জ্বলদর্চি

ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা ৯৩

ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা  ৯৩



সম্পাদকীয়,
বর্ষাকাল হলে কি হবে, আকাশে কিন্তু শরতের মতো মেঘ উড়ছে। ঝিরঝিরে বৃষ্টি শহরের অলিতে গলিতে লুকোচুরি খেলছে। এই আকাশের ছবি তুলে তোমাদের বন্ধু শ্রীপর্ণা এক আকাশ মেঘ ধরে রেখেছিল নিজের মোবাইলে। আমি খপাত করে সেই মেঘগুলোকে ধরে নিয়ে তোমাদের জ্বলদর্চির প্রচ্ছদে সেঁটে দিলাম। কি ভালো করলাম কিনা? আরে মজার ব্যাপার কি জানো? মেঘগুলো কিন্তু ছাড়া পেয়ে ওড়বার জন্য ছটফট করছিল। আমি বললাম, ছাড়া পেয়ে তোমরা কোথায় যাবে? বলে কিনা বেথুয়াডহরী । সেখানে কেন? বলে কিনা সেখানে ছোটোবেলার কত্ত কত্ত বন্ধুরা আছে। তাদের কাছে। ঠিকই তো বানীয়া দিদি, অমিত দাদা, রূপম, আরো কত কত আপনারজন। খুব খুশি হলাম মেঘেদের কথা শুনে। আসলে মেঘগুলো এবার খুব ফর্সা। ফর্সা মেঘে বৃষ্টি হয় নাকি? কালো মেঘে বৃষ্টি বেশি হয়। এত বৃষ্টি হয় যে ব্যাঙেদেরও সর্দি জ্বর হয়। কে বলল? কেন রঞ্জনা আন্টি। ব্যাঙেদের সর্দি হবে না এমন কোনো নিয়ম আছে নাকি? নিয়ম থাকলেও নিয়ম ভঙ্গ হবে না তারও কোনো মানে নেই। রিকু তো ঠাম্মার শ্রাদ্ধের নিয়ম ভঙ্গের দিন.....  কি করল? বলব না কুহেলি আন্টির লেখা পড়ে জেনে নাও। কেমন? এবারের ছোটোবেলায় মলয় জেঠু আবার ঘুরু ঘুরু করে বিশ্বের নানা চমকদার জায়গার গল্প নিয়ে হাজির হয়েছেন। সঙ্গে ঠান্ডার দেশের ছবি। কি মজা না? তবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সঙ্গে নিজের দেশকেও ভালভাবে জানতে হবে। সব জায়গা তো আমরা যেতে পারব না, সেসব জায়গার কথা পড়ে জানতে হবে। এমন একজন লেখক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, তিনি দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কথা তাঁর লেখায় তুলে ধরেছেন। পীযূষ আঙ্কেল তাঁর কথা স্মরণ করিয়ে খুব ভাল করেছেন। তোমাদের বন্ধু প্রবাহনীলের ছড়া আর জয়দীপ ও অনুশ্রুতির আঁকা ছোটোবেলার পাতায় শরতের মেঘের মতো পেঁজা পেঁজা সাদা মেঘের সারি এনে দিয়েছে তা বলাই বাহুল্য। শেষপাতে সুখবর। মেঘেরা জানালো মধু দাদা ফিরে এসেছে। সে প্রথমবার এদেশে এসেছে। কোন দেশে? আরে সোনাটিকরিতে গো। তাও জানো না? নাকি ভুলে যাচ্ছ? জয়াবতীর জয়যাত্রা কিন্তু তড়তড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ঘোড়ার চেপে টগবগিয়ে। চলো আমরাও মেঘের সঙ্গে পাড়ি দিই সোনাটিকরি গাঁতে। কি সবাই রাজি তো? আয় আয় কে যাবি, আয় মন হারাবি...   মৌসুমী ঘোষ।



ধারাবাহিক উপন্যাস
জয়াবতীর  জয়যাত্রা
পঞ্চবিংশ পর্ব
তৃষ্ণা বসাক

২৯
রামগতির টোল বাড়ির লাগোয়া। সেখানে যাবতীয় কাজকর্ম করে এই মধুদাদা।টোল আর আঙ্গিনা পরিষ্কার রাখা। কোন ছাত্রের অসুখ হলে তাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসা। কেউ অনেক দিন না এলে তার খোঁজ নিতে ছোটা। আবার অন্দরমহলের কাজেও তাকে লাগে।তরকারির ছোট বাগানের দেখাশোনা থেকে ফি হাটবারে  হাটে যাওয়া- সবেতেই মধুদাদা।
সেই মধুদাদা এসেছে যে তাদেরই নিতে, অন্য কোন কাজে নয়, তা নিয়ে কোন সন্দেহই নেই ওদের। খুড়িমা হেসে বললেন ‘বাব্বা মেয়েদের মুখ দেখো, মধুদাদাকে দেখে  ধড়ে যেন প্রাণ পেয়েছে। যেন এখানে না খেয়ে আছিস সব’ বলতে বলতে তাঁর গলা কেন যেন একটু ধরে এল। তিনি মানোর মাকে বললেন মধুর পা ধোবার জল গামছা দিতে, তারপর তাকে গুড় আর জল দিতে, কতটা পথ এসেছে। অনেক ভোরে বেরিয়ে পৌঁছতে পৌছতে বেলা শেষ। আজ রাতটা জিরিয়ে কাল যেতে হবে। যাবে তো ঘোড়ায়, মেয়ের যা জেদ, বলে রেখেছে অনেক আগেই।
মধুদা একটু পরে দাওয়ায় বসে মুড়ি গুড় আর নাড়ু খেতে খেতে দুর্গাগতির গল্প করছিল, সে নাকি খুব দুষ্টু হয়েছে, এক মুহূর্ত  এক জায়গায় বসে না, হামা টেনে সারা উঠোন ঘুরে বেড়ায়, মা তাকে সামলাতে পারে না, রাঁধনিও না, আর রামগতির তো সময়ই নেই, তাঁর টোলে আরো ছাত্র আসা বেড়েছে শুধু না, এখন তাঁকে জমিদার মশাইয়ের বাড়িতে গিয়ে পড়াতে হয় সপ্তায় তিনদিন।
জমিদারমশাইয়ের বাড়ি গিয়ে পড়াতে হয়! শুনে অবাক হয়ে গেল জয়াবতী।কেন? জমিদারমশাইয়ের তিন নাতি তো টোলেই পড়তে আসে, তারা নিজেদের আসন নিয়ে আসে, আর দোয়াত ঝুলিয়ে আসে। তাদের চাকর বাড়ির বাইরে অবদি এলেও, দরজা থেকে টোল অব্দি নিজেদের জিনিস নিজেদেরই বয়ে আনতে হয়।রামগতির কড়া নির্দেশ। জমিদারমশাইয়ের নাতিদের জন্যে কোন আলাদা ব্যবস্থা টোলে করা হবে না। তাদেরও সবার সঙ্গে মাটিতে আসন পেতে বসে পাঠ নিতে হবে, ভুল করলে শাস্তি পেতে হবে আর পাঁচজনের মতোই। রামগতির এই টোলে মূলত গ্রামের ব্রাহ্মণ আর কায়স্থ সন্তানরাই আসে। তবে নিচু জাতের কেউ পড়তে আগ্রহী হলে রামগতির টোলে তার অবারিত দ্বার। দরিদ্র ছাত্রদের থেকে তিনি কোন বেতনও নেন না। মধুদাদা বলছিল আশেপাশের গ্রাম থেকে এখান আরো অনেক ছাত্র আসছে। আজকাল প্রায় কোন তরি-তরকারিই হাট থেকে কিনতে হয় না। ছাত্ররা রোজই ঝুড়ি করে ক্ষেতের বেগুন, বেতশাক, মাচার লাউ কুমড়ো  নিয়ে আসে। রামগতি এইসব একদমই পছন্দ করেন না, তিনি বলেন গুরুর সংগতি না থাকলে ছাত্রদের এইসব ভেট তিনি নিতেন, কিন্তু তিনি তো অপারগ নন। মাসিক বেতন ছাড়া আর কিছুই তিনি নেবেন না।

কিন্তু এরা বেশিরভাগই  নিজেদের বংশের প্রথম প্রজন্মের বিদ্যার্থী, এদের বাবা মার ধারণা গুরুমশাই এগুলি পেলে খুশি হবেন আর তাদের ছেলেদেরও বেশি করে বিদ্যে ঢেলে দেবেন। পিতাঠাকুর এসব শুনে আরো রেগে যান। বলেন মূর্খরা আর কত উচ্চ চিন্তা করতে পারবে?আমি সবাইকে সমান করেই বিদ্যা দান করি। এখন যার যেমন নেবার ক্ষমতা। আসল কথা হচ্ছে আধার কেমন? বৃষ্টি তো ক্ষেত্র বিচার না করেই পড়ে। কিন্তু আধার বিশেষে জল ধারণ ক্ষমতা বাড়ে বা কমে। একটি পিত্তলের বাটি যা জল ধরবে, একটি পুষ্করিণী নিশ্চয় তার তুলনায় অনেক বেশি জল ধরতে পারবে। তার চেয়েও বেশি পারবে খাল বিল নদী। সুতরাং গুরুমশাইকে উৎকোচ দিয়ে লাভ নেই। নিজে অধ্যয়ন করতে হবে মন দিয়ে, অধ্যয়নের কোন বিকল্প নেই। এই কথাগুলি পিতাঠাকুর মাকে বলতেন, জয়াবতী কান খাড়া করে শুনত, তার সেভাবে কিছু মনে হয়নি তখন। কিন্তু এখানে এসে যেন তার চোখ খুলে গেছে। পিতাঠাকুর বাইরের বালকদের শিক্ষা নিয়ে এত চিন্তিত হলেও, তাঁর হাতের কাছে নিজের কন্যাটি যে সামান্য অক্ষর পরিচয় ছাড়া আর কিছুই শিখতে পারেনি, তা তাঁর নজরে পড়েনি তো? ভাগ্যিস তাঁদের ব্যামো হল আর পুন্যির জন্য পুথি পড়ে ঠিক লতা খুঁজে আনল তারা, নইলে কি আর কবরেজি শিখতে এখানে আসা হত? হঠাৎ সেই রাতের কথা মনে পড়ে যায় তার। আহা কী আনন্দই না হয়েছিল।
দুটিতে মিলে দুরুদুরু বুকে বেরোনো, পাহারাদারের চোখে ফাঁকি দিয়ে ছুট ছুট ছুট।  তারপর প্রাণ হাতে করে জঙ্গলে গিয়ে মধুলতা খুঁজে আনা! ভাবলেও শরীরের লোম খাড়া হয়ে যায়। সেই থেকে আর অমন বাইরে বেরোনোর সুযোগ হয়নি। এ বাড়িতে সব ভালো, কিন্তু মোটে বেরোতে দেয় না।
মধুদাদা আরো কত আগড়ম বাগড়ম বলে চলছিল। কিন্তু কী যেন বলল? পিতাঠাকুর জমিদার বাড়িতে কাদের পড়াতে যাচ্ছেন?
মধুদাদা নিজেই বলে দিল-
জমিদার মশাইয়ের দুই নাতনি আছে আর তাঁর ভাইয়েরও তিন নাতনি। এরা পড়বে বলে জেদ করেছে। এদেরই পড়াতে যেতে হচ্ছে রামগতিকে।
শুনে প্রথমে যেটা হল সেটা হচ্ছে দুর্জয় অভিমান। তাকে পড়ালেখা শেখাতেই চাননি পিতাঠাকুর, পড়ালেখা করলে মেয়েমানুষ তার্কিক হয়, কবে তাদের বংশের দুই মেয়ে, লক্ষ্মী আর সরস্বতী পড়ার দম্ভে তর্ক করেছিল কাশীর পণ্ডিতের সঙ্গে, তাতে নাকি ভারি অপমান হয়েছিল বংশের! শাস্তরে নাকি বলে বিদ্যা  বিনয় দেয়, কিন্তু বিনয় মানে কি লোকের পায়ের ধুলো চাটা? ধলাকে ধলা, কালকে কালো বললে কি অংকার হয়? এদিকে তো সবসময় কপচাচ্ছে, সত্যম ব্রুয়েত, সদা সত্য কথা বলিও। তা মেয়েমানুষ সত্য কথা বললেই দোষ? তাহলে তো দেখা যাচ্ছে সে মেয়েমানুষের আর পুরুষমানুষের সত্য আলাদা।নাহ, বেশিরভাগ মানুষেরই সে দেখছে কথায় কাজে কোন মিল নেই, এই যে পিতাঠাকুর, শুধুমাত্র মেয়েমানুষ বলেই তাকে মুখ্যু করে এত দিন বসিয়ে রেখে দিলেন। যদিও পুথির বিদ্যে ছাড়া আর যত রকম বিদ্যে আছে পিথিমিতে, তাতে সে শিক্ষিত হয়ে উঠেছিল।
তাদের বোলসিদ্ধি গাঁয়ের যত খেটে খাওয়া, নিচু জাতের মানুষ, তাদের কাজ করা  দেখতে তার ভারি ভালো লাগত। পাতু কুমোরের হাঁড়ি কুড়ি গড়া, কামারশালায় লোহা পেটাই, জেলেপাড়ার বিন্দে ঠাকুমার বসে বসে মাছ ধরার জাল বোনা, অঘোর তাঁতীর তাঁত বোনা- বসে তো দেখেছেই, এদের কাকুতিমিনতি করে এসব যন্তর সে চালিয়েও দেখেছে নিজে। তাই তো  ওষুধপালা তৈরি করতে হলে জয়াবতীকেই সবার আগে ভরসা করেন সেনমশাই। কোনটার সঙ্গে কোনটা কী অনুপাতে মেশাতে হবে, হাতের তাগবাগ তার মতো আর কারো না। এতদিন বাবার পুথির কালি তয়ের করে এসেছে, সে কি এমনি এমনি?তফাতের মধ্যে কালি হচ্ছে মনের ওষুধ, আর সেনমশাইয়ের কাছে তয়ের হয় শরীরের ওষুধ।
জয়াবতীর মতো মেয়েকে আশ্চর্যভাবে চুপ থাকতে দেখে সবাই বেশ অবাক হয়। মধুদাদা মুড়ি চিবুতে চিবুতে বলে
‘ও জয়াদিদি, এখনই গিয়ে তোমাদের তল্পিতল্পা বেঁধে নাও গো। কাল ভোর ভোর বেরিয়ে পড়তে হবে যে’
জয়াবতী সাড়া করে না। হঠাৎ তার মনে একটা ভাবনা উঁকি দিয়েছে? পিতাঠাকুর কি তবে দুটো বেশি কড়ির লোভে জমিদারমশাইয়ের বাড়ি গিয়ে তাঁর নাতনিদের পড়াতে রাজি হলেন? সে এটা ভাবতেই পারছে না। এমন হলে সে আর কোনদিন পিতাঠাকুরকে ভালবাসতে পারবে না। জয়াবতী অনেক কষ্টে সে ভাবনাকে সামলে নিল।
সেনমশাই বার বার একটা কথা বলেন, চিকিৎসাবিদ্যা একটা জ্ঞানচর্চার শাখা, সেখানে বুদ্ধি বিচার দিয়ে কাজ করতে হয়, হঠাৎ করে কিছু ভাবা যায় না। প্রমাণ ছাড়া কিছু বিশ্বাস করা চলে না। তাহলে এত মাস তাঁর কাছে কী শিক্ষে পেল জয়াবতী? সে যদি মধুদাদার একটা কথার ভিত্তিতে, নিজের চোখে কিছু না দেখেই পিতাঠাকুরকে মন্দ ভাবে? নাহ, আগে গাঁয়ে গিয়ে দেখা যাক, সত্যিটা কী? তারপর নয় এ নিয়ে ভাবলে চলবে।
সে বলল ‘ও মধুদাদা, তুমি তো এই পেত্থম এ দেশে এলে। আবার কবে আসবে ঠিক নেই কো। ঘোড়া থাকলে আমরা নিজেরাই ফিরে আসতে পারি। এখনো বেশ দিনের আলো আছে। চলো তোমাকে সোনাটিকরি গাঁখানা ঘুরিয়ে দেখাই। ফিরে গিয়ে তোমাদের জমিদার মশাইকে বলবে বোলসিদ্ধিকেও এমনি পস্কের করে রাকতে। তাহলে সবার এমন হঠাৎ হঠাৎ জ্বর আসবে না, অসুকবিসুক কম হবে’।



ব্যাঙের ব্যামো
রঞ্জনা বসু


ব্যাঙের হলো সর্দি ব্যামো
জিভে তে নেই রুচি
ভোঁদড় শুনে হেসে বলল
হচ্ছে বুঝি হাঁচি? 

ব্যাঙার আবার নোলা বড়ো
জোনাক ধরে খায়
বৃষ্টি তখন নেমেই এলো
কি করে ব্যাঙ লাফায়? 

উঠোন জুড়ে বৃষ্টি নাচে
নাচতে নাচতে পাড়া
গ্যাঙোর গ্যাঙ উচ্চ স্বরে
বইছে সুরের ধারা। 

চামচিকা সব জড়ো হল
আম কাঁঠালের গাছে
ঐ দেখা যায় চাঁদের আলো
গাছ গাছালির ফাঁকে। 

গানের গুতো ক্লান্ত হয়ে
ক্ষান্ত দিল অবশেষে
ব্যাঙ, ব্যাঙা ঘুমিয়ে পড়ে
ছিটে বেড়ার পাশে। 

ভোরের আলো উঠলো ফুটে
থামলো ব্যাঙের হাঁচি
ব্যাঙের আবার সর্দি হবে
ভেবেছে কেউ বুঝি।



নিয়ম ভঙ্গ 
কুহেলী দাশগুপ্ত 

রিকুর ক্লাস  নাইনের ফাইনাল পরীক্ষার আগে  ঠাকুমা দেহ রাখলেন।উননব্বই বছর বয়স হয়েছিল। একঘর পরিজনদের মাঝে  কোন আক্ষেপ রেখে যাননি। সেবা শুশ্রূষার কমতি ছিলনা।
তিনটি জেনারেশনকে জড়িয়ে এতগুলো বছর পার করেছেন।শেকড়ের গভীরতা কতখানি!এতদিনের সেবা, ওষুধের গন্ধ,  ডাক্তারবাবুর আসা সব থেমে গিয়ে একটা  শূন্যতা ঘিরে  আছে বাড়িটাতে।অশৌচ পালন চলছে। বাবা আর ছোটকা হবিষ্যি করছে। মা বলেছে, এই কটা দিন আঁশ ছুঁতে নেই। আপনজনের জন্যে  এটুকু  মানতে হয়।চতুর্থীতে পিসিরা  কাজ করে গেল। ঠাকুমারই  তো ছেলে  মেয়ে। কাজ কেন আলাদা হবে! রিকু  এতো নিয়মের গেরো  বোঝেনা। পুরুত ঠাকুর নিয়মিত আসেন। নিয়ম কানুন সব ওনার আয়ত্বে। ঠাকুমা অনেকদিন থেকেই ভুগছিলেন। বেডসোড়  হয়ে গিয়েছিল। মা, কাকিমা অনেক সেবা করেছে। চব্বিশ ঘন্টা দেখাশোনার লোক ও রাখা হয়েছিল। বার্ধক্যের জরাজীর্ণ শরীর।আর নিতে  পারলোনা। রিকু বুঝেছিল,  ঠাম্মা  মুক্তি  পেয়েছে। 

           ওর মন খারাপ হয়েছিল, যেদিন বাড়ির সবাই শ্রাদ্ধদিনের খাওয়া আর নিয়মভঙ্গের মেনু বাছাই করছিল।দেড়শ জন নিমন্ত্রিত! এই মন খারাপের দিনে কিসের এতো আয়োজন! রিকু ছোটকার কাছে জেনেছে, আত্মার শান্তির জন্য নর নারায়ণ সেবা দিতে হয়। তবেই নাকি আত্মার তুষ্টি হয়। ওর মন কেমন করে ওঠে। শ্রাদ্ধের দিন বাড়িতে লোকজন ভর্তি।
ছাদের ওপর খাওয়ার আয়োজন আর একতলার হলঘরে শ্রাদ্ধের কাজ হচ্ছে। ঠাম্মার কথা খুব মনে পড়ছে ওর। কাজ শেষে সারা বাড়ি  শান্তির জল ছিঁটানো হল। সন্ধ্যের পর কাছেই এক পুকুর পাড়ে ভাতসরা দেয়া  হল। বাবা আর ছোটকা আধসেদ্ধ রান্নাগুলো করেছে। মৎস্যমুখের দিন সকাল  থেকেই রিকুর মন অস্থির হয়ে আছে। আয়োজনে এতোরকম মাছের পদ! কোন আনন্দে! নিমন্ত্রিতরা খেয়ে সুখ্যাতি  গাইছে। শেষ ব্যাচে খেতে বসে রিকুর গা গুলিয়ে উঠল। ওকে খাওয়া ছেড়ে উঠতে  দেখে মা  ,কাকি ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

--সকাল থেকে কিচ্ছুটি খাসনি। তাই অমন হয়েছে।  রিকু  চোখে মুখে জল দিয়ে ছাদের  একধারে  দাঁড়াল। রাস্তার  ওপাশে কিছু মলিন জামাকাপড় পরা ছেলেমেয়ে দাঁড়িয়ে।  হয়তো কিছু পাওয়ার আশায়!
রিকু ওর প্লেটটা নিয়ে আরো কিছু খাবার  চেয়ে নিল। সবাই  অবাক হয়ে জানতে চাইলো,  কি ব্যাপার! কিছু না বলে ও বাইরে গিয়ে খাবারটা বাচ্চাগুলোকে  দিয়ে এলো।


পুকুরের কাহিনি
প্রবাহনীল দাস
অষ্টম শ্রেণী
 বিদ্যাসাগর শিশু নিকেতন
পশ্চিম মেদিনীপুর 

সকাল সকাল কোঁকোঁরকোঁ-তে ঘুম ভেঙ্গে যায় বলে
এই ভেবো না আমার কোন গ্রামের মাঝে বাড়ি,
আমার বাড়ি ঠিক শহরেই, তাতে কী যায় আসে?
ঘরের কাছের মুরগিগুলোই চেঁচায় তাড়াতাড়ি।
আমার ঘরের উলটোদিকেই পুকুর আছে এক,
গরমকালে জল নেমেছে, রয়েছে জেগে ডাঙা।
ঘাসের উপর ছাগল চড়ে, কুকুর করে স্নান,
হাঁসও ঘোরে, মুরগি থাকে যেইখানে পাড় ভাঙা।
দুপুর রোদে পাড়া যখন এক্কেবারে ফাঁকা,
মাছরাঙাতে তখন জলে ছোঁ মেরে মাছ তোলে,
জলের তলায় ডুবসাঁতারে পানকৌড়ি মাতে,
বিকেল হলে বাছুর এসে শরীর ডোবায় জলে।
যেই শহরে দূষণ ঢাকে রাস্তাঘাট আর বাড়ি,
কথায় কথায় কাজ করে যায় কলকব্জার যন্ত্র,
তেমনই এই পরিবেশে এমন পুকুর যেন
স্বয়ংপূর্ণ স্বনির্ভর এক দারুণ বাস্তুতন্ত্র।



ধারাবাহিক ভ্রমণ
হিমবাহের ঘাড়ের উপর 
পর্ব - ১
মলয় সরকার

ছোট্ট বন্ধুরা, তোমাদের এর আগে শুনিয়েছি তোমাদের প্রিয় শীত বুড়ো সান্টা ক্লজের কথা। এবার নিয়ে এসেছি আর এক হাড় হিম করা গল্প।হ্যাঁ, সত্যিই হাড় হিম হয়ে যাবে এমন জায়গার কথা।

আমরা গিয়ে হাজির হয়েছিলাম আলাস্কায়।তোমরা যারা বইয়ে পড়েছ তারা জান, এটা হল উত্তরমেরুর কাছে সেই এস্কিমোদের দেশ, বা স্লেজ গাড়ি আর মেরু ভল্লুকের দেশ, যেখানে ছ' মাস একটানা দিন আর ছ' মাস একটানা রাত।এখানে শীতকালে যাওয়া মুস্কিল, কারণ সব সময়েই রাত হলে আর ঘুরব, বেড়াব, দেখব কি করে? তা ছাড়া তখন, এত শীত পড়ে যে, বেড়াতে যাওয়ার কথা ভাবাই যাবে না।তখন, (নভেম্বর থেকে মার্চ) তাপমাত্রা নামে -১৮ ডিগ্রী থেকে -৩৫ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড পর্যন্ত।কাজেই আমরা ভাবতেই পারি না সেই অবস্থায় বাইরে ঘোরার কথা।তা ছাড়া বরফও পড়ে খুব।তাই গরম কালে যাওয়াই ভাল।তখন তাপমাত্রা ১২-২৩ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড। তবে সূর্য সারাদিন সোজাসুজি রোদ দেয় বলে, এখানে গরমটা ভালই হয়।


গ্লেসিয়ারের সামনে থেকে বেরিয়ে আসছে মাতানুষ্কা নদী


আগের দিন বেশ খানিকটা ঘুরে সান্টাক্লজের চত্বরে কাটিয়ে আমাদের যাওয়া হবে এক নতুন জিনিস দেখতে। তাই, যাতে আমাদের পরের দিন সকালে যেতে বেশি সময় না লাগে, আজই এখান থেকে অনেকটা এগিয়ে গিয়ে ওঠা হল একটা মোটেলে। মোটেল কি জান তো সবাই? নিশ্চয়ই জান, তবু যারা জান না, তাদের জন্য, সংক্ষেপে বলে নিই।

মোটেল, আসলে মোটরযাত্রীদের জন্য রাত কাটানোর জায়গা।এটা ঠিক হোটেলের মত এত সুযোগ সুবিধা সম্পন্ন বা ঝাঁ চকচকে দর্শনযোগ্য কেতাদুরস্ত নয়। এটা আমেরিকাতে মোটামুটি চালু হয় ১৯৬০-৬৫ সাল নাগাদ, যখন লোকে বেশি মোটর গাড়িতে দূরে দূরে যাওয়া শুরু করল। রাস্তায় খুব ভাল হোটেল তো আর পাওয়া যায় না সবসময়।এগুলো আমাদের এখানকার পথচলতি ধাবার মত অনেকটা। হাইওয়ে রাস্তার মাঝে মাঝে যেখানে বড় হোটেল নেই, আর শহরও দূরে, সেখানে মোটর যাত্রীদের, কম খরচে বিশ্রাম ও রাত্রিবাসের, জন্য এগুলো তৈরী হয়েছিল। এখানে মোটরের পার্কিং থেকেই যাতে সহজে ঘরে ঢোকা যায়,  তার জন্য ঘরের দরজা পার্কিং এর কাছেই হয়। আর আরাম, সুযোগের ব্যবস্থা এখানে অনেক কম।

তা, এই রকম একটা মোটেলেই থাকার ব্যবস্থা হল, যাতে আগামী কাল সকালেই সময় নষ্ট না করে পৌঁছে যেতে পারি গন্তব্যে আর বেশি সময় থাকতে পারি সেখানে।কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এখানে সেই একই, রাতে ঘুম আসছে না।আসলে রাতের অন্ধকার না হলে যে ঘুম আসতে এত কষ্ট হয়, সেই ব্যাপারটা আগে এত বেশি করে বুঝি নি। সারা রাতই আকাশে দিনের আলো। আমরা এসেছি আলাস্কায় ছ' মাস দিনের সময়ে তো।সারা রাত জেগে শুয়ে এপাশ ওপাশ করছি, শেষে রাত তিনটের সময় আলোটা আমাদের ওখানের শেষ বিকালের মত হতে, ক্লান্তিতে একটু ঘুম এল।

যাই হোক সকালেই আবার উঠে তৈরী হয়ে নেওয়া গেল।( ক্রমশ)


স্মরণীয়
(তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়)
কলমে - পীযূষ প্রতিহার

   রাঢ় বাংলার বীরভূম ও বর্ধমান জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলের সাঁওতাল, বাগদি, ডোম, বোষ্টম, বাউরি সহ সকল প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষের জীবন আলেখ্য যাঁর কলমে সবচেয়ে ভালোভাবে ফুটে উঠেছে তিনি হলেন কথাশিল্পী তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর রচনায় ছত্রে ছত্রে ফুটে উঠেছে সামাজিক পরিবর্তন ও মানুষের মহত্ত্বের ছবি। ১৮৯৮ সালের ২৩ শে জুলাই বীরভূমের লাভপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তাঁর বাবা ছিলেন হরিদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও মা ছিলেন প্রভাবতী দেবী। মাত্র ছ'বছর বয়সে ১৯০৫ সালে পিতৃহারা হন তিনি। ১৯১৬ সালে গ্রামেরই যাদবলাল এইচ.ই. স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় পাশ করেন তিনি। এরপর প্রথমে কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ ও পরে সাউথ সাবার্বান কলেজে (বর্তমান আশুতোষ কলেজ) আই এ পড়া শুরু করেন। কিন্তু শারিরীক অসুস্থতা ও ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রবাহে জড়িয়ে পড়ে পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি। ১৯৩০ সালে জাতীয় কংগ্রেসের আইন অমান্য আন্দোলনে যোগ দিয়ে জেলে যেতে হয়েছিল তাঁকে। ১৯৩২ সালে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ হয় তাঁর। ঐ বছরই তাঁর লেখা প্রথম উপন্যাস 'চৈতালি ঘূর্ণি' প্রকাশিত হয়। ১৯৩৩ সালে প্রকাশিত হয় একমাত্র কাব্যগ্রন্থ 'ত্রিপত্র'। ১৯৩৯ সালে প্রকাশিত হয় 'ধাত্রীদেবতা' উপন্যাস। ১৯৪০ সালে সপরিবারে গ্রাম ছেড়ে কলকাতায় চলে আসেন তিনি। ১৯৪২ সালে তিনি ফ্যাসিবাদ বিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘের সভাপতি নির্বাচিত হন। তাঁর লেখা বিখ্যাত সব উপন্যাস গুলি হল 'কালিন্দী', 'গণদেবতা', 'মন্বন্তর', 'পঞ্চগ্রাম', 'কবি', 'সন্দীপন পাঠশালা', ও 'অভিযান'। তিনি অসংখ্য ছোটগল্প ও কিছু নাটক লিখেছেন। তাঁর মোট ৬৫ টি উপন্যাস, ৫৩ টি ছোটগল্প সংকলন, ১২টি নাটক, ৪টি প্রবন্ধ সংকলন, ৪টি স্মৃতিকথা এবং ১ টি করে কাব্যগ্রন্থ ও প্রহসনের হদিস পাওয়া গেছে।

    সাহিত্য রচনার জন্য নানা সম্মানে ভূষিত হয়েছেন সারা জীবন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৪৭ সালে তাঁকে শরৎ স্মৃতি পদক প্রদান করে। ১৯৫৫ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁকে 'আরোগ্য নিকেতন' উপন্যাসের জন্য রবীন্দ্র পুরস্কার দেয়। ১৯৫৬ সালে সাহিত্য একাডেমী সম্মান অর্জন করেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯৫৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগত্তারিনী পদক পেয়েছিলেন তিনি। ১৯৬২ সালে ভারত সরকারের পদ্মশ্রী পুরস্কার পান তিনি। ১৯৬৭ সালে 'গণদেবতা' উপন্যাসের জন্য জ্ঞানপীঠ পুরস্কার লাভ করেন তিনি। ১৯৬৮ সালে পান পদ্মভূষণ। ঐ বছরই কলকাতা ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাম্মানিক ডি লিট পান তারাশঙ্কর। ১৯৬৯ এ সাহিত্য একাডেমীর ফেলো নির্বাচিত হন ও বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন।
    তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাহিনী নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্রের সংখ্যা প্রচুর। তবুও উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হল 'জলসাঘর', 'অভিযান', 'সপ্তপদী', 'গণদেবতা', 'হাঁসুলী বাঁকের উপকথা' প্রভৃতি।
    শুধু সাহিত্য রচনাতেই নয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবেও তিনি ছাপ রেখেছেন। ১৯৫২ সালে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার সদস্য মনোনীত হয়েছিলেন তিনি। ১৯৫৬ সালে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে এক সাহিত্য সমাবেশে চীনদেশে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন কিন্তু অসুস্থ হয়ে পড়ে যেতে পারেননি। পরের বছর চীন সরকারের আমন্ত্রণে সেদেশে গিয়েছিলেন তিনি। ১৯৫৮ সালে আফ্রো-এশীয় লেখক সম্মেলনের প্রস্তুতিতে যোগ দিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতীয় লেখক দলের নেতা হিসেবে তাসখন্দ গিয়েছিলেন। ১৯৬০ সালে বিধানসভা থেকে অবসর নেন এবং রাষ্ট্রপতির মনোনীত সদস্য হিসেবে সংসদে ভূমিকা পালন করেন। ১৯৬৬ সালে সাংসদ পদ থেকে অবসর নেন।
    ১৯৭১ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বর ভোরে এই কথাশিল্পী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।


পাঠ প্রতিক্রিয়া
( ছোটোবেলা ৯১ পড়ে বেথুয়াডহরীর বানীয়া সাহা যা লিখল) 

কথায় বলে বাঙালিদের বারো মাসে তেরো পার্বণ! সত্যিই তাই। আমরা একটু সুযোগ পেলেই মেতে উঠতে চাই খুশির আলোকে, সেটা উৎসব হোক বা ব্যক্তিগত আনন্দ! এই তো কিছু দিন আগে, উল্টো রথযাত্রার সেই একত্রিত হইচই আর ভীষণ চেনা কোলাহল গুলো এখনো যেন কান পাতলেই শুনতে পাই প্রগাঢ় স্মৃতির রোমান্থনে। আজ "জ্বলদর্চি" র ৯১ তম সংখ্যার প্রচ্ছদটি আরও একবার মনে করিয়ে দিলো রথোৎসবের মিষ্টি দিনটিকে। অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই শ্রদ্ধেয় চিত্রগ্রাহক কল্যাণ সাহা মহাশয় কে তাঁর সুদক্ষ ক্লিকে ফুল দিয়ে সাজানো এমন সুন্দর রথযাত্রার বর্ণময় একটি ছবি আমাদের উপহার দেওয়ার জন্য। 
উৎসবের কি আর শেষ আছে? বাঙালির সবচেয়ে বড়ো উৎসবে মায়ের আসার সময় যে হয়ে এলো! জয়াবতী, পুণ্যি, উমাশশী নৌকায় চেপে আগামী শরতের যে মিষ্টি আবহাওয়াটা উপভোগ করছে সেই মুহূর্তটাকে কাছে পাওয়ার লোভটাই যেন সামলাতে পারছি না আমি। সাথে আবার গঙ্গার ইলিশ!এসব দেখে ইচ্ছে পূরণের খিদে আর পেটের খিদে ক্রমশ যেন বেড়েই চলছে। একদিকে সবুজের ভিড় অন্যদিকে গঙ্গা বক্ষে হিমেল হাওয়ার স্পর্শ এ যেন "প্রাণের আরাম মনের আনন্দ আত্মার শান্তি"। কিন্তু  আমাদের এমন সুন্দর শস্যশ্যামলা দেশে সামাজিক রীতিনীতির জটিলতা শুধু মেয়েদেরই নয়, ছেলেদেরও কিভাবে পায়ে শিকল দিয়ে রেখেছে তার একটা ছোট্ট ঝলক বিখ্যাত লেখিকা, কবি, কথাসাহিত্যিক, ঔপন্যাসিক শ্রদ্ধেয়া তৃষ্ণা বসাকের " জয়াবতীর জয়যাত্রা" র ত্রিবিংশ পর্বটি থেকে স্পষ্ট উপলব্ধি করা যায়। লেখিকার লেখার আড়ালে লুকিয়ে থাকা এই কঠিন সত্য গুলি আমায় অনেকখানি বুঝতে ও চিনতে শেখাল বাস্তব জীবনটাকে। ছোট্ট একটা মেয়ে জয়াবতী যে কিনা  "অধ্যয়ন" এর অর্থটাই জানে না অথচ সমাজের কঠিন বিষয় গুলো সব যেন তার নখদর্পনে! কুসংস্কার ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে তার এই প্রতিবাদী সত্তা আমার কাছে এক নতুন অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করলো। এমনকি এই মেয়েটির গাংচিল হওয়ার যে ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন লেখিকা নিজের কলমের মধ্য দিয়ে সেই লাইনটির ভিতর লুকিয়ে থাকা স্বাধীনতার স্বাদ আমাকে ভীষণ তৃপ্ত করলো। উপন্যাসটির এই অংশে পুরোহিত মশাই পুণ্যির তর্পণ করা নিয়ে ব্যঙ্গের সহিত যে কটুক্তিগুলো করেছিল তার যোগ্য জবাবে জয়াবতীর সাহসীকতার রূপটিকে যেভাবে লেখিকা ফুটিয়ে তুলেছেন তা আমার মতো চরম ভীতু মানুষের মধ্যেও নির্ভীকতার বীজ বপন করে গেল। উপন্যাসটি পড়তে পড়তে ইচ্ছে হচ্ছিল আমার ভিতরেও যেন একটা জয়াবতী জেগে উঠুক। আশা রাখি লেখিকার কলমের ম্যাজিকে "জয়াবতীর জয়যাত্রা" খুব শীঘ্রই ঘোষিত হবে। আর এই জয়ের আনন্দেই আরও রঙিন হয়ে উঠবে বাঙালির উৎসব আঙিনা। বাংলা মাসের শুরুতে হোক বা মাসের শেষ দিন, উৎসবের আলোকে মানুষ গা ভাসায় পরমানন্দে। এরকমই এক উৎসব হলো বাঙালির চড়ক উৎসব। আর এটা নিয়েই আস্ত একটা কবিতা নামিয়ে ফেললেন মাননীয় কবি ভজন দত্ত মহাশয়। জিলিপি, পাঁপড়ভাজার গন্ধ, হাউইবাজির শব্দ সবকিছুর অনুভূতি কীভাবে ঘুরেফিরে মিলেমিশে যাচ্ছে পিঠে বড়শি ফোটানো মানুষটার হৃদয়কোণে চড়কের ঘূর্ণনে তার এক টুকরো ছবি যেভাবে ছন্দে ছন্দে  ফুটিয়ে তুলেছেন কবি তা আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল চড়ক প্রাঙ্গনের সেই চেনা কিছু  কোলাহলের ভিড়ে।
দারুণ উপভোগ করলাম কবিতাটি।
আরও একটি সুন্দর কবিতা পড়লাম এবারের সংখ্যায়। শ্রদ্ধেয় কবি তারাপ্রসাদ সাঁতরা মহাশয়ের শ্যামাদাস আর রামাদাসের কথোপকথন পড়ে দারুণ মজা পেলাম। গাধাকে ঘোড়া বলে হাস্যকর ঘটনাটার বিচার বিশ্লেষণ করতে গিয়ে যখন নিজেরই হাঁড়ির খবর ফাঁস হওয়ার জোগাড় তখন চুপ হওয়া ছাড়া আর উপায় কী? 
এদিকে আবার ছোট্ট ভানুপ্রিয়া দেখছি আমার মনের কথাই লিখেছে, 
"ধুর ছাই/ ভাল্লাগে না/ বোরিং এই লেখাপড়া"......
সত্যি বলতে যখন ছোট ছিলাম তখন ভানুপ্রিয়ার মতো আমারও বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজে পড়ে থাকতে মোটেই ভালো লাগতো না, কিন্তু যখন ধীরে ধীরে বেড়ে উঠলাম, খুঁজে পেলাম নিজের পছন্দের সাবজেক্টটাকে তখন আর বোরিং লাগেনি। তাই ভানুপ্রিয়াকে বলতে চাই,  তুমিও তোমার প্রিয় বিষয়টাকে খুঁজে বের করো, এগিয়ে যাও তার হাত ধরে,  চিনতে ও বুঝতে চেষ্টা করো সাবজেক্টটাকে, দেখবে আর বোরিং লাগবেনা। আর তোমার পাখি হওয়ার ইচ্ছে টা আমারও ভিতর ঘরে উঁকি দেয়। যদি তুমি আর আমি দুজনেই কোনোদিন পাখি হতে পারি তাহলে চুপিচুপি দুজনেই উড়ে যাবো দূর অজানায়, কেমন?.....
আর হ্যাঁ লেখালিখিটা ছেড়ো না যেন! পরেরবার এর চেয়েও সুন্দর কবিতা তোমার কাছ থেকে পাওয়ার আশায় থাকলাম।
এই সংখ্যায় জানা অজানার গল্প বিভাগে বিশিষ্ট লেখক সৌগত রায়ের "ক্যাট কাহন" আমায় ভীষণরকম বিস্মিত করেছে।  বিড়ালদের যে সুইট ব্লাইন্ড বলা হয় তা আমার সত্যিই অজানা ছিল। শুধু তাই ই নয়, পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো ধনী বিড়াল "ব্লাকি", মহাকাশে পাঠানো প্রথম বিড়াল "ফেলিসেট" এদের কথাও আমার জানা ছিল না। বিড়ালকে নিয়ে এত সব অজানা তথ্য পেয়ে আমি মুগ্ধ এবং সমৃদ্ধ। এরকম আকর্ষণীয় ইনফরমেশন পেলে বারবার এই ধরনের লেখা পড়তে ইচ্ছে করে। আমি ভীষণ উপকৃত হয়েছি "ক্যাট কাহন" পড়ে। এই ধরনের আরও ভিন্ন ভিন্ন নতুন তথ্য যেন "জ্বলদর্চি" র প্রতি সংখ্যায় আমাদের কাছে উপহার হয়ে ফিরে আসে, এই কামনা করি। 
পত্রিকার "স্মরণীয়" বিভাগে প্রকাশিত দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের অজানা কিছু জীবনকথা আমার জ্ঞানের ভান্ডারকে অনেকটা বিকশিত করলো। এই মহান ব্যক্তিত্বদের জানা ভীষণ প্রয়োজন বর্তমান প্রজন্মদের। কারণ এঁনাদের আদর্শেই তো লুকিয়ে থাকে সাফল্যের চাবিকাঠি! মাননীয় লেখক পীযূষ প্রতিহার মহাশয় কে জানাই অসংখ্য ধন্যবাদ প্রতিটি সংখ্যায় এমন মহৎ ব্যক্তিদের সংস্পর্শ এনে দেওয়ার জন্য। 
শ্রদ্ধেয়া লেখিকা অদ্রিজা সাঁতরা মহাশয়ার লেখা "জ্বলদর্চি" র ৯০ তম সংখ্যার পাঠপ্রতিক্রিয়া পত্রিকাটির জনপ্রিয়তার শিখরকে চিহ্নিত করে। লেখিকার এই বিশ্লেষণ তার সুনিপুণ পর্যবেক্ষণকে তুলে ধরে; পত্রিকার খ্যাতিকে স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করা যায় লেখিকার পাঠপ্রতিক্রিয়া বিচার করলে। 
শুধু লেখালেখিই নয়, "জ্বলদর্চি" সুযোগ করে দেয় বিভিন্ন সৃজনশীল প্রতিভা বিকাশেরও। তাই তো এখানে চোখে পড়ে ছোট্ট ছোট্ট হাতের নিখুঁত রঙের টান। এবারের সংখ্যায় যেই ছবিটি আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে তা হলো সুরজিতের বাঁশি হাতে বসে থাকা মিষ্টি কৃষ্ণটির ডিজিটাল পেইন্টিংটা। রঙের ব্যবহার এত সুন্দর ও মসৃণ ভাবে করেছে সুরজিত, সত্যিই অবিশ্বাস্য! তোমার এই শৈল্পিক প্রতিভা বিকশিত হোক তোমারই তুলির সূক্ষ টানে।

আবার দশম শ্রেণির পৃথার ইউনিক থিমটাও আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছে। রঙের ব্লেনডিং অসাধারণ। প্রতিটি শিল্পীরই নিজস্ব কিছু ভাবনা থাকা একান্ত দরকার,  কারণ দেখে দেখে কপি করে আঁকার মধ্যে  কোনো ক্রিয়েটিভিটিকে প্রকাশ করা যায় না। সেদিক থেকে বলতে গেলে পৃথার আঁকাটি সত্যিই অন্যরকম। এভাবেই সৃজনশীলতায় থেকো পৃথা। অনেক শুভকামনা রইলো তোমার জন্য। 
এই প্রসঙ্গে পত্রিকায় প্রকাশিত "জয়াবতীর জয়যাত্রা" ধারাবাহিক উপন্যাসটির প্রচ্ছদের কথাটিও সমানভাবে উল্লেখ প্রয়োজন,  উপন্যাসের পরিপ্রেক্ষিতে সুদীপ্তা আদিত্যের এই ডিজিটাল পেইন্টিংটি ভীষণ মানানসই হয়েছে। আমার মতো ছোটোরাও যে এই ছবিটি নিজেদের মতো করে মনের আনন্দে উপভোগ করবে তা বলাই যায়। 
এভাবেই সকলকে সাথে নিয়ে "জ্বলদর্চি" পাড়ি দিক এক নতুন দেশে যেখানে লেগে থাকবে বহুরূপী প্রতিভার সার্থক ছাপ। সৃষ্টি হোক সাহিত্যের এক অভিনব অধ্যায়।

আরও পড়ুন 
জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments