জ্বলদর্চি

স্বপ্নময় চক্রবর্তী /বিশ্বজিৎ পাণ্ডা

বাংলা গল্পের পালাবদল— ১০  

স্বপ্নময় চক্রবর্তী 

বিশ্বজিৎ পাণ্ডা



স্বপ্নময় চক্রবর্তী (জন্ম-১৯৫১) তিনশোরও বেশি গল্প লিখেছেন। শুধু সংখ্যার দিক থেকে নয়, তাঁর গল্পের বিষয়ের পরিধি বিস্তীর্ণ। সেই সত্তরের বছরগুলি থেকে ছোটোগল্প নিয়ে বিস্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন তিনি। বারবার পাল্টেছেন গল্পের বিষয়। শুধু বিষয় নিয়ে নয়, গল্পের আঙ্গিক নিয়ে, ভাষা নিয়েও পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন। উইট স্যাটায়ার যেমন এসেছে তাঁর গল্পে, তেমনি এসেছে বিশুদ্ধ হিউমারও। কর্মসূত্রে ঘুরেছেন নানান জায়গায়। বাংলার বাইরের বিভিন্ন প্রদেশে। সেখানকার মানুষজনের সঙ্গে মেলামেশা করেছেন। তাঁদের ভাষা-কৃষ্টি-সংস্কৃতি সবই বিভিন্নভাবে উঠে এসেছে তাঁর গল্পে। গ্রামীণ জীবন নিয়ে তিনি যেমন গল্প লিখেছেন, তেমনি শহর জীবনও ব্রাত্য হয়নি তাঁর লেখায়। সব মিলিয়ে স্বপ্নময়ের গল্পের জগৎ ব্যাপ্ত এবং বিচিত্র। সমানভাবে তাঁর গল্প যথেষ্ট জনপ্রিয়ও। 

একটু লক্ষ করলে দ্যাখা যাবে গ্রামীণ দরিদ্র মানুষদের জীবন-কেন্দ্রিক গল্প বাংলায় যত লেখা হয়েছে, তার তুলনায় সমসময়ে শহরের দরিদ্র মানুষদের নিয়ে অপেক্ষাকৃত কম গল্প লেখা হয়েছে। এদিক থেকে স্বপ্নময় চক্রবর্তীর গল্পের পৃথক গুরুত্ব রয়েছে বইকি। তাঁর প্রচুর গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র শহুরে মাথা হেঁট করে চলা নিম্নবর্গের মানুষজন। 

কলকাতার নিচুতলার একেবারে হত দরিদ্র হা-ঘরে অন্ধকার জীবনের গল্প ‘রক্ত’ (‘অগ্রণী’, ১৯৮৬)। ঝাঁ চকচকে শহর কলকাতার অন্য একটি মুখ ধরা পড়েছে এই গল্পে। জমজমাট শহুরে পটভূমিতে ধরা একটি অশ্রুঘন জীবন। বেঁচে থাকার তাগিদে রক্ত বিক্রি করতে হয়, এমনই দুই নারী-পুরুষের গল্প। পাঁচু আর জবা। তাদের জীবন-যন্ত্রণা ভাব-ভালোবাসার গল্প।

“—নাম ?
—লেখেন— অমিতাভ বচ্চন। 
—বয়স ?
—লেখেন না যা খুশি। 
—জন্ডিস-ফন্ডিস, ভিডি-ফিডি আছে ?
এবার একটা স্লিপ পেল লোকটা। যিনি স্লিপটা লিখে দিলেন, তিনি আস্তে আস্তে বললেন— বচ্চনের যায়গায় বাগ্‌চী করে দিয়েছি। মিনিট দশেক আগেই অন্য একটা অমিতাভ বচ্চন এয়েছেল। লোকটা লুঙ্গিটা একটু ঢিলে করে শুয়ে পড়ল। ছাত থেকে নেমে আসা লম্বা ডাঁটির ফ্যানের ডগায় কিচির-কিচির ওষুধের গন্ধ, হাতের মধ্যে সূঁচ ঢুকে গেল। লাইলন শাড়ি আর পাইলট পেন, উত্তমের পকেটে সুচিত্রা সেন, এই বাক্য দুটো জপ করতে থাকে, আটবারের মাথায় চোখ খোলে, ঘাড় কাত করে দেখে নেয় আজকের মেনু, ...দুধ, কলা, পাঁউরুটি, আর লাড্ডু। ‘ধুস্‌ আজও ডিম নেই’! মোট বারোবার জপ করতেই ওর শরীর থেকে ২৫০ সি সি বস্তু টানা হয়ে যায়, এবং দুধের গ্লাসটি ধরে।
পাঁচু বাইরে বেরিয়েই দেখল জবা ঢুকছে। পাঁচু দাঁত বার করে হাসল। জবা বলল— ক্যালাসনি। পাঁচু বলল— কলা খাবা ? জবা বলল— তুই খা। পাঁচু বলল— কী নাম রাখিচো আজ। জবা বলল— তুই বলে দেনা। পাঁচু বলল— হেমামালিনী। জবা বলল— মরণ দশা।”      

জবার সঙ্গে তার পরিচয় এই রক্ত বিক্রির সূত্রে। ধীরে ধীরে ঘন হয় পরিচয়। বিধবা জবা দুই ছেলে নিয়ে মুচিপাড়ায় দাদার সংসারে থাকে। 

সিঁড়িতে বসে পাঁচু অপেক্ষায় থাকে জবার। বিড়ি ধরিয়ে দ্যাখে চলমান রক্তের ট্যাঙ্কি। ফর্সা বউ, বডিটা থালুস থালুস করছে। “ডেরহাজার ট্যাকার রক্ত আছে লিচ্চয়, জবার বডিতে কত রক্ত আছে ?” জবা বেরিয়ে এলে পাঁচু তার নিজের খাবারটা ভালোবেসে দিতে চায় জবাকে। জবা নেয় না। তারপর সে জবার কাছে আবদার করে একদিন ঢেঁকি শাক ভাজা খাওয়ার। কতদিন সে গেরস্থবাড়ির খাবার খায়নি। জবা আজই তাকে খাওয়াবে বলে খাবার আনতে যায়। আর অপেক্ষা করতে করতে গান ধরে পাঁচু— “আপনা দিল/পন্দে মারো ঢিল/পন্দে হোলো ঘা/ডাক্তার বাড়ি যা/ডাক্তার বাড়ি যাব/পয়সা কোথায় পাব/বেলাড বেংকে যাব/তবে যেতে পারব।” জবা খাবার নিয়ে আসে। ভাত, শাক ভাজা, আলু সেদ্ধ, তেলাপিয়া মাছের ঝাল। ঘরে নিয়ে গিয়ে আরাম করে খায় পাঁচু। 

এরপর ও-নেগেটিভ রক্তের পাঁচু অন্যত্র বেশি দামে রক্ত বিক্রির সন্ধান পায়। রক্তের এই মহাজনরা রক্ত মজুতে বিশ্বাস করে না। একেবারে টাটকা বিক্রি করে, তাই দাম বেশি। এখন জবার সঙ্গে দ্যাখা সাক্ষাৎ কম হয় তার। মাস তিনেক পর একদিন সে খবর পায় জবা হাসপাতালে। রক্ত দরকার জবার। অনেক রক্ত। সেদিন পাঁচুর শরীরটাও খারাপ। তবু ছুটে যায় সে হাসপাতালে। কিন্তু ডাক্তার জানায় তার রক্ত নেওয়া যাবে না জন্ডিস হয়েছে। সে তার ট্যাংকিতে বয়ে বেড়াচ্ছে পচা রক্ত। ওয়ার্ডে ঢুকে জবার কাছে এগিয়ে যায় সে— “তুই অ্যাতো রক্ত দিলি, তুই এক ফোঁটা রক্ত পেলি না”।

জবা তাকায়। ওর চোখের কোণায় একফোঁটা জল এসে জমে। মুখটা তবু হাসি হাসি হয়। পাঁচুর হাতটা আস্তে আস্তে জবার হাতের মুঠোর মধ্যে চলে যায়। জবার ঠোঁটটা নড়ে ওঠে। পাঁচু যেন বোঝে— আমাকে বাঁচা। সে বলে— “তোর শরীলের রক্ত মহাজনরে দেছিস্‌। আর আমার রক্ত পচা...”

এরপর জবা তার শরীরের সব শক্তি দিয়ে চেপে ধরে পাঁচুর হাত। বাঁচা আমাকে বাঁচা। কান্না বের হয়ে আসে তার পচা শরীরটা থেকে। পাঁচু চোখ বুজে থাকে। দাঁতে দাঁত চেপে থাকে। চোয়াল কঠিন হয়— লাইলন শাড়ি আর পাইলট পেন—। 

প্রেমের গল্প। এক অসহায় মর্মন্তুদ প্রেমের গল্প। দুটি নারী-পুরুষের প্রেমকে নষ্ট করেছে দারিদ্র্য। জবা বাঁচতে চেয়েছিল। তাদের প্রেমকে বাঁচাতে চেয়েছিল। শুধু অর্থের অভাবে শেষ হয়ে গেল দুটো মানুষ! শেষ হয়ে গেল একটি চমৎকার গভীর প্রেমের সম্পর্ক। এ তো শুধু জবা আর পাঁচুর গল্প নয়। এরকম কত কত জবা-পাঁচু ঝাঁ চকচকে কল্লোলিনী তিলোত্তমার অন্ধকার গহ্বরে গুমরে মরছে ; প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে। 

কিন্তু শেষ পর্যন্ত এ আর শুধু প্রেমের গল্পে আটকে থাকে না। স্বপ্নময়ের মনে রাখবার মতো প্রচুর গল্পের মধ্যে এটি একটি। লক্ষ করবার মতো গল্পের আঙ্গিকটি। একটা বড়ো জায়গা জুড়ে আছে সংলাপ। সংলাপ থেকে চরিত্রদের ভিতরের স্বরূপটাও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। জবা পাঁচুকে আমরা ভুলতে পারি না তাদের এই সংলাপের জন্যই। শুধু এই গল্পটি নয়, স্বপ্নময়ের গল্পের একটি বৈশিষ্ট্য এই সংলাপ-নির্ভরতা। শুধু সংলাপ নির্ভর বললে ঠিক হবে না। গল্পের বিষয় অনুযায়ী সংলাপেরও ভিন্নতা চোখে পড়ে। আঞ্চলিক ডায়ালেক্ট সংলাপে তো থাকেই, কাহিনি বর্ণনায়ও চলে আসে সাবলীলভাবে। আর এই ডায়ালেক্ট তাঁর গল্পগুলিতে পৃথক মাত্রা যোগ করে। যেমন এই গল্পে এসেছে শহর কলকাতার প্রান্তিক মানুষের সংলাপ। 

কোনও কোনও গল্পে এসেছে গ্রামীণ মানুষের ডায়ালেক্ট। যেমন ‘শনি’ গল্পে। বাংলার গ্রামীণ এলাকায় বহুদিন ধরে হিন্দু মুসলমান পাশাপাশি বসবাস করছে। এর ফলে দুই সম্প্রদায়ের মানুষের ধর্মবিশ্বাসের মধ্যেও মিল দ্যাখা যায়। ধর্মীয় নিয়ম নীতিকে বহু ক্ষেত্রে আলাদা করা সম্ভব হয় না। হিন্দুরা পীরের দরগায় সিন্নি চড়ায়। আবার মুসলিমরাও শনি ঠাকুরের বাক্সে পয়সা ফ্যালে। ‘শনি’ (‘অনুষ্টুপ’, ১৯৮৭) গল্পে উঠে এসেছে এরকমই কিছু বিষয়। ‘রক্ত’ গল্পের কেন্দ্রে ছিল শহরের নিম্নবর্গের মানুষ। আর এই গল্পে গ্রামের দরিদ্র জীবন।  

সীমান্ত অঞ্চলের একটি গ্রাম এই গল্পের পটভূমি। ওপারে বাংলাদেশ। এপারে ভারতবর্ষ। মাঝে ইছামতী। গল্পের তাজুদ্দিনের স্ত্রীর অনেকদিন পর্যন্ত কোনও সন্তান পয়দা হয়নি। তার দুহাতে নানা রকমের তাবিজ। তাজুদ্দিন বহু জায়গা থেকে এনেছে এই দোয়া-তাবিজ। বনগাঁ বাজারে একবার সে হাতও দেখিয়েছে জ্যোতিষীর কাছে। সেই জ্যোতিষী মাদুলির পাশাপাশি শনি ঠাকুরের পুজো করতেও বলেছেন। যেখানে শনি ঠাকুরের পুজো হয় সেখানে প্রতি সপ্তাহে পাঁচ সিকে করে পয়সা দিতে বলেছেন। কিছুদিন পরে তার বউয়ের পেটে সন্তান আসে। সেই থেকে তাজু শনি ঠাকুরের ভক্ত। 

পঞ্চায়েত মেম্বার বিপ্রদাসবাবুর বাড়ির শনি পুজোয় যায় সে। ঠাকুরের কাছে সিজদা করে। প্রাণ ভরে সিন্নি খায়। বাংলাদেশ থেকে আসা সস্তার গুঁড়ো দুধের সুস্বাদু সিন্নি। শনির পাঁচালিও কিনেছে সে দুটাকা দিয়ে। তার বউ হাসুনারা সেই বইটাকে কুলুঙ্গিতে রাখে মছলা-মাছায়েলের সঙ্গে। আবার ফরজ ওয়াজির ছোন্নত পালন করে যতটা সম্ভব। তার নিজের একটা দোকান আছে। বেশি লাভের জন্য এক বস্তা বাংলাদেশি দুধ কিনে ছোটো ছোটো প্যাকেট করে বিক্রি করে। বউকেও দুধ খাওয়ায় খুব।

ইছামতীর ওপার থেকে এখানে পীর মৌলানাও আসেন মাঝে মাঝে। হাজি সাহেবের কথা শুনতে যায় তাজু। তিনি কথা প্রসঙ্গে বলেন গুঁড়ো দুধের অপকারিতার কথা। গর্ভবতী মেয়েরা খেলে তার সন্তান বিকলাঙ্গ হবে। তাজু সেদিন বাড়ি ফিরে বউকে দুধ খেতে বারণ করে। নিজের দোকানের দুধও বিক্রি করে না আর। একটা খবরের কাগজে খবর বেরোল এই দুধ নিয়ে। তাতে বলা হয় রাশিয়ার সীমান্তে অবস্থিত চেরনোবিল পারমাণবিক কেন্দ্রে বিস্ফোরণ হয়েছিল। তার তেজস্ক্রিয় ছাই পড়েছিল পোল্যান্ডের চারণভূমির উপর। ঐ অঞ্চলের ঘাস খাওয়া পশুদুগ্ধেও সেই তেজক্রিয়তা আছে। তার থেকে নাকি তৈরি হয়েছে গুঁড়ো দুধ।   

পরদিন বিপ্রদাস বাবুর মেয়ে একটি সন্তান প্রসব করে। মৃত এবং বিকলাঙ্গ। তাজু ভয় পেয়ে গেল। বউয়ের পেটে মাথা রেখে ধুকপুকি শুনতে চাইল। বিজ্ঞানের শিক্ষক সামসুদ্দিনের কাছে জানতে চাইল চেরনোবিলের খবর। পীরসাহেবের কাছ থেকে তাবিজ এনে বয়ান পড়তে পড়তে ঝুলিয়ে দিল বউয়ের কোমরে। আর হাসুনারা হাত জোড় করে বলল— “দোহায় সাতঙা-দেও কিরপা কর— দোহায় জোহল সেতারা কিরপা কর, কিরপা করগো। শনিঠাকুর হে, শকুনচড়া নীল বন্নের ফেরেশ্‌তা, কিরপা কর। রাশিয়া দেশ, বিলাত দেশ, কিরপা কর, কিরপা কর সাতঙা-দেও, কিরপা কর চেন্নোবিল।” 

কাকে বিশ্বাস করবে বুঝতে পারে না তাজু। হাসুনারার দিকে এগিয়ে যায়। পেটের উপর কান রেখে ধুকপুকি শোনে— “সমস্ত চেন্নোবিল, সমস্ত শনি সাতঙা-দেওদের কেরদানিকে নাথি মারতি মারতি, নাথি মারতি আয়রে আমার আহ্লাদ। তুই কেমন জানি না।”

হিন্দুর শনিঠাকুর আর মুসলমানের ফেরেশ্‌তা একাকার হয়ে গেছে এই মুসলিম দম্পতির কাছে। শেষ পর্যন্ত আর কোনও দেবতা বা ফেরেশ্‌তা নয়, নিজের অনাগত সন্তানের উপরই বিশ্বাস নিয়ে তারা অপেক্ষা করে ভবিষ্যতের। সন্তানের জন্যই পীরের কাছে এবং শনির কাছে দরবার করেছিল, মানত করেছিল। বিশ্বাস রেখেছিল তাঁদের উপর। আর শেষ পর্যন্ত সেই বিশ্বাসে ভরসা রাখতে পারে না। সব বিশ্বাস নিয়ে আগলে রাখতে চায় সন্তানকে। দেবতার থেকেও বড়ো হয়ে ওঠে অনাগত ভবিষ্যৎ। বহু সাধনার ধন। সন্তান। তাদের বাৎসল্যের কাছে ম্লান হয়ে যায় ধর্মবিশ্বাস।  

এই একটি গল্প নয়। মুসলিম জীবন-নির্ভর বহু গল্প লিখেছেন তিনি। তাঁর লেখা বাংলার মুসলিম মানস-নির্ভর গল্পগুলির মধ্যে অন্যতম ‘ইউসুফের মা’, ‘বেশরম’, ‘ফুল ছোঁয়ানো’, ‘ভগবানের চেয়ার’, ‘ভূতগ্রস্ত’ ইত্যাদি। বিদেশের পটভূমিতে বহু গল্প লিখেছেন তিনি। যেমন ‘ঝড়ের পাতা’, ‘নিখোঁজ বৃত্তান্ত’ ইত্যাদি। এই দুটি গল্পও মুসলিম জীবন-কেন্দ্রিক। এই গল্পগুলিতে মুসলিম সমাজের এমন কিছু দিক আলোকিত হয়েছে যেগুলি আম-আদমির বাঙালি মুসলমান বিষয়ক ধারণাটাই বদলে দেয়। 

উল্লেখ করা দরকার ‘বেশরম’ এবং ‘ঝড়ের পাতা’ গল্পদুটির কেন্দ্রে রয়েছে যৌনতা। তাঁর গল্পের যৌন প্রসঙ্গেরও কত বৈচিত্র্য। গল্প অনুযায়ী যৌনতার স্বরূপও বদলে বদলে যায়। ‘ব্লু সিডি নিয়ে একটি গল্প’-এ যৌনতার অন্য এক রূপ। এই গল্পটিও বিদেশের পটভূমিতে লেখা। স্বপ্নময় চক্রবর্তীর বহু গল্পের কেন্দ্রে আছে তৃতীয়লিঙ্গের মানুষ। যেমন, ‘সিলি সিলিকন’। প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে ‘হলদে গোলাপ’ উপন্যাসটির কথা। রূপান্তরকামীদের নিয়ে রচিত এই আখ্যানে যৌনতার নানান দিক উন্মোচিত হয়েছে।  

প্রযুক্তিবিজ্ঞানের উন্নতির উপর নির্ভর করে আমাদের জীবন যাপনের উন্নতি। সামগ্রিকভাবে সভ্যতার উন্নতিও। সেই উন্নতি আমাদের মধ্যবিত্তের প্রাত্যহিকতার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে। উন্নতির আগ্রাসনের অসহায় শিকার আমরা। সেই অসহায়তা তাঁর গল্পে বারবার ঘুরেফিরে আসে। গোলকায়নের নামে ভোগসর্বস্বতার আক্রমণ ও পণ্যসংস্কৃতি গ্রামীণ সমাজ-অর্থনীতিতে কীভাবে প্রভাব ফেলেছে স্বপ্নময় চক্রবর্তী তাঁর একটি গল্পে দেখিয়েছেন সুন্দরভাবে। ‘অমৃতলোক’ (১৪০৩) পত্রিকায় প্রকাশিত গল্পটির নাম ‘পেপসি আনে গাঁয়ের আলো’। গ্রামের গরিব-গুর্বো মানুষরাও পিছিয়ে নেই আর। প্রতিটি নামী কোম্পানির ব্রাণ্ডের ডুপ্লিকেট পাওয়া যায় সেখানে। আর্থিক কারণে এই সব ‘কমা মাল’-এর ডিম্যান্ড বেশি গ্রামে। “এসব জায়গায় নকল বোরোলীন, সানলাইট, লাকস্‌, রকমারী পাউডার, এসব পাওয়া যায়। ... বোরোলীনের কমা মালের নাম বোরোনীল, ল্যাকমের নাম লাইক মি...এরকম। এছাড়া হুবহু লাক্‌স আছে, রেক্সোনা-লাইফবয়-সানলাইট আছে। প্যাকেটটা সেম সেম। এসব মালে সেন্ট খুব জব্বর হয়।” 

ইলেকট্রিক লাইনের সঙ্গে সঙ্গে গ্রামে টিভিও এসে গেছে। গ্রামের মনসা মন্দিরের চাতালে সন্ধেবেলা টিভি দ্যাখে সবাই। আগে সেখানেই সাক্ষরতার পাঠ নিত তারা। চর্চা না থাকলেও সাক্ষরতার স্লোগান শোনা যায় আজও—“বাঁকড়া জেলা দিল ডাক, নিরক্ষরতা নিপাত যাক— বলে এখন জলে ঝাঁপ দেয় ছেলেরা কিংবা শিরতোলা চালতাপাতা কিংবা আস্ত কোনো পেঁপে পাতার ডাটিটা নিশানের মতো উচিয়ে হাঁকে— সাক্ষরতার পেপসি ভালো/পেপসি আনে গাঁয়ের আলো। আসলে এটা ছিল সাক্ষরতার পিপাসা ভালো/পিপাসা আনে জ্ঞানের আলো।”

গ্রামের অনেকেই এখন হাতে টাকাপয়সা এলে নিজেকে ভদ্রলোক করবার দ্রুত চেষ্টা করে। যেমন এ গল্পের খ্যাংরা। জঙ্গলছাপ জামা আর ফুল প্যান্ট পরে, যেগুলি গ্যাট চুক্তির বিরুদ্ধে মিছিল করতে কলকাতায় গিয়ে কেনা। সে হিটার কিনে যায় বাড়িতে। অথচ তার মা এই আধুনিক ‘উনুন’কেও গোবর-ন্যাকড়া দিয়ে মুছতেন। কারণ, ‘রান্না হল শকড়ি’। আর এর ফলেই ইলেকট্রিক শক লেগে মৃত্যু হল তার। বাউরি খ্যাংরার মায়ের শ্রাদ্ধ বাউরি বামুনকে দিয়ে না করিয়ে সে করায় বর্ণ-হিন্দুর ব্রাহ্মণ ভানুবাবুকে দিয়ে। এভাবেই ভদ্রলোক হয়ে উঠতে চায় গ্রামের বাগ্‌দি-বাউরি অপেক্ষাকৃত নিচু জাতের মানুষজন। “আমাদের ঘরে কাজকর্ম্মে চক্রবর্তী বামুন ডাকি— এই কথাটার মধ্যে কোথায় যেন অহংকার আছে।” স্বপ্নময় এ গল্পে বিশ্বায়ন-পণ্যসংস্কৃতির ফলে গ্রামের যে উন্নতির ছবি পাঠকের সামনে তুলে ধরলেন তার মধ্যে এক ধরনের বিকৃতি আছে। 

স্বপ্নময় বিশ্বাস করেন— “যে প্রক্রিয়া মানুষকে ভূমিদাস করে, সেই প্রক্রিয়ারই প্রলম্বিত ছক মানুষকে যন্ত্রদাস বানায়।” এই অনুভব থেকে উঠে এসেছে তাঁর বেশ কিছু গল্প। ‘অ্যালুমিনিয়ামের ডানা’ —এই ধারারই একটি উল্লেখযোগ্য গল্প। গ্রামের মানুষ গুয়ে, ভালো নাম তারাদাস এক বুড়ো সাহেবের কাছ থেকে দুটো পাখা পেয়েছে। সেই পাখার সাহায্যে সে ইচ্ছে মতো উড়তে পারে। এত ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও সে নারানবাবুর হয়ে গেল। নারানবাবু তাকে কোয়ার্টার দেন, পোশাক দেন। নানান রকম কাজ করান তাকে দিয়ে। তার হাতে থাকে একটা মাইক কল। কানে হেড ফোন। দূরে উড়ে গেলেও ছাদ থেকে নারানবাবু যা হুকুম করেন তা সে শুনতে পায়। তাঁর হুকুমে নদী পেরিয়ে ওপারে আতা বনে পোড়োবাদির ভিতর থেকে পদ্মফুল আঁকা বাক্স আনতে যায় গুয়ে। চারটে বাক্স কোনোটাতেই পদ্মফুল ছাপ নেই দেখে সবকটা নিয়েই উড়তে থাকে। তারপর—

“আমি আস্তে আস্তে নদীর দিকে নেবে যাচ্ছি। মনে হল এত বোঝা নিতে পারছি না। একটু হাল্কা হতে হবে। মাইক কলে বলি টি-ডি কলিং, নদীতে নেবে যাচ্ছি, আমাকে একটু হাল্কা হতে হবে। একটা বাক্স ফেলে দি ? ওরা বলে উঠল রাসকেল। ঐ একটা বাক্‌সেই আসল জিনিসটা থাকতে পারে। তুই বরং পোশাক খুলে ফ্যাল। তাই করলাম। ইউনিফর্ম খসিয়ে দিলাম নদীর জলে। এতে কিছু লাভ হল না। আবার বল্লাম— টি-ডি কলিং পড়ে যাচ্ছি হাল্কা হতে হবে।...ওরা বোলো, গান্ডু, দাঁত নেই বানচোত, শিরা ছিঁড়ে রক্ত ফেলে দে শরীরের। তখন মনে হল আমি শালা মানুষ, কোলবালিশ না। কোলবালিশটার নিজের ইচ্ছা ছিল না। খালি সুইচ মারা কথা শুনতো। আমি তো মানুষ। আমাকে একটা সিদ্ধান্ত নীতি হবে।”  

তখন চারটি বাক্সই নদীতে ফেলে দেয় সে। হেডফোনও ফেলে দেয়। উড়তে উড়তে সে আসে লেখকের ছাদে। একটু আগে জল চাইলে বোতল নিয়ে সিন্‌ট্যাক্সের ট্যাঙ্কের দিকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন যে লেখক, সেই লেখকই তার জন্য কোল্ড-ড্রিংক্স আনতে চান। কারণ তিনি টি-ডি-কে দিয়ে ক্যুরিয়ারের ব্যবসা করাবেন। সে নারানের কব্জা থেকে বেরিয়ে আবার ঢুকে পড়ে লেখকের কব্জায়। কিন্তু সে চায় গুয়ে হতে মানুষ হতে। তাই গল্পের শেষে একটা লোহার রোড দিয়ে সে তার ডানাটা ফুটো করে ফ্যালে। তারপর হাত ঘুরিয়ে ছিঁড়ে ফ্যালে তার ডানা।

এ গল্পে কল্পবিজ্ঞানের একটা ছায়া আছে। কিন্তু এই ফ্যান্টাসির মূল অনেক গভীরে। অন্তর্লোকের জটিলতা উন্মোচিত হয়েছে। লেখকের তীব্র সমাজ সচেতনতা, সময় সচেতনতা থেকে উঠে এসেছে এই গল্প। স্বপ্নময়ের অধিকাংশ গল্পের মধ্যেই আছে এই সময় সচেতনতা। তাঁর অসাধারণ গদ্যে হাস্যরসের আপাত মোড়কের ভিতর জেগে থাকে এক ধরনের বেদনার সুর। সেই সুর পাঠকের হৃদয়ে ঢুকে যায় নিঃশব্দে। পাঠকেও হাসায় কাঁদায় কাঁপায় আন্দোলিত করে।  

সরস গল্পের ধারায় অন্যতম শ্রেষ্ঠ একজন লেখক স্বপ্নময় চক্রবর্তী। তিনি হাসি দিয়ে শুরু করেন যে গল্প, তা শেষ হয় বেদনায়। হয়তো বা সমাপ্তিতে চোখের কোণদুটো চিকচিক করে ওঠে। হাসি কান্নার মিলিত রূপেই দাঁড়িয়ে থাকে তাঁর গল্প। কখনও কখনও ফ্যান্টাসির জগতে চলে যান। কিন্তু সেই ফ্যান্টাসির মূল অনেক গভীরে। পাঠকের অস্তিত্বকে নাড়িয়ে দেয় তাঁর গল্পের হাস্যরস, তাঁর গল্পের স্যাটায়ার। তাঁর ব্যঙ্গ বিদ্রূপের লক্ষ্য প্রধানত পণ্য সংস্কৃতি ও যন্ত্র সভ্যতা। গল্পের নামকরণের মধ্যেও বিদ্রূপ ও কৌতুক প্রকাশিত হয়েছে। যেমন— ‘অষ্টচরণ ষোলো হাঁটু’, ‘ভিডিও ভগবান নকুলদানা’, ‘জার্সি গরুর উল্টো বাচ্চা’, ‘সতর্কতামূলক রূপকথা’, ‘সর্ষে ছোলা ময়দা আটা’, ‘ভালো করে পড়গা ইস্কুলে’, ‘ঝড়ে কাক মরে’, ‘হাতি ও পিঁপড়ের গল্প’ ইত্যাদি।  
 
স্বপ্নময় চক্রবর্তীর গল্প শেষ পর্যন্ত বিষয় নির্ভর। আঙ্গিক নিয়ে নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে কখনওই ম্লান হয়ে যায়নি গল্পের বিষয়। তিনি বিশ্বাস করেন বক্তব্যে। আর সেই বক্তব্য তিনি তুলে ধরেন স্বচ্ছন্দ নির্ভার এক আশ্চর্য মায়াবী ভাষায়। সেই ভাষার মধ্যে মিশে থাকে ছড়া গান পাঁচালি কবিতার পঙ্‌ক্তি। ভাষাভঙ্গি এবং পরিবেশ রচনা তাঁর গল্পগুলিকে স্বতন্ত্র করে তোলে। গল্পে যে হাস্যরসের সন্ধান পাই তাও মূলত পরিবেশ রচনার ইন্দ্রজাল। সেই পরিবেশকে কৃত্রিম বলা যায় না। তাঁর গল্পের বিষয়ের মতো সংলাপ, পটভূমি পরিবেশও জীবন-সংলগ্ন। ‘শ্রেষ্ঠ গল্পে’-র ভূমিকায় লেখক বলেছেন— “ভালবাসি বলেই জীবনকে বকাঝকা করি। অনুরাগ থাকে বলেই অভিমানও থাকে।” জীবনের প্রতি এই রাগ-অনুরাগ মান-অভিমান থেকে উঠে আসে স্বপ্নময় চক্রবর্তীর গল্প।


পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

7 Comments

  1. স্বপ্নময় চক্রবর্তী আমার ভীষণ প্রিয় লেখক। এই আলোচনাও দুর্দান্ত হয়েছে।

    ReplyDelete
  2. খুব ভালো লাগলো এই আলোচনা

    ReplyDelete
  3. ভীষণ প্রিয় লেখক বিষয় বৈচিত্র, লেখনী, স্বাভাবিক রসবোধ, জীবন থেকে নেওয়া রসদ সব নিয়ে জমাট প্যাকেজ।

    ReplyDelete
  4. স্বপ্নময় চক্রবর্তী আমার অত্যন্ত প্রিয়। আলোচনাটি পড়ে সমৃদ
    ধ হলাম।

    ReplyDelete
  5. বিশ্বজিৎ, খুব ভালো। স্বপ্নময় আমার প্রিয় মানুষ, আর অতি প্রিয় গল্পলেখক।

    ReplyDelete
  6. খুব ভালো আলোচনা। যাঁদের লেখা পড়ে পড়ে লেখার আগ্রহ বেড়েছে, সেই প্রিয় লেখকদের একজন স্বপ্নময়দা, স্বপ্নময় চক্রবর্তী।

    ReplyDelete
  7. A great writer of our time.

    ReplyDelete