জ্বলদর্চি

বাঁদনা পরব - ২য় পর্ব /সূর্যকান্ত মাহাতো

জঙ্গলমহলের জীবন ও প্রকৃতি

পর্ব - ৪৪

বাঁদনা পরব - ২য় পর্ব

সূর্যকান্ত মাহাতো


"তিন চার দিন ধরে 'বাঁদনা' পরবের যে অনুষ্ঠান ধুমধাম করে পালিত হয় তা স্রেফ গোরু ও মোষকে কেন্দ্র করেই। এই উৎসবে নানা রকমের যে আচার ধর্মগুলো পালন করা হয় তাও এই প্রাণীগুলোকে ঘিরেই। কখনো তাদের প্রতি ধন্যবাদ জ্ঞাপন। কখনো তাদের মঙ্গল কামনা করে নানান পূজা আচার। আবার কখনো তাদের নিয়ে বিনোদন করা। এক কথায় 'বাঁদনা' পরবের প্রতিটি ছোট বড় যে কোন অনুষ্ঠানেই এরা সরাসরি যুক্ত থাকে। পরবের সূচনা থেকে সমাপ্তি পর্যন্ত অনুষ্ঠানের মূল কেন্দ্রবিন্দু এই গোরু মোষেরাই। কোন এক  প্রাণীকুলকে ঘিরে এত বড় উৎসবের উন্মাদনা 'জঙ্গলমহল' কেন, পশ্চিমবঙ্গে আর দ্বিতীয়টি নেই।" বন্ধু একটানা কথাগুলো বলল।

আমি বললাম, "কোন একটি ঘটনার উপর আলোকপাত করে 'বাঁদনা' পরবকে নিশ্চয়ই ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ করা যায় না। এই সংস্কৃতিকে প্রকৃতই বুঝতে হলে এই পরবের একেবারে ভিতর থেকে পটে পটে, আলোচনা করতে হবে।"

বন্ধু বলল, "ঠিক বলেছিস। আজ পর্যন্ত 'বাঁদনা' নিয়ে যতগুলো লেখা প্রকাশিত হয়েছে, "ঝাড়খণ্ডের লোকসাহিত্য" গ্রন্থ ছাড়া বাকি সবগুলোই ভাসা ভাসা। ওপর ওপর। নয় তো খন্ড চিত্রের মতো। তাই আজ 'বাঁদনা' পরব কী, তা নতুন করে আরো একবার বোঝার চেষ্টা করে দেখা যেতেই পারে।"

আমি তো প্রচন্ড উৎসাহ নিয়ে বললাম, "এ তো দারুণ ব্যাপার! আজকের দিনে দাঁড়িয়েও প্রাচীনতার বেশ একটা স্পর্শ নতুন করে পাওয়া যাবে। এত বড় একটা উৎসবের সঠিক ব্যাখ্যাও খুঁজে পেতে পারি। তাই একদম উৎসবের সূচনা থেকেই শুরু করা হোক। ঠিক কতদিন ধরে এই উৎসব চলে?"

বন্ধু বলল, "প্রকৃত পরব বা উৎসবের সময়কাল হল, মূলত তিন থেকে চার দিন। কার্তিকী অমাবস্যার দিন, প্রতিপদের দিন আর দ্বিতীয়ার দিন। অনেক সময় তৃতীয়ার দিন পর্যন্তও চলে। তবে মূল পরবটি তিন থেকে চারদিনের হলেও এই উৎসবের একটি সূচনা পর্ব বা প্রাক মুহূর্ত আছে। সেটাও এই উৎসবেরই একটি অন্যতম প্রধান অঙ্গ বলে মনে করা হয়। একে বলে "ঘাওয়া" অনুষ্ঠান।"

আমি বললাম, "'ঘাওয়া' মানে কী?"

বন্ধু বলল, "'ঘাওয়া' হল, গোরু ও মোষের শিঙে তেল মাখানোর অনুষ্ঠান। গোরুকে ভালোভাবে ধুয়ে স্নান করানো হয়। তারপর তাদের শিঙে তেল মাখানোর পর্ব চলে। এই 'ঘাওয়া' অনুষ্ঠানেরও কিছু আগে থেকেই জন সমাজে উৎসবের আনন্দ কিছুটা অন্যরকম ভাবে শুরু হয়ে যায়। গোয়ালঘর থেকে শুরু করে নিজেদের বাড়িঘরগুলো এসময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করার মধ্য দিয়ে। মাটির দেওয়ালগুলোর উপর নতুন করে মাটি লেপনের কাজ শুরু হয়ে যায়। দেয়ালের উপর বেশ নকশা করে নানা রকমের দেয়াল চিত্রও ফুটিয়ে তোলা হয়। এটা 'বাঁদনার' একটি প্রাক মুহূর্ত।"

আমি বললাম, "বর্ষার জলে মাটির বাড়িগুলো কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই সেগুলোকে বর্ষা বিদায়ের শেষে এই সময় আবারো নতুন করে পরিপাটি করে গড়ে তোলা হয়। এটাও তো একটা কারণ হতে পারে?"

বন্ধু বলল, "অবশ্যই। সেটাও একটা কারণ। তবে উৎসব মানে তো কেবল নিজের মনের আনন্দটুকুই নয়। তা যতটা না অন্তরের তার থেকেও বেশি বাইরের। 'দেখনদারিটাই' তো আনন্দের বহিঃপ্রকাশ। আমরা সেজে উঠি কেন? আমাদের মনের খুশি টাকে অন্যের কাছে উপস্থাপিত করতেই তো। নেচে উঠি কেন? উদাত্ত কণ্ঠে গান গাই কেন? সেও তো মনের খুশিকে বাইরে প্রকাশ করার জন্যই। তাছাড়া পরবের সময় আত্মীয় বন্ধুদের উপস্থিতি ঘটে। তাই বাড়িঘর এই সময় বেশ পরিপাটি করে সাজিয়ে তোলা হয়। তাছাড়া কৃষিজীবী মানুষগুলোর আর সময়ও হয়ে উঠবে না। বর্ষার ধান এ সময় পাকতে শুরু করলে তখন হাজারো কাজ। ধান কাটা, বাঁধা, ঝাড়াই করা আরো কত কী। উৎসবের সময়টাতেই যা একটু অবসর মেলে। কারণ তখন আমাদের ধান পুরোপুরি পাকতে কিছুটা দেরি থাকে। তাই হাতে কিছুটা সময়ও থাকে। যাই হোক আমরা "ঘাওয়া" নিয়ে কথা বলছিলাম তো?"

আমি বললাম, "হ্যাঁ। গোরুর শিঙে তেল মাখানোর অনুষ্ঠান।"

বন্ধু বলল, "আমার মনে হয়, গোরুর শিঙে তেল মাখানোটা অন্য কিছু নয়, গোরুর সৌন্দর্য বাড়ানোই এর একমাত্র লক্ষ্য। গোরুকে স্নান করানোর পর তার শরীরের উজ্জ্বলতা এমনিতেই বাড়ে। তার উপর তার শিঙে তেল পড়া মাত্রই শিং দুটো চকচকে হয়ে ওঠে। তখন সেই সৌন্দর্য যেন শতগুনে বেড়ে যায়। তাদের প্রতি আমাদের  যত্নবান হওয়ার এ এক দারুন দৃষ্টান্ত বলা যেতে পারে।"

আমি বললাম, "সৌন্দর্য বৃদ্ধির কথা মনে হওয়ার কারণ?"

বন্ধু বলল, "দ্যাখ, গোরুর শিঙে একবার তেল পড়ে যাওয়া মানে তাদের পুরোপুরি কর্ম বিরতি শুরু হয়ে গেল। আর তাদেরকে দিয়ে মাঠে-ঘাটে ধুলো কাদার মধ্যে কাজ করানো যাবে না। ধুলো ও কাদার মধ্যে তাদের সেই সৌন্দর্য যাতে নষ্ট না হয়ে যায় সেটা একটা কারণ। তবে একমাত্র নয়। 'ঘাওয়া'-র আসল উদ্দেশ্য হল, গোরুগুলোকে পরিপূর্ণরূপে বিশ্রাম দেওয়া। তাদের বিশেষ সেবা ও পরিচর্যা করা। কারণ তাদের জন্যই আমাদের মুখে অন্ন জোটে। তাদের নিঃস্বার্থ শ্রমের বিনিময়ে আমাদের বেঁচে থাকা। তাই তাদের উপর এটুকু কৃতজ্ঞতা দেখানোটা তো আমাদের একরকম মানবিক ধর্মই।"

জিজ্ঞেস করলাম, "গোরুর শিংগুলোতে সরষের তেল মাখাতে দেখলাম। এটাই কি রীতি?"

বন্ধু বলল, "না। সরষের তেল তো এখন ব্যবহার করছে। শুধু সরষে কেন এখন কচড়া সহ অন্যান্য তেলও ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু এই তেল আগে ব্যবহৃত হত না। আগে "কুজরী"র তেল ব্যবহার করা হত।"

অবাক হয়ে বললাম, "'কুজরী!' সেটা আবার কি!

বন্ধু বলল, "'কুজরি' বা 'কুজবী' হল, এক ধরনের বনজ লতানো গাছের ফল। সেই ফল থেকেই এই ধরনের তেল নির্গত হত। সেটাই গোরুর শিঙে দেওয়া হত। সেই তেলের উজ্জ্বলতা ছিল আরো বেশি। কিন্তু বন জঙ্গল উচ্ছেদ হওয়ার কারণে ওই লতানো গাছ এখন আর নেই। তাই সর্ষে সহ অন্যান্য তেল ব্যবহার করা হছে।"

বললাম, "কোন সময় এই তেল মাখানো হয়।" 

বন্ধু বলল, "এই তেল মাখানোর একটা নির্দিষ্ট নিয়ম আছে। যখন খুশি যেভাবে খুশি মাখানো যায় না। সবার প্রথম শিরি(শ্রী) বলদ(ষাঁড়) ও শিরি(শ্রী) গাই(গাভী) এর শিঙে তেল মাখানো হয়। তারপর বাছুর সহ অন্যান্যদের শিঙে তেল মাখানো হয়। বাড়ির মধ্যে খাবার বা বাসনপত্র 'এঁটো' রেখে তেল মাখানো নিষিদ্ধ। বাড়ির সব কিছু পরিষ্কার করে তারপর খাওয়া-দাওয়ার শেষে হাত পা ধুয়ে তেল মাখাতে হয়। অমাবস্যার তিন,পাঁচ নয়তো সাত দিন পূর্বকাল থেকে তেল মাখানো শুরু হয়। চলে একেবারে অমাবস্যা, প্রতিপদ ও দ্বিতীয়া পর্যন্ত। এরপর অমাবস্যার দিন 'গোঠ' পূজা দিয়ে প্রকৃত 'বাঁদনা'-র শুভারম্ভ ঘটে।"

বললাম, "'গোঠ' পূজা ঠিক কী পূজা?  এ পূজা কেনই বা করা হয়?"

বন্ধু বলল, "'গোঠ' পূজা হল "বাঘুত" দেবতার পূজা।"

আমি বললাম, "বাঘুত' দেবতা! সেটা আবার কোন দেবতা!

বন্ধু বলল, "এই 'গঠ' বা 'গোঠ' কথাটা এসেছে 'গোষ্ঠ' কথা থেকে। 'গোষ্ঠ' হল গোচারণভূমি বা বাথান। যেখানে সমস্ত গরু একত্র হয়ে চরে বেড়ায়। তারপর সেখান থেকেই এদিক ওদিক ঘুরে ঘুরে চরে বেড়ায়। এই 'গোঠ" পূজা হল আসলে "বাঘুত" দেবতার পূজা। গোরুগুলো চরে বেড়ানোর সময় যে কোন মুহূর্তে ওরা বাঘের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে পড়ত। তাই যাতে প্রিয় পোষ্যগুলো বাঘের শিকার না হয়ে পড়ে সে কারণেই দেবতা "বাঘুত" এর পূজা করা হয়। ইনি পুরুষ দেবতা। তাই তাকে সন্তুষ্ট করতে 'মোরগ' বলি দেওয়া হয়। এই পূজার জন্য লাগে দুধ, ঘি, গুড়, আতপ চাল সিঁন্দুর ও একটি হাঁস বা মুরগির ডিম। বাথান বা মাঠে একটি গোল বৃত্ত এঁকে তার মধ্যে এই দেবতার পূজা করা হয়। পূজার শেষে ডিমটি একটি নির্দিষ্ট স্থানে রেখে সমস্ত গরুর পালকে ডিমের উপর দিয়ে দৌড় করানো হয়। যে গরুর পায়ে ওই ডিম ভেঙে যায় সেই গোরুর বাগালকে 'ভাগ্যবান' বলে ঘোষণা করা হয়। এবং উপস্থিত সকলে মিলে তাকে কাঁধে তুলে আনন্দে নাচানাচি করতে থাকে। সেই বাগালও সন্ধ্যে বেলা সকলকে বাড়িতে ডেকে পিঠা খাওয়াই। ডিম ভাঙা সেই গরুটিকেও কাঁচা ধানের মোড় বা মুকুট পরিয়ে বিশেষভাবে সম্মান জানানো হয়।"(ঝাড়খণ্ডের লোকসাহিত্য/ বঙ্কিমচন্দ্র মাহাতো)

আমি বললাম, "বাহ! 'গোঠ' পূজার এমন ইতিহাসটা তো জানা ছিল না!"

বন্ধু বলল, "কেবল 'বাঘুত' দেবতার পূজা নয়, এই 'গোঠ' পূজায় আরো একটি পূজা হয়। "ছাঁদন দড়ির বাঁধন দড়ির" পূজা।"

আমি তো আরো অবাক। বন্ধু কি সব নাম যে বলে চলেছে! বললাম, "ছাঁদন দড়ির বাঁধন দড়ির" পূজা আবার কী? এমন দেব-দেবীর নাম তো কখনো শুনিনি!"

বন্ধু বলল, ""ছাঁদন দড়ি ও বাঁধন দড়ি" কোন দেব-দেবী নয়। বন জঙ্গলের গভীর ও দুর্গম কিছু লতাপাতা মাত্র। গোরু বাছুর জঙ্গলে চরতে গিয়ে মাঝে মাঝেই এমন গভীর লতায় জড়িয়ে পড়ে। আটকে যায়। তখন তারা ঘরে ফিরতে পারে না। তাই সব লতাপাতাকে সন্তুষ্ট করা প্রয়োজন। যাতে গরুর পায়ে জড়িয়ে না পড়ে। সে কারণেই "ছাঁদন দড়ি ও বাঁধন দড়ির" পূজা করা হয়। আসলে একেবারে আদিমকালে মানুষ যুক্তি দিয়ে কোন কিছুকে বিচার করার মতো অবস্থায় ছিল না। জীবনযাত্রায় যেখানে যেখানেই বিপন্ন বোধ করেছে কিংবা অসহায় হয়ে পড়েছে সেখানেই সেই শক্তিকে সন্তুষ্ট করতে পূজা বা ভক্তির পথ অবলম্বন করেছে। এ পূজাও ঠিক তেমনি একটা পূজা। তবে গোরুগুলোর জীবন সুরক্ষার কথা ভেবে এই যে পূজা দেওয়া সেটা প্রাণীগুলোর ওপর কতখানি ভালোবাসা থাকলে হয় সেটা বাঁদনার অনুষ্ঠানগুলো দেখলেই বোঝানো যায়।"

আমি বললাম, "শুধু তাই নয়, কোন কিছুর থেকে প্রভূত উপকার পেলেও আমরা তার পূজা করে চলি। এই যেমন গোরু মোষগুলো। তাদের থেকে প্রভূত উপকার পাই বলেই তো তাদের 'ভগবতী' রূপে ভক্তি করে আসছি।"

বন্ধু বলল, "হ্যাঁ। একদমই তাই। এ পূজা মনের ভয় থেকে নয়। কৃতজ্ঞতা থেকে। 'বাঁদনা' তো গোরুগুলোকে ধন্যবাদ জ্ঞাপনেরই অনুষ্ঠান। (ভারতের আদিবাসী ও দলিত সমাজ/ পশুপতি মাহাতো; পৃষ্ঠা ৯৪)

জিজ্ঞেস করলাম, "'গোঠ' পূজা ছাড়া অমাবস্যার দিন আর কী কী আচার ধর্ম পালন করা হয়?"

বন্ধু বলল, "ঐদিন সন্ধ্যায় "কাঁচি জিউরী"র অনুষ্ঠান পালন করা হয়।"

বললাম, "সেটা আবার কি!"

বন্ধু বলল, "চালের গুঁড়িকে গোরুর দুধ দিয়ে মাখিয়ে গোল গোল পিণ্ড বানানো হয়। সেগুলো একটি করে শালপাতার ওপর রাখা হয়। একটি কার্পাস তুলোর টুকরোকে সলতের মতো পাকিয়ে ঘিয়ে ডুবিয়ে ঐ পিণ্ডের মধ্যে গুঁজে দেওয়া হয়। তারপর সেটা জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। জ্বলন্ত গুঁড়িপিন্ড সহ একটি শাল পাতা, দু পাশে দু আঁটি "মড়দা" ঘাস, গোবরের দুটি ঢেলা তার উপর বাতি প্রথমে তুলসী তলায় ও কুলহি দুয়ারে দিয়ে প্রণাম করতে হয়। এরপর একইরকম ভাবে বাড়ির প্রতিটি দুয়ারে, জানালায়, গোয়ালঘরে, কুয়াতলায়, সবজির ক্ষেতেও দেয়া হয়। এটাই হলো কাঁচি জিউরীর অনুষ্ঠান।"

বন্ধুর কথা শুনে বললাম, "এই অনুষ্ঠানের পিছনেও কী কোন কারণ আছে?"

বন্ধু বলল, "এর একটা যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করেছেন বিশিষ্ট গবেষক বঙ্কিমচন্দ্র মাহাতো। তিনি তার "ঝাড়খণ্ডের লোকসাহিত্য" গ্রন্থে বলেছেন, এই "মড়দা" কথাটা "মেনঢা দাহ" কথাকে মনে করিয়ে দেয়। "মেনঢা দাহ" হল দোল পূর্ণিমার আগের রাত্রের "বহ্নুৎসব"। ওই দিন রাত্রিতে বিভিন্ন প্রদেশে মেনঢাসুর দাহ করা হয়। সেই উপলক্ষ্যে বিপুল আনন্দ উচ্ছ্বাস চলে। বাঁদনাও তাই। একদম কচিকাঁচার দলসহ সকলেই পাটকাঠি, শনকাপাটি জ্বেলে, আগুনের গোলা পাকিয়ে, 'মুঢ়া' কাঠ জ্বালিয়ে টিন থালা বাজিয়ে হৈ হুল্লোড় করে অগ্নি উৎসব পালন করা হয়। একে আবার ধো-মশাও বলে। দুয়ারে দুয়ারে "কাঁচি জিউরী"র অনুষ্ঠানও কিছুটা 'বহ্নুৎসব' পালনের মতোই।"

সেই সঙ্গে বলল, "কাঁচি জিউরী"র গুড়িপিণ্ড পুড়িয়ে খেলে নাকি চর্মরোগ হয় না, এমন একটি কথাও প্রচলিত আছে। তবে নিজস্ব বাড়ির গুঁড়িপিন্ড খাওয়া বারণ। অন্যের বাড়ির খাওয়া যায়।"

বললাম, "এরপরেই নিশ্চয়ই জাগরণ অর্থাৎ গরুর জাগানোর পালা।"

বন্ধু বলল, "না। 'কাঁচি জিউরী'র পর বাড়ির মেয়েরা পিঠা করতে বসে। ছাঁকা পিঠা, মাংস পিঠা, ডিম ও মসলা পিঠা সহ কতরকমের পিঠা তৈরি করে। তারপর খাওয়া দাওয়া সারে। এঁটো বাসনপত্র তুলে রেখে হাত পা ধুয়ে গোরুর শিঙে তেল মাখায়। এরপর "চুমান" ও "নিমছানো" অনুষ্ঠান পালন করা হয়। এ দুটিই 'বাঁদনা'র বেশ উল্লেখযোগ্য অনুষ্ঠান। 

বললাম, "এগুলো আবার বাঁদনায় কেন? এ দুটো তো বিয়ে উপলক্ষে হয়!"

বন্ধু বলল, "বাঁদনা তো একরকম গোরুর বিবাহ অনুষ্ঠানই। এই দিন গোরু "চুমানো" অনুষ্ঠান যেন অনেকটাই তাদের গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান। একটি বলদ ও গাইকে জোড়ায় জোড়ায় পূর্ব মুখে দাঁড় করানো হয়। বাড়ির গৃহিনী এই যুগলবন্দী গো-জোড়াকে চুমায়। গৃহিনী নতুন কাপড় পরে। হাতে থাকে একটি নতুন কুলা। কুলায়  সাজানো থাকে ধান, দূর্বা, ধূপ, ধুনো, প্রদীপ। অন্য হাতে থাকে ঘটি ভর্তি হলুদ গোলা জল। তাতে থাকে আম্রপল্লব। প্রথমে হলুদ গোলা জল গোরুর চার পায়ে ছিটিয়ে ছিটিয়ে ধোয়া হয়। এবার ধান ও  দূর্বাঘাস গোরুর মাথার উপরে ঘুরিয়ে কুলার মধ্যে নামাতে হয়।  এইভাবে তিনবার করার পর গোরু দুটোর মুখের দিকে হাত বাড়িয়ে চুমু খাওয়া হয়। এটাই হল 'গোরু চুমানো'। শেষে প্রণাম করে।

এরপর 'নিমছানো' হয়। চুমানোর সময় একটি ভেলাই পাতা ধুনোর মধ্যে ফেলে সেটাকে গোরুর মাথার উপর ঘুরিয়ে এনে দুই পায়ের মাঝে গলিয়ে আবার গরুর মাথার উপর ঘোরানো হয়। এরকম তিনবার করা হয়। এবার সেটিকে কুলহি(রাস্তায়) দুয়ারে উপুড় করে পা দিয়ে ভেঙ্গে জল ছিটিয়ে নিভিয়ে দিতে হয়। একেই বলে 'নিমছানো' বা 'নির্মঞ্ছন'"।

"নিমছানো কেন?" জিজ্ঞেস করলাম।

বন্ধু বলল, "কারন ভুত-প্রেত বা অশুভ শক্তি যাতে গোরুর কোন ক্ষতি করতে না পারে তার জন্যই এই রকম ভাবে নিমছানো হয়।"

আমি অবাক, একটা প্রাণীকুলের জন্য এত গভীরভাবে ভাবতে পারত আগেকার দিনের মানুষ!

চলবে...

তথ্যসূত্র: ঝাড়খণ্ডের লোকসাহিত্য;  লেখক: বঙ্কিমচন্দ্র মাহাতো
 
পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

4 Comments