জ্বলদর্চি

কবিতা অ্যাভিনিউ /পর্ব ২৪ /বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়

কবিতা অ্যাভিনিউ
পর্ব ২৪ 
বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়  

জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ভাবনার প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলি কাব্যিক আদল নিয়ে এক স্বতন্ত্রদীপ্ত তরঙ্গবেগ তৈরি করেছে কবি মোহিনীমোহনের কবিতায়।বস্তুতপক্ষে মোহিনীমোহন সেই কবি যাঁর দৃঢ় বিশ্বাস রয়েছে এক সীমান্তহীন পৃথিবীর। রবার দিয়ে যাবতীয় ভেদরেখা  মুছে ফেলার এক গভীর প্রত্যয় তাঁর কবিতার শরীর জুড়ে অহরহ বেজে উঠেছে। তা ভাষার সীমান্ত হতে পারে, ভৌগোলিক সীমান্ত হতে পারে ধর্মীয় সীমান্ত হতে পারে  আবার অর্থনৈতিক সীমান্তও হতে পারে। যেকোন বিভেদকে মুছে ফেলার এক উন্নতশীর্ষ ঘোষণা এবং জীবন সম্পর্কে মৌল দৃষ্টিভঙ্গির  তন্নিষ্ট প্রকাশ তাঁর কবিতার মূলসুর হয়ে উঠেছে। তা সত্ত্বেও গ্রামীণ অর্থনীতি এবং নিসর্গের  বিষয় নিয়েই কেন তার কবিতার ভেতর প্রবেশ করব এ কথা বলে নেওয়া দরকার প্রথমেই। মোহিনীমোহন গঙ্গোপাধ্যায় আমার বাবা। আমি তো বাবার কবিতা সপর্কে আলোচনা না করে ব্যক্তিগত অনুষঙ্গও লিখতে পারতাম। যতই ব্যক্তিগত পরিসর লেখা হোক না কেন একজন কবিকে জানতে হলে তাঁর কবিতার কাছে এসে দাঁড়াতে হবে আমাদের। সেই কবিতা যে কবিতা মাটির ভেতর থেকে পল্লবিত হয়েছে ঋজু বৃক্ষের মতো। গ্রামই হচ্ছে সভ্যতার ভিত্তিভূমি। এই ভিত্তিভূমিকে না জেনে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয় নিয়ে তাত্বিক বক্তব্য রাখা যেতে পারে কিন্তু তার প্রায়োগিক বিশ্ব দাঁড়িয়ে থাকে মিথ্যের উপর কল্পনার উপর। একমাত্র গ্রামকে জানলেই স্বচ্ছ এবং সুসংহতভাবে সারা পৃথিবীকে জানা যায়। জানা যায় ভারতবর্ষের আসল চেহারা। সেই ভারত যেখানে অর্থনৈতিক পরিচয়ে ঋদ্ধ পুজিপতিবর্গের স্বার্থ সংরক্ষনই হয়ে উঠেছে দেশের ঘোষিত নীতি। আধিপত্যপ্রবণ ক্ষমতা কেন্দ্র থেকে কখনই সরে আসেনি পরিধির দিকে। অথচ কথা ছিল গ্রামীণ বিকাশের মধ্য দিয়ে দেশের সামগ্রিক বুনিয়াদকে মজবুত করবার।       
কথা ছিল জ্যোৎস্না জ্বালিয়ে আমরা আমরা পায়ে পায়ে সাঁকো পার হবো
ধুয়ে ফেলবো শরীরের নুন ঘাম নিবিড় যন্ত্রণা ( গৃহযুদ্ধ) 
শ্রমিক এবং কৃষকের নুন ঘাম নিবিড় যন্ত্রণাকে মূলধন করেই কায়েমী স্বার্থগুলি বিকশিত হয়েছে। সংখ্যাভিত্তিক গণতন্ত্রে শ্রমলিপ্ত এই মুখগুলিকে ভোটার ছাড়া আর কোন আইডেনটিটি দেওয়া হয় নি। মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়নি জীবন ও সমাজশরীরের গভীর অবতলে লুকিয়ে থাকা বেদনাপীড়িত ক্ষতগুলি।অথচ অনুভূতিদেশ থেকে আলো ফেলে জ্যোৎস্না জ্বালিয়ে বিচ্ছিনতার সমস্ত উপাদানগুলিকে দূরীকরণ করা জরুরি ছিল। জরুরি ছিল মানবিক চেতনার সমন্বয়।কৃষিভিত্তিক ভারতবর্ষে দিনের পর দিন বিপন্ন হয়েছে কৃষকের নিরাপত্তা। মাঠ ও মৃত্তিকালালিত নিম্নবিত্ত এবং বিত্তহীনের যন্ত্রণা সবসময় যে নদীর শান্ত সংগীতের মতোই নিরীহ নির্বিরোধী জীবনযাপনের বিস্তৃতি লাভ করেছে তা কিন্তু নয়। রক্তের ভেতর জন্ম নিয়েছে বেয়নেট। এই ইতিহাস কেবলমাত্র ঘটনা বা কাব্যিক ব্যঞ্জনাসঞ্জাত কিছু পেলব অনুভূতি নয়, এর অন্তরালে লুকিয়ে আছে গ্রামীণ বিপন্ন মানুষের অবিচ্ছিন্ন সংগ্রাম ও প্রতিরোধের কাহিনি।  
শস্যের একাগ্র পুরুষ জানে রক্তের ভিতরে আছে বেয়নেট
মাটির গর্ভকোষে জ্বলন্ত ফেস্টুন
পুরানো কঙ্কাল খুঁড়ে হারানো ভাতের গন্ধ
কারো কারো মেদ রক্তে কিছুটা আগুন ( শস্যের একাগ্র পুরুষ)
লাতিন আমেরিকার বিখ্যাত কথাকার মারিও ভার্গাস ইয়োসাও লক্ষ্য করেছিলেন- Reality  can hardly be logical for the exploited Indian peasant ,scorned and humiliated all his life and defeceless against disease and poverty; nor can the world be rational for the outcast child, rootless among men, for ever exited . On the contray it is essentially absurd . This is source of his fatalistic irrationality,his animism and that secret fetishism which leaves him to venerate the strangest objects with religious unction 

 এত কিছু বিপ্রতীপতা সত্ত্বেও  অন্তর্গত রক্তের ভেতর লালিত হয় ভালোবাসা যার মৃত্যু নেই। খুব সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠতে পারে পন্যসর্বস্ব ভোগবাদের ছায়া কি তাহলে  গ্রাম অর্থনীতিকে গ্রাস করছে না ? অবশ্যই করছে। জন্ম নিচ্ছে ফাঁপা পরশ্রমজীবি এক গভীর বলয়। প্রাকৃতায়ন থেকে উত্তরায়নের দিকে ধাবমান  আধুনিকোত্তর উৎকেন্দ্রিকতার বহুমুখি ছায়া এসে পড়ছে প্রান্তিক জনভূমিতে।কৃষি থেকে শিল্পএর দিকে শুরু হচ্ছে অভিযাত্রা।  ফলে গ্রামীণ আঙিনাতেও এসে ঢুকে যাচ্ছে মুক্ত হাওয়া। তবু ধোঁয়া যতখানি ছড়াচ্ছে সূর্য  তার চেয়েও বেশি উজ্জ্বল হয়ে আছে। এখনও স্বপ্নগুলি বেঁচে থাকে রক্তের ভিতর।  মোহিনীমোহনের কবিতায়’ ধান’ গ্রামীন অর্থনীতির মূলস্তম্ভ হিসেবে যেমন বিবেচিত হয়েছে পাশাপাশি প্রাকৃতিক সমৃদ্ধির জীবন্ত রূপক হিসেবে বারবার প্রতিবিম্বিত হয়েছে।   
সোনালী ধানের খেত রমণীয় রমণীর মতো
সোহাগে দোলায় অঙ্গ , ভালোবেসে দেয় সে চুম্বন
আশ্চর্য রমণে চাষী সর্বাঙ্গে জিইয়ে রাখে সক্ষম পৌরুষ 
নিবিড় আশ্লেষে তার স্বপ্নগুলি বেচে থাকে রক্তের ভিতর ( ধান) 
 পাঁচের দশকে  একদিকে মানভূমের ভাষা আন্দোলন এবং অন্যদিকে ছয়ের দশকে খাদ্য আন্দোলনের অনিবার্য পটভূমি, মানুষের মুখে  খাবার ও ভাষা  তুলে দেবার দাবি নিয়ে উত্তাল হয়ে উঠেছিল রাজপথ।এই সময়ের ভেতর দিয়েই মোহিনীমোহনের কবিতার অভিমুখ নির্ণীত হয়েছিল। স্বাভাবিক কারণেই খিদের নগ্ন ভয়াবহ রূপ তাঁর সেই সময়ের কবিতার ভেতর অন্য এক মাত্রা নিয়ে আসে।একে শৈল্পিক অঙ্গীকারে বা  সৃষ্টিক্ষম প্রজ্ঞায় শুধু নয় বাস্তবোচিত পর্যবেক্ষনে তুলে এনেছেন তিনি। একদিকে বর্গা অপারেশনের কথা যেমন এসেছে, এসেছে আর এল আই এবং সেচ প্রকল্পের কথা। সমবায়িক ভাবনার ভেতর দিয়ে গ্রামীণ বিকাশের কথাও কবিতা জুড়ে বিবৃত হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। তবু জ্যোৎস্না এসে জরিপ করে ভাতের হাড়ি।      
নড়বড়ে সাকো পার হলেই ঘর
ঘর থেকে দেখা যায় খড়ের চাল, বাশের বাতা
মাঝরাতে উকি দেয় চাদ
জ্যোৎস্না এসে জরিপ করে ভাতের হাড়ি
ছেড়া কাথা ঘর গেরস্থালী সংসার ( জীবন যাপন)
আমাদের  জীবন সমস্যার বৃত্তে ও বোধে আমরা কি খুঁজে পেতে পারি যুগচৈতন্যের নতুন কোন গতিমুখ? এর উত্তর খুব তীক্ষ্ণ সূচিমুখ নয়।হাজার মনীষার কাজ। হাজার বছরের অপেক্ষাজারিত সেই সুচেতনা। তবু আমরা যারা বিশ্বাস করি সভ্যতায় মানুষ তার প্রজাতিগত সত্তা থেকে বিয়োজিত এবং পুঁজি দ্বারা নির্বিত্তের নিষ্পেষণ আজকের অতি আলোকিত সভ্যতা এবং আঙ্কিক নিয়মের এই নষ্ট সভ্যতাই শেষ কথা নয়। ক্রমমুক্তির স্বপ্ন মানুষকে উজ্জীবিত করবেই তাদের কথাই তিনি লিখেছেন।    
সামাজিক পোশাকের নিচে 
গোপন অস্ত্র আছে ভীষণ ধারালো 
তাকে বের করে আনে সভ্যতার শক্ত দুটো হাত
আগুনের ঘরে বসে শুক্লবর্ণা নারী 
ইতিহাস পড়ে যায়, বেদনার হিমে ভেজা চোখে 
সে জেনেছে দু;খগুলো ফুল হবে ফুলের ফসল ( শিকড়ের দাঁত)
মানুষই রচনা করে ইতিহাস। রক্তাক্ত প্রান্তরে উলগুলানের লড়াই লেখা হয়। তিতুমার বীরসা মুন্ডারা আগুনের অক্ষরে লিখে ফেলে কৃষক বিদ্রোহ। বৃটিশ উপনিবেশবাদ যাকে চুয়াড় বিদ্রোহ আখ্যা দেয় তা আসলে গ্রামীণ প্রান্তিক মানুষের মুক্তিযুদ্ধ। প্রকৃত স্বাধীনতার লড়াই।গঙ্গানারায়ণ তাই আমাদের আত্মার ভেতর চৈতন্যবোধের ভেতর লিখে যায় নতুন ইতিহাস।   
 মৃত্যুকে পুড়িয়ে বাচে তিতুমীর- বীরসা মুন্ডার 
কঠিন প্রতিজ্ঞাগুলি মানুষের বুকে বুকে টানটান ছিলা
সমস্ত মানভূম জুড়ে লেলিহান কৃষক বিদ্রোহ 
প্রবাদপুরুষ তার দৃঢ়চেতা গঙ্গানারায়ণ ।( আমি ও আমার ভারতবর্ষ )
 মানভূমের রুখা এবং কাটখোট্টা ভাষায় যে কবিতা লেখা যায়। শব্দের ভেতর যে মুক্তি ঘটানো যায় তা তিনি দেখিয়েছেন।কবিতার মধ্যে মাদল বাজানোর স্পর্ধা ও হিম্মত নিয়ে তিনি তছনছ করে দিয়েছেন  বাংলা কবিতার সমস্ত ডিকশন প্যাটার্ণ। মাড়ভাতের লড়াই মানুষের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই, মানুষের রুটি রুজির সংগ্রাম। এ লড়াই তো সেখানেই যেখানে " কাঁথা নাই বিছনা নাই পরনের কনহ টেনা নাই উদাম গায়ে হু হু কইরে কাঁপা মাঝেমধ্যে চুটি বেনাই টানা ভুরসি জ্বাইলে আগুন পুহালেও সুয়াস্তি নাই বাপ ( দমে জাড় লাইগছে হে ) এই শীতার্ত মানুষের কাছে উষ্ণতার বার্তাটকু পৌঁছে দেওয়াই শুধু নয় তাদের  কাঁধে কাঁধ রাখাই কবির দায়। একদিকে মানুষের যন্ত্রনাদীর্ণ জীবন অথচ তার ভেতরেই উন্মুক্ত প্রকৃতির নিরাভরণ রূপ,এই সৌন্দর্যের স্থাপত্য নির্মাণ তাঁর কবিতাকে মহিমান্বিত করেছে। মাতলা কাড়া যেখানে শিং লাড়ে “ টাড় বাইদের জমিগুলাতে সবুজ রঙের বাহার, কচি ধানের শিরশিরানি” এই রোমান্টিকতাও কবিকে আচ্ছন্ন করে , স্বপ্ন দেখায়। ( ক্রমশ)

 
পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments