জ্বলদর্চি

খর্জুর বীথির ধারে--১৪/মলয় সরকার

খর্জুর বীথির ধারে

মলয় সরকার
(১৪শ পর্ব ) চতুর্দশ পর্ব




হঠাৎ দেখি, দূর থেকে, একটা পরিবার ঘুরে বেড়াচ্ছে। বেশি লোকজন তো নেই। আমরা ছাড়া আর খুব বেশি মানুষ নেই। কাছে গিয়ে মনে হল, বাঙালী বাঙালী মনে হচ্ছে। আর একটু এগোতেই, দেখি, ওনারাও আমাদের দিকে এগিয়ে আসছেন। এসেই আমাদের দেখে উল্লসিত হয়ে, অপেক্ষাকৃত কম বয়সী মেয়েটি , আমাদের দেখে বলল, আপনারা কি বাঙ্গালী? আমরা তো খুব খুশি হয়ে উঠলাম। বললাম, হ্যাঁ, আপনারা কোথা থেকে এসেছেন? ওনারা বললেন, আগরপাড়া, ডানলপের কাছে। আমরা বললাম, আমরা তো পাশেই সোদপুর থেকে। দুপক্ষই কত উল্লসিত হয়ে উঠলাম, বিদেশে এসে দেশীয় একজন মানুষকে পেয়ে। মনে হল, আমার কত নিকটের মানুষ, কত আত্মীয়।
অথচ, আমাদের সোদপুরের বাড়ীর কাছেই কত মানুষের সাথে কথাই বলা হয় না। অনেকদিন আগে পড়া একটা কথা মনে হল, ‘স্বদেশকে কি ভাল করিয়াই না চিনিলাম বিদেশে গিয়া’। তাই হয় বটে। 
বাঃ খুব ভাল হল। এত দূরে এসে নিজের জায়গার একজন মানুষকে পেলাম। কতদিন পর নিজের ভাষায় কথা বলতে পারলাম, বাইরে এসে।আসলে  যতই বলি, নিজের ভাষায় কথা বলতে না পারলে বহুদিন পর যেন কেমন বদ হজম হয়।
ঠিক বলেছেন আন্টি। আমি দূর থেকে আপনাদের দেখেই মাকে বলছি, মা, হাব ভাব দেখে মনে হচ্ছে বাঙ্গালী। দেখলে তো মা, আমি ঠিকই বলেছি।
মুচকি হাসলেন পাশে দাঁড়ানো ভদ্রমহিলা। 
এখান থেকে আপনারা কোথায় যাবেন? 
জিজ্ঞাসা করল বুলবুল।
আমরা যাব প্যালেস্তাইন। আপনারা?
আমরা আজই কলকাতায় ফিরব। 
তাহলে আপনাদের ঠিকানা টা দিন। ফিরে গিয়ে অবশ্যই যোগাযোগ করব।


এরকমই হয়। এর আগে তুরস্কের ইস্তানবুলে বাংলাদেশী পরিবারটিকে পেয়েও এমনই মনে হয়েছিল। তখন মনে হয়, কত আত্মীয় , কত নিজের লোক। কিন্তু পরে হয়ত, বাড়ি ফিরে স্বজনদের মাঝে পড়ে রাস্তার বন্ধু রাস্তাতেই হারিয়ে যায়। পথের বন্ধুত্ব শেষ হয় পথেই, তবু ছোট্ট ক্ষণিকের হলেও স্মৃতিচিহ্নটুকু ছাপ ফেলে যায় সুদূর ভবিষ্যতের জমিতে।আমি তো পথিক। জীবনের পথে পথে , কত বাঁকে বাঁকে এমন কত বন্ধু এসেছে জীবনে, তারপর তারাও আর যোগাযোগ রাখেনি, আমিও নয়। কেউ বা কিছুদিন যোগাযোগ রেখে হারিয়ে যায় তার নিজের চলার পথে। জীবন পথের পথিকের এসব আঁকড়ে বসে থাকার সময় নেই। তাই পথের ধূলাকে মাথায় নিয়েই চলতে হয় নতুনের সন্ধানে।তার শুধু খুঁজে ফেরাই কাজ আর আঁচলে বেঁধে নেওয়া নতুন পথের সঞ্চিত মণিমুক্তো–

এখান থেকে এবার গন্তব্য আমাদের জেরাশ। 

জেরাশ হল আমাদের পরবর্তী  এবং শেষ গন্তব্য। আম্মান সিটাডেল থেকে প্রায় ৫০ কি মি দূরেই জেরাশ।এখানে পৌঁছাতেও প্রায় একঘণ্টাই লাগল। এখানে পৌঁছে আমাদের চক্ষু ছানাবড়া, এত বড় রোমান ধ্বংসাবশেষ রোমের বাইরে আগে দেখিনি, যার অনেকখানিই ভাল অবস্থায় রয়েছে, গুঁড়িয়ে মাটিতে মিশে যায় নি।
রায়েধ এখানে আমাদের গাইডের হাতে ছেড়ে দিয়ে বলল,দেখুন যতক্ষণ সময় লাগে। আপনাদের এটাই শেষ দ্রষ্টব্য। কাজেই সময় নিয়ে ভাল করে দেখুন।আমরা এগোলাম। আজ পরপর শুধু আম্মান শহরের অতীত ইতিহাসের মধ্যেই ঘুরে চলেছি আর ভাবছি, কত সমৃদ্ধ ছিল এই অতীতের আম্মান!

এই জেরাশের ইতিহাস প্রায় ৬৫০০ বছরের পুরানো।এখানে প্রথমে কিছু মানুষ চাষবাস করার জন্যই এসেছিলেন।পরে এটি যখন নতুন রাজত্বের অংশ হিসাবে বিজিত হয়, এখানে আসতে শুরু করে নানা ব্যবসায়ী ও ভাগ্য সন্ধানী মানুষ ।ক্রমশঃ শহর যত বাড়তে ও সমৃদ্ধ হতে  থাকে, ততই বিভিন্ন শক্তিশালী রাজ্যের  নজর পড়ে এর দিকে। এখানে গ্রীকরাও আসে ৩২৬ খ্রীঃ পূঃতে, আলেক্সান্ডার ও তাঁর বাহিনীরাও এর দখল নেয়।পরে ৬৩ খ্রীঃ পূঃতে আসে রোমানরা। তার অনেক পরে ৬১৪ সালে পারসিকরা এর দখল নেওয়ার পর এর পতন হতে আরম্ভ করে।ক্রুসেডাররা এখানে এসে আবার কিছু পরিবর্তন সাধিত করে।
১৯২০ সালে এই অঞ্চলটির খনন কার্য চালু হয়।
এই শহরটি অক্ষত থাকার একটি বড় কারণ হল, এখানের জিনিসপত্র বেশি চুরিও হয় নি, কেউ লুঠও করে নি বা নষ্টও করে নি। এবং এই জায়গাটা সংরক্ষণও সুন্দর ভাবে করা হয়েছে। 

সামনেই দেখি এক বিশাল গেট । প্রাচীন ঐতিহ্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, প্রায় অক্ষত, বেশ উঁচু এবং কারুকার্য মণ্ডিত। এটি হার্দ্রিয়ান গেট ।এই গেটটি দ্বিতীয় শতাব্দীতে তৈরী। মাথায় রয়েছে বেশ সুন্দর একটি আর্চ। আমার মনে পড়ল আমাদের দেশের বর্ধমানে কার্জন গেট রয়েছে, যা লর্ড কার্জনের সম্মানে তৈরী হয়েছিল। এটি অনেকটি যেন তার মত। এই সম্রাট হার্দ্রিয়ান বেশ প্রবল পরাক্রমী সম্রাট ছিলেন, এঁর নামে আমি অনেক গেট , দেওয়াল, ইত্যাদি বিভিন্ন জায়গায় দেখেছি। যেখানে গেছেন , সেখানেই তাঁর নামে কিছু হয়েছে। ইনি রোমের প্যান্থিয়নটাও করিয়াছিলেন। আমি রোমে ওনার সমাধিও দেখেছিলাম পরে।

এই ১১ মি উঁচু  ও ৬ মি চওড়া গেটটি, ১২৯-১৩০ খ্রীষ্টাব্দে তৈরী হয়েছিল, তাঁর এখানে আগমন উপলক্ষ্যে। এটি তিন ভাগে ভাগ করা গেট। মাঝে বড় এবং উঁচু গেট হয়ত গাড়ী যাওয়ার জন্য । এর দুপাশে  রয়েছে ছোট গেট।এই হাদ্রিয়ান গেট দিয়েই ঢোকা যেত তখনকার জেরাসা ( Gerasa) শহরে। এর দুপাশে রয়েছে দেওয়াল।খুব সম্প্রতি, ২০০৫-২০০৭ সালে এর কিছু সংস্কার হয়।এর থামের তলায় রয়েছে বেশ পাতা আকৃতির কারুকাজ। গেটটি তিন ভাগে যে ভাগ রয়েছে, তার মাথাগুলোতে তিনটি ত্রিকোণা কার্নিশ ধরণের করা আছে। 
এই গেট দিয়ে ঢুকে দেখি এক বিশাল এলাকা জুড়ে শুধু ধ্বংসাবশেষ রয়েছে, যেন সদ্য কোন বম্বিং এ শহরটা নষ্ট হয়েছে। রায়েধ আমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল গাইডের, যিনি সব ঘুরিয়ে দেখাবেন। এখান থেকে যে রাস্তা ভিতরে গেছে, সেটি পুরোটাই পাথরে বাঁধানো। চারপাশে সবটাই আসলে পাথরে তৈরী।
এখানে দেখি রয়েছে রাস্তার পাশে দেওয়াল দিয়ে ঘেরা হিপোড্রোম, যার  ভিতরে সব গ্ল্যাডিয়েটর বা প্রাচীন রোমান সৈন্যের পোষাক পরে কিছু লোক প্রাচীন দিনের যুদ্ধের অভিনয় করছে, এবং একটি গ্যালারীতে বেশ কিছু দর্শক বসে উপভোগ করছেন। বুঝলাম, এটাও এক ধরণের আনন্দ দেওয়ার প্রচেষ্টা। এই হিপোড্রোমটি ২৬৫ মি লম্বা আর ৫২ মি চওড়া ।এই হিপোড্রোমে  ১৫-১৭০০০ লোক বসতে পারতেন।এটিই আসলে সে যুগের স্টেডিয়াম। এটি তৈরী হয় দ্বিতীয় বা তৃতীয় শতাব্দীতে। খৃষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে এর উত্তরাংশে তৈরী হয় এম্ফিথিয়েটার, যেখানে গ্ল্যাডিয়েটরদের লড়াই হত। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শতাব্দী পর্যন্ত এখানে বিভিন্ন জিনিস মেরামতির কাজের জন্য ব্যবহৃত হত। পরে একসময় প্লেগে বহু লোক মারা যাওয়ায় তাড়াহুড়োতে এখানে গণকবরের ব্যবস্থা করাও হয়েছিল। এখন এখানে মাঝে মাঝেই গ্ল্যাডিয়েটরের লড়াই বা রথের রেসের অভিনয় দেখানো হয়।এটি আজও বেশ ব্যবহার হয়।

 এখান থেকে আমরা গেলাম যে জায়গাটিতে সেটি সেকালের প্রধান রাজপথ। রাস্তার পাশে পরের পর উঁচু কারুকার্য করা থাম, যেমন সব রোমান রাস্তাতেই থাকে; এছাড়া রয়েছে পাথরের বাঁধানো রাস্তা। রাস্তার উপরে রয়েছে, সেদিনের ঘোড়ার গাড়ির, বেশি চলাচলের ফলে , চাকার দাগ।আর এই যে রাস্তা, গাইড বললেন, এটিতে সেদিনও যেমন দাগ ছিল, সেই রাস্তার দাগই দেখছেন আজ প্রায় ২০০০ বছর পরে। রাস্তায় পা দিয়ে অনুভব করলাম, সেদিনের সেই সময়টাকে।এটিকে বলে Colonnaded Street বা  Cardo Maximus।  এর আশে পাশে চতুর্দিকে শুধু একটা  বিশাল সমৃদ্ধ শহরের অবশিষ্টাংশ পড়ে রয়েছে। এখানে রাস্তাগুলো দেখি সব একেবারে সমকোণের ক্রশিং।অর্থাৎ উত্তর দক্ষিণমুখী রাস্তাকে পূর্ব-পশ্চিমমুখী রাস্তা পেরিয়েছে সমকোণে।রাস্তার পাশে পাশেই এবং এর চারিদিকেই ছিল দোকান পাট , মন্দির ইত্যাদি।
প্রত্যেক স্তম্ভের মাথার উপরের দিকে যথেষ্ট কারুকাজ করা পাতা ফুল আকৃতির নক্সা খোদাই করা।এই রকম রাস্তা আরও অনেকই রয়েছে। তবে পাশাপাশি এত অবিকৃত নিটোল স্তম্ভ আর কোন রাস্তাতেই নেই।


এর কাছেই বা পাশেই রয়েছে Oval Forum বা Oval Plaza । এটি একটি ডিমের আকৃতির ঘেরা জায়গা , প্রায় ৯০ মি লম্বা ও ৮০ মি চওড়া  আয়তনের। যার চারদিকে  রয়েছে পরপর ৬-৮ মি উঁচু ১৬০ টি  থাম দিয়ে ঘেরা।এটি দ্বিতীয় শতাব্দীতে তৈরী।এর মাঝে একটি ফোয়ারা রয়েছে যেটি সপ্তম শতাব্দীতে সংযুক্ত হয়েছিল।এছাড়া দুটি স্তম্ভ আছে, হয়ত কিছু বসানো ছিল তার উপরে (সম্ভবতঃ কোন রোমান মূর্তি)। এর ধারে যে স্তম্ভগুলি রয়েছে, তার মাথা গুলোর উপরে পর পর পাথরের টুকরো দিয়ে জোড়া রয়েছে, অর্থাৎ উপর দিকটা সবটাই প্রায় রিং মত করে সব থামগুলো জোড়া। 
এর দক্ষিণ দিকে রয়েছে একটি গেট।যেটি তৈরী হয়েছিল ১৩০ খ্রীঃ তে।এটিও ওই তিনভাগে দরজা সমেত প্রধান হার্দ্রিয়ান গেটের মতই ,শুধু এর মাথাটা ফাঁকা। হয়ত নষ্ট হয়ে গেছে। আর এটা একটু সাদা মাটা। অবশ্য তৈরীর ব্যাপারে কোন খামতি নেই, যথেষ্ট শক্ত পোক্ত।
চলুন, ধীরে ধীরে আমরা প্রায় শেষ পর্যায়ে। সঙ্গে থাকুন।

ক্রমশঃ —

পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments