জ্বলদর্চি

আড্ডা, অনুভবে কবি অরুণ : কবিতার ময়নাতদন্ত / সোমদত্তা



আড্ডা, অনুভবে কবি অরুণ : কবিতার ময়নাতদন্ত  

সোমদত্তা


বস্তুনির্ভর জীবনে ক্রমশ অভ্যস্ত হতে হতে, নাগরিক বিলাসিতায় গা ভাসিয়ে দিয়ে, যখন কল্পনাশ্রিত বিষয়গুলিকে তুচ্ছ ভাবতে প্রায় শুরু করেছি, ঠিক তখন, ঠিক তখনই, হাতে এল ডঃ রঞ্জিত কুমার সিনহা'র "আড্ডা, অনুভবে কবি অরুণ" বইটি। মুখপত্রিকার যুগে সবাই প্রায় যখন কবি, চলতে ফিরতে, উঠতে বসতে, খেতে শুতে যখন ফল্গুধারার মত কবিতা বইছে, তখন কবিতার অন্তঃস্থলে এই অতর্কিতে হানা দিতে কেউ যে পারেন, অনুভূতিতে জড়িয়ে নিতে পারেন, তা বেশ অবাক করল। 

বলতে দ্বিধা নেই কবি পরিচিতি আমার ছিল না।খুঁজে পড়ে ফেললাম কয়েকটি (খুবই অল্প) লেখা। আবারো বলতে দ্বিধা নেই, বেশ দুর্বোধ্য ঠেকলো। 

এরপর, একবার নয়, বেশ কয়েকটি জায়গা বেশ কয়েকবার পড়লাম "আড্ডা, অনুভবে কবি অরুণ " কে। আলোচনা করতে বসে বুঝলাম, আমার মত মূর্খের পক্ষে এ কাজ সত্যিই ধৃষ্টতার। কবিরলেখনীরঅন্তঃস্থলে পৌঁছাতে যে অসমসাহসিকতার প্রয়োজন, লেখক ডঃ  সিনহা তা অনায়াসে, স্বচ্ছন্দ ভঙ্গিতে করেছেন। চায়ের আড্ডাই হোক বা বারিক বাড়ির গুপ্ত-কুঠুরিই হোক, লেখক স্বতঃস্ফূর্ত, অনর্গল অরুণের হৃদয় কুঠুরিতে  প্রবেশ করেছেন অবাধে। কবির অনুভবকে ছুঁতে উনি উদ্দীপক নন, অনুঘটকের কাজ করেছেন। 
কবি সত্যিই বিবাগী বাউল, ব্যাকুল হয়ে খুঁজে চলেছেন তাঁর সেই পরম পাওয়াকে। ক্ষুদ্র জড় বা চেতন, সবের মধ্যেই তিনি খুঁজে ফেরেন তার মোক্ষকে। সীমার মাঝে থেকেও অসীমের পানে ধাবিত কবি, এক ঘাট থেকে অন্য ঘাটে। সৃষ্টির নেশায় বুঁদ তিনি। 

কবিতা তো কবির ভালোলাগা, ভালোবাসা, মন্দলাগা, রাগ দুঃখের এক নিখাদ দলিল চিত্র। কবির লেখার উদ্দেশ্য, বিষয়ে, ভাবনার স্থায়িত্ব, অনুভূতি শক্তির লেনদেন, কবিতা লেখার পর তার সাথে কবির সম্পর্ক — লেখক তাঁর প্রশ্নবাণে কবির ভেতর থেকে নিংড়ে বের করে নিয়েছেন। কবির মানসিক স্থিতাবস্থা তাঁকে প্রসারিত প্রাঙ্গণ দেয়  কখনো, কখনো সংকীর্ণ করে তোলে — লেখক তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন কবির নিজস্ব প্রেক্ষাপটে, নিজস্ব ভঙ্গিতে। অসম্ভব সত্য লেগেছে "কবির অহং, মায়া ও আত্মজ্ঞান" অধ্যায়টি। আমরা প্রতিনিয়ত বাঁধার সম্মুখীন হই এই অহংবোধে। ভাবনায় থাকলেও কাটিয়ে  উঠতে পারি না এই অহংবোদ। আবার মায়া জর্জরিত হয়ে, বশে রাখতে পারি না কল্পনাকে। আমাদের আত্মজ্ঞানের স্বরূপ খুঁজতে গিয়ে কবি চোখে আঙুল দিয়ে সেই আত্মম্ভরিতাকেই দেখিয়েছেন, পরমচেতনার সন্ধান দিয়েছেন।

সবথেকে ভালো লেগেছে, "জেড প্রজন্মের পথ, পরম চেতনার পথ" অধ্যায়টি। সেই অনিত্য,অনিন্দ্য সুন্দরের তাড়নায় আমরা চলছি তো চলছিই। সেখানে দৈহিক স্থুল আবেগ, বাহ্যিক রূপ, দৃষ্টিনন্দন বিষয়কে তুচ্ছ করতে পারলে তবেই আমরা সেই অরূপরতন, সেই বিশ্বরূপের খোঁজ পাই। যে খোঁজে মানুষের অনেকেরই কেটে যায় সারাজীবন। 

লেখক ডঃ সিনহা লিখেছেন "বৈচিত্র্যময় উৎপাদনের আত্মার সাথে কবির আত্মার মিলনই কবিতা। এ মিলন প্রেমভাবের মিলন।" এখানে আমার মনে হয় শুধু কি প্রেম?...আমি তো যন্ত্রনা থেকে, ঘৃণা থেকেও কবিতার জন্ম হতে দেখেছি। তবে সে কিসের মিলন? কবির মনের আনন্দ, দুঃখ, হাসিকান্না, রাগ, অভিমান, ঘৃণা সবই কবির ব্যক্তিসত্তার একেকটি পর্ব — কবির মনন, চিন্তন, আবেগ জড়িয়ে কবিতার জন্ম — যে কোনো পরিস্থিতিতেই তা ঘটে যায়, শুধুমাত্র নান্দনিক মুহূর্ত থেকেই নয়,  না পাওয়া, পেয়ে হারানোর  জ্বালাও তো কবির মনেরই ভিন্নভাবের নামান্তর। আসলে সেই পরমব্রহ্মের সাথে মিলিত হবার চাহিদা — কখনো তা আদরে, কখনো রাগে, ঘৃণা বা অভিযোগে। 

যাইহোক, প্রতিটি ছাত্রের ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন। তাতে লেখার আকার বৃদ্ধি পাবে বা আমার পক্ষে কুঠিনও  হবে। তবে এ লেখা শুধুমাত্র আমাদের মতন পাঠককুলের অনুভূতির গোড়ায় ধোঁয়া দেবে, তা নয়,   গবেষণায় যুক্ত মানুষের সহায় হবে। 

পরিশেষে বলি কবি অরুণ দাসের ভাবনা, কথা প্রসঙ্গে উঠে আসা ব্যাখ্যা, নতুন সৃষ্টির রহস্য আমাদের মতো সাধারণ মানুষের, যাদের অস্বচ্ছ ভাবনা, নড়বড়ে লেখা, সংকীর্ণ উঠুন, তাদেরকে এক স্বচ্ছদৃষ্টি দেয়, এক পূর্ণতার সন্ধান দেয়। তাঁকে শ্রদ্ধা। 

আর লেখক, ডঃ রঞ্জিত কুমার সিনহা কে জানাই কৃতজ্ঞতা। তাঁর ঝরঝরে লেখনী, কবিতা মহলের আনাচে কানাচে অনায়াস পদচারণা মানসিক উত্তরণ ঘটায়। তাঁকে বলি, বারবার এরকম ব্যতিক্রমী বিষয়কে তুলে ধরুন আমাদের মত পাঠকমহলে — আমরা সমৃদ্ধ হই বারবার।

পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

2 Comments

  1. Tomar gayner poridhi oshim, ontoto amar moto noggonno manusher kache. Egiye jao Somdutta. Onek subho kamona thaklo.

    ReplyDelete
    Replies
    1. তুমি আমায় ভালবাসো, তাই সবকিছু ভালো দেখো। এটা তোমার কৃতিত্ব। আমার কিছু নেই।

      Delete