জ্বলদর্চি

তানসেন - এক অসাধারণ সঙ্গীতশিল্পী /ষষ্ঠ পর্ব /দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

তানসেন - এক অসাধারণ সঙ্গীতশিল্পী    
           
ষষ্ঠ পর্ব         

দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

সম্রাট হরিদাস স্বামীকে অনুরোধ করে বললেন "প্রভু আপনি আমার সঙ্গে দিল্লীতে গিয়ে যদি শাহী দরবারে সভাগায়কের পদ অলঙ্কৃত করেন তাহলে আমি নিজেকে ধন্য মনে করব"। 

সব শোনার পরে হরিদাস স্বামী বললেন "সম্রাট, আমার সমস্ত সংগীত প্রভু শ্রীহরির জন্য। যে যেভাবে শোনে আর ভাবে তিনি সেভাবেই তাদের কাছে ধরা দেন। আমি তো তাঁর দাস, নিমিত্ত মাত্র। আমি তো কারোর রাজদরবারে যেতে অপারগ। বিশ্বপ্রভু শ্রীহরির দরবারের আমি চিরকালের গায়ক। আমার সংগীতের ডালি তো তাঁর চরণেই নিবেদিত। তাঁর সভা ছেড়ে আমার কোথাও যাবার উপায় নেই। আমি তাঁরই প্রেমে বদ্ধ। তিনিই আমার হৃদমাঝারে অনন্তের অধিপতি"। 
এই কথা বলে তিনি সম্রাটকে আশীর্বাদ করে বললেন "সকলের মাঝে সেই অনন্তের অধিপতিকে দেখার চেষ্টা করবেন তাহলেই আপনার মনের অহমিকা দূর হয়ে যাবে। সকলকে আপনি সমানভাবে দেখবেন, তাহলেই আপনি যথার্থ ভারত সম্রাট হবেন"। হরিদাস স্বামীর আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে সম্রাট ফিরে যাবেন আগ্রাতে। 

এমন সময় হরিদাস স্বামী তানসেনকে একান্তে ডেকে বললেন “তুই যে এতদিন পরে আমার কাছে এলি আমার জন্য কি প্রণামী নিয়ে এসেছিস?" তানসেন লজ্জিত হয়ে গুরুকে প্রণাম করে তার গলার বহুমূল্য হার খুলে হরিদাস স্বামীর চরণতলে নিবেদন করলেন। হরিদাস স্বামী তা দেখে বললেন "তুই তো জানিস বাপু, জগতের পার্থিব কোন জিনিসের প্রতি আমার আকাঙ্ক্ষা নেই। সারা জীবন যে শ্রীহরির আরাধনা করেছি সেই শ্রীহরি যেন আমাকে অন্তিমে তাঁর পাদপদ্মে স্থান দেন। এই আমার জীবনের আকাঙ্ক্ষা। বয়সও তো হয়ে গেল। কোনদিন হয়তো তাঁর ডাক এলে চলে যেতে হবে। তবে তোকে যাবার আগে একটা অনুরোধ করবো তা তোকে রক্ষা করতে হবে"। তানসেন বললেন "বলুন গুরুজী, কি আপনার অনুরোধ। আপনি আমাকে অনুরোধ কেন করবেন আপনি আমাকে আদেশ করুন, যে আদেশ আমি সর্বতোভাবে পালন করব। যদিও জন্মদাতা পিতা মাতা বা গুরুর ঋণ কখনো পরিশোধ করা যায় না"। হরিদাস স্বামী বললেন "কয়েকদিন পূর্বে আমার আশ্রমে একটি রাজপুত যুবতী এসে আশ্রয় চাইতে তাকে আমার আশ্রমে স্থান দিয়েছি। রাজপুতানার ঝালোয়ার থেকে প্রাণের ভয়ে সে কয়েকজন স্বদেশী বিধবা রমণীর সাথে বৃন্দাবনে এসে পৌঁছায়। আকবর বাদশার সাথে যুদ্ধে ঝালোর দুর্গের রাঠোর অধিপতির পরাজয় ঘটে। সেই যুদ্ধে এই যুবতীর বাবা রাঠোর অধিপতির হয়ে যুদ্ধে প্রাণত্যাগ করাতে তার মা সহমরনে জহরব্রত পালন করে। ঝালোয়ারে সে থাকা নিরাপদ মনে না করে বিধবা রমনীদের সাথে বৃন্দাবনে চলে আসে। বৃন্দাবনে এসে সেই বিধবা রমণীরা একটি বিধবা আশ্রমে এসে ঠাঁই পায়। মেয়েটি সেখানে স্থান না পেয়ে অন্য একটি আশ্রমে যায়। কিন্তু সেখানেও সে নিজেকে নিরাপদ ভাবতে পারেনি। সেখানে কতিপয় আশ্রম মহন্তের কুনজরে পড়ে যায়। রাজপুত রমনীর কাছে প্রাণের চেয়েও সম্ভ্রম বড়। একদিন সন্ধ্যার আলো ছায়ায় সে আমার আশ্রমে এসে সমস্ত ঘটনা বলার পরে আমি তাকে আশ্রমে থাকতে দিয়েছি। তুই যদি তোর সাথে মেয়েটিকে নিয়ে গিয়ে আশ্রয় দিস তাহলে আমি অন্তত শান্তি পাবো এই ভেবে যে মেয়েটি নিরাপদে থাকবে"। তানসেন কিয়ৎক্ষণ চিন্তা করে বললেন "গুরুজী আপনার আদেশ শিরোধার্য, কিন্তু কিভাবে তাকে আমি নিয়ে যাব"? হরিদাস স্বামী বললেন "আমার আশ্রমে একটি ঘোড়া আছে। সেই ঘোড়ার সওয়ারী হয়ে ছদ্মবেশে সে তোর সাথে তোদের দলের পিছনে যেয়ে তোর হাভেলিতে পৌঁছে যাবে"। এই বলে গুরুজী মেয়েটিকে ডাকলেন। অবগুন্ঠনবতী যুবতীকে সমস্ত পরিকল্পনা বলে বললেন "মা রূপবতী, তুমি তানসেনের সাথে আগ্রা চলে যাও। তানসেনের কাছে থাকলে তোমার জীবন ও সম্ভ্রমের কোন হানি হবে না। এখানে পথে ঘাটে বিপদ ওৎ পেতে আছে। তাছাড়া আমারও বয়স হয়েছে। আমি আশীর্বাদ করছি তুমি সুখী হও"। রূপবতী তখন গুরুজী এবং তানসেনকে প্রণাম করে ছদ্মবেশে অশ্বপৃষ্ঠে তানসেনকে অনুসরণ করে আগ্রা নগরীতে যেয়ে তানসেনের হাভেলীতে পৌঁছায়। হাভেলীতে পৌঁছানোর পরে তানসেন তাঁর হাভেলীর প্রধান বাঁদী আয়েশার হাতে তাকে সমর্পন করে দিয়ে বললেন "বৃন্দাবন থেকে আমি একে নিয়ে এসেছি। তুমি এখানে ওর থাকার ব্যবস্থা করো। ওকে দিয়ে কি কাজ করাবে তা আমি তোমাকে পরে বলে দেবো"। 
এখানে উল্লেখ করা সমীচীন হবে যে হরিদাস স্বামী পূর্ব জন্মে ছিলেন শ্রী কৃষ্ণের অষ্ট সখীর অন্যতম ললিতা দেবী আমরা শ্রীচৈতন্য এর মহাপ্রভুর জীবনেও দেখেছি স্বরূপ দামোদরকে যিনি পূর্বজন্মে অষ্টসখীর অন্যতম বিশাখা দেবী ছিলেন, স্বভাবতই তারা হরি গুনগান ছাড়া অন্য কিছু চিন্তা করতে পারতেন না। 

আগ্রা যেয়ে সম্রাট বীরবলকে বললেন "কবিবর আজ আমি একজন সত্যিকারের সংগীত সাধকের দর্শন পেলাম, যিনি আমার মনের সমস্ত মলিনতা, অহংবোধ দূর করে দিলেন। আমি হৃদয়ে প্রশান্তি নিয়ে ফিরে এলাম"। 
                                                                   ক্রমশঃ

পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments