জ্বলদর্চি

ড. মৌসম মজুমদার (শিক্ষারত্ন, সমাজসেবী, প্রবন্ধকার, গবেষক)/ ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন পর্ব -- ১৮

ড. মৌসম মজুমদার ( শিক্ষারত্ন, সমাজসেবী, প্রবন্ধকার, গবেষক )

ভাস্করব্রত পতি

বিয়েতে যৌতুক হিসেবে পাওয়া নিজের স্ত্রীর গলার হারটা অবলীলায় অন্যকে দিয়েছিলেন বিজনবিহারী মজুমদার। আর ছবিরাণী মজুমদার প্রায়শই দিয়ে দিতেন নিজের কাপড় চোপড় সহ অন্যান্য সামগ্রী। অন্যের পাশে এভাবেই বাবা মাকে নিয়মিত 'উড়নচণ্ডী' হতে দেখেছেন সেই ছোটবেলা থেকেই। শুধু নিজে বাঁচা নয়, আরো অনেককে নিয়ে বাঁচার আনন্দটা কি, তা বুঝতে পেরেছিলেন তখন থেকেই। কিন্তু 'বাপের ধনে পোদ্দারি' করে নয়, নিজের কোমরের জোর দেখাতে অপেক্ষা করতে হয়েছিল চাকরি জীবনে প্রবেশের মুহূর্ত পর্যন্ত। তারপর আর ফিরে তাকানোর সময় কোথায় মৌসম মজুমদারের?

কুইজ। শুধু একটাই শব্দ। কখনও কখনও একটা শব্দ হয়ে উঠতে পারে 'শব্দব্রম্ভ'। আর সেই শব্দের সাথে যখন কারোর Passion জড়িয়ে যায় আষ্টেপৃষ্ঠে, তখন তা হয়ে ওঠে তাঁর পরিচয়লিপি। হাজারো তথ্য আর হাজারো জিজ্ঞাসার রক্তমাংসের কারিকুরি নিয়েই একটা আলাদা জগত তৈরি করেছেন তিনি। আর সেখান থেকেই তাঁর জীবনের শাখাপ্রশাখা বিস্তৃত সমাজসেবা থেকে পরিবেশ সচেতনতার সোপান রচনায়। এ পর্যন্ত ২৫০০ এর বেশি কুইজ প্রতিযোগিতা পরিচালনা করেছেন জাতীয় স্তর, রাজ্যস্তর, জেলাস্তর, আঞ্চলিক স্তর এবং কর্পোরেট স্তরে। এ এক বিশাল দক্ষতা। ২০১১ তে জনপ্রিয় টিভি শো "দাদাগিরি"তে রানার্স হয়েছিলেন কুইজকে আশ্রয় করেই। নিজেই সম্পাদনা করেছেন "কুইজ ডট কম" পত্রিকা। অবিভক্ত মেদিনীপুরের অন্যতম সমাজসেবী সংস্থা "মেদিনীপুর কুইজ কেন্দ্র সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি"র প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক তিনিই। যে সংস্থা আজ জেলা ছাড়িয়ে রাজ্যের আর্ত দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়ানোর ধৃষ্টতা দেখানোর সাহস পেয়েছে।

তিনি ড. মৌসম মজুমদার। ভূগোলের এমিথিস কিংবা মুনস্টোন। কুইজের জগতে 'লং লেগ ছক্কা'। সমাজসেবামূলক কাজে 'মন্দিরের দানপাত্র'। আর পরিবেশ সচেতনতার প্রসারে 'Heritiera fomes'। স্রেফ পরিবেশ বাঁচানোর অসম লড়াইতে করে ফেলেছেন দুখানা করে সাইকেল এবং বাইক Rally। লাল কাঁকড়া বাঁচাতে চাঁদিপুর থেকে শঙ্করপুর পর্যন্ত ১০৭ কিমি কোস্টাল ট্রেকিং করেছেন। বৈচিত্র্যময় তাঁর জীবনের রঙগুলি।
প্রথমে বৈষ্ণবচক হাইস্কুল এবং তারপর কৃষ্ণগঞ্জ কৃষিশিল্প বিদ্যালয়ে পড়াকালীন সান্নিধ্য পেয়েছিলেন তিন শিক্ষক সুকুমার রায়, বানেশ্বর জানা এবং অর্ধেন্দু পড়িয়ার। কুইজের হাতেখড়ি এনারাই করে দিয়েছিলেন। এরপর ভূগোল নিয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরে দুই ক্ষেত্রেই GOLD MEDALIST হওয়ার অনন্য কৃতিত্ব অর্জন তাঁর পক্ষেই সম্ভব। আর ভূগোলে সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়ার জন্য 'লক্ষ্মীবালা সামন্ত স্মৃতি পুরস্কার' পেয়েছেন তিনি। "জঙ্গলমহলের পরিবর্তিত পরিবেশে আদিবাসীদের জীবনযাত্রার উপর প্রভাব" শীর্ষক বিষয়ে গবেষণা করে PhD লাভ করেও কলেজ বা ইউনিভার্সিটিতে পড়াতে যাননি। স্কুলে পড়ানোর অদম্য ইচ্ছেতেই তাঁর স্বপ্ন লালিত হত দুই চোখে। SSC পরীক্ষায় Western Zone এ প্রথম হয়ে বেছে নিয়েছিলেন তমলুক শহরের প্রান্তে এক অখ্যাত অনাড়ম্বর 'বঁহিচাড় বিপীন শিক্ষা নিকেতন'কে। এখানকার পরিবেশ, সহকর্মী, অভিভাবক এবং ছাত্র ছাত্রীদের জন্য নিজেকে উজাড় করে দিতে চেয়েছেন বারংবার। বাবা ও দাদার নামে বিদ্যালয়ে দুটো কক্ষ বানিয়েছেন। স্থাপন করেছেন বিদ্যাসাগরের মূর্তি। স্কুলের হঠাৎ অসুস্থ ছাত্র ছাত্রীদের প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য দিয়েছেন Sick Bed।

সেই ২০০১ থেকে লেখালেখিতে মনোনিবেশ। অনেকটা পথ পেরিয়ে এসে আজ তিনি জেলার অন্যতম লেখক। শিক্ষকতা, কুইজ, সমাজসেবা, আর লেখার সূত্রেই বহু মানুষের সান্নিধ্য লাভ করার সাথে সাথে নিজেও হয়ে উঠেছেন সেলিব্রেটি। ভালোবাসেন গান শুনতে আর গাইতে। ক্যাকটাস ব্র্যাণ্ডের ৩০ বছর উপলক্ষে গায়ক সিধুর জীবনকাহিনীর বই লিখে ফেলেছেন তিনি। এ পর্যন্ত ২৭ টি টেক্সট বই, ১০ টি প্রবন্ধের বই আর ২৫ টির বেশি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য সম্পাদিত বইয়ের লেখক মৌসম মজুমদার। কর্মক্ষেত্র, আনন্দবাজার পত্রিকা, শুকতারা, নবকল্লোল সহ অসংখ্য পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে লেখা। বলা যেতেই পারে যে, "K.G. থেকে P.G." -- সব ক্লাসের বই লিখে ফেলেছেন তিনি। 

একসময় বহু বেকার ছেলে মেয়েরা তাঁর লেখা Competitive Examination এর বই পড়ে SSC, PSC ও আরো নানা পরীক্ষার বৈতরণী পার হয়ে সরকারি চাকুরে হতে পেরেছে। আজ কেউ শিক্ষক, কেউ প্রফেসর, কেউ অফিসার। জেনারেল নলেজের পশরা নিয়ে বেকার শিক্ষিত ছাত্র ছাত্রীদের পাশে দাঁড়ানোর স্পর্ধা দেখানোর শক্তি দেখিয়ে তাঁদের স্বপ্নটা উস্কে দিয়েছিলেন তিনিই। শুধু মেদিনীপুর নয়, সারা রাজ্যের শিক্ষিত বেকারের চোখে তিনি হয়ে উঠেছেন "মৌসম স্যার"! পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শিক্ষা দপ্তর ২০২২ এ এই শিক্ষানুরাগী শিক্ষককে দিচ্ছে মর্যাদাসম্পন্ন "শিক্ষারত্ন" পুরস্কার। যদিও এর আগেই পেয়েছেন ভারত জ্যোতি পুরস্কার (দিল্লি, ২০১৪), BEST CITIZENS OF INDIA AWARD (২০১৪), রক্তকরবী সম্মান, কচিপাতা সম্মান, BEST TEACHER AWARD ( জৈন সভা ), সকলের কথা সম্মান, উদয়ন সম্মান, গুরু সম্মান (Future Care) ইত্যাদি। আজ নিজের কর্মতৎপরতাতেই তিনি হয়ে উঠেছেন 'মেদিনীপুরের মানুষ রতন'।

মৌসম মজুমদার নামটি কেবল শিক্ষকতা বা সমাজসেবাতেই আবদ্ধ নয়। তিনি জেলা তথা রাজ্যের একজন অন্যতম সংগ্রাহক। তাঁর হেফাজতে রয়েছে ৫৫০ জন সেলিব্রেটি মানুষের অটোগ্রাফ। রয়েছে ১৩১ টি দেশের মুদ্রা, ১০০ টি দেশের ২৫০০ ডাকটিকিট, ৫০ টির বেশি বিভিন্ন ধরনের হাতি, ৩৭ ধরনের শাঁখ, ৩০০ ধরনের পাথর এবং ভারতের সব উপকূলীয় এলাকার বালি! ঘরময় বই।

মৌসম মজুমদার মানেই একরাশ কর্ম তৎপরতার আঁচলা ভরা জল। রক্তদান থেকে চুলদান, দেহদান থেকে চক্ষুদান -- এরকম হাজারো মহতী কাজে জড়িয়ে থাকেন বিনাবাক্যব্যায়ে। যদি সত্যিকারের 'অনুপ্রেরণা' নিতে হয় কারোর কাছে, তবে যাবতীয় পঙ্কিলতা, অসারতা এবং দোলাচলতা দূর করে নিঃসঙ্কোচে এবং নিঃসন্দেহে অনুসরণ, অনুকরণ এবং অনুরণন করা চলে মৌসম মজুমদারের কাজের সাথে। এতে নিজেকে আপ্লুত করা যায়। নিজেকে আবেগতাড়িত করা যায়। নিজেকে Charge করা যায়। নিত্য নতুন ভাবনার মিশেলে এক অনাবিল মনের মানুষ এই 'রতন'টি। আমাজনের মতো দীর্ঘ তাঁর কাজের ফিরিস্তি। এভারেস্টের মতো সুউচ্চ তাঁর মানসিক প্রসারতা। আর শিশির ধোওয়া দুব্বোর মতো অন্তরের অন্তঃস্থল। এহেন মানুষটি আজ সত্যিই মেদিনীপুরের গর্ব। অসংখ্য যুবকের চলার পথের দিশারী। অনেকের কাছেই অচিরেই হয়ে উঠেছেন 'আইকন পুরুষ'।

পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

7 Comments

  1. অসাধারণ লেখা, মোহিত হয়ে পড়লাম,এক নিঃ শ্বাসে🙏

    ReplyDelete
  2. Hazar hazar manus ke protiniyoto bodle deoa ekjon osadharon manus holen Dr Mousam Majumder...
    Unar aloi amra sobai udbhasito..... Govir shrodhya janai.

    ReplyDelete
  3. অনুপ্রেরণার আর এক নাম মৌসম মজুমদার।

    ReplyDelete
  4. দারুন লেখা 🙏🙏🙏🙏

    ReplyDelete
  5. এক অনুপ্রেরণার নাম মৌসম sir

    ReplyDelete
  6. দারুণ লিখেছো ভাস্কর দা.....মুগ্ধ হতে হতে পড়লাম ❤️

    ReplyDelete
  7. Mausam da amader jibon e Iswar er ashirbaad... uni desh er gorbo.... Hazar hazar manus er jibon bodle deoa ekjon osadharon byaktitto... pronam

    ReplyDelete