জ্বলদর্চি

কবিতা অ্যাভিনিউ/পর্ব ২২/ বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়

কবিতা অ্যাভিনিউ

পর্ব ২২


বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়

‘যেকোন শিল্পই হবে রক্ত দিয়ে ফোটানো গোলাপ’

কবিতা কোন সুস্থির আশ্রয় নয়, কোন সফলতার গান নয়।নিরাপদ নিস্তব্ধ আস্তানায় বসে চুপচাপ কল্পনা বিলাসের নাম কবিতা নয়। বুকের ভেতর অবিরাম রক্তক্ষরণ না থাকলে কবিতা লেখা যায় না। এই রক্তক্ষরণের মধ্য দিয়ে গোলাপ ফোটানোর নামই শিল্প। কবি পবিত্র মুখোপাধ্যায় দূরাভিসারী কল্পনাবিলাসের স্বপ্নময় প্রতিবেশ রচনা করেননি, নিরন্তর অস্থিরতা এবং দুর্বিনীত সময়ের বিরুদ্ধে অতিক্রম করেছেন সময়ের আগ্নেয়গিরি। কবিতা তাঁর কাছে হয়ে উঠেছে অতিক্রমণের মন্ত্র।নিজস্ব যন্ত্রণামোক্ষণের শিল্পক্ষেত্র। কবিতা নিয়ে তাঁর উন্মাদনা শুরু হয়েছিল একেবারে পাঠশালা থেকে। মায়ের মৃত্যুর পর একজন শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ যেমন ব্যাহত হয় কবি পবিত্র মুখোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল।এক বৃষ্টিভেজা দিনে  তাঁর মায়ের অকালমৃত্যু সাত বছর বয়সে তাকে রিক্ত করে দিয়েছিল। দিয়েছিল আবহমান এক শূন্যতার বোধ, ‘জীবন কী, কেন এই পৃথিবীতে আসা, মানুষ কোথায় যায় মৃত্যুর পর, এইসব ভাবনা তাকে ক্রমাগত অস্থির করে তোলে অল্প বয়সেই।এবং তাঁর বোধ জন্মে জীবন আসলে এক মুহূর্তের খেলা। তাঁর কবিতায় যে বিষাদ , যে শূন্যতা এবং জীবনের  অনিশ্চয় ভবিতব্যের কথা আছে তা মূলত মায়েরই স্মৃতিনিপীড়িত। মাকেই তিনি খুঁজেছেন নিজস্ব দর্পনে- দর্পনে অনেক মুখ, মার মুখ মনেও পড়ে না।

  দাঙ্গা বিধ্বস্ত বাংলাদেশ থেকে এক বিধবা মাসিমার হাত ধরে ১৯৪৮ সালে কলকাতায় চলে এসেছিলেন মাত্র আট বছর বয়সে।বরিশালের জলভাঁটি অঞ্চলের  আমতলিতে কেটেছে তাঁর ছোটবেলা।মায়ের মৃত্যু নিয়ে তীব্র শোকে তিনি লিখেছিলেন জীবনের প্রথম কবিতা।ঠিকানা বদল হতে হতে ভবানীপুরের চক্রবেড়ে রোডের এক পুরোনো জমিদার বাড়িতে আশ্রয় পেয়েছিলেন। ভবানীপুর সাউথ সাবার্বান মেন স্কুলে ক্লাস সেভেনে ভর্তি হয়েছিলেন।  ছোটবেলা থেকেই অভাব অনটন আর অস্থিরতা তাঁর নিত্যসঙ্গী। তিনি বলেছেন- ‘দারিদ্রকে ভয় পাইনি কোনোদিন, কেননা জন্ম থেকেই দারিদ্র আমার নিত্যসঙ্গী।… ওর মধ্যে আমার ধ্রুব আনন্দের লক্ষ্য তখন কবিতা। কবিতা আমাকে দারিদ্রের পীড়ন থেকে বাঁচাতো, অসীম আশায় বুক বাঁধতে বলতো, শেখাতো। (দ্রোহীপুরুষ)।

দেশভাগের যন্ত্রণা নিয়ে মাতৃবিয়োগের স্মৃতি নিয়ে বাস্তুচ্যুত, স্নেহ নির্বাসিত একজন  মানুষের কাছে কবিতাই হয়ে উঠেছিল একান্ত আশ্রয়। নিজের আত্মাকে তিনি সমর্পণ করেছিলেন শব্দের ভূমিতে। ভবানীপুরে পড়ার সময় এই স্কুলেই মৃণাল দত্তের সাথে পরিচয়। সহপাঠী ছিলেন তিনি। দুজনেরই ছিল স্বপ্ন দেখার রোগ। ছোটবেলা থেকেই একটা পত্রিকা প্রকাশের স্বপ্ন তাঁদের তাড়া করত। এই দুজনের যৌথ উদ্যোগে ১৯৫৭ সালে  প্রকাশিত হয়েছিল কবিপত্র।পরে ষাটের দশকের মাঝামাঝি তা ধ্বংসকালীন আন্দোলনের মুখপত্র হয়ে ওঠে। পাঁচের দশকের শেষভাগে বাংলা কবিতায় পবিত্র মুখোপাধ্যায়ের আবির্ভাব, কিন্তু প্রতিষ্ঠা ছয়ের দশকের গোড়ায়। কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর খ্যাতি যখন তুঙ্গে এবং হাংরি কবিরা যখন অন্তর্ঘাতময় ইশতেহার ছড়িয়ে দিচ্ছেন, পবিত্র তার মধ্যেও নিজের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছেন, বস্তুত তিনি নিজেই হয়ে উঠেছেন বাংলা কবিতার স্বতন্ত্র একটি ভাবধারা।

একদিকে কলাকৈবল্যবাদী অর্থাৎ স্থিতাবস্থার সমর্থক ও প্রহরী এবং অন্যদিকে প্রতিবাদ-প্রধান সাহিত্যের মাঝখানে কবিপত্র পত্রিকাকে কেন্দ্র করে তৃতীয় বিকল্প চিন্তার জন্ম হয়েছিল। সাহিত্যের ইতিহাসে যা থার্ড লিটারেচার মুভমেন্ট নামে পরিচিত।কবিপত্রের প্রতিবাদী চরিত্র ক্রমেই সকলের কাছে গ্রহনযোগ্য হয়ে উঠতে শুরু করে।প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষনা নয় লেখক তাঁর নিজের প্রতিভার জোরে  অনুশীলনের সততায় নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করবে।প্রকৃত সাহিত্যপত্র সত্যের ভিত্তিতে নির্মিত নন্দন তত্বগত উৎকর্ষতায় উত্তীর্ণ মহৎ শিল্পকেই প্রাধান্য দেবে। মিথ্যা মনোহারী  শিল্পকে কঠোর বর্জন করবে। এসব কথা বাবার কাছে শুনতে শুনতে কবিপত্রের পাতায় চোখ রাখতে রাখতে অজান্তেই কবি পবিত্র মুখোপাধ্যায়ের  এক মূর্তি স্থাপিত হয়েছে মনে। মিথ হয়ে যাওয়া তাঁর অজস্র কবিতা সে তো সেই কবে থেকে ঢুকে গেছে রক্তের ভেতর। ‘যেকোন শিল্প হবে রক্ত দিয়ে ফোটানো গোলাপ’ বা ‘যে যাবে অনেকদূর, তাকে বলি ধীর পায়ে হাঁটো’ । এক একটি কবিতার লাইন কীভাবে ঋষিবাক্যের মতো অমোঘ হয়ে যায় এ তো তারই উজ্জ্বল উদাহরণ।

কবি পবিত্র মুখোপাধ্যায়ের ‘ইবিলিশের আত্মদর্শন’ নিয়ে  প্রচুর আলোচনা হয়েছে। সর্বস্তরের সর্বশ্রেণির পাঠকের কাছে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ নিয়ে উপস্থিত হয়েছে এর মর্মার্থ। তাঁর কবিতায় কাব্যিক ভাষ্য এবং বাচনিক ভাষ্যের বিভেদরেখা  মুছে গেছে কত সহজেই। শিল্পসত্তাকে অক্ষুণ্ণ রেখে  কবিতাকে সাধারণ মানুষের মুখের দিকে ফিরিয়ে দেওয়ার, মানুষের কাছাকাছি নিয়ে আসবার এক আত্মমগ্ন আয়োজন ছিল তাঁর ভাবনায়।পেশায় অধ্যাপক কবি পবিত্র মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘দর্পনে অনেক মুখ’’,শবযাত্রা’, ‘হেমন্তের সনেট’,’আগুনের বাসিন্দা’,’ইবলিসের আত্মদর্শন’,’অস্তিত্ব অনস্তিত্ব সংক্রান্ত’,’বিযুক্তির স্বেদরাজ’,’দ্রোহহীন আমার দিনগুলি’,’অলর্কের উপাখ্যান’,’আমি তোমাদের সঙ্গে আছি’,’আছি প্রেমে,বিপ্লবে বিষাদে’ প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থে এই সত্যকেই তুলে ধরেছেন।মূলত সুসংবদ্ধ দীর্ঘকবিতা ও বৈচিত্র্যময় সনেটের জন্য স্মরণীয় কবি পবিত্র মুখোপাধ্যায় দু’টি সাহিত্য আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব— ধ্বংসকালীন আন্দোলন (১৯৬৯) ও থার্ড লিটারেচার (১৯৮০)। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলা কাব্যধারায় এক পথের অনুসন্ধান করেছে তাঁর  সম্পাদিত কবিপত্র (১৯৫৭)। হয়ে উঠেছে তরুণ মেধাবী কবিদের শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম। কৃত্তিবাস বা শতভিষা-র মতোই কবিদের একান্ত আশ্রয় হয়ে উঠেছে কবিপত্র। অনেক প্রতিভাবান কবি ও গদ্যকার এই পত্রিকার পাতা থেকেই বিকশিত হয়েছেন।  ছয় দশকের বেশি সময় ধরে এই পত্রিকা নিরন্তর আমাদের বাংলা কবিতায় এক উজ্জ্বল মাইলস্টোন হয়ে উঠেছে। কবি পবিত্র মুখোপাধ্যায়ের সাথে গুনে গুনে পাঁচবার দেখা হয়েছে আমার।প্রথম দেখা হয়েছিল মেছেদায় ২০১৩ সালে স্বপন বাগ সম্পাদিত সাহিত্য প্রগতি পত্রিকার অনুষ্ঠানে।কবি অনন্ত দাশ পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন।পরে দুর্গাপুরে নকুল মৈত্র সম্পাদিত একাল পত্রিকার অনুষ্ঠানে আবার দেখা।ডাঃ প্রেমাঙ্কুর মৈত্রের আমন্ত্রণে গিয়েছিলাম,সাক্ষাত হল শ্রদ্ধেয় কবি পবিত্র মুখোপাধ্যায়, সাহিত্যিক সাধন চট্টোপাধ্যায় সাহিত্যিক প্রগতি মাইতির সাথে। পরে আরও কয়েকবার দেখা হয়েছে এই সামান্য দেখা, তবু মানুষটিকে মনে হত কত চেনা। এর কারণ বাবার কাছে তাঁর এত গল্প শুনেছি,কবিপত্র নিয়ে এত কথা হয়েছে যে তাঁকে কখনই আমার অচেনা মনে হয়নি। ২০০৯ সালে তিনি তাঁর কাব্যকৃতির জন্য রবীন্দ্র স্মৃতি পুরস্কার পান। শুধু এই কথাগুলো বলার জন্য কবিতা অ্যাভিনিউ  নয়। কবিতার ভেতর তিনি যে পথরেখা এঁকে গেছেন তার অনুসন্ধানই কবিতা অ্যাভিনিউএর মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। তাঁর কবিতার পংক্তি জুড়ে আলোর প্লাবন, চরিতার্থ জীবনের সুখ যেমন আছে, আছে ব্যক্তিগত দ্রোহের শেষে শূন্য মেঘের প্রেম ও বিষাদ।


সুবাতাস ভারি করে কেউ কেউ দারুণ আহ্লাদে

পৃথিবীর রাজপথ গলিপথ জুড়ে

রাজকীয় আলোর প্লাবন

দেখে যায়, পায়

চরিতার্থ জীবনের সুখ।(কিছু পড়ে থাকে)


ব্যক্তিগত দ্রোহের শেষে  শূন্য মেঘ জমে ( অসঙ্কোচে দিয়েছি মেলে) 


নিত্য উচ্ছল জীবনে ভেসে থাকি,

ভাবছি সারাদেশে কার্নিভাল।

আমার স্থুলদেহ আরামে ঢেকে রাখি।

অদূরে দেখি হাসে ক্রান্তিকাল ।( মধ্যবিত্ত)


আমাদের মাঝখানে সবুজ প্রান্তর পড়ে আছে-

আর কিছু নেই।

অথচ আমরা কত দূরে, এই মাঠ পেরুলেই

যেতে পারি কাছে

ছোটবেলাকার মতো ( আমাদের মাঝখানে)


ক্রমশ ধূসর হয়ে যাচ্ছে মুখ, পরিচিত শরীর তোমার

আমাদের ভাষাব্যবহার

দেখে মনে  হয় শব্দ তার

হারিয়েছে অর্থ  ও ব্যঞ্জনা ( আমাদের মাঝখানে )


চাঁদ যেম ব্যাধিগ্রস্ত ঈশ্বরের মুখ


 দর্পনে অনেক মুখ মার মুখ মনেও পড়ে না


এক একটা দিন মেঘ ও রৌদ্রে শৈশব থেকে

ছুটে আসা হাওয়া

হু হু করে বুক, কীসের অসুখ বুঝি না

মেঘেরা ঝুঁকে পড়ে নীচে,

গগন ঠাকুর মৃত্যু সিরিজ সাদা কালো রঙে

এঁকে যায় ,আর-

 শুরু হল যাওয়া, শুরু হল যাওয়া ( এক একটা দিন) 

 

 সুমিত শব্দচয়ন,রূপময় চিত্রকল্প এবং অনুভুতিময় ভাবাবেশ তাঁর কবিতার উপর আলো ফেলেছে।

 কবিতা এবং মহাকবিতায় কবি পবিত্র মুখোপাধ্যায় মানুষের সত্তা ও শূন্যতা এবং  মহাসময়ের প্রতিচ্ছবিকে এক অখণ্ড সুত্রে গেঁথে দিয়েছেন।  সাবললীভাবে অনায়াস দক্ষতায়  তিনি স্মৃতি সত্তা এবং স্বপ্নকে  বর্তমানের ক্যানভাসে যেমন আঁকতে পেরেছেন সেরকমভাবে  বররতমানকে করে তুলেছেন চিরকালীন।

কবি পবিত্র মুখোপাধ্যায়ের কবিতায় জীবনের নানা দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে।আত্মমগ্ন অনুভবের গরিমায় তাঁর মেধা ও মনন দিয়ে দিয়ে তিনি কবিতা ইতিহাস এবং মানবতার সমন্বয় ঘটিয়েছেন। ( চলবে)


পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments