জ্বলদর্চি

ধা রে মশা ধা /ভাস্করব্রত পতি

পশ্চিমবঙ্গের লৌকিক উৎসব, পর্ব -- ৪৩

ধা রে মশা ধা

ভাস্করব্রত পতি 

অদ্ভুত এক লৌকিক উৎসব এই 'ধা রে মশা ধা'। দেওয়ালী এলেই কচিকাঁচারা দিন গুনতে থাকে এই উৎসবে অংশ নিতে। 'চাঁদ বাঁধুনি' বা 'চাঁদবাদানি' বা 'শুক বাঁধুনি' নামেও পরিচিত এই 'ধা রে মশা ধা'। ভাতৃদ্বিতীয়ার ভোরে আলো ফোটার আগেই এই লোকাচার পালিত হয়। ঐ দিন ভোরে আকাশের শুকতারাকে প্রনাম করে বাড়ির মহিলারা শুরু করেন 'শুক বাঁধুনি'। তুলসী মঞ্চের সামনে গোবর দিয়ে দুটো মণ্ড তৈরি করে বসানো হয়। এগুলিকে বলা হয় শুক এবং সারি। নিকোনো তুলসী মঞ্চের সামনে এই শুক সারির সাথে দেওয়া হয় দুটি কাঁচা সুপারী, দুটি কাঁঠিলা কলা এবং আখ। শালুক ফুলের মালা এই পূজোর অন্যতম উপকরণ। নিম্ফিয়েসি (NYPHYECEAE) গোত্রভূক্ত ওয়াটার লিলি তথা শালুকের বিজ্ঞানসম্মত নাম NYPHEA LOTUS। যা গ্রামে গঞ্জে প্রচুর পরিমাণে দেখা যায়। শালুকের মালা ছাড়াও ফুল, চন্দন, ধান, দুর্বা, কাঁচা সুপুরি, কাঁচা ও শুকনো হলুদ বাটা, নারকেল তেল, সরিষার তেল, যেকোনও একটি গহনা উপকরণ রাখতে হয়। এবার পূজো করা হয় শুক সারিকে। ভোররাতে এই পুজোর সময় আতসবাজি ফাটার শব্দ শোনা যায়। এটাই 'শুক বাঁধুনি'। 

কোথাও কোথাও নিয়মের ফারাক লক্ষ্য করা যায়। এক্ষেত্রে প্রথমে তুলসী মঞ্চের কাছে পিটালী বাটা দিয়ে ২১ টি বর্গাকার ঘর তৈরি করা হয়। এরপর রান্নাঘরে ব্যবহৃত মশলাপাতি, তেল, ডাল, চাল, কলা, গোটা কাঁচা সুপারি, আখ দিয়ে সব ঘরগুলি পূরণ করা হয়। এবার বরণডালা সাজিয়ে শুকতারার ২১ টি ঘরকে বরণ করা হয়। শুকতারাকে 'শুক্রদেবতা' হিসেবে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন মহিলারা। 

দেবতাকে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর বরণডালা নিয়ে যাওয়া হয় গোয়ালঘরে। খামার থেকে গোয়ালঘর পর্যন্ত আল্পনাতে আঁকা হয় গরুর পায়ের ছাপ। গরুর মাথায় পরানো হয় নতুন ধানের শিষ দিয়ে তৈরি বিশেষ টোপর। আগের দিন স্নান করিয়ে রাখা গরুর কপালে তেল, সিঁদুর, হলুদ মাখানো হয়। মাদি গরুর কপালে সিঁদুর এবং এঁড়ে গরুর কপালে হলুদ দেওয়া হয়। একটা সিংয়ে কাঁচা হলুদ বাটা, অন্য সিংয়ে শুকনো হলুদ বাটা মাখানো হয়। গলায় পরানো হয় শালুক ফুলের মালা। চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়ে দেওয়া হয়। এরপর গরুর সামনে আয়না ধরা হয়। গরুকে খেতে দেওয়া হয় রুটি এবং এস্কা বা গদা পিঠা। গরুকে খাওয়ানোর সময় বলা হয় -- "গোকল গোকুলে বাস / গোরুর মুখে দিয়ে ঘাস / আমার যেন হয় স্বর্গবাস"। সেইসাথে গরুর পা হলুদ গোলা জলে ধুইয়ে নিজের কাপড় দিয়ে মুছে প্রনাম করেন মহিলারা। আর তালপাতার পাখা দিয়ে বাতাস করতে করতে গরুর কাছে বলেন -- "ভগবতী পুণ্যবতী আমার কথা রাখ / রোগ শোক কীট পতঙ্গ যেন থাকে নাক / তোমাকে ঘুরিয়ে পাখা / আমার হোক সোনার শাঁখা / অগরু চন্দন বিল্বের বা / শীতল করে ভগবতীর গা"। এছাড়াও বলা হয় "রোগ শোক দূর হোক / কীটপতঙ্গ দূর হোক / মশা মাছি দূর হোক / তোমাকে ঘুরিয়ে পাখা / আমার হোক সোনার শাঁখা / তোমাকে বাতাস করি / সতীন মেরে ঘর করি"। আসলে মহিলারা সংসারের মঙ্গলের জন্য মানত করেন গো দেবতার কাছে। তখন শাঁখ বাজে, উলুধ্বনি হয়। তিনবার বরণ করতে হয় গরুকে। এরপর ঐ বরণডালা দিয়ে ছেলে মেয়েদের বরণ করা হয়। 
গরু পূজা হয়ে গেলেও তার আরও নানা আনুসঙ্গিক উপচার থাকে পরবর্তীতে। সকাল হলেই ভাতৃদ্বিতীয়া তথা ভাইষষ্ঠীর ব্রত। রাত থাকতে থাকতেই গরু পূজার পর কাজলপাতি দিয়ে বাড়ির ছোট ছেলেমেয়েদেরকেও কাজল পরানোর রীতি রয়েছে। একসময় মনসাপাতায় প্রদীপের শিষ থেকে কালি তৈরি করে কাজল হিসেবে পরানো হত। সেইসঙ্গে কপালে হলুদ তেল মাখানো হয়। গরু পূজাকে ভালো ভাষায় বলে 'গোধন পূজা'। গো জাতির মঙ্গলার্থে এই পূজা করে থাকেন হিন্দুরা। একে অনেকে 'মাকড়ী পূজা' নামেও অভিহিত করেছেন। পুরুলিয়াতে হয় 'অহীরা' গান বা গো বন্দনা। একে 'গোয়াল জাগানো গান'ও বলে। আদিবাসীরা তাঁদের লৌকিক আচারের মাধ্যমে গরু পূজা করে থাকে, যা পরিচিত ‘বাঁধনা পরব' নামে।
গরু পূজার দিন গো দেবতা তথা গোয়ালের গরুকে কোনও রকম শারীরিক কষ্ট দেওয়া হয়না। গরুর জন্য গোয়ালঘর থেকে মশা তাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। মশার কামড়ে গো দেবতার কষ্ট হতে পারে এই বিশ্বাস থেকে শুরু হয় 'মশক তাড়ানো অভিযান'। কেবল গোয়ালঘর থেকে নয়, এই মশা তাড়ানো হয় পুরো এলাকা থেকে। গরু পূজার আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলে শুরু হয় 'ধা রে মশা ধা' পালন। মেদিনীপুর জেলায় আদিবাসীরা যে ‘বাঁধনা পরব' করে থাকে, তাঁদের সেই অনুষ্ঠানেও 'মাছি খেদা' বা 'মাছি বাইটা গান' পরিলক্ষিত হয়। 'ধা রে মশা ধা'র গানগুলির সাথে এই ‘মাছি খেদা' গানের মিল রয়েছে। কেউ কেউ একে বলেন 'দাদুড় খেদা'। অর্থাৎ অপদেবতাদের বিদায় করা। আর এজন্য বলতে শোনা যায় -- "লক্ষ্মী আইলা গুড়গুড়ায়ে / অলক্ষ্মী গেল ধড়ফড়ায়ে"। মেদিনীপুর জেলায় কুলো, তালপাতার চাঁটাই, টিন বাজিয়ে মশা তাড়ায় ছেলেমেয়েরা। উদ্দেশ্য যে, শীত আগতপ্রায়। এবার মশার দল এলাকা ছেড়ে পালাও। তোমাদের দিন শেষ।

বিচিত্র ধরনের ছড়া আউড়ে বাড়ির ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা রাতের আঁধার থাকতে থাকতেই বেরিয়ে পড়েন কুলো, টিনের বাক্স, ক্যানেস্তারা নিয়ে। আর বাজানোর জন্য থাকে ছোট লাঠি কিংবা আখ। কুলোর পিঠে আখ দিয়ে বারংবার চপেটাঘাত করতে থাকে, আর মুখে আউড়ে চলে — “ধা রে মশা ধা / নল বনকে যা / নলের চোঙা পঁদে দিয়ে / স্বর্গে উঠে যা / স্বর্গ থেকে নেমে এসে / উমুকের পঁদ খুলে খুলে খা”। উচ্চারণের ভেদে ছোট ছেলেমেয়েরা নল বনের বদলে 'লালবন' উচ্চারণ করে থাকে। তবে নলখাগড়া (NOODING REED) তথা PHRAGMITES KARKA (পোয়েসি বা গ্র্যামিনী গোত্রভূক্ত) একটি অতি পরিচিত গাছ। এই ছড়াটির অর্থ হল যা মশা তুই নল বনে পালা। সেখানে নলগাছে চড়ে সরাসরি স্বর্গে চলে যা। অন্যভাবে পাওয়া আরেকটি ছড়া হল -- "ধা রে মশা ধা / নলের বনে যা / নলের বাঁশি বাজাতে বাজাতে / স্বর্গে চলে যা"। কিংবা --  "ধারে মশা ধা / আমাদের বাড়ির যত মশা / অমুকের বাড়ি যা" এবং "ধারে মশা ধা / নলবনকে যা / নলের চোঙায় বসে বসে / স্বর্গে উঠে যা" বেশ জনপ্রিয়। এরকমই অন্য একটি ছড়ার সন্ধান মিলেছে তমলুকের পদুমবসান এলাকায়। তা হল— “ধা রে মশা ধা / খড়ি বনকে যা / খড়ি বনকে গিয়ে তুই / স্বর্গপুরী যা”। তেমনি প্রবন্ধকার ছন্দা ঘোষাল একটি ছড়ার সন্ধান দিয়েছেন— 'যারে মশা যা / নল বনকে যা / নলের চোঙা ফুঁড়ে দিয়ে / স্বর্গে উঠে যা”। এই ছড়াগুলির বিষয় এবং ভাষা প্রায় সমান। পুরুলিয়াতে গাইতে শোনা যায় "ধা মশা ধা / মশা গেল বনকে / লক্ষ্মী আ'ল ঘরকে"। এছাড়া কেউ কেউ বলেন, "ধা মশা ধা / লক্ষ্মী আল ঘরকে / হাভাত রে তুই যা"।

এলাকা ভেদে 'ধা রে মশা ধা' পালিত হয় অন্যভাবে। ছোট ছোট কচিকাঁচারা পাটকাঠি জ্বালিয়ে গ্রামের পাড়ায় পাড়ায় ছোটে। কিছু কিছু ছেলে মেয়েরা সেই আগুন নিয়ে চিৎকার করে বলে, 'ইঁজয় পিঁজয় রে / ব্যানা বুড়ির বাণ কাটই রে'। এরপর এক জায়গায় আগুন জ্বেলে ছেলে মেয়েরা সমবেত ভাবে সেই আগুনের ওপর তিনবার করে লাফ দিতে দিতে বলে --  'দাওদা বুড়হি দাদ লে / খোওসা বুড়হি খোস লে'। এরপর তাঁরা বাড়ি ফিরে যায়। মানুষের বিশ্বাস যে, ঐ আগুনের ওপর দিয়ে লাফ দিলে নানা ধরনের খোস পাঁচড়ার হাত থেকে 'বুড়ি' রক্ষা করবেন। 
বিশিষ্ট লোকসংস্কৃতি গবেষক তরুণ সিংহ মহাপাত্র জানান, পশ্চিম মেদিনীপুরের গোয়ালতোড় থেকে দক্ষিণ বাঁকুড়া পর্যন্ত এলাকায় এই লোকাচারকে বলে 'ইঁজল পিঁজল' বা 'ইঁজয় পিঁজয়'। যা 'ধা রে মশা ধা'র আরেকটি রূপ। এইদিন ভোররাতে ছেলে মেয়েরা অন্যের বাড়ির ফল চুরি করে। একে বলা হয় 'চোখ চাঁদা'। আর মশা তাড়ানোর সময় বলে -- "ইঁজোরে পিঁজোরে / ধোরে মশারে / আমদের পাড়ার মশাগুলান / উঁয়াদে পাড়াক যা রে"।

'ইঁজল পিঁজল' বা 'ইঁঞ্জ পিঁঞ্জ'তে ছেলে মেয়েরা পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে ঘুরে গায় -- "সনকাপাটি রট রট, বাঘা ভয়ে ছট পট / ইঁঞ্জরে পিঁঞ্জরে ইঁঞ্জরে পিঁঞ্জরে / হামদের কুলহির মশা মচ্ছড় / ছাউ কুলহি কে যা / দাউদা বুঢ়হির দাদ লো / খঁইস্যা বুঢ়হির খোঁস লো / রওগ জ্বালা অসুখ বিসুখ / গুটায় লিয়ে যা"। 

ব্রাহ্মণ এবং মাহিষ্য উভয় জাতির মানুষজনের কাছে এই উৎসব চালু আছে। মূলত দীপাবলীর অমাবস্যার পর দ্বিতীয়ার দিন ভোরবেলা এই গরু পূজার আয়োজন করা হয়। হিন্দুদের কাছে গরুকে দেবতার মতো পূজো করা হয়। সর্বোপরি গরু তাঁদের কাছ কোনও সাধারণ প্রাণী নয়। তাই তাঁদের কাছে গোহত্যা ব্রহ্মহত্যার সমান। আর গরু মাংস খাওয়া তো নরকে যাওয়ার নামান্তর। হিন্দুদের কাছে গোহত্যাকারীরা হল 'ম্লেচ্ছ'। এই অবলা জন্তুটিকে বৎসরে একদিন রীতিমতো শ্রদ্ধা সহকারে পুজো করার রীতি চলে আসছে। মূলত ভোররাতেই পূজো করা হয়। 

গরু পূজার জন্য থালায় সাজানো বরণডালাই সকাল বেলায় ভাইফোঁটার সময় ভাইকে বরণ করার কাজে বোনেরা ব্যবহার করে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ভোর রাতে গো পূজার পর শুরু হওয়া মশা তাড়ানোর গান চলে দিনের আলো ফোটা পর্যন্ত। আর তার পরেই বাঙালী মাতে আরেক উৎসব ভাইফোঁটাতে। এই ভাইফোঁটাকে মহারাষ্ট্রতে বলে 'ভাওবিজ', নেপালে বলে 'ভাইতিহার', গুজরাটে বলে 'ভাইয়াদুজ', বিহারে বলে 'ভাইদুজ' এবং দক্ষিণ ভারতে পরিচিত 'যম দ্বিতীয়া' নামে।

 
পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

1 Comments