জ্বলদর্চি

বাঁদনা পরব: গোরু খুঁটান /সূর্যকান্ত মাহাতো

জঙ্গলমহলের জীবন ও প্রকৃতি

পর্ব - ৪৬

বাঁদনা পরব: গোরু খুঁটান

সূর্যকান্ত মাহাতো


"বাঁদনা" পরবে 'গরয়া' পূজা বা 'গোয়াল পূজা' ছাড়াও আরো দুটি অনুষ্ঠান বেশ সাড়ম্বরে পালিত হয়।

বন্ধুর কথা শুনে বললাম, "কী কী ওই দুই অনুষ্ঠান?"

বন্ধু বলল, "একটি হল 'গোরু চুমানো' আর অন্যটি হল, 'চোকপুরা' অনুষ্ঠান। আগেই আমরা 'গোরু চুমানো' নিয়ে আলোচনা করেছি। 'গোরু চুমানো'র এই অনুষ্ঠান এখন আর আগের মতো করে হয় না। আগে 'গোরু চুমানো'-কে ঘিরে বেশ হইচই হত। গোটা গ্রামের নারী পুরুষেরা একত্রিত হয়ে এই অনুষ্ঠান পালন করত।"

আমি বললাম, "একত্রিত মানে! সবাই তো দেখলাম, যার যার বাড়িতে গোরু চুমানোর অনুষ্ঠান পালন করেছে।"

বন্ধু বলল, "হ্যাঁ। এখন এমনটাই হয়। কিন্তু আগে তার  ব্যাপ্তি ছিল আরো বড়। আগে গ্রামের যিনি 'প্রধান' তার বাড়ি থেকেই প্রথম এই অনুষ্ঠান শুরু হত। তারপর সকলে মিলে একে একে অন্যের বাড়িতে গিয়ে এই অনুষ্ঠান পালন করত। গ্রাম প্রধানের বাড়িতে উপস্থিত হয়ে গোরু চুমানোর সময় সকলে গান ধরত। সেরকমই একটি গান হল---

"কনে ত দেয় ত ভালা ঝিলিমিলি শাড়ি গ কনে ত দেয় ত ধেনু গাই
কনে ত দেয় ত ভালা দুই কানের সনা গ কনে দেয় সিঁতাকে সিন্দুর।"


বললাম, "বাহ! আগে তো তাহলে বেশ জমকালো ভাবে  এই অনুষ্ঠান পালিত হত। তবে এই গানটার সুর ও কথা তো অনেকটাই বিয়ের গানের মতো।"

বন্ধু বলল, "ঠিক বলেছিস। আসলে 'গোরু চুমানো' অনুষ্ঠানটা তো অনেকটা 'গো-বিবাহ'-রই অনুষ্ঠান। তাই 'অহীরা'র এই গানগুলোকে এই সময় বিয়ের গানের মতো সুর করেই গাওয়া হয়। অন্য একটা গানে যেভাবে 'বরযাত্রী'র কথাটি এসেছে তাতে আরো বেশি করে প্রমাণিত হয় 'গোরু চুমানো'র গানগুলো এক রকম বিবাহের গানই। সেরকম একটি গান হল---
"ডিগিমিগি ডিগিমিগি বাজ বাজনা রে বেঁঘা রাজা সাজল বৈরাত রে
গাঢ়ার ভিতর মশা যে গুঞ্জরে আমি দাদা যাব রে বৈরাত।"

"এইসব গানে 'বর', 'কনে', 'বরযাত্রী', 'কন্যা দান', 'সিন্দুর দান' প্রভৃতি শব্দগুলো দারুণভাবে উপস্থিত। এতেই তো পরিষ্কার এটা এক রকম বিবাহেরই অনুষ্ঠান।"

আমি বললাম, "আর একটা অনুষ্ঠান 'চোকপুরা' না কি যেন বললি, সেটা কী?"

বন্ধু বলল, "হ্যাঁ। 'চোকপুরা' অনুষ্ঠান হল উৎসব পালনের অলংকরণ। এই উৎসব উপলক্ষে পাড়ার মূল রাস্তা থেকে বাড়ির গোয়ালঘর সহ সমস্ত আঙিনা জুড়ে এক ধরনের আলপনা আঁকা হয়। এটাই হল 'চোকপুরা' অনুষ্ঠান। আতপ চালের গুঁড়িকে 'পানিয়া' ( এক ধরণের লতানো উদ্ভিদ, যার রস অত্যন্ত পিচ্ছিল) লতার পিচ্ছিল রসে ভেজানো জলে গুলে চটচটে করে তোলা হয়। সেই গুঁড়িতে হাতের পাঁচ আঙুল ডুবিয়ে খুব দ্রুত হাত নেড়ে নেড়ে নানা রকমের ক্রসমার্কা চৌকো ঘর ও বিভিন্ন লতাপাতার ছবির আলপনা আঁকা হয়। আলপনার প্রতিটি মিলনস্থলে দেওয়া হয় একটি করে সিঁদুরের টিপ। এই আলপনা জুড়ে কিছুটা দূরে দূরে ছড়িয়ে দেয়া হয় ঘাসের আঁটি। সেই আলপনার উপর দিয়েই গোরু বাছুরগুলোকে হাঁটিয়ে হাঁটিয়ে ঘাস খাইয়ে খাইয়ে গোয়াল ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। এখনকার বিশিষ্ট ও সম্মাননীয় অতিথিবর্গকে যেমন রেড কার্পেটের উপর দিয়ে হাঁটিয়ে আপ্যায়ন করা হয় ঠিক তেমনি। 'চোকপুরা'য় গোরুগুলোকে আলপনার ওপর এভাবেই হাঁটিয়ে সম্মান জ্ঞাপন করা হয়।"

বন্ধু বলল, "এই অনুষ্ঠানের সময়ও গান গাওয়া হয়।"

কন মাল্যানী ভালা গুঁড়ি যে কুটে রে কন মাল্যানে গুঁড়ি ঝাড়ে।
কন মাল্যানী ভালা চোক যে পুরে রে, দাঁয়ে-বাঁয়ে ফেঁকে তরু ডাল।"

বললাম, "পরের দিন তো দ্বিতীয়, তথা ভ্রাতৃ দ্বিতীয়ার দিন।"

বন্ধু বলল, "হ্যাঁ, ওই দিনকে বলা হয় 'বুড়ি বাঁদনা' বা গোরু খুঁটানের দিন। এই দিন দুপুর গড়াতে না গড়াতেই গোরু ও কাড়াগুলো অদ্ভুত সাজে সেজে ওঠে।"

বললাম, "কী রকম?"

বন্ধু বলল, "তেল মেখে ওদের শিংগুলো চকচক করতে থাকে। কপালে থাকে পাকা ধানের 'মোড়' বা মুকুট। গলায় ফুলের মালা। সারা গায়ে ছোপ ছোপ রঙিন অলংকারের দাগ। এদিক ওদিক বাজতে থাকে মাদল ও নাগাড়া। কেউ না কেউ উচ্চকণ্ঠে গেয়ে চলে অহীরার গান। বেশ গমগমে একটা ভাব। এই সার্বিক পরিবেশটাই গোরু কাড়াকে বেশ উত্তেজিত করে তুলে। মাঝে মাঝে সেই উত্তেজনা বাড়াতে কখনো পরিয়ে দেওয়া হয় ঘুঙুরের মালা।"

জিজ্ঞেস করলাম, "গোরু বা কাড়া খুঁটান বলতে ঠিক কি বোঝায়?"

বন্ধু বলল, "এই উৎসবকে ঘিরে একাধিক মত প্রচলিত হয়ে আসছে সেই প্রাচীনকাল থেকেই। তাই উৎসবের প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে 'গোরু খুঁটান' আসলে কী সেটা আগে জানা দরকার। গোরু ও কাড়াগুলোকে একটা শক্ত খুঁটিতে বাঁধা হয়। গলায় পরানো হয় শক্ত দড়ি। সহজে যেন ছিঁড়ে না যায়। এবার গোরু কাড়াকে খেলানোর দল বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র যেমন ঢাক, ঢোল, মাদল, নাগাড়া, করতাল, ঝুনঝুনি প্রভৃতি গুরু গম্ভীর বাদ্যযন্ত্র নিয়ে সেখানে উপস্থিত হয়। প্রথমে এক বা একাধিক জন 'অহীরা' গান ধরে। গানের একদম শেষ মুহূর্তেই বাদ্যযন্ত্র গুলো একসঙ্গে প্রবলভাবে বেজে ওঠে। কেউ কেউ সেই উল্লাসে চিৎকারও করে উঠে। উদ্দেশ্য একটাই এভাবে গোরু ও কাড়াগুলোকে উত্তেজিত করে তোলা। গোরু খেলানোর দলের কারো হাতে থাকে পশুর চামড়া। সেটাকে বাঁধা গরুটির সামনে নাড়তে থাকে। উত্তেজিত গোরুটিও তখন শিং উঁচিয়ে সেই চামড়ার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। মারমুখো হয়ে গুঁতোতে আসে। উপস্থিত জনগণ গোরুর এই মারমুখী আচরণে প্রচন্ড উল্লাস করতে থাকে। এটাই হলো 'গোরু খুঁটান'।"

আমি ঐদিন গোরু-খুঁটান বেশ ভালোভাবে প্রত্যক্ষ করলাম। দেখলাম, সব গোরুগুলোই যে সমানভাবে খেলায় মারমুখো হয়ে উঠছে এমনটা নয়। কোন কোন গরু অদ্ভুত রকমের শান্ত। এত বাজ-বাজনাতেও বেশ নির্লিপ্ত। তাদেরকে তখন একটু জোরপূর্বক উত্তেজিত করে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছিল। সেই সঙ্গে গোরু কাড়ার আক্রমনে একটা দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ারও প্রবল সম্ভাবনা থাকে এই অনুষ্ঠানে। গোরু খুঁটানের অনুষ্ঠানে কেবল এই দুটো বিষয়ের ওপর আরো একটু বেশি সাবধানতা ও যত্নবান হওয়া উচিত বলে মনে করি। তা বাদে পুরো অনুষ্ঠানটি খুবই উত্তেজক ও উপভোগ্য। দেখতে দেখতে মনে পড়ে যাচ্ছিল তামিলনাড়ুর "জাল্লিকাট্টু"-র কথা। সেখানেও ষাঁড়েদের খেলা জঙ্গলমহলের এই গোরু খুঁটানের মতোই সমান জনপ্রিয়। মনে একটা প্রশ্ন জাগল, জঙ্গলমহলের মাহাতো, কুড়মি সহ যারা গোরু খুঁটায় তাদের সঙ্গে সুদুর তামিলদের এমন অদ্ভুত মিল কীভাবে হল?" বন্ধুকে সে কথা জিজ্ঞাসা করলাম।

বন্ধু বলল, "জন গ্রিয়ারসন  তো বলেছে, বিশেষ করে জঙ্গলমহলের কুড়মিরা দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর একটি শাখা। (লিঙ্গুইস্টিক সার্ভে অফ ইন্ডিয়া পঞ্চম খন্ড পৃষ্ঠা ১৪৩)। তামিলেরাও দ্রাবিড় জনগোষ্ঠী ভুক্ত। তাই প্রাচীনকাল থেকেই হয়তো ষাঁড়েদের নিয়ে এই ক্রীড়া অনুষ্ঠান দ্রাবিড়দের একটি অন্যতম বিনোদনের অংশ ছিল। যা এখন তামিলনাড়ু ও জঙ্গলমহলে সমান ভাবে জনপ্রিয়।

"গোরু খুঁটান নিয়ে ডক্টর আশুতোষ ভট্টাচার্য "বাংলার লোকসাহিত্য" গ্রন্থের 'তৃতীয় খন্ডে', লিখেছিলেন, "এই অনুষ্ঠানের একটি প্রধান অঙ্গ গরু মহিষ নাচানো। শক্ত খুঁটিতে একটি বলিষ্ঠ মহিষ কিংবা ষাঁড়কে বাঁধিয়া তাহাকে কাঠি দিয়া খুচাইয়া খুচাইয়া তাহাকে ক্ষিপ্ত করিয়া তোলাই ইহার উদ্দেশ্য। পূর্বে এইভাবে অস্ত্র দ্বারা আঘাত করিতে করিতে ইহাকে শেষ পর্যন্ত হত্যা করা হইত। বর্তমানে লাঠি দিয়া খুচাইয়া ছাড়িয়া দেওয়া হয়।" (বাংলার লোকসাহিত্য, তৃতীয় খন্ড, গীত ও নৃত্য, পৃষ্ঠা- ২২৪)

"এই লেখাটির দারুণ সমালোচনা করেছেন পশুপতি প্রসাদ মাহাতো তার "ভারতের আদিবাসী ও দলিত সমাজ" গ্রন্থে। তিনি ডক্টর আশুতোষ ভট্টাচার্য সহ আরো কয়েকজন গবেষক সম্পর্কে বলেছেন যে, "আসলে দীর্ঘদিন কোনো সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে সরেজমিন তথ্য সংগ্রহ না করে, বৈজ্ঞানিক শিক্ষনের প্রথাগত ও পদ্ধতি না জেনে সংবাদিকসুলভ মনোভাব নিয়ে কোনো কিছু লেখার লোভ এরা সামলাতে পারেন না।" খুঁটান সম্পর্কে আশুতোষ বাবুর লেখাটা তথ্য বিকৃত হতেই পারে। তিনি কলকাতার মানুষ। তাই বলে বঙ্কিমবাবু কীভাবে ভুল করতে পারেন! উনি তো জঙ্গলমহলেরই ভূমিপুত্র। নিজেও কুড়মি জনজাতির মানুষ। তারও কি তবে তথ্যগত ত্রুটি ঘটেছে! একই ভুল দুজন লেখক কীভাবে করতে পারেন? না কি এটাই আসল তথ্য?"

বললাম, ""ঝাড়গ্রামের লোকসাহিত্য" গ্রন্থের লেখক বঙ্কিম চন্দ্র মাহাতোও একই কথা লিখেছেন না কি!"

বন্ধু বলল, "হ্যাঁ। "ঝাড়খণ্ডের লোক সাহিত্য" গ্রন্থে বঙ্কিমচন্দ্র মাহাতো কী লিখেছেন, সেটা একবার দেখা যাক।

"এই অনুষ্ঠানে মাতাল জনতাও যেন অনেকটা হিংস্র হয়ে ওঠে। গরু মোষকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে উত্তেজিত করে হিংস্র করে তোলে। (পৃষ্ঠা ১৩৮)। ওই গ্রন্থেরই ১৩৯ পৃষ্ঠায় আশুতোষবাবুর কথারই প্রতিধ্বনি যেন, "আমাদের বিশ্বাস সুদূর অতীতে ঝাড়খণ্ডেও এই বাঁধনা পরবে ষাঁড় হত্যা করে গোষ্ঠীর প্রত্যেকে তার মাংস ভক্ষণ করত। গরু খুঁটানো অনুষ্ঠানটি অতীতে ষাঁড়কে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করার স্মৃতিই বহন করে চলেছে।" (ঝাড়খণ্ডের লোকসাহিত্য, পৃষ্ঠা ১৩৯)
বললাম, বঙ্কিম বাবুর সঙ্গে ডঃ আশুতোষ ভট্টাচার্যের লেখার এমন অদ্ভুত মিল কীভাবে হল? তবে কি বঙ্কিমবাবুর কথাই একরকম ঠিক! উনি বলেছেন, গোরুকে খুঁটানো নিছক খেলামাত্র নয়, আবার হিংস্র জীবজন্তুর হাত থেকে তাদের এইভাবে আত্ম রক্ষার কৌশল শেখানো নয়, গোরু খুঁটানো অনুষ্ঠানটি অতীতে ষাঁড়কে  খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করার স্মৃতিই বহন করে চলেছে।(পৃষ্ঠা ১৩৯)  এখন প্রশ্ন হল পশুপতি প্রসাদ মাহাতো মহাশয় তাহলে এই তথ্যের সমালোচনা করলেন কেন?  গো-ভক্তি বা গো-বন্দনা থেকেই বাঁদনা পরব হয়ে আসছে। সেখানে  গো- হত্যার কথা অবশ্যই মেনে নেওয়া যায় না। সুতরাং পশুপতি প্রসাদ মাহাতো মহাশয়ের যুক্তিগত ভাবে ভিন্ন মত থাকতেই পারে। 'গো-বন্দনা' কীভাবে 'গো-হত্যা' ছিল সেটা অবশ্যই সংশয়ের বাইরে নয়। তাই ভিন্ন মত প্রকাশ করা বা সমালোচনা করা কোনোটাই অযৌক্তিক কিছু নয়।"

বন্ধু বলল, "বাঁদনা" পরবের শেষ দিন তথা তৃতীয়ার দিন হল "দেশ বাঁদনা" বা "কাঁটা কাড়া"র দিন।"

আমি বললাম, "কাঁটা কাড়া কেন?"

বন্ধু বলল, "আসলে ঐ দিন বাগালদের বিশ্রাম। বনে জঙ্গলে গোরু চরাতে গিয়ে পায়ে যে কাঁটা খোঁচার আঘাত হয়। ঐদিন পায়ের কাঁটা বের করে তার সেবা শুশ্রুষা করে বলেই এমন নামকরণ। আসলে ঐদিন  তাদের বিশ্রমই হল মূল উদ্দেশ্য।"

'বাঁদনার' এমন গভীরতা সত্যিই জানা ছিল না। এক শ্রেণীর পশুকে ঘিরে এমন উন্মাদনা সত্যিই দ্বিতীয়টি আর নেই। এখানেই বাঁদনার তাৎপর্য সব থেকে বেশি।

তথ্যসূত্র: ১)ঝাড়খণ্ডের লোকসাহিত্য/ লেখক- বঙ্কিমচন্দ্র মাহাত
২) ভারতের আদিবাসী ও দলিত সমাজ/ লেখক- পশুপতি প্রসাদ মাহাতো
৩) বাংলার লোকসাহিত্য, তৃতীয় খণ্ড/ আশুতোষ ভট্টাচার্য
 
পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments