জ্বলদর্চি

নাস্তিকের ধর্মাধর্মপর্ব-৫৮ /সন্দীপ কাঞ্জিলাল

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম
পর্ব-৫৮

সন্দীপ কাঞ্জিলাল

ধর্ম ও মুক্তচিন্তা


বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যুগান্তকারী আবিষ্কার ও চিন্তাধারা সৃষ্টি করেন পরবর্তী বৈজ্ঞানিক নিকোলাস কোপার্নিকাস (১৪৭৩- ১৫৪৩)। এক কথায় বলতে গেলে কোপার্নিকাস প্রমাণ করেন যে, সূর্য এবং অন্যান্য গ্রহতারারা পৃথিবীর চারিদিকে ঘোরে না। পৃথিবীই সূর্যের চারিদিকে ঘোরে। আর এই ধরনের অসংখ্য গ্রহ তারা মহাবিশ্বে আছে। বাইবেলের সৃষ্টিতত্ত্ব যাতে বলা হয়েছে যে ভগবান স্থির পৃথিবী ও পৃথিবীতে মানুষ সৃষ্টি করে তারপর মানুষের মঙ্গলের জন্যই সূর্য চন্দ্র এবং গ্রহ নক্ষত্র সহ মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন। এই ধারণা কোপার্নিকাসের আবিষ্কার এর ফলে একেবারে ধূলিসাৎ  হয়ে গেলো। মহাবিশ্বে মানুষ ও পৃথিবীর কেন্দ্রীয় গুরুত্ব তথা ট্রিনিটির তত্ত্ব, ঈশ্বরপুত্রের পৃথিবীতে আবির্ভাব, মানুষের পাপের জন্য জীবন দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত, এবং কবর থেকে পুনরুত্থান প্রভৃতি খ্রিস্টধর্মের অনেকগুলো মূল বিশ্বাস খুব জোর আঘাত পেলো। ফলে কোপার্নিকাসের মূল গ্রন্থ on the revolution of the heavenly bodiesbodies প্রকাশিত হবার পর খ্রিস্টধর্মের জগতে মহা কলরব উপস্থিত হলো। ক্যাথলিক এরা যে কোপার্নিকাসের বিরোধিতা করবে তা ছিল এক রকম অবধারিত। কিন্তু এ ব্যাপারে প্রটেস্টান্টরাও পিছিয়ে রইলো না। প্রটেস্টান্ট বাদের সস্তা মাটির লুথার কোপারনিকাস কে তীব্র আক্রমণ করে বলেন- "এই মূর্খ জ্যোতির্বিদ্যাকে একেবারে উল্টে দিতে চাইছে কিন্তু পবিত্র ধর্মগ্রন্থ আমাদের বলছে যে যশুয়া সূর্যকেই  স্থির থাকার আদেশ দিয়েছিল, পৃথিবীকে নয়।"

 প্রোটেস্টান্টদের আরেক ধর্মগুরু ক্যালভিন ধর্মগ্রন্থের নির্দেশ সম্বন্ধে একই মত প্রকাশ করে তারপর বলেন- "ঈশ্বরের কর্তৃত্বের উপরে কোপার্নিকাসের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার দুঃসাহস কে দেখাতে পারে?" কিন্তু ব্রুনোর পরিণতি থেকে কোপার্নিকাস রক্ষা পেয়েছিলেন মূলত দুটি কারণে। তিনি তার গ্রন্থটি লেখা হয়ে যাবার পরেও শাস্তির ভয়ে অনেক বৎসর পর্যন্ত সেটি প্রকাশ করেননি। ১৫৪৩ খ্রিস্টাব্দে সেটি প্রকাশিত হবার অল্প পরেই তার মৃত্যু হয়। দ্বিতীয়ত তিনি বইটি পড়তে উৎসর্গ করেন এবং তার প্রকাশক একটি মুখবন্ধে বলেন যে, কোপার্নিকাসের তথ্য শুধু একটি হাইপথিসিস বা প্রমাণসাপেক্ষ বক্তব্য মাত্র এবং এর পেছনে কোনো প্রমাণিত সত্যের দাবি নেই। 

কোপার্নিকাসের তত্ত্বকেই যখন গ্যালিলিও (১৫৬৪-১৬৪২) পূর্ণাঙ্গ রূপ দেন, তখন কিন্তু তিনি ইনকুইজিশনের হাত থেকে অব্যাহতি পাননি। নিজের তৈরি টেলিস্কোপের সাহায্যে কোপার্নিকাসের আবিষ্কাররের সমর্থন এবং পরিবর্ধন ছাড়াও গ্যালিলিও বৃহস্পতির চারটি উপগ্রহ, সূর্যের কলঙ্ক বা সানস্পটএবং চাঁদের পাহাড় আবিষ্কার করেন। এসব ছিল খ্রীষ্টধর্মীয় সৃষ্টিতত্ত্বের সম্পূর্ণ বিরোধী। ফলস্বরূপ গ্যালিলিও ইনকুইজিশনের কবলে পড়লেন। ইনকুইজিশন রায় দিল যে সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে না, পৃথিবীই সূর্যের চারিদিকে ঘোরে, আর পৃথিবী মহাবিশ্বের কেন্দ্র নয় এসব তত্ত্ব মূর্খতাপ্রসূত, অসম্ভব মিথ্যা এবং ধর্মবিরোধী। পোপের আদেশে গালিলিও ইনকুইজিশনের সামনে হাজির হলে, তাকে নির্দেশ দেওয়া হয় যে, এই স্বীকারোক্তি দিতে হবে যে তার তত্ত্ব ভ্রান্ত, আর আদেশ দেওয়া হয় এসব তত্ত্ব লিখিতভাবে অথবা মৌখিকভাবে আর কখনো প্রকাশ না করতে। মাত্র ষোল বছর আগে ব্রুনোর জীবন্ত দগ্ধ হবার পটভূমিতে গ্যালিলিও ইনকুইজিশনের আদেশ এবং সব শর্ত মেনে নিলেন।

 আর পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘোরে এই তত্ত্ব সম্বলিত যাবতীয় পুঁথিপত্র নিষিদ্ধ করা হলো। এর সাত বছর পরে তার এক ব্যক্তিগত কার্ডিনাল বন্ধু অষ্টম আরবান নাম দিয়ে পোপ হবার সুবাদে কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে গ্যালিলিও একখানি বই লেখেন, যাতে তিনি খ্রিস্টধর্মীয় স্থির পৃথিবীর তত্ত্ব আর কোপার্নিকাস এর বিপরীত তত্ত্বকে মহাবিশ্বের দুটি বিকল্প সিস্টেম হিসেবে নিরপেক্ষভাবে দেখাতে চেষ্টা করেন। কিন্তু এই কৌশলেও অব্যাহতি পাওয়া গেল না। তার প্রাক্তন বন্ধু পোপ অষ্টম আরবান তাঁর শত্রু হয়ে দাড়ালেন, এবং আবার ইনকুইজিশন বসলো। গ্যালিলিওকে হাঁটু গেড়ে বসে ভুল স্বীকার করতে এবং ক্ষমা ভিক্ষা করতে হলো। আর বাইবেল-এ হাত রেখে শপথ করতে হলো যে তিনি জীবনে আর কখনো এসব মিথ্যা এবং ধর্মবিরোধী তত্ত্ব প্রচার করবেন না, আর কেউ এসব প্রচার করলে তাকে তিনি ধরিয়ে দেবেন। তারপর তাকে গৃহবন্দি থাকবার এবং কোনো আত্মীয় বা বন্ধুর সঙ্গে দেখা না করবার আদেশ দেওয়া হলো। এভাবে পাঁচ বৎসর নিঃসঙ্গ গৃহবন্দী জীবন যাপনের পর, ১৬৩৭ সনে তিনি অন্ধ হয়ে যান, এবং ১৬৪২ সনে তার মৃত্যু হয়। ১৮৩৫ সন পর্যন্ত মহাবিশ্ব এবং পৃথিবী সম্বন্ধে কোপার্নিকাস- গ্যালিলিও তত্ত্বের সব পুঁথিপত্র রোমান ক্যাথলিক চার্চ দ্বারা নিষিদ্ধ ছিলো।

সপ্তদশ শতাব্দীর আর একজন ধর্মের শিকার ছিলেন স্পিনোজা (১৬৩২-১৬৭৭)। তার পিতা স্পেনের অধিবাসী ছিলেন। ইনকুইজিশনের ভয়ে বাহ্যিকভাবে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করলেও পরিবারের মধ্যে তারা ইহুদি ধর্মই পালন করতেন। পরে তিনি নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডাম শহরে চলে আসেন এবং সেখানে সফল ব্যবসায়ীর মাধ্যমে স্থানীয় ইহুদিদের মধ্যে ধনী এবং গণ্যমান্য হয়ে ওঠেন। আমস্টারডাম সে সময়ে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের কেন্দ্র রূপে গড়ে উঠেছিল, আর সে কারণে এখানকার অধিবাসীরা ধর্ম বিষয়ে কিছুটা উদারপন্থী ছিলো। জন্মগতভাবে ইহুদি হলেও স্পিনোজা ছিলেন বলিষ্ঠ মুক্তচিন্তক। চিন্তার স্বাধীনতা রক্ষার উদ্দেশ্যে পৈত্রিক সম্পত্তি ত্যাগ এবং অন্যভাবে বিত্তলাভের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে, তিনি নিজ হাতে চশমার লেন্স তৈরি করে স্বাধীনভাবে জীবিকা নির্বাহ করতেন। মহাবিশ্ব সম্বন্ধে তার নিজস্ব চিন্তার ফসল ছিল এক ধরনের প্রাকৃতিক অদ্বৈতবাদ।  তিনি বলতেন যে বিশ্বপ্রকৃতির বাইরে কোন ঈশ্বর নেই। বিশ্বপ্রকৃতির এক ও অভিন্ন সত্তা সর্বত্র বিরাজমান। বস্তু ও মন, জড় ও চেতন পদার্থ, মানুষ অদৃশ্য মহাবিশ্ব, এসবই একটি পূর্ণ সত্তার বিভিন্ন রূপ মাত্র। মঙ্গল ও অমঙ্গলের দ্বন্দ্ববোধ, এবং সময়ের ধারণা মানুষের সীমিত চৈতন্যের ফসল।

 বিশ্ব প্রকৃতি আদি-অন্তহীন, চিরন্তন, এবং মঙ্গল-অমঙ্গল নিরপেক্ষ। পাপ-পূণ্য বলেও কিছু নেই। আদি-অন্তহীন মহাবিশ্বে নিয়ম ও শৃঙ্খলা আছে। বিশ্ব প্রকৃতির নিয়মের উপলব্ধি এবং মহাকাল চৈতন্যই মানুষের জীবন মুক্তির উপায়। স্পিনোজা নানা যুক্তিবাদী প্রশ্ন তুলে বাইবেলের ঐতিহাসিক ভিত্তিকেও অস্বীকার করেছিলেন।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
 

Post a Comment

1 Comments

  1. এই তথ্য সমৃদ্ধ লেখার মাধ্যমে অনেক কিছুই নতুন করে জানতে পারছি। ধন্যবাদ।

    ReplyDelete