জ্বলদর্চি

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা -৩৮/প্রীতম সেনগুপ্ত

পর্ব ৩৮

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা

প্রীতম সেনগুপ্ত

স্বামী নিরঞ্জনানন্দ

বলরাম ভবনে বা ভক্তপ্রবর বলরাম বসুর গৃহে একদিন ভাবাবিষ্ট হয়ে শ্রীরামকৃষ্ণ একজনকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন,“আলেখ, নিরঞ্জন। নিরঞ্জন আয় বাপ -- খারে, নেরে -- কবে তোরে খাইয়ে জন্ম সফল করব। তুই আমার জন্য দেহধারণ করে নবরূপে এসেছিস।” উদ্দিষ্ট ব্যক্তিটি হলেন শ্রীরামকৃষ্ণের ত্যাগী যুবক ভক্ত নিত্যনিরঞ্জন ঘোষ, পরবর্তীকালে সন্ন্যাস নাম -- স্বামী নিরঞ্জনানন্দ। ঠাকুরের অন্যতম ঈশ্বরকোটি পার্ষদ এবং ওঁর সম্বন্ধে ঠাকুর বলেছিলেন -- শ্রীরামচন্দ্রের অংশে অবতীর্ণ হয়েছেন। চব্বিশ পরগণা জেলার রাজারহাট-বিষ্ণুপুর গ্রামে ১৮৬২ সালের শ্রাবণ পূর্ণিমার দিন জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম অম্বিকাচরণ ঘোষ। বারাসত নিবাসী পণ্ডিত কালীকৃষ্ণ মিত্র সম্পর্কে তাঁর মাতুল ছিলেন। তাঁর কলকাতায় অবস্থিত বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করতেন নিরঞ্জন। যৌবনের প্রারম্ভে তিনি প্রেতত্ত্বান্বেষী দলের সঙ্গে যুক্ত হন। এই দলটি তাঁকে প্রেত অবতরণের মাধ্যম বা মিডিয়ম হিসেবে ব্যবহার করত। পরবর্তী সময়ে শ্রীরামকৃষ্ণের সংস্পর্শে এলে তিনি নিরঞ্জনকে বলেন, “দ্যাখ নিরঞ্জন, ভূত ভূত করলে তুই ভূত হয়ে যাবি, আর ভগবান ভগবান করলে ভগবানই হবি। তা কোনটা হওয়া ভাল।” নিরঞ্জন উত্তর দেন, “তা হলে ভগবান হওয়াই ভাল।”

 নিরঞ্জন শ্রীরামকৃষ্ণের সংস্পর্শে আসেন সম্ভবত ১৮৮১-৮২ সালে। তখন তাঁর বয়স আনুমানিক ১৮ বৎসর। কেননা ‘কথামৃত’ ৩য় ভাগে উল্লেখ আছে -- ১৮৮৭ সালের এপ্রিল মাসে তাঁর বয়স ছিল ২৫-২৬ বৎসর। সুন্দর সুঠাম চেহারার অধিকারী ছিলেন তিনি। দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের অহৈতুকী ভালোবাসায় বাঁধা পড়েছিলেন। ঠাকুর বলতেন, “ওরে নিরঞ্জন, দিন যে যায় রে -- তুই ভগবান লাভ করবি কবে? দিন যে চলে যায়, ভগবান লাভ না করলে সবই যে বৃথা হবে। তুই কবে তাঁকে লাভ করবি বল, কবে তাঁর পাদপদ্মে মন দিবি বল? আমি যে তাই ভেবে আকুল!” অদ্ভুত সারল্যের অধিকারী নিরঞ্জনের প্রতি মুগ্ধতা থেকে ঠাকুর একদিন মাস্টারমশায় ( কথামৃতকার শ্রীম )-কে বললেন, “তোমায় নিরঞ্জনের সঙ্গে দেখা করতে বলছি কেন? সে সরল ইহা সত্য কি না, এইটি দেখবে বলে।” (শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত, পঞ্চম ভাগ)

 বৃদ্ধা মাতার ভরণপোষণের জন্য নিরঞ্জনকে চাকরি করতে হত। শ্রীরামকৃষ্ণ চাইতেন না তাঁর কোনও উচ্চ অধিকারী যুবক ভক্ত কাঞ্চনাবদ্ধ হয়ে পড়ে। এই বিষয়ে নিরঞ্জনকে একদিন বলেন, “দেখ তোর মুখে যেন একটা কালো আবরণ পড়েছে। তুই আফিসের কাজ করিস কিনা, তাই পড়েছে। আফিসের হিসাব-পত্র করতে হয় আরও নানারকম কাজ আছে -- সর্বদা ভাবতে হয়। সংসারী লোকেরা যেমন চাকরি করে, তুইও চাকরি করছিস, তবে একটু তফাত আছে। তুই মার জন্য চাকরি স্বীকার করেছিস। মা গুরুজন, ব্রহ্মময়ীস্বরূপা। যদি মাগ-ছেলের জন্য চাকরি করতিস, আমি বলতুম -- ধিক, ধিক, শত ধিক, একশ ছি!” (শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তমালিকা) ঠাকুর অপার স্নেহদানে পরিপূর্ণ করেছিলেন নিরঞ্জনকে। তবে প্রয়োজনীয় শিক্ষাদান, কঠোর শাসনও করতেন। স্বামী সারদানন্দ রচিত ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ লীলাপ্রসঙ্গ’ গ্রন্থের দিব্যভাব পর্যায়ে আমরা এই বিষয়ে উল্লিখিত একটি ঘটনা পাই। ঘটনাটি এইরকম --

 “ শ্রীযুক্ত নিরঞ্জনের স্বভাবতঃ উগ্রপ্রকৃতি ছিল। গহনার নৌকায় করিয়া দক্ষিণেশ্বর আসিবার কালে আরোহী সকলকে ঠাকুরের অযথা নিন্দাবাদ করিতে শুনিয়া তিনি প্রথমে উহার তীব্র প্রতিবাদে নিযুক্ত হইলেন এবং তাহাতেও উহারা নিরস্ত না হওয়াতে বিষম ক্রুদ্ধ হইয়া নৌকা ডুবাইয়া দিয়া উহার প্রতিশোধ লইতে অগ্রসর হইলেন। নিরঞ্জনের শরীর বিশেষ বলিষ্ঠ ও দৃঢ় ছিল এবং তিনি বিলক্ষণ সন্তরণপটু ছিলেন। তাঁহার ক্রোধদৃপ্ত মূর্তির সম্মুখে সকলে ভয়ে জড়সড় হইয়া গেল এবং অশেষ অনুনয়, বিনয় ও ক্ষমা প্রার্থনা করিয়া নিন্দাকারীরা তাঁহাকে ঐ কর্ম হইতে নিরস্ত করিল।” ঠাকুর এই কথা পরে জানতে পেরে তাঁকে তিরস্কার করে বলেছিলেন, “ক্রোধ চণ্ডাল, ক্রোধের বশীভূত হতে আছে? সৎ ব্যক্তির রাগ জলের দাগের মতো, হয়েই মিলিয়ে যায়। হীনবুদ্ধি লোক কত কি অন্যায় কথা বলে, তা নিয়ে বিবাদ বিসংবাদ করতে গেলে ওতেই জীবনটা কাটাতে হয়। ওরূপ স্থলে ভাববি লোক না পোক ( কীট ) এবং তাদের কথা উপেক্ষা করবি। ক্রোধের বশে কি অন্যায় করতে উদ্যত হয়েছিলি, ভাব দেখি -- দাঁড়ি-মাঝিরা তোর কি অপরাধ করেছিল যে, সেই গরীবদের উপরও অত্যাচার করতে অগ্রসর হয়েছিলি?” আবার নিরঞ্জন বেশি ঘি খান জানতে পেরে ঠাকুর তাঁকে সাবধান করে দিয়েছিলেন, “অত ঘি খাওয়া? শেষে কি লোকের ঝি-বউ বার করবি?”

 বিপুল আধ্যাত্মিক সাম্রাজ্যের সম্রাট ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর অন্তরঙ্গ পার্ষদদের মধ্যে সমূহ আধ্যাত্মিকতা সঞ্চার করতেন। ‘লাটু মহারাজের স্মৃতিকথা’ গ্রন্থ অনুযায়ী জানা যাচ্ছে লাটু মহারাজ একবার বলেছিলেন -- “নিরঞ্জন ভাইকে ঠাকুর একদিন ভাবাবেশে ছুঁয়ে দিলেন। তাতেই তিন দিন, তিন রাত্রি তার চোখের পাতা পড়ে নি, কেবল জ্যোতি দেখেছে আর জপ করেছে। তিন দিন জিব থেকে তার জপ ছুটে যায় নি। ভারী ভূত নামাত কি না, তাই তিনি মস্করা করে বলেছিলেন, ‘এবার আর যে-সে ভূত নামেনি, একেবারে ভগবান ভূত ঘাড়ে চেপেছে। তোর সাধ্য কি যে তুই তাকে ঘাড় থেকে নামাস।” ‘শ্রীশীরামকৃষ্ণ লীলাপ্রসঙ্গ’ দিব্যভাব অধ্যায়ে এই প্রসঙ্গে উল্লেখ আছে এইরকম -- “ভক্তদিগের মধ্যে কোন কোন ব্যক্তিকে ঠাকুর স্পর্শ করা ভিন্ন কখন কখন আনবী বা মন্ত্রদীক্ষাও প্রদান করিতেন। ঐ দীক্ষাপ্রদানকালে তিনি সাধারণ গুরুগণের ন্যায় শিষ্যের কোষ্ঠীবিচারাদি নানাবিধ গণনা ও পূজাদিতে প্রবৃত্ত হইতেন না। কিন্তু যোগদৃষ্টিসহায়ে তাহার জন্মজন্মাগত মানসিক সংস্কারসমূহ অবলোকনপূর্বক ‘তোর এই মন্ত্র’ বলিয়া মন্ত্রনির্দেশ করিয়া দিতেন। নিরঞ্জন, তেজচন্দ্র, বৈকুণ্ঠ প্রভৃতি কয়েকজনকে তিনি ঐরূপ কৃপা করিয়াছিলেন, একথা আমরা তাঁহাদের নিকট শ্রবণ করিয়াছি।” কলকাতার শ্যামপুকুরে যে সময়ে চিকিৎসার সুবিধার্থে ঠাকুর অবস্থান করছেন সেই সময় গিরিশাদি ভক্তগণ ঠাকুরের দেহে মা-কালীর আবির্ভাব প্রত্যক্ষ করেন। তাঁরা ঠাকুরের শ্রীপদে পুষ্পাঞ্জলিও অর্পণ করেন। সেই রাত্রে নিরঞ্জনও ভক্তিপূর্ণ চিত্তে ‘ব্রহ্মময়ী’, ‘ব্রহ্মময়ী’ সম্বোধনে অঞ্জলি প্রদানের শেষে ঠাকুরের শ্রীচরণে মাথা রেখে প্রণাম করেছিলেন। স্বরূপের পরিচয় পেলেও  ঠাকুরের সঙ্গে নিরঞ্জন তথা সকল অন্তরঙ্গেরই ছিল মূলত তীব্র ভালোবাসার বন্ধন।

পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments