জ্বলদর্চি

ভগীরথ মিশ্র /বিশ্বজিৎ পাণ্ডা


বাংলা গল্পের পালাবদল—৬

বিশ্বজিৎ পাণ্ডা

ভগীরথ মিশ্র

ভগীরথ মিশ্র (জন্ম-১৯৪৭) জন্মসূত্রে মেদিনীপুরের মানুষ। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার কেশিয়াড়ি থানার সাঁতরাপুর গ্রামে জন্ম তাঁর। লেখালেখি শুরু করেন বিশ শতকের সত্তরের বছরগুলিতে। সত্তরের সংকটময় সময়ে দাঁড়িয়ে লিখলেন তাঁর আবাল্যের গ্রামের গল্প। বাল্য-কৈশোরের গ্রামীণ দৃশ্যপট— স্মৃতির ভাণ্ডার থেকে উঠে এল তাঁর লেখার বিষয়— পটভূমি। তাঁর গ্রাম সম্পর্কে এক জায়গায় বলেছেন— “একেবারে সামন্ততান্ত্রিক পরিমণ্ডল, ঘরে ও বাইরে। চারপাশে আদিবাসীদের গ্রাম। সন্ধে প্রহরে মাদলের দ্রিমি দ্রিমি বোল ভেসে আসে হাওয়ায়। শাল-মহুয়ার জঙ্গল নিরন্তর হাতছানি দিয়ে ডাকে।” তাঁর বহু গল্পের কেন্দ্রে রয়েছে এরকম সামন্ততান্ত্রিক গ্রাম। আদিবাসী মানুষজন। শাল-মহুয়ার জঙ্গল। ভগীরথের লেখক সত্তার বৈশিষ্ট্য এই গ্রামীণতা। তিনি বিশ্বাস করেন, গ্রামীণ ভারতবর্ষে সেই অর্থে শহরের কোনও অস্তিত্বই নেই। এমনকি কলকাতা শহরটাকেও তাঁর মনে হয়, বৃহদাকার গ্রাম। সত্যিই তো শহরের মধ্যেও লুকিয়ে আছে গ্রাম। গ্রাম্যতা সেখানেই বেশি। তাই তিনি বলেন একজন লেখককে জীবনে অন্তত একটি গ্রামের গল্প লিখতে হয়—না হলে তার ‘কলমশুদ্ধি’ হয় না। এরকম একটি বোধ ও চেতনা থেকে গল্প লেখেন তিনি।   

ভগীরথ মনে করেন, শোষণ মানুষের একটা অতি প্রয়োজনীয় প্রবৃত্তি। সেই প্রবৃত্তির তাড়নায় মানুষ শোষণ করে। প্রতিটি মানুষই তার থেকে দুর্বলকে শোষণ করে। না হলে বেঁচে থাকতেই পারবে না। মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত পুরো সময়কালটিই তো একটা ধারাবাহিক নিরবচ্ছিন্ন শোষণের ইতিহাস। শুধু মাত্র খাদ্যের প্রয়োজনেও মানুষ শোষণ করতে বাধ্য। ভগীরথ তাঁর বহু গল্পে এই ভাবনাটিকে সঞ্চারিত করতে চেয়েছেন। 

যেমন তাঁর ‘রাবণ’ (‘অনুষ্টুপ’, ১৯৯১) গল্পটি। গল্পের প্রধান চরিত্র রাবণ মাঝি ছোটোবেলায় জমিদার সতীকান্ত সিংহের কোপানলের শিকার হয় সপরিবারে। রাবণের বাবা দিদি ভাই সবাই চরম লাঞ্ছিত হয়। ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করে সিংহ। উপবাসে-ভিক্ষে করে-জঙ্গলের ফল-পাকুড় খেয়ে নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রেখেছে। তার আঠারো বছরের দিদি সিংহবাবুর কামনার শিকার হয়েছে। পরে মরতেও হয়েছে তাকে। তারপর রাবণ শুধু ‘পেটভাতুয়ায়’ শক্তিচঁদের বাড়ির কাজ করে। গুড়ের মহালের গুড় জাল দেয়। এভাবে প্রতিমুহূর্তে শোষিত হতে হতে এক সহৃদয় বিডিও সাহেবের কল্যাণে ঘোড়ার গাড়ি পেয়ে যায় ব্যাঙ্ক থেকে। পরে নিজেই মহাল খোলে গুড়ের। ‘আড়াই কুড়ি উম্বরের’ রাবণের ‘বিয়া’ করা হয় না আর।
    আজন্ম শোষিত লাঞ্ছিত রাবণ আজ শোষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ। তার মহালের রাতের জাগুয়া প্রহরাজ বেজের স্ত্রীর প্রতি আসক্ত হয়ে প্রহরাজকে হত্যা করে। শুধু হত্যা নয়, যেভাবে প্রহরাজকে খুন করে রাবণ, তা সকল নৃশংসতাকে হার মানায়। প্রহরাজকে সে অত্যধিক মদ খাইয়ে বেহুঁশ করে দেয়। দুগাছা মোটা পাটের দড়ি দিয়ে তেঁতুল গাছের সঙ্গে বেড় দিয়ে শক্ত করে বাঁধে। হাত-পা কষে বাঁধা। বেহুঁশ প্রহরাজ জিজ্ঞেস করে, “আমাকে বাঁইধ্‌ল্যে ক্যানে রাবণদা ? বাঁইধ্‌ল্যে ক্যানে ?” রাবণের অভয় বাণী, “অমনি রে। ভয় পাস্‌ নাই।”

তার পরনের কাপড় খুলে মুখ বেঁধে দেয় রাবণ। দড়িগাছা দিয়ে পা থেকে গলা অবধি পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে গাছের সঙ্গে বাঁধে। তার নিজের বর্ণনায়—

“আড়ত থেকে একখানা গুড়ের পায়া এনে গাছের তলায় রাখি। তারপর খাবলা খাবলা গুড় নিয়ে যেমন করে আবড়া মেয়ার গায়ে তেল-হলুদ মাখায় বিয়ার আগে, ঠিক তেমনি করে মাখাতে থাকি প্রহরাজের সারা গায়ে। বেশ পরিপাটি করে মাখাই। নাকের ছ্যাঁদা, কানের গর্ত, চোখ, মুখ, লিঙ্গ, অণ্ডকোষ—কিছুই বাদ দিই না।”

গুড়ের মিঠে গন্ধে গাছের বিষ পিঁপড়েরা প্রহরাজের সর্বাঙ্গে কুরে কুরে ঝাঁঝরা করে দেয়। মর্ম-বিদারক মৃত্যুমুখে ফেলে রাবণ প্রহরাজের ঘরের দিকে এগোয়। কিন্তু ঘরের কাছে এসে সামলে নেয় নিজেকে, “আজ রাতে কদাচ লয়। সতীকান্ত সিংহবাবু বারবার বলতেন, ‘কোনও অবস্থাতেই সংযম হারাতে না।’ যে রমণীর সোয়ামী লরক-যন্তণ্ণা পেতে পেতে মরছে শীতের রাতে, তেঁতুল তলায়, নিঃশব্দে,—উহার সাথে সহবাস! মহাপাপ হব্যেক তাতে। আর একথা দুনিয়ার কে-ই বা না জানে যে পাপ উয়ার বাপকেও নাই ছাড়ে!” 

একজন খুনির মুখে পাপ-পুণ্যের কথা! মানুষটাকে খুন করবার জন্য তার মনে কোনও পাপবোধ জন্মায়নি। কিন্তু মৃত্যু পথযাত্রী মানুষের স্ত্রীর সঙ্গে সহবাসকে ভয়ানক পাপ মনে করছে সে। এবং নিজেকে সংযতও করছে। এখানে কোথায় যেন তার মধ্যেও একটা সততা রয়েছে। একজন নৃশংস মানুষের মধ্যেও তার মতো করে ন্যায়-অন্যায়ের বোধ থাকে। এটা স্বাভাবিক। কিন্তু বহু ক্ষেত্রে দেখি এই ধরনের চরিত্র নির্মাণে লেখক একপেশে হয়ে যান। ভগীরথ এই খল চরিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে সে পথে হাঁটেননি। একটিমাত্র বাক্যে লম্পট চরিত্রটির মধ্যেও একটা স্বাভাবিকতা নিয়ে এলেন। তার মধ্যে একটু মায়া ঢেলে দিলেন। আর তাতে এই খলচরিত্রটাও একরঙা না হয়ে স্মরণীয় হয়ে উঠল। গল্পকারের স্বাতন্ত্র্য এখানেই। মানুষ খুনের এহেন পদ্ধতি বাঙালি পাঠক এর আগে দেখেনি। 

এই শোষক-শোষিতের বিষয়টি তাঁর গল্পগুলিতে কত বিচিত্রভাবেই না এসেছে। উল্লেখ্য ‘জাইগেনসিয়া’ (‘সেরা ৫০টি গল্প’, দে’জ পাবলিশিং, ২০১০) গল্পটির কথা। জাইগেনসিয়া আসলে এলা গাছ। গোলাপের মতো দেখতে। কিন্তু গোলাপ নয়। কষ্ট সহিষ্ণু এই গাছ কাদা জল রুক্ষ মাটি যে-কোনো জায়গায় বেঁচে যায়। গোলাপ গাছের চোখ বেরোলে সেই চোখ কেটে বসিয়ে দিতে হয় এই এলা গাছের ডালে। সুখি গোলাপ কাদায় বাঁচে না। জংলা এলা গাছ সকল ঝক্কি সামলায়। আর গোলাপ শুধু এর রস খেয়ে ফুল ফোটায়। 

বড়োলোক গোপেশ্বর পালের মস্ত নার্সারি। কত জায়গায় তার গাছ যায়। আর সেই নার্সারির মালি নকুল। নকুলের গায়ের যা জোর, যা স্বাস্থ্য তাতে সে সত্তর বছর পর্যন্ত কাজ করতে পারত। গোপেশ্বর তার নার্সারির ব্যবসার কথা ভেবে নকুলকে বিয়ে করতে না বলেছিল। তার বাড়িতে কয়েকজন বিধবা আছে। নকুলকে বলেছিল তাদের সঙ্গে সাধ-আহ্লাদ মিটাতে। ভালোমন্দ কিছু হয়ে গেলে সে সামলাবে— “খাটালে রোজ দুধ মিললে কোন উজবুক গাই পোষে!” কিন্তু নকুল কথা শোনেনি। ঐ বিধবাদের একটাকে একদিন হুট করে বিয়ে করে বসল। মালি হিসেবে সে বড় ভালো বলে তাকে তাড়াতে পারল না গোপেশ্বর।

নকুল এখন রাতে ধড়ফড় করে উঠে বসে। তার ঘাঢ়ে কে যেন চেপে আছে তিন পুরুষ ধরে। গোপেশ্বর বেতন বাড়ায় না। তার বউ বলে অন্য কোথাও কাজ নিতে কিন্তু তা হবার উপায় নেই। কোন্‌ যুগ থেকে সে ঢুকেছে গোপেশ্বরের বাড়িতে। বছর শেষ হওয়ার আগে কিছু নগদে আগাম নিত। তা শোধ দিত না। সুদে আসলে বেড়ে যেত খাটালির দিন। বছর দশেক আগে শেষবার খোঁজ নিয়েছিল। তখনই মূল খাটালির উপর আরও বছর আটেক বেড়েছে। তারপর আর খবর নেয়নি।

বৃষ্টি হলে নিজের ঘরের কথা না ভেবে দৌড়োয় নার্সারিতে খোলা সারের বস্তা চাপা দিতে। দুবেলা বউ ছেলেকে ভালো করে খেতে দিতে পারে না, এদিকে গোপেশ্বরের সম্পত্তি বাড়তে থাকে। নকুল যেন নিজেই একটা এলা গাছ— জাইগেনসিয়া। আর গোপেশ্বর সুখি গোলাপ। অন্যের রক্ত-রস শুষে নিজে ফুল ফোটায়। এরমধ্যে এক রাতে সে দৌড়ে যায় নার্সারিতে। গোলাপের ডালগুলোকে কেটে মাটিতে পুঁতে দেয়। শ’য়ে শ’য়ে। সারারাত। আর তার গাঁটে গাঁটে এলাগাছের চোখ বসিয়েছে। সুখি গোলাপের ডালে কীকরে শিকড় হবে গোপেশ্বর জানতে চাইলে সে বলে— “হত্যে ও তো পারে। খাদ্য জুগান পেয়্যে পেয়্যে ইরা মেড়া মের‍্যে গেঁইছে এক্কেরে। দিন কতক রস না পেল্যে, আপ্‌সে শিকড় ছাড়তে বাধ্য। না খেয়্যেঁ কে আর মরত্যে চায় এই দোনিয়ায় ?”

গোপেশ্বর থমথমে মুখে বলে— “যদি বাঁচেও, উপরের এলা গাছে ফুল ফুটবেক ?” একটু চুপ থেকে সে উত্তর দেয়— “ফুটত্যেও  তো পারে গ’ পালের পো। কে আর পরীক্ষা কর‍্যে দেখ্যেছে কুন্‌ দিন ?” সারা বাগানে ঘুরে গোপেশ্বর বিরক্ত হয়ে দেখে গোলাপগুলোর গোড়ায় গোড়ায় এলা গাছের ঝাড় লকলকিয়ে বেড়েছে।
    
নকুল বোঝে তাকে সহজে ছাড়বে না গোপেশ্বর। সে নার্সারির কুঠরি থেকে সারের বস্তা বার করে এনে ছড়িয়ে দিল এলাগাছের গোড়ায়— “খা’। চটপট খেয়্যে ফ্যাল। অত খাটালি কর‍্যে দিনরাত কাদো-মাটিতে বস্যে বস্যে রস তুলিস্‌ তুয়ারা। টুকচান লা হয় খেল্যো তুয়াদের ব্যাটা-বেটিরা। উয়ারা তো তুয়াদের ঘাড়ের উপর বস্যে মজাসে খেত্যেই আছে, বারোমাস, তিরিশ দিন।”

গোপেশ্বরের সমস্ত সংগ্রহ নিঃশেষ করে উঠে দাঁড়াল নকুল। পাগলের মতো বুক চাপড়াতে লাগল এক অস্থির উন্মাদনায়।  

নকুল এবং এলাগাছ একাকার হয়ে গেছে। শোষিত-বঞ্চিত মেহনতি মানুষ নকুল বুঝে নিতে পেরেছে নিজেদের ক্ষমতা। অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছে। আর এই অধিকার বুঝে নেওয়ার একটি ঐতিহাসিক তাৎপর্য রয়েছে। সত্তর-আশির দশকের পশ্চিমবঙ্গের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক মানচিত্রটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ক্ষমতার বদল ঘটছে। মুখ বুঝে অত্যাচার সহ্য করবার দিন শেষ হয়ে আসছে। মৌনমুখে জেগে উঠছে প্রতিবাদের ভাষা। ভগীরথ এই সমাজবাস্তবতাকে তুলে ধরেছেন শিল্পের আধারে। তাই তো এই জাইগেনসিয়ার রূপক ; এলাগাছের ব্যঞ্জনা। এই ঐতিহাসিক মানচিত্র তুলে ধরবার ক্ষেত্রে লেখকের শিল্প-সত্তা ম্লান হয়ে যায়নি। ভগীরথের গল্পের স্বাতন্ত্র্য এখানেই।             

তাঁর গল্পের আরেকটি বৈশিষ্ট্য—ভৌগোলিকতা। শহর-মফস্‌সল সবই এসেছে তাঁর গল্পে। কিন্তু গ্রামেরই প্রাধান্য দেখি। আরও স্পষ্ট করে বললে মেদিনীপুরের— পশ্চিম মেদিনীপুরের গ্রাম— গ্রামীণ জীবন। শুধু পটভূমি পরিবেশ হিসেবে নয়, গল্পের বিষয় হয়ে উঠেছে গ্রাম। সেই গ্রাম এসেছে তার সকল ভৌগোলিকতা নিয়ে। সত্তর-আশির দশকে বাংলার গ্রামীণ জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন দ্যাখা যায়। আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবর্তন। সেই পরিবর্তিত গ্রাম সবাক হয়ে উঠেছে তাঁর গল্পে। এক-আধজন মানুষের জীবন-চর্যায় বদল আসেনি। গ্রামের সামগ্রিক যাপনচিত্রে বদল এসেছে। সেই বদলটাকে নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছেন ভগীরথ। 
 
‘লেবারণ-বাদ্যিগর’ (১৯৭৯) গল্পে এসেছে এক বাদ্যিকরের কথা। বাদ্যিকরের নাম লেবারণ। গাজনের বাদ্যি মাঝে মাঝে বাজালেও লেবারণ প্রধানত বিয়ের বাদ্যি বাজায়। ফুলশয্যার রাতে বর কনেকে নিয়ে যখন ঘরে খিল দেয়, তখন লেবারণ উঠোনে নেচে নেচে ঢোল বাজায় ঝাঁ গুড় গুড়, ঝাঁ গুড়। বহু জায়গায় এখনও বিয়ে বাড়ি উপলক্ষে ব্যান্ড-পার্টি তাসাপার্টি বাজনা-বাদ্যির চল আছে।

নিজের ঘরে বউ না থাকলেও মেয়ে মানুষ নিয়ে কম নাড়া চাড়া করেনি লেবারণ। মালতী সুবচনী ললিতে কারো ঘরেই বারণ নেই তার। কিন্তু “সাঁঝের আঁধারে মেয়া মাইন্‌ষের ঘরে পা টিপে টিপে ঢোকা, আর ফুলশয্যের রাতে বৌয়ের ঘরে ঢোকা” যে একই ব্যাপার নয়, তা জানে লেবারণ। অথচ তারও বউকে নিয়ে ফুলশয্যায় যাওয়ার কথা ছিল। বিয়ে হয়েছিল তারও। অবশ্য বিয়ের ঘটনা আজ আর তার ভালো করে মনে পড়ে না। তখন তার বয়স সাত ; আর বউয়ের দুই। কোলে চড়ে গিয়েছিল সে। বিয়ে করে ফিরেও ছিল কোলে চড়ে। হলুদ জলে ছোপানো ছোট আট হাত ধুতি পরিয়ে কীসব যেন হয়েছিল। অতি আবছা একটা ধোঁয়া ধোঁয়া গোছের স্মৃতি আজও রয়ে গেছে তার। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সে বুঝেছিল তার জন্য একজন দিন গুনছে। 

বউ ঘরে আনার প্রসঙ্গ ওঠে, লেবারণের বয়স যখন সতেরো। তার মনও আনচান করেছিল। পাখা মেলে উড়ে যাচ্ছিল বারবার। বউ আনার দিন স্থির করতে গেল রসিক খুড়ো। শালপাতা দিয়ে মোড়া মাটির গাড়ুতে বোঁদের মেঠাই, হলুদে ছোপানো লালা পেড়ে শাড়ি, গুয়া পান সবই নিয়ে গেল। পরদিন বিকেলে ফিরে হতাশ করল লেবারণকে। তার ‘শউর’ বলেছে—“রূপার বাজু দিবার হক্‌ দ্যালো লেবারণের বাপের। সেটা দিতে লাগবে। আর লাগবে বাড়তি দুকুড়ি টাকা।” 

তার জ্বালা বোঝে না কেউ। বছর খানেক এ নিয়ে গণ্ডগোল চলে। বউ আর আসে না। বাবা মা মরল। তারপর থেকে সে একা। 

গল্পের শেষে অন্য এক চমক। রোহিণীতে বাজাতে এসে যে বউটার সঙ্গে রগড় করে সেই রাইমনিই তার পূর্ব স্ত্রী, শশী বাগলার মেয়ে। তা জানা ছিল না তার। রাইমনির ঘরে রাত কাটাতে আসে লেবারণ। আর রাইমনি লেবারণের গ্রামের নাম শুনে ভাবে তার পূর্ব স্বামীকে সে নিশ্চয়ই চিনবে। তার বিয়ের গল্প বলে। নিজের বউয়ের বিয়ের গল্প শুনতে হয় তাকে! সারা গায়ে কাঁটা দেয় তার। আঠাশ বছর বয়সে বউকে প্রথম দ্যাখে সে। পলকহীন অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে।

রাইমনি এখন অন্যের স্ত্রী। তার বাবা টাকার লোভে অন্যত্র বিয়ে দিয়েছিল তার। কিন্তু রাইমনির অন্তরে প্রথম স্বামীর প্রতি প্রেম জেগে আছে আজও। তা বুঝতে পেরে লেবারণ জানতে চায়— এখন যদি সে এসে তাকে নিয়ে যেতে চায় বাড়িতে। কিন্তু বুড়াকে ছেড়ে যাবে না সে। তৃপ্ত মুখে রাইমনি বলে একবার সে ফিট হয়ে গিয়েছিল। “বুড়ার সে কি মড়াকান্না। ট্যাস্কি ভাড়া করে সদরে লি যাতে চায়।” রাইমনির চোখে মুখে তৃপ্তির হাসি দেখে হতাশ হয় লেবারণ। রাইমনি তারপর বলে— “তুমার সাথে তার দেখা হলে বলো, সে যেন একটা বে’ করে সনসারী হয়। বলো, রাইমণির এই মিনতি তার ছিচরণে।”

লেবারণের বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। রাইমণির স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ মনটা স্পষ্ট হয়ে উঠল তার সামনে। তারপর রাইমণির সামনে থেকে কোনও রকমে পালিয়ে বাঁচল সে। 

লেবারণ একজন শিল্পী। শিল্পীর সংযম তার মধ্যে আছে। তাই সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও সে রাইমণিকে তার লালসার শিকার করেনি। স্বামীর প্রতি তার ভালোবাসায় মুগ্ধ হয়েছে সে। নিজেকে লুকোতে চেয়েছে। চমৎকার একটি প্রেমের গল্প হয়ে উঠেছে শেষ পর্যন্ত। লক্ষ করবার মতো এই প্রেমবোধ। রাইমণি তার শৈশবে বিয়ে করা, না দ্যাখা বরকে ভালোবাসে। আবার অতি বৃদ্ধ বর্তমান স্বামীর প্রতি এই কিশোরীর প্রেমেরও ঘাটতি নেই। আমাদের প্রথাগত প্রেম বোধকে এ গল্পে ভেঙে দিয়েছেন লেখক। ভগীরথের প্রেমের গল্পও তথাকথিত প্রেমের গল্পের মতো নয়। 

কত বিচিত্র রকমের চরিত্রের ভিড় ভগীরথের গল্পে। অদ্ভুত রকম পেশার মানুষ সব। ‘পটিদার’ (‘সেরা ৫০টি গল্প’, দে’জ পাবলিশিং, ২০১০) গল্পে এসেছে এক পটিদার— পটুয়ার কথা। বাংলা গল্পে পটুয়ারা নতুন কিছু নয়, কিন্তু এখানে যে পটুয়ার কথা বলেছেন লেখক সে আমাদের কাছে নতুন বইকি। পটের ছবি আঁকা বা ছবি দেখিয়ে গান গাওয়া নয়, এই গল্পের ঝলক পটিদার মরা মানুষের ছবি আঁকে। আত্মীয়-স্বজনদের ছবি এঁকে দ্যাখায়—তাদের মৃত পূর্ব পুরুষ স্বর্গে কেমন আছে। কতটা সুখে বা কষ্টে আছে। সব পটুয়ারা মৃত মানুষদের দেখতে পায় না। তার জন্য গুণিন হতে হয়।  

আগে কেবল মরবার সময়, পুড়িয়ে-টুড়িয়ে এসে পটিদার ডেকে ফটো আঁকাত মরে যাওয়া বাপ-মায়ের। এই লোক থেকে গিয়ে মানুষটা শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে পৌঁছল, কেমন রয়েছে এই সব দেখার জন্য। এখন মানুষের হাতে অনেক টাকা, প্রতি বছর বার্ষিকির দিনে পটিদার ডাকে। আর পটিদার কাগজের উপর কাঠকয়লা দিয়ে একটা মানুষের মতো ছবি এঁকে বলে— বাপ/মা কষ্টে আছে। পরার কাপড় পর্যন্ত নেই— এইসব বলে কাপড়-চোপড় সিধে নিয়ে ফেরে। 

তবে এই গল্পের ঝলকের আঁকার হাতটি চমৎকার। গুণিন-বিদ্যার সঙ্গে ছবি আঁকাটাও শিখেছিল সে। অভাবের সংসার। বিয়ের পর থেকে বউয়ের সঙ্গে তার রুগ্ন মায়ের খিটিমিটি লেগেইছিল। এখন বছর দুই বউয়ের পরামর্শে মাকে তাড়িয়ে দিয়েছে ঘর থেকে। মাঝে মাঝে মা এসে কান্নাকাটি করে কিছু আদায় করে নিয়ে যায়। 

এই ঝলক গরুড় মণ্ডলের মায়ের বার্ষিকিতে গেছে ছবি আঁকতে। বড়লোক গরুড়ের দেওয়ার হাতটাও বেশ। তাই আগে থেকেই তার মায়ের সম্বন্ধে কিছু খবরাখবর সংগ্রহ করে গেছে। ছবিটি এঁকে উল্টে রাখে সে। বাড়ির লোকজন ছাড়া পাড়াপ্রতিবেশীরাও ভিড় করেছে। ঝলক সকলকে সরিয়ে আলাদা করে গরুড়কে ডেকে ছবিটি দেখায়। সে ছবি দেখে আঁতকে ওঠে গরুড়—

“কি না গরুড় মণ্ডলের মা, ওপারে গিয়ে তার পরনে একটা ছৈতা অবধি জুটছে নাই, এক্কেরে ল্যাংটো হইয়া দিন কাটাচ্ছে বুড়ি। টুকচান তেল বিহনে উয়ার মাথার চুল যেন বাবুই পাখির বাসা। সারা শরীলে পাকা চালকুমড়ার পারা খড়ি ফুইট্যে রয়েছে।”

সকলের সামনে এরকম ছবিটা না দেখিয়ে বিবেচকের কাজ করে ঝলক। তাই গরুড় তার নির্দেশ মতো সবই কিনে এনে দেয়— একটা ভালো দেখে শাড়ি, মাথার জন্য এক শিশি জবাকুসুম তেল, গায়ে মাখবার জন্য কেজিটাক সরষের তেল, চাল-ডাল-আনাজপাতি, আলতা, সিঁদুর, মাথা পরিষ্কার করার জন্য শ্যাম্পু, ভালো দেখে একটা টনিক, এক বোতল হরলিক্স।

    খেয়েদেয়ে গড়িয়ে বিকেলে বেরোতে একটু দেরি হয়ে যায় ঝলকের। পাঁচ কিলোমিটার পথ। ঝলক জোরে পা চালায়। ভুতডাঙার শ্মশানের কাছে আসতেই অন্ধকার নামে। বুকটা ঢিপ ঢিপ করে। সহসা চোখের সামনে ছায়া মূর্তি। সারা গায়ে একগাছা সুতো নেই। ‘কে’—জিজ্ঞেস করলে খনখনে গলায় উত্তর আসে— “সে কী বাপ ? ধিয়ানযোগে আমাকে দেইখ্যে আমার ফোটো এঁইক্যে অত বাহবা পেলি, আর স্বচক্ষে সুমুখে দেইখ্যেও চিনতে লারছু ?” তারপর বলে— “আমার ব্যাটা যে সিধেপাতি পাঠালেক তুয়ার হাত দিয়ে, উগুলান তো কই আমাকে দিলি নাই।”

এমন অভিজ্ঞতা আগে হয়নি তার। ভয়ে কাঁধের ঝোলাটা নামিয়ে রেখে জোরে পা চালায়। বাড়ি গিয়ে শোনে তার মা এসেছিল। বউ তার দুবরাজপুর যাওয়ার কথা জানিয়ে বিদায় করেছে। পরদিন সকালে হাটখোলার রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অকস্মাৎ তার নজর যায় গাছের তলার দিকে। যেন ভুত দেখে সে। সেখানে বসে তার মা। গরুড় মণ্ডলের বাড়িতে পাওয়া নতুন শাড়িটা বেশ পেঁচিয়ে পরেছে। কপালে সিঁদুর। পায়ে আলতা। সামনে জবাকুসুম তেলের শিশি। রাজ-রাজেশ্বরীর ভঙ্গিমায় বসেছে মা। ব্যাটার চোখাচোখি হতে ঠোঁটের কোণে হাসল বুড়ি— “এক চিলতে ভারী মিহি-চিকন হাসি। সকালের নরম রোদ্দুরের সঙ্গে সেই হাসি মিশে যায় নিঃশেষে।” 


    ভগীরথ মিশ্র প্রচুর রম্য রচনা, সরস গল্পও লিখেছেন। তাঁর লেখার বিন্যাসই হাসির উদ্রেক করে। তাঁর বেশ কিছু গল্পের চলনেই জড়িয়ে আছে হাসি। এই হাসি দিয়েই তিনি বেঁধে ফেলেন পাঠককে। তারপর পাঠকও লেখকের সঙ্গী হয়ে ওঠেন। মাঝে মাঝে বিশুদ্ধ হিউমার থাকলেও উইট এবং স্যাটায়ার ভগীরথের গল্পগুলিকে সরস করে তুলেছে। এই স্যাটায়ার তাঁর সময় সচেতনতাসঞ্জাত। তাঁর সরস গল্পগুলির হাত ধরে চেনা জগতকে অন্যভাবে আবিষ্কার করা যায়। সজ্জিত যাপনের নানারকম অসঙ্গতির প্রতি বিদ্রূপ প্রকাশিত হয় তাঁর গল্পগুলিতে। তবে সে বিদ্রূপও আপাতভাবে ঝাঁঝহীন। ‘ঢেঁকি কল’, ‘মান্যবরেষু’, ‘হাউস দ্যাট’, ‘ফ্যামিলি পাশন সেট’, ‘কালচার বিয়া দ্যান’, ‘একটি নির্বাচনী বক্তৃতা’ ইত্যাদি গল্পে এই ঝাঁঝহীন সরস বিদ্রূপ চমৎকার ভাবে ফুটে উঠেছে।

তবে ভগীরথ মিশ্রের গল্পের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে গ্রাম— গ্রামীণ ভারতবর্ষ। তাঁর সময়ে অনেকের গল্পেই এসেছে গ্রাম। কিন্তু ভগীরথের গল্পের গ্রামকে— তাঁর গল্পকে আলাদা করে চিনে নিতে অসুবিধে হয় না মনস্ক পাঠকের। চেনা গ্রামকে কিছুটা অন্যভাবে তুলে ধরেন তিনি। কখনো-বা গ্রাম সম্পর্কে আমাদের আজন্ম লালিত বিশ্বাস নাড়িয়ে দেয়। গ্রাম— গ্রামের মানুষ সম্পর্কে শহুরে মানুষের আপাত ধারণাগুলোকে ভেঙে দেয়। ভগীরথের গল্প থেকে বোঝা যায়— হিংসা ঈর্ষা শত্রুতায় গ্রামের মানুষেরাও কম যায় না। গ্রামীণ মানুষেরাও কম জটিল নয়। একই সঙ্গে রুদ্র এবং স্নিগ্ধ সেই গ্রামীণ আবহ, ভালো মন্দে মেশানো। তাঁর ছোটোগল্পগুলি একাধারে গ্রামীণ দলিতজীবনের এক আশ্চর্য চিত্রশালা ও নগরজীবনের পিঠে এক-একটি নির্মম চাবুক। গ্রামীণ প্রাত্যহিকতার জীবন্ত সত্যকে তুলে ধরেন তিনি। আর এভাবেই গ্রামীণ ভারতের জন্ম-শিকড়কে ছুঁতে চান।
      
আরও পড়ুন

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

2 Comments

  1. এমন নির্ভার গদ্যে এভাবে বিশ্লেষণ পড়তে আরাম লাগে। বুঝে নিতে চিনে নিতে সুবিধে হয়। সত্তরের দশকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্পকার যার লেখায় গ্রামবাংলার সমাজচিহ্ন তাঁর স্বকীয় ভঙ্গিতে ফুটে উঠেছে, তাঁর লেখা নিয়ে এ লেখাটি তাঁকে আরও জানার আগ্রহ বাড়িয়ে দিল।

    ReplyDelete
  2. দারুণ লাগল। ভালো ভালো গল্পের নামগুলো জানতে পারলাম। যেগুলো পড়া নেই পড়ে ফেলব। খুব সুন্দর আলোচনা।

    ReplyDelete