জ্বলদর্চি

চিত্তরঞ্জন কুণ্ডু ( 'দি প্রদীপ' পত্রিকার সম্পাদক, তমলুক শহর ) /ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ১৫

চিত্তরঞ্জন কুণ্ডু ('দি প্রদীপ' পত্রিকার সম্পাদক, তমলুক শহর)

ভাস্করব্রত পতি

বয়স মানে না কাজের ধারা। মন চাইলেও কাজ থেকে বিরত থাকা যায় না। তাই নব্বুই ছুঁইছুঁই হয়েও বয়সের দোহাই না দিয়ে সমানভাবে সাংবাদিকতা চালিয়ে গিয়েছিলেন মনপ্রাণ দিয়ে। ২০২১ পর্যন্ত বহাল তবিয়তে প্রকাশ করে গিয়েছেন জেলার প্রাচীনতম সাপ্তাহিক কাগজ 'দি প্রদীপ'। সবাই ডাকতো 'চিন্তা' নামে। আসল নাম চিত্তরঞ্জন কুণ্ডু। 

তমলুক শহরের প্রাণকেন্দ্রে তাঁর বসতবাটি। সেই ১৯২৮ এর ১৯ জানুয়ারি জন্ম। ২২ বছর বয়স থেকে ১৯৫০-এ শুরু লেখালেখির সাথে সখ্যতা। আমৃত্যু তথা ২০২১ এর ১ লা নভেম্বর পর্যন্ত তা থেমে থাকেনি। ঘনঘন নাকে নস্যি নেওয়া চিত্তবাবুর অভ্যাস। তেমনি লেখনী সমানভাবে থেকেছে সাবলীল। দুই মেদিনীপুর তো বটেই, সম্ভবত এ রাজ্যের কোনো সংবাদপত্রের সবচেয়ে বর্ষীয়ান সম্পাদক ছিলেন তিনি। ১৯৪১ এর ১৪ এপ্রিল থেকে প্রকাশিত হচ্ছিল সাপ্তাহিক কাগজ 'দি প্রদীপ'। প্রথম থেকেই সম্পাদক ছিলেন চিত্তবাবুর বাবা শৈলেন্দ্রনাথ কুণ্ডু। তিনি ছিলেন মেদিনীপুর শহরের মীরবাজারের বাসিন্দা। পরে তমলুকে এসে স্থাপন করেন বীণা প্রেস। শৈলেন্দ্রবাবু ছিলেন স্বদেশী মনোভাবাপন্ন মানুষ।

১৯৪৯ এ এই পত্রিকার সাথে যুক্ত হন লেখালেখির মাধ্যমে। বাবার সম্পাদনার কাজে সহায়তা করতেন। লিখতেন। হাত পাকানো শুরু হয় বাবার হাত ধরেই। ১৯৪৬ নাগাদ কলকাতায় যখন থাকতেন তখন 'ভগ্নদূত' ও 'ভারতবর্ষ'তে সাংবাদিকতা করতেন। চেন্নাইতে চাকরি পেয়েছিলেন। ছেড়ে দেন। ১৯৭৩ এর ফেব্রুয়ারি মাসে 'দি প্রদীপ'-এর সম্পাদক হিসাবে অভিষেক ঘটে চিত্তরঞ্জন বাবুর। আসলে বাবার মৃত্যুর পর তাঁকেই ধরতে হয় হাল। যা শেষ দিন পর্যন্ত কৃতিত্বের সাথে চালিয়ে গিয়েছেন। তবে সাংবাদিকতা করতে গিয়ে ১৯৭৪ সালে এক মিথ্যা অভিযোগে জেলে যেতে হয়েছিল তাঁকে। গ্র্যাজুয়েট পর্যন্ত পড়াশুনা করেছেন। কলমের আঁচড় কাটার শক্তি পেয়েছেন বাবার কাছ থেকেই। বহু সাংবাদিক, লেখক আজ তাঁর হাত দিয়েই লেখার মুন্সিয়ানা পেয়েছে।

এই বয়সেও লেখার উন্মাদনা পান কি করে? চিত্তবাবু জানিয়েছিলেন, স্বদেশের জন্য কিছু করা দরকার। নিজের জন্মভূমির জন্য কিছু প্রয়োজন। সেই তাগিদ থেকেই আমি সাংবাদিকতার কাজ করছি। যদিও এখন সাংবাদিকতা মানে রাজনীতির খবরের বেসাতি। আগে স্বদেশ এবং জাতিকে নিয়ে সাংবাদিকতার চল ছিল। এখন সেসব নেই। এখনকার সাংবাদিকতায় জন্মভূমিকে উন্নীত করা বা গৌরব বৃদ্ধি করার মানসিকতা তেমন একটা পরিলক্ষিত হয় না বলে তাঁর ক্ষোভ এবং অভিমান ছিল। ভালোবাসতেন ঘোড়ায় চড়তে আর রাইফেল শুটিংয়ে অংশ নিতে।

অর্থ এবং রাজনীতি প্রবেশ করেছে সাংবাদিকতা জগতে। বড় বড় সংবাদপত্র হাউসগুলি আজ বড় শিল্পে পরিণত হয়েছে। তাই তারা হয়ে উঠছে শিল্পপতি। আদর্শ, নীতি আজ বিসর্জিত। বড় বড় সংবাদপত্র গোষ্ঠীর লেলিহান আক্রমনে নিমজ্জমান ক্ষুদ্র সংবাদপত্র ও তার সম্পাদকেরা। এই কষ্ট কুরে কুরে খায় তাঁকে। অভাব আর সমস্যাকে গায়ে মেখে তিনি প্রকাশ করে গিয়েছেন ক্ষুদ্র সংবাদপত্র 'দি প্রদীপ'।

ক্ষুদ্র সংবাদপত্রের স্বার্থে তাঁর লড়াই ছিল অগ্রণী। ১৯৮০ সালে মহারাষ্ট্রে গিয়েছিলেন মাঝারি পত্রিকার সম্মেলনে। ১৯৮১ তে দ্বিতীয় প্রেস কমিশনের ক্ষুদ্র পত্রিকার সমস্যার কথা তুলে ধরতে গিয়েছিলেন দিল্লি। 'ওয়েষ্ট বেঙ্গল ইউনিয়ন অব জার্নালিস্টস' এর অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি। ২০০৩ পর্যন্ত সারা ভারত ক্ষুদ্র পত্রিকা সংগঠনের উপসভাপতি ছিলেন চিত্তরঞ্জন কুণ্ডু।

তাঁর মতে, ভালো সাংবাদিক হতে গেলে তাঁর কৌতূহল থাকতে হবে। অনুসন্ধিৎসা থাকতে হবে। ভালো মনের অধিকারী হতে হবে। তারপর তাঁর লক্ষ্য হবে আদর্শ ও সত্যকে প্রতিফলন করা। কেননা সাংবাদিকতা হল বিশ্বের পাঁচটি মহৎ কাজের একটি। স্থানীয় সাংবাদিকরা নিজেদের দেশ, স্থানীয় সংস্কৃতিতে উন্নত করার চেষ্টা করলেও তাঁদের পত্রিকার মালিকরা সেসব সমাদর করেনা। স্বভাবতই স্থানীয় সাংবাদিকদের নিজেদের স্বাদেশিকতা ও স্থানীয় বৈশিষ্ট্যকে ত্যাগ করতে হচ্ছে। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে তোল্লা দিতে হচ্ছে। ফলে বাস্তব প্রতিক্রিয়ার পরিস্ফুরণ হচ্ছেনা।

'দি প্রদীপ' পত্রিকা গুরুত্ব দিত স্থানীয় বৈশিষ্ট্যকে। দেশের উন্নতির পাশে দাঁড়ায়। দেশের মানোন্নয়নের কথা লেখে। সেই বৈশিষ্ট্য তথা রীতিকে শেষ দিন পর্যন্ত বজায় রাখার লক্ষ্য নিয়ে সম্পাদনার কাজ চালিয়ে গিয়েছেন পত্রিকা সম্পাদক চিত্তরঞ্জন কুণ্ডু। ১৯৫১-৫২ থেকে প্রদীপ পত্রিকার শারদীয়া সংখ্যাও প্রকাশ করে চলেছেন। মেদিনীপুরের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি আর ইতিহাস তুলে ধরতে কখনো আপোষ করেননি।

শুধু লেখালেখি নয়, তমলুকের বুকে প্রথম নাচের অনুষ্ঠান করেছিলেন তিনিই। রূপশ্রী সিনেমা হলে মেয়েদের প্রথম নাচের অনুষ্ঠানে তাঁকে সহায়তা করেন শ্রুতিনাথ চক্রবর্তী এবং প্রফুল্ল অধিকারী। ষাটের দশকে মেয়েদের প্রথম নাচের স্কুল তৈরি করেন তিনি। 'মণিমালা স্পোর্টস অ্যাসোসিয়েশন' গঠনের কৃতিত্বও তাঁর। এজন্য অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন বিমল ঘোষের কাছ থেকে। এর শিল্ড দিয়েছিলেন বিনয় দে। জুনিয়র ফুটবল টিমের জন্য এই সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। একসময় 'বসুমতি' কাগজে লিখেছেন। ইচ্ছে ছিল 'দি প্রদীপ' কে দৈনিক করবেন। কিন্তু সময় এবং প্রেসের সংকটের কারণে তা হয়ে ওঠেনি। কিন্তু জন্মকাল থেকে সাপ্তাহিক হিসেবে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে প্রকাশিত হয়েছে 'দি প্রদীপ'।

পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments