জ্বলদর্চি

পথরেখা গেছে মিশে - পর্ব -৪/ মিলি ঘোষ

পথরেখা গেছে মিশে - পর্ব ৪

জগৎ দর্শন

মিলি ঘোষ

তখন ক্লাস টেন। মানসিক বয়স বাড়েনি অপার তখনো, শারীরিক বয়সের অনুপাতে। সমাজ যে তাকে একটু একটু করে অন্য দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করেছে, বুঝত না অপা। কড়া দৃষ্টি, নরম দৃষ্টি এসব দেখেই সে অভ্যস্ত। দৃষ্টির যে আরো ভাষা থাকতে পারে, মাথাতেই আসেনি। মানুষের লোলুপ দৃষ্টি কেমন, জানতই না বা আলাদা করে এর কোনো অর্থ থাকতে পারে ভাবেওনি অপা। তখনো মাঠ দেখলে মন আনচান। অথচ দুনিয়া তাকে জোর করছে অন্যদিকে মুখ ঘোরাতে। তার স্বাভাবিকতা বিসর্জন দিতে বাধ্য করা হচ্ছে। কেউ দেখে শেখে, কেউ ঠেকে। তখনও সাদা কালোর প্রভেদ করতে শেখেনি অপা। কী দেখবে সে ? তাই ঠেকতে ঠেকতেই সে শিখতে লাগল। 

অপার বাবা একদিন অপাকে তাঁরই বয়সী এক সম্মানীয় ব্যক্তির কাছে পাঠিয়েছিলেন একটি বিশেষ দরকারে। সেদিন তাঁর স্ত্রী বাড়িতে নেই, অপা জানত না। আর জানলেই বা কী ? তখনও তো জগতের কিছুই দেখেনি অপা। কারোর উপস্থিতি বা অনুপস্থিতিতে কোনও মানুষের আচরণ পাল্টাতে পারে ভাবতেও পারেনি সে।  
ভদ্রলোকের গায়পড়া ভাবটা অসহ্য লাগছিল অপার। অন্যদিন এমন করে না তো। কাজের অছিলায় গায় হাত দেবার চেষ্টা করছিল। অপা যেন এক অন্য পৃথিবী দেখছে। এ আবার কী! একজন পিতৃস্থানীয় মানুষ, এরকমও হয় নাকি ? বাবার দেওয়া কাজটা সেরে, কোনওরকমে লোকটার হাত ছাড়িয়ে দৌড়ে পালিয়ে আসে অপা। কী বলবে বাড়ি এসে, কেউ বিশ্বাস করবে ? 
হয়তো বড়োরা বলবে, "তুই ছোটো, তোকে স্নেহ করেন।" 
দুই একজনের হয়তো কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়বে, কিন্তু মুখে কিছু বলবে না। বিষয়টা যে অপার স্বপক্ষে যাবে না, তা বুঝে নিয়েই পুরো চেপে গেল অপা। শুধু বলল একজনকে। অপার ঠিক ওপরের দিদিকে। 
ফোঁস করে উঠেছিল, "কী ?"
চোখে যেন ওর আগুন জ্বলছিল। 
বলেছিল, "আর কোনওদিন যাবি না।"
একটু চুপ করে থেকে বলেছিল, "প্রতিবাদ করে লাভ হবে না কিছু। লোকটা দেখছি ধরিবাজ। ভালো মানুষের মুখোশ পরে ঘোরে।"
সেই মুখোশধারী কিন্তু দিব্য ছিল। এতটুকু পরিবর্তন তার মধ্যে দেখা যায়নি। আগেও সকলের সাথে যেমন ব্যবহার করত, সেদিনের পরেও তেমনই।  অপার মতো একটা ছোটো মেয়ের কথা যে ধোপে টিকবে না, সেটা সে ভালই বুঝেছে। কেউ বিশ্বাস করবে না। এমন কি বাড়িতেও না। 
কিন্তু অভিজ্ঞতা তাকে যা শেখায়নি, তাই ঘটেছিল। 
অপার থেকে কিছু বড়ো একটি মেয়ে রাস্তায় তাকে শাসিয়েছিল। 
সেই ব্যক্তি একটুও না টোলে গলায় মধু ঢেলে বলেছিল, "কী সব বলছ তুমি মা, আমি তো বুঝতেই পারছি না। যাও যাও, তুমি বাড়ি যাও। আমি তোমার বাবার সাথে এ নিয়ে কথা বলব।"
হ্যাঁ, প্রতিবাদ করেছিল অপার দিদি। একেবারে নিজের দায়িত্বে। লোকটার মিষ্টিভাষ শুনে আরো ক্ষেপে গেছিল।
ওই যে লোকটা বলল, "তোমার বাবার সাথে এ নিয়ে কথা বলব," এটা কিন্তু মিষ্টি সুরে এক ধরনের থ্রেট।
সে ব্যক্তি কিছুই বলেনি অপার বাবাকে। সযত্নে প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেছে এবং খুব স্বাভাবিক ব্যবহার করেছে। তবু চালাকি করতে কথাটা বলেছিল অপার দিদিকে। 
অপার গা ঘিন ঘিন করত। মানুষ এমনও হয় ? ছি ছি! 
অপার দিদি বলেছিল, "এই তো দুনিয়া। আরো কত কী দেখবি। সাবধানে থাকিস।"
ওই ব্যক্তিকে রাস্তায় দেখলে বুক কাঁপত অপার। উল্টো ফুটে অন্য দিকে তাকিয়ে বেরিয়ে যেত। 
একদিন টার্নিং এর মুখে মুখোমুখি হয়ে যায় অপা লোকটার সাথে। সুযোগ কাজে লাগায় সে ব্যক্তি। পাশ দিয়ে যাবার সময় সাপের মতো হিলহিলিয়ে বলে যায়,"হার্টলেস।"
কাঁদতে ইচ্ছা করছিল অপার। কিন্তু বাড়িতে এত লোক। কান্নারও তো জায়গা নেই। অপার মনে হচ্ছিল, "মরে যাই। বাবার বয়সী একটা লোক। সে যেমনভাবে আমাকে বাজাতে চেয়েছে তেমনভাবে বাজিনি বলে, আমি হার্টলেস ?" 

ভালো লাগত না কিছু অপার। যা মাথার মধ্যেই আসেনি কোনওদিন, তাই নিয়েই সাবধান হতে হলো। সাবধান হতে গিয়ে দরজা বন্ধ করে তো আর বাড়িতে বসে থাকা যায় না। যায় না বলেই ফেস করতে হয়। 
অপা তখন কলেজে পড়ে,কো-এডুকেশন। ছেলে মেয়ের মধ্যে কোনও প্রভেদ ছিল না। কত সহজ সরল ছিল বন্ধুরা। সবাই সবার বাড়িতে যেত। অপা ভেবে পেত না, "ঐ লোকগুলো কেন এমন ? ওদের প্রত্যেকেরই তো বাড়িতে স্ত্রী আছে।"
এই ধরনের ঘটনার মুখে অপাকে আরো একবার পড়তে হলো। সেও পরিচিত। বাড়িতে তাদেরও লোকজন আছে। একদিন একা পেয়ে স্বরূপ বার করেছিল। পালিয়ে এসেছিল অপা। সেই ব্যক্তি কিন্তু বুঝেছিল, অপা বাড়িতে জানিয়েছে। তারপরেও সে কলার তুলেই  চলেছিল। 

গ্রীষ্মের এক দুপুরে কলেজ থেকে বেরিয়ে অপা এক আত্মীয়ের বাড়ি যাচ্ছিল। সেই আত্মীয়ের একটি ছোটো ছেলে ছিল, যাকে অপা খুব ভালোবাসত। বাচ্চাটির টানে মাঝেমাঝেই ছুটত অপা সেই বাড়িতে। বাস থেকে নেমে কিছুটা হেঁটে যেতে হতো। অপা দেখল, একটা সাদা এম্বাসেডর ওর পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল। অপা আপন মনেই হেঁটে যাচ্ছিল। একটু বাদে মনে হলো, ওই গাড়িটাই পেছন থেকে এসে আবার ওকে ক্রস করল। অপা বুঝল গাড়িটা ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু দু'তিন মিনিটের মধ্যে মনে হলো আবার গাড়িটা আসছে। এবার অপা পেছন ঘুরে দেখে, হ্যাঁ ওই গাড়িটাই। সেকেন্ড এর মধ্যে অপা সিদ্ধান্ত নিল, কারোর একটা বাড়িতে ঢুকে পড়তে হবে। অপা বাঁ দিকের বাড়ি গুলোর দরজা দেখতে লাগল, কোনটা খোলা আছে। একটা বাড়ির গ্রিলের গেটে হাতও দিয়েছে। গাড়িটা তখন একদম অপার গায়ের কাছে এসে প্রায় থেমে গেছে। ঠিক তখনই ডান দিকের রাস্তা থেকে এক ভদ্রলোক বেরিয়ে এসে ওই রাস্তায় পড়েছেন। তাঁকে দেখে গাড়ি গতি বাড়িয়ে বেরিয়ে গেল। ডান দিকের ওই রাস্তাতেই অপার আত্মীয় থাকে। অপা জোরে পা চালিয়ে পৌঁছে যায় সেখানে। কয়েকবার ক্রস করেছে বলে, অপা গাড়ির নম্বরটা মোটামুটি দেখে নিয়েছিল। 
আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়েই এই প্রসঙ্গ তোলেনি সে। একটু বাদে বলেছিল, "তোমাদের এখানে কারোর সাদা এম্বাসেডর আছে না কি।"
গাড়ির নম্বরও মনে করে বলার চেষ্টা করে। আত্মীয় ভদ্রলোক ও তাঁর স্ত্রী শুনেই বলল, "হ্যাঁ, এই তো কাছেই থাকে। খুব ভালো ছেলে।"
এরপরে কথা এগোনোর আর কোনো মানেই হয় না। অপা বলেওনি আর কিছু। ফেরার সময় আত্মীয়ের বাড়ির সামনের স্ট্যান্ড থেকে রিক্সা নিয়ে একদম বাস স্ট্যান্ড। তখন অবশ্য বিকেল হয়ে গেছে। রাস্তায় লোকজন। আর কখনও দুপুরে ওদিকে যায়নি অপা।
বাসে জানলার ধারে বসে ভাবছিল, "সাদা এম্বাসেডর শুনে যে ভালো ছেলেটির কথা বলা হলো, হয়তো ওই গাড়ি তার নয়। অন্য কারোর এবং অন্য কোনো মহৎ লোকেরা গাড়িতে ছিলেন। কিন্তু কথাই তো এগোল না।" অপা যখন প্রসঙ্গ তুলেছিল, মুখ গম্ভীর ছিল তার। 'ভালো ছেলে' শোনার পরেও চিন্তার ভাঁজ যায়নি মুখ থেকে। এমন কি গাড়ির নম্বর পর্যন্ত বলে দিল। তারপরেও কী সেই আত্মীয়দের একবারও মনে হলো না, অপা কেন বলছে এসব। অন্তত পক্ষে জিজ্ঞাসা তো করতে পারত, "কেন কী হয়েছে ?"

দিনে দিনে অপা বুঝতে শিখল, যারা অন্যায় করে আর যারা অন্যের সমস্যা শুনতে চায় না বা জেনেও চুপ করে থাকে, তাদের মধ্যে পার্থক্য বিশেষ নেই।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

1 Comments

  1. খুব সুন্দরভাবে এক জ্বলন্ত সমস্যা নিয়ে লেখা। ভালো লাগলো।

    ReplyDelete