জ্বলদর্চি

তুর্কী নাচন /পর্ব- ১৯ /মলয় সরকার

তুর্কী নাচন 

পর্ব- ১৯ (পূর্ব প্রকাশিতের পর)


মলয় সরকার

 এই ইস্তানবুল শহরে বেশ কয়েকটি বাজার রয়েছে।

তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য, এখানে দর্শনীয় আর একটি বাজার রয়েছে , যেখানে আমাদের  ইচ্ছা থাকা সত্বেও যাওয়া হয় নি। তার নাম মশলা বাজার বা Spice Bazar। সেখানে শুকনো ফল থেকে শুরু করে কত রকমের মশলা পাওয়া যায় তার ইয়ত্তা নেই।


  আমার মনে হল, এখানে এলাম, অথচ কিছু নেব না, এটা কেমন করে হয়।কাজেই দু’ একটি জিনিস না নিলে নয়। তাই দর করতে গিয়ে দেখি, ভালই দরাদরি করতে হয় এখানে।কাপাদোসিয়ার পথে রুইয়া সুন্দরীর সাথে হাঁটতে হাঁটতে খেয়েছিলাম পথের ধারে, প্রথম আপেল চা।আজও মুখে তার স্বাদ লেগে আছে।তাই ভাবলাম, দেখি, এখানে সেটি পাওয়া যায় কি না।

  পেলাম, দেখি শুধু আপেল নয়, বেদানা, গোলাপ,জুঁই ইত্যাদি নানা রকমের চা পাওয়া যাচ্ছে।আপেল বেদানা ইত্যাদির চা গুলো মোটেই গন্ধ দেওয়া নয়, সত্যি সত্যি আপেল বেদানার টুকরো দিয়েই করা। নিলাম নিজেদের জন্যে বেশ কিছুটা।সঙ্গে সঙ্গে মনের আয়নায় ভেসে উঠল, বেশ কিছু প্রিয় জন আত্মীয়,  বন্ধুদের মুখ।তাদের জন্য না নিলে কি চলে? ভরে উঠল ব্যাগ।

এই চা এখন কলকাতাতেও পাওয়া যায়।তবে তখন, এত চল ছিল না। 

  জিনিস এখানে যাই কিনি, সেটা বড় কথা নয়। কিন্তু এখানকার দোকানীদের আতিথ্য, কথা বলার বা গল্প করার ঢং, দরাদরি সব মনের খাতায় চিরকালের মত খোদাই হয়ে থাকবে এটা নিশ্চিত। এই দোকানীরা মোটামুটি খরিদ্দারের মুখ দেখেই বুঝতে পারে তারা কোন দেশীয়।ওরা সেইরকম ভাষাতেই কথা বলতে চেষ্টা করে, যেহেতু এখানে সারা পৃথিবী থেকে প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ মানুষ এখানে আসেন, ওরাও হয়ে উঠেছে বহুভাষী। আমাদের দেখে যদিও ‘ঈন্দিয়া’, দিল্লী, কাশ্মীর ইত্যাদির নাম করল, তবে কথা বলল, ইংরাজীতে। কেউ কেউ বলল, হাত জোড় করে, ‘নমস্তে’। বিদেশে 'নমস্তে' শব্দটাই বিদেশীদের মুখে শুনে এত আপন লাগল, সে আর বলে বোঝাতে পারব না।

 অনেক ভেবে চিনতে ভাবলাম, তুরস্ক তো অনেক খানি দেখা হল, তুর্কী নাচনটা কি তা তো খুঁজে পাই নি।এখানে পাই কি দেখি। 

  লোককে এটা সেটা বলে বোঝাতে গেলাম,কেউ তো আর বোঝে না।শেষে একজনের কথা থেকে বুঝে নিয়ে  যা পেলাম, তা বলি।তা হল একটি পিতলের মূর্তি। একটি বল বেয়ারিং এর উপর রাখা আছে। হাত লাগলেই ঘোরে । আর মূর্তিটি কি?

  সেটি হল , এক সুফীগানের দরবেশ গায়কের মূর্তি। বুঝলাম ব্যাপারটা। এই হল তুর্কী নাচন। আসলে তুরস্কের সুফী দরবেশ গায়করা যে সাদা ঘেরের স্কার্ট ও জামা পরে তাঁদের উপাসনার নৃত্য পরিবেশন করেন, তাই হল আমাদের সাদা বাংলায় ‘তুর্কী নাচ’। এই নাচের ব্যাপারে অনেক কিছু জানার আছে, যা আমরা জানতাম না।এই নাচ হল উপাসনার এক পদ্ধতি।এটি সম্ভবতঃ পারস্যের কবি সাধক জালাল উদ্দীন রুমী (১২০৭-১২৭৩)র হাতে সৃষ্টি হয়েছিল।  এই সম্মিলিত উপাসকের দল মাথায় লম্বা টুপী পরে ঘাড়টি বাঁদিকে অল্প হেলিয়ে দুহাত দু দিকে প্রসারিত করে সম্পূর্ণ ঘুরে নাচতে থাকেন এক ভক্তি সংগীতের সুরে। এতে তাঁদের স্কার্টের নীচের দিকের অংশটি উঠে চক্রের মত ঘুরতে থাকে এবং এই ঘোরার মধ্যে দলীয় ভাবে নাকি ওনারা সূর্যমণ্ডলের অনুসরণ করেন।এঁদের বলা হয় ‘তারিক বা তুরুক’। সবতঃ এর থেকেই আমাদের বেশি ঘুরিয়ে বা দৌড় ঝাঁপ করে কোন কাজ করা হলে বলা হয় তুর্কী নাচন।এঁরা এইভাবেই আল্লা বা ভগবানের সাধনা করেন।ইজিপ্টে এই নাচের নাম তানুরা (tanoura )। সেখানে আবার নাচের সদস্যরা সাদা স্কার্টের বদলে রঙীন স্কার্ট পরেন। পাকিস্তানে এর নাম ধামাল (Dhamaal)। এই ভাবে বিভিন্ন দেশে এর আরাধনার পদ্ধতি বদলে গেছে।

   অবশ্য নিজে নিজে ভাবছিলাম, এই যে কয়েক দিনে তুরস্কের এমাথা থেকে ওমাথা নেচে বেড়ালাম, এটাকেও নিশ্চয় ‘তুর্কী নাচন” বলা যায়। কি বলেন?

  যাই হোক, আমরা একটি ছোট পিতলের মূর্তি নিলাম অনেক দরাদরি করে। আসলে বিক্রেতারা তো জানে আমরা বিদেশী পর্যটক । কাজেই ওরাও যথেচ্ছ দাম হাঁকে। আর আমাদের গাইড বলে দিয়েছিলেন, দরাদরি না করে কিছু কিনবেন না।তবে বেশি কিছু না নেওয়াই ভাল আর তাছাড়া এখানে পকেটমার, ঠগবাজ প্রচুর ঘুরে বেড়ায়। কাজেই বেশি কারোর সাথে কথা না বলাই ভাল। 

 এখানে অনেকক্ষণ সময় কাটিয়ে বের হয়ে এলাম। বেরোতেই গাইড বলল, ‘নমস্তে’। 
 ও  বলল, এবার আমার ছুটি। ভাল থাকবেন।

  আমি মাঝে ওকেও জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আবার রাস্তাঘাটেও অনেক সাধারণ মানুষকেও জিজ্ঞাসা করেছি, আলোচনার ছলেই, যে কামাল আতাতুর্ককে ওরা কিভাবে দেখে।

  অল্প একটু আলোচনা করি, সেই মানুষটির ব্যাপারে। হয়ত অনেকেই জানেন, তবু  জানাই, তাঁর নামের যে পদবী ‘আতাতুর্ক’, এটা কিন্তু তাঁর বংশগত পদবী নয়। দেশের মানুষ আদরে, ভালবেসে তাঁঁকে নাম দিয়েছিল আতাতুর্ক অর্থাৎ তুর্কী জাতির জনক, আমাদের দেশের ‘জাতির জনকে’র মত। মাত্র সাতান্ন বছর বয়সের মধ্যে তিনি যা করে গিয়েছিলেন, তাকে আজও তুরস্কবাসীরা সম্মানের সঙ্গে স্মরণ করে। ওনার সম্বন্ধে কথা বলতে গেলেই , আবালবৃদ্ধবনিতা সবাই, সম্মান দেখিয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে কথা বলে, এত বছর পরেও।

এবার দেখি, তিনি কি কি করেছেন, সংক্ষেপে।

  প্রথমতঃ এত বছরের অপমানজনক অটোমান রাজবংশের রাজতন্ত্র থেকে মুক্ত করে 
তুরস্কবাসীকে একটা সুন্দর স্বাধীন গণতন্ত্র উপহার দিয়েছেন। পৃথিবীর ইতিহাস থেকে চিরতরে মুছে গিয়েছে সুদীর্ঘদিন ধরে চলা একটি রাজবংশের বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র। সরিয়ে নিয়ে গিয়েছেন দেশের রাজধানীকে নিজের মত করে গড়ার জন্য ইস্তাম্বুল থেকে আংকারাতে।

  এছাড়া আপাদমস্তক পরিবর্তন এনেছেন দেশের সর্বস্তরে।হাজার হাজার স্কুল স্থাপন করেছেন দেশে যেখানে শুধু তুর্কীতেই পড়ানো হবে। দেশে তুর্কী ভাষাকে সর্বস্তরে চালু করেছেন। সকলের জন্য সমান ধর্মনিরপেক্ষ উন্নতিশীল উদার রাষ্ট্রের সূচনা করেছেন। পুরানো অটোমান তুর্কী বর্ণমালার পরিবর্তন করে ল্যাটিন নির্ভর তুর্কী ভাষার প্রচলন করেছেন।মেয়েদের জন্য সমান ভোট  দেওয়ার অধিকার এবং শিক্ষার ব্যবস্থা করেছেন।আয়া সোফিয়া ধরণের বিতর্কিত ধর্মপ্রতিষ্ঠানগুলিকে ধর্মের বাইরে নিয়ে গিয়ে মিউজিয়ামে পরিবর্তিত করেছেন।এক কথায় সমগ্র দেশকে এক স্বাধীন নতুন যুগের অগ্রদূত হিসাবে বিশ্বের কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। 

 এছাড়া অনেক কিছু করে সামাজিক, রাজনৈতিক ইত্যাদি বহুল পরিবর্তন সাধন করেছিলেন নতুন যুগের উপযোগী করে।

সম্মান জানিয়ে তাঁর জন্ম শতবার্ষিকী বছরকে ইউনেস্কো ‘আতাতুর্ক বছর’ হিসাবে চিহ্নিত করেছে।  

  আমরাও কয়েকটা দিন এই অল্প ভাষী বিনয়ী নিরামিশাষী তরুণ গাইডের সঙ্গে খুব ভালই ঘুরেছিলাম। অল্প কিছু টাকা (লিরা) তার হাতে দিয়ে বললাম, বড় ভাইয়ের ভালবাসার দান হিসাবে, যেন ও কিছু মনে না করে নেয়, আমাদের ভাল লাগবে। 

  সকালটা এইভাবে কাটিয়ে বিকালটা আমরা ফাঁকা। আমি বুলবুলকে বললাম, এখানে সব দেখলাম, শুধু আমার ট্যাক্সিম স্কোয়ারটা দেখা হয় নি, ওখানে যাব বিকালে।
সে-ও ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি দেয়, সবই যখন দেখা হল, ওটাই আর বাকী থাকে কেন? চল, ওটাও দেখে নেব।

 বিকালে হোটেলে জিজ্ঞাসা করলাম, কি করে যাব। ওরা বলল, খুব সোজা। সামনে যে ট্রামলাইন আছে ওতে যে ট্রাম আসবে, তাতে চেপে পড়লেই হল।

  দেখলাম , সামনেই ট্রামের লাইন চলেছে-ক’দিন ধরেই দেখছি। ট্রামগুলো খুব সুন্দর।  এর টিকিট কাটতে হয় নিজেকেই। ট্রামের প্ল্যাটফর্মের উপর সেলফ টিকিট ভেন্ডিং মেসিন আছে। তাতে টিকিট কেটে চললাম, আয়া সোফিয়ার পাশ দিয়ে।বেশ কিছুটা গিয়েই ট্রাম থেমে গেল শেষ স্টেশনে।
এর পর আমরা যাব ট্যাক্সিম স্কোয়ারে। পাঠক সংগে থাকবেন-

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments