শ্রীগনেশের এ হেন বাহনটিকে জাপটে ধরতে হুমড়ি খেয়ে পড়ল রান্নাঘরের সকল কর্মী। প্রাণে বাঁচতে কে না চায়? সুতরাং মূষিক ছানাটি প্রাণ হাতে একবার ওদিকে, তো পরক্ষণে এদিকে ছুটে বেড়াল ঘরময়। তার পেছনে রান্নাঘরের কর্মীরাও ছুটে ছুটে ক্লান্ত। এমন সময় ইঁদুর ছানার চেহারা একঝলক দেখে অতিথির চোখ ছানাবড়া! বেজায় পেল্লাই সাইজের চারপেয়ে বটে!

 কর্মী সকলের এত ছোটাছুটি, দৌড়াদৌড়ি সব পণ্ডশ্রম! অনেক ছোটাছুটির শেষে মূষিক প্রবর পাশের বারান্দায় অন্ধকারে মিলিয়ে গেল নিমেষে। ধরা তো দূর অস্ত, কেউ তার টিকিও ছুঁতে পারল না। স্বভাবতই, রণক্লান্ত পরাজিত কর্মীরা যে-যার নির্ধারিত কাজে লেগে পড়ল। ড. বরদানন্দ চট্টোপাধ্যায় নিজের রুমে ফিরে এলেন। অতিথি ড. সুশীলকুমার মুখোপাধ্যায়ের চোখাচুখি হতেই ফিক করে একগাল হেসে ফেললেন তিনি। সিনিয়র প্রফেসর ড. বরদানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের সান্ধ্যভোজনের নেমন্তন্ন রক্ষা করতে এসে এ কী বিপত্তি! ড. মুখোপাধ্যায় তখন সদ্য বিজ্ঞান কলেজে যোগ দিয়েছেন। তিনি এবং ড. বরদানন্দ চট্টোপাধ্যায় একই ল্যাবরেটরিতে কাজ করতেন। সে-সুবাদে দুজনের পরিচিতি, আন্তরিকতা খানিক বেশি।

  সেদিন ডিনারের মেনুতে মাংসের পদটি খুব সুস্বাদু রান্না হয়েছিল। অতিথির বেজায় পছন্দ হয়েছে। সবাই চেটেপুটে সাবাড় করেছিল মাংসের রেসিপি। ভুরিভোজ খেয়েদেয়ে রাতে বাড়ি ফিরে গেলেন অতিথি।
     
 দুই-তিনদিন পরের কথা। গবেষণারত মিস অসীমা মুখার্জির সঙ্গে হঠাৎ দেখা। মুখোমুখি। সায়েন্স কলেজের করিডোরে। সামান্য আড়ষ্টতা সুশীল বাবুর মুখচোখে। স্বাভাবিক কুশল বিনিময়ের শেষে একথা-সেকথা'র পর নবাগত সুশীল বাবু বলে ফেললেন― 'ড. বরদানন্দ চট্টোপাধ্যায় মেসের অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে কেন থাকছেন, তা বুঝতে পারি না!' 
এ বিষয়ে দু-চার কথা গড়াতে না-গড়াতেই মিস্টি হেসে অসীমা মুখার্জির সপাট জবাব― 'ওখানে না-কি ইঁদুরের মাংস খাইয়েছেন!'
দুজনেই হেসে উঠলেন। অসীমা দেবীর বাহ্যিক আপাত কঠিন বেষ্টনীর ভেতরে যে একজন কোমলমতি নারীর অধিষ্ঠান, তাঁর নিখাদ রসিকতায় মুগ্ধ ড. সুশীল বাবু। সেদিনের পরে অনেক সহজ, সাবলীল হয়েছিল তাঁদের আড্ডা। ড. বরদানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে অসীমা দেবীর বিবাহের পর চট্টোপাধ্যায় ফ্যামিলির সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুবর্ণ সুযোগ হয়েছিল ড. সুশীলকুমার মুখোপাধ্যায়-এর। পারিবারিক যোগাযোগ বাড়ে। অথচ, তখন ক্যাম্পাসে একটা কানাঘুষো ছিল যে ড. অসীমা চ্যাটার্জি না-কি খুব বেশি গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ। নিজের চারদিকে কৃত্রিম গাম্ভীর্যের স্বঘোষিত বেড়াজাল তৈরি করেছেন তিনি। যার-তার সঙ্গে অযথা কথা কন না। নিজের গবেষণার কাজে সবসময় একাত্ম হয়ে থাকেন। তাঁর ডিকশনারিতে আড্ডা নৈব নৈব চ। এমন কত সব রটনা তাঁর নামে, যা সর্বৈব মিথ্যা প্রচার বই অন্যকিছু নয়! 

  বিজ্ঞান কলেজে তখন মহিলা গবেষক বলতে একমাত্র তিনি। দ্বিতীয় জন নেই। কার সঙ্গে আড্ডা মারবেন তিনি? যদিও সেসময় ছেলে আর মেয়েদের মধ্যে মেলামেশার অবাধ সুযোগ সুবিধা না থাকলেও তেমন কোনও বিধিনিষেধও ছিল না। তাছাড়া, আড্ডা দিয়ে সামান্য কালক্ষয় করতে নিমরাজী ছেলে-মেয়ে সকলে। আড্ডার দোহাই দিয়ে গবেষণায় সময় নষ্ট করার পক্ষপাতী নয় কেউ। এ যেন বিলাসিতার নামান্তর! জীবনের যেন একটাই মূলমন্ত্র ― সারাদিন শুধু কাজ আর কাজ। মুখে কুলুপ এঁটে গবেষণার কাজ চালিয়ে যাওয়ার নিয়তি।

   কিন্তু ড. অসীমা চ্যাটার্জির সঙ্গে মেলামেশার সুবাদে ড. সুশীলকুমার মুখোপাধ্যায়ের ভ্রান্ত সে-ধারণার অবলুপ্তি ঘটে অচিরে। গবেষণা সংক্রান্ত আলাপ আলোচনার পাশাপাশি হালকা চালের কথাবার্তা হত তাঁদের মধ্যে। আসলে অসীমা দেবী ছিলেন ভীষণ কর্মনিষ্ঠ, কঠিন শ্রমক্ষমতা আর তীক্ষ্ম বুদ্ধির অধিকারিণী আপাতমস্তক একজন সাধারণ গৃহিণী এবং স্নেহবৎসল মা।

(২)
সালটা ১৯৩৮। বছরের শেষ দিকে সায়েন্স কলেজে যোগ দিলেন ড. সুশীলকুমার মুখোপাধ্যায়। বছর খানেক বাদে ১৯৩৯ সালের ঘটনা। 

'হঠাৎ একদিন অসীমা মুখার্জির মুখোমুখি আমি'― স্মৃতিচারণায় ডুবে ড. সুশীলকুমার মুখোপাধ্যায়। তিনি আরও যোগ করলেন― 'জিজ্ঞেস করলাম, গবেষণার কাজ কেমন চলছে?'
প্রত্যুত্তরে তিনি যা বললেন, তাতে যারপরনাই বিস্মিত ড. সুশীলকুমার মুখোপাধ্যায়। 
'ভালোই। আপনিও তো খুব পরিশ্রম করছেন।' পরক্ষণেই তাঁর সস্নেহ উপদেশ― 'খাওয়া-দাওয়ার অবহেলা করবেন না যেন।'
নাহ! মোটেও কঠিন চিত্ত নন অসীমা মুখার্জি। তাঁর এতদিনকার ধারণা সম্পূর্ণ ভুল ছিল। ক্যাম্পাসের ভেতরে আড়ালে-আবডালে রসকষহীন নারীর যে-প্রতিমূর্তির রটনা প্রচলিত ছিল তাঁর নামে, এক মূহুর্তে তা ভেঙে খানখান হয়ে গেল সু্শীল বাবুর কাছে; সে দিন-ই। তার বদলে ঘনিষ্ঠ মহলে অসীমা দেবীর আন্তরিক, স্নেহ-বৎসল একজন পূর্ণাঙ্গ নারীর স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি প্রতিভাত হল তার নয়ন-সম্মুখে।

(৩)
১৯৪৬ সাল। তখন সদ্য জন্মেছে জুলি। জুলির জন্মের মাস খানেক বাদের ঘটনা। হঠাৎ জরুরি তলব। একেবারে শয়নকক্ষে ডাক পড়ল ড. সুশীলকুমার মুখোপাধ্যায়-এর। আকাশ থেকে পড়বার জোগাড়! কী ব্যাপার? কী এমন ঘটল?
সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে ড. সুশীলকুমার পৌঁছে গেলেন একেবারে শয়ন ঘরে। অসীমা দেবীর কোলে তখন খেলা করছে একরত্তি জুলি। বেশ ফুটফুটে হয়েছে মেয়েটি। ড. সুশীলকুমার মুখোপাধ্যায়কে বিছানার একপাশে বসতে বললেন গৃহকর্ত্রী, তারপর জিজ্ঞেস করলেন― 'কেমন দেখছেন?'
'খুব ভালো দেখছি। লাগছেও ভালো'― অকৃতদার সুশীলকুমারের চটজলদি উত্তর। 
'আপনারও ভালো লাগবে'― অতিথির আইবুড়োত্ব ঘোচানোর খাঁটি উপদেশ দিলেন অসীমা দেবী। 
ওদিকে, মূহুর্তে লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠল অতিথির চোখ-মুখ-নাক-কান-গাল। পালানোর পথ খুঁজে বেড়াচ্ছেন তখন। কী করণীয় আর কী করণীয় নয়― মাথা কাজ করছে না। অগত্যা মুখে সেলো-টেপ এঁটে বসে থাকাই শ্রেয়।
      
  তারপর এগারো মাসের জুলিকে সঙ্গে নিয়ে আমেরিকা পাড়ি দিলেন বিজ্ঞান-সাধিকা। পাশ্চাত্যে রওনা হয়ে যাবার আগে আরেকপ্রস্থ উপদেশের ডালি― 'আপনি তো ড. চ্যাটার্জির সঙ্গে একসঙ্গে থাকতে পারেন।'

  ড. বরদানন্দ চ্যাটার্জী তখন বি ই কলেজের কোয়ার্টারে থাকতেন। কোয়ার্টারের রুমগুলো বেশ বড়ো আর উঁচু। কোয়ার্টারের প্রসস্থ ঘরগুলো থেকে প্রবহমান গঙ্গাকে পরিস্কার দেখা যায়। রাত্রির অন্ধকারে কলকল সুরতানে বয়ে চলা গঙ্গার সুদৃশ্য দর্শন ও অনুভব করা― সে এক অনির্বচনীয় অভিজ্ঞতা!

  বৈজ্ঞানিক দম্পতি যখন মানিকতলার বাসায় থাকতেন, সেখানেও অবাধ যাতায়াত ছিল ড. সুশীলকুমার মুখোপাধ্যায়-এর। খুব কাছ থেকে তিনি অসীমা দেবীকে নিঁখুত পর্যবেক্ষণ করেছেন। তাঁর স্বাগতিক উপলব্ধি― 'বৈজ্ঞানিক কাজে মিসেস চ্যাটার্জির মন একাগ্রতায় ভরা। আমার ধারণা― তাঁর মনটি অন্য একটি দিকে অধিকতর একাগ্রতায় ভরা। সেটি হল তাঁর অধ্যাত্ম জীবন। রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের ভাবধারায় তিনি তাঁর আধ্যাত্মিক জীবনকে গড়ে তুলেছেন। মূলত তাঁর অসীম মানসিক শক্তির উৎস সেখানেই।'

তথ্যসূত্র :
●'বারোজন বাঙালি রসায়নবিজ্ঞানী'―ড. রবীন্দ্রনাথ পাত্র
●'অর্ধশত বিজ্ঞানী-কথা'― ড. সন্তোষকুমার ঘোড়ই
●'জৈবরসায়নবিজ্ঞানী অসীমা চট্টোপাধ্যায়'― দীপককুমার দাঁ
●বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, দৈনিক সংবাদপত্র
●উইকিপিডিয়া, সায়েন্টিফিক উইমেন পেজ

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments