জ্বলদর্চি

ঢেরাপূজা /ভাস্করব্রত পতি

পশ্চিমবঙ্গের লৌকিক উৎসব, পর্ব -- ৩০

ঢেরাপূজা

ভাস্করব্রত পতি


"বেরা ঘরে ঢেরাপূজা / ঘি চড়চড় কুত্তা ভাজা / কুত্তা ভাজা খাবনি / বেরা ঘরে যাবনি।" 

'ঢেরাপূজা' নিয়ে এরকম মজার ছড়া একসময় শোনা যেত। এখন প্রায় হারাতে বসেছে এই লৌকিক উৎসবটিই। তবে এই ছড়াটির পাঠান্তরে একটি ভিন্ন ছড়ার সন্ধান দিয়েছেন ড. অমর সাহা। তিনি তাঁর "পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ছড়ার সমীক্ষা"তে ঘাটালের খুকুড়দহ এলাকা থেকে প্রাপ্ত একটি ছড়ার উল্লেখ করেছেন এরকম -- "বেরা ঘরে ঢেরা পূজো / ঘি চর চর কলমিভাজা / কলমিভাজা খাবনি /বেরাঘরে যাবনি"।

মেদিনীপুর জেলায় মাহিষ্যদের একটি পরিচিত পদবী 'বেরা'। যে পূজায় ঠাকুরবাড়িতে পূজার নৈবেদ্য নিয়ে যাওয়ার সময় উচ্চারিত করা হয় এই ছড়াটি। আসলে বেশি পরিমাণ ঘি দিয়ে কলমি শাক ভাজা হয় ঢেরা পূজা তথা খইঢেরার অঙ্গ 'শাকপালন' আচারে। বাঁকুড়াতে এই শাকপালন হয় তিনদিন ধরে ( সূত্র -- মেঘদূত ভুঁই )। দুপুরে ভাতের সাথে সকলকে খেতে হয় যেকোনও শাক। তবে পরেরদিন অবশ্য কোনো ধরনের শাক নিজের বাড়িতে ও আত্মীয় বাড়িতেও খাওয়া চলবে না তরিতরকারি সাথে। আর মনসা দেবীর উদ্দ্যেশ্যে দেওয়া হয় নয় ধরনের শাক। উৎসর্গকৃত শাক কিন্তু বঁটিতে কাটা হয়না। স্রেফ হাতে ছিঁড়ে দিতে হয়। পুঁই, লাউ, কানশিরা, পাট, কুমড়া, কুলত্যা, শুশনি, শতপুণ্যা এবং সজনে শাক দেওয়া হয় কচু পাতায় করে। কিছু শাক রেখে দেওয়া হয়, তা রাতে সেদ্ধ করে সকলকে খেতে হয়। অনেকেই রসুন দিয়ে শাক রান্না করেন। তবে বেশিরভাগ যায়গায় এই শাক রান্নায় রসুন নিষিদ্ধ। এই 'শাকপালন' উপচারকে সামনে রেখেই উপরোক্ত ছড়ায় 'ঘি চর চর কলমীভাজা' কথাটি এসেছে। যদি প্রথমে মঙ্গলবার 'শাকপালন' আচার পালন হয় তবে পরের শনিবার পালিত হয় 'খইঢেরা'।

বাঁকুড়া জেলায় ঢেরাপূজাকে বলে 'খইঢেরা'। কেননা এই উৎসবে খই লাগবেই। খই দেওয়া হয় ডালা ভরে। নৈবেদ্য হিসেবে খইয়ের ডালার সাথে থাকে পৃথক পৃথক ডালায় ছোলা ভাজা, মটর ভাজা, চাল ভাজা, তিলের নাড়ু, চালের নাড়ু, নারকেলের নাড়ু ইত্যাদি।

আর মেদিনীপুরে তা শুধুই 'ঢেরা পূজা' নামে কথিত। এই পূজাতে কিন্তু সূতো পাকানো কৃষিযন্ত্র "ঢেরা" উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়না। কোনো সম্পর্ক নেই 'ঢেরা'র সঙ্গে ঢেরাপূজার। আসলে মনসা পূজার অন্য নাম এই 'ঢেরা পূজা'। শ্রাবণ মাসের অমাবস্যার পর প্রতিপদ থেকে ঐ মাসের ২২ শের মধ্যে যেকোনো শনিবার ও মঙ্গলবার ধরে ঢেরাপূজা হবে। তাই একে বলা হয় 'বাইশা ঢেরা'। ব্রাম্ভণদের পূজার নাম 'নাগপঞ্চমী', আর মাহিষ্য সম্প্রদায়ের পূজার নাম 'ঢেরাপূজা' বলে কথিত। তবে এই ঢেরাপূজা আসলে এখানকার মনসা পূজা। গোটা শ্রাবণমাস জুড়েই পূজা চলে প্রতি শনিবার এবং মঙ্গলবার ধরে। 

'ডালা' থেকে এসেছে 'ঢেলা' শব্দটি। 'ডালা' অর্থে 'চেঙ্গারী' বোঝায়। 'পিটিকা' তথা বাঁশ নির্মিত পাত্র বা আধার বলতেও এই 'ডালা'।
ডল(ল্ল)ক > ডালা
খই ডালা > খইঢেলা > খইধারা > খইঢেরা

'মনসার ভাসান' এ পাই 'হেন পুত্র কারে দিলাম ডালি'। তেমনি 'গোরক্ষবিজয়'তে আছে 'জথ ধন য়াছিল সকল দিলা ডালি'। কোথাও কোথাও ঢেরাপূজাকে বলে 'ঢেলা ফেলা'। এই 'ঢেলা ফেলা' বা 'ঢ্যালা ফ্যালা' হল মনসা বিষয়ক একপ্রকার পার্ব্বণবিশেষ। 'হুতোম প্যাঁচার নক্সা'তে রয়েছে 'ঢেলাফেলা'র প্রসঙ্গ -- "শ্রাবণ মাসে ইলিস মাছ ওটবার পূর্ব্বে ও ঢ্যালা ফ্যালা পার্বণে গুরুদাসের দু মাসের মাইনেই খরচ হয়"। আবার ক্ষেমানন্দ দাসের 'মনসার ভাসান'তে আছে “শাক রাখা ঢেলা ফেলা দশহরা আর / মনসার পূজা নানা প্রতি ঘরে ঘর"। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, "বিবাহ করিতে আসার সময়ে বরকে বা বর যাত্রীকে ঢেলা ফেলিয়া মারার লৌকিক আচার ; ঢেলা ফেলানিবারণার্থ দেয় অর্থ।" এই ঢ্যালা ফ্যালার কথা মেলে 'হুতোম প্যাঁচার নক্সা'তে -- “ঢ্যালা ফ্যালা ও বিয়ে ভাটির হুকুম হাকাম ও নিষ্পত্তি করার ভার মিত্তির বাবুদের ওপরই দেওয়া হয়"।

'ঢেলাফেলা' উৎসব হাওড়া জেলাতে হয় শ্রাবণ সংক্রান্তিতে। এই দিনেই বাঁকুড়ায় পালিত হয় 'খইধারা' বা 'খইঢেরা', নদীয়ায় 'পাতালফোঁড়' এবং বর্ধমানে 'খইদই'। এই উৎসবের সঙ্গে অনেক সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায় হুগলীতে ভাদ্র সংক্রান্তিতে আয়োজিত 'বুড়িআরন্দ', দক্ষিণ ২৪ পরগনায় ভাদ্র সংক্রান্তিতে 'অরন্ধন' বা 'রান্নাপূজা'র সঙ্গে। বাঁকুড়ার পাত্রসায়রে এই উৎসবকে বলে 'আরণপালা' বা 'অরন্ধন'।

এই পূজায় কেয়াফুল লাগে। না পাওয়া গেলে কেয়া পাতা দিয়ে কাজ চালানো হয়। এইদিনে প্রতিটি বাড়িতে কেয়াফুল টাঙানো থাকে। আসলে কেয়াফুলের গন্ধ দুর্গন্ধনাশক। এইসময় বর্ষার পচা জলে যে দুর্গন্ধ তৈরি হয়, তা নিবারণের প্রাকৃতিক উপায় এই কেয়াফুল তথা Pandanus tectorius। উল্লেখ্য বিরিয়ানি বানাতে ব্যবহৃত ক্যাওড়ার জল তৈরি হয় এই কেয়াফুলকে বাষ্পীভবনের মাধ্যমে।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

1 Comments