জ্বলদর্চি

মেদিনীপুরের কৃষিবিজ্ঞানী ড. রামচন্দ্র মণ্ডল স্যারের বর্ণময় জীবনের উত্থান-পতনের রোমহর্ষক কাহিনী /উপপর্ব — ০২ /পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

বিজ্ঞানের অন্তরালে বিজ্ঞানী — ৬৭

এগ্রিকালচারাল রেটুনিং

(মেদিনীপুরের কৃষিবিজ্ঞানী ড. রামচন্দ্র মণ্ডল স্যারের বর্ণময় জীবনের উত্থান-পতনের রোমহর্ষক কাহিনী)

উপপর্ব — ০২

পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

যেমন বজ্র আঁটুনি, তেমনি ফস্কা গেরো! ঘরে বাইরে নিরাপত্তার কড়া বেষ্টনী আর ভেতরটায় ডাহা ফাঁকা। ঢিলেঢালা নিরাপত্তা ব্যবস্থা। এই তো সুবর্ণ সুযোগ! সুযোগ কঠিন প্রতিশোধ নেওয়ার। যাকে বলে, দৃষ্টান্ত মূলক বদলা। অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলায় অত্যাচারী ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামী সোচ্চার। গর্জে উঠল বন্দেমাতরম ধ্বনি। সমষ্টিগত বিদ্রোহের আগুন। এর অবশ্যম্ভাবী ফল হিংসাত্মক প্রতিঘাত। প্রমাণ কী? ১৯৩১ সালের ৭ এপ্রিল জেলাশাসক জেমস পেডি'র মৃত্যু। ৩০ শেষ এপ্রিল ১৯৩২-এ মেদিনীপুরের দ্বিতীয় শ্বেতাঙ্গ ম্যাজিস্ট্রেট ডগলাস নিহত। ১৯৩৩ সালের ২ রা সেপ্টেম্বর অত্যাচারী জেলাশাসক বার্জ হত্যাকাণ্ড। মেদিনীপুরের বিপ্লবীদের হাতে ক্রমান্বয়ে তিন তিনজন শ্বেতাঙ্গ ম্যাজিস্ট্রেটের হত্যায় দারুণ বিস্মিত শ্বেতাঙ্গ সরকার! শত্রু খানিক থতমত। রীতিমত শিউরে উঠার মতো ঘটনা। শিরদাঁড়া বেয়ে মৃত্যুর হিমশীতল স্রোত বইয়ে দেয়। টনক নড়ে গেল ইংরেজ শাসনের। শুরু হল অকথ্য অত্যাচার। সীমাহীন নির্যাতন। ভিত্তিহীন অভিযোগ। বিপ্লবীর আস্তানায় হানা। রাতের কার্ফু। ধরপাকড়। সবকিছু চলে জোরকদমে। অত্যাচারের হাত থেকে কারও নিস্তার নেই। বিপ্লবী কৃষক ব্যবসায়ী এমনকি পথ চলতি মানুষজন – কারও রক্ষে নেই। অযাচিত হয়রানি, নিত্য ক্ষয়ক্ষতি লেগেই থাকে। মেদিনীপুরের আকাশে তখন ঘন কালো মেঘ। অত্যাচারী শাসকের কুনজর, শ্যেনদৃষ্টি। অস্থির পরিবেশ। পুরো তিরিশের দশক ধরে চলেছিল চরম অরাজকতা। এমনই আবহে ছোট্ট রাম শৈশবের গণ্ডি পেরল। ১৯৪০-এ দশ পেরিয়ে এগারোয় পা দিয়েছে সে।

কশাড়িয়া থেকে, উত্তর - পশ্চিম কোণে, মাইল দশেক দূরে দেখালী গ্রাম। রসুলপুর নদীর পূর্ব ধারে। এক পিসিমার শ্বশুর বাড়ি দেখালী। সেখান থেকে খানিক পূর্ব দিকে হলুদবাড়ি হাইস্কুল। সাড়ে তিন থেকে চার কিলোমিটার হাঁটা পথ। হলুদবাড়ি হাইস্কুলের সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হল রাম। বাড়ি থেকে স্কুলের দূরত্ব মাইল সাতেকের বেশি। বাড়ি থেকে প্রতিদিন এত পথ হেঁটে স্কুলে যেতে - আসতে অনেকটা সময় কাবার হয়ে যাবে। পরিশ্রমও যথেষ্ট হবে। পড়াশুনার সময় পাবে না। একলা স্কুলে যাবে, সঙ্গী সাথী নেই। ভগবান না করুন, রাস্তায় হঠাৎ একটা অসুবিধা হাজির হলে? হাজার একটা সমস্যা। মায়ের মন কু ডাকে। অজানা ভয়ে শিউরে ওঠে বাবার হৃদয়। কী জানি কী হয়, কী হয়! অগত্যা উপায়? আসু একটা সমাধান বের হল। দেখালীর পিসিমার বাড়ি থেকে সাড়ে তিন কিলোমিটার থেকে চার কিলোমিটার দূরের স্কুলে যাতায়াত করবে রাম। ভালো-মন্দ যাচাই করে ছেলেকে বোনের বাড়িতে রাখা সঙ্গত মনে করেন প্রহ্লাদবাবু। আপাতত রামের ঠিকানা দেখালী, পিসিমার ঘর। তার বয়স তখন অল্প। অশান্ত শৈশবের গণ্ডি পেরিয়ে বর্ণময় কিশোর বেলার হাতছানি। বড় কঠিন এ সময়! কঠিন বাবা মা-কে ছেড়ে বাইরে একলা থাকা। উপায়ও নেই। অগত্যা! বাক্স প্যাঁটরা বই কলম খাতাপত্র গুছিয়ে দেখালী রওনা হয় সে। বট গাছের মতো পিসিমার স্নেহের ছায়ায় বাবা-মা-ভাইবোনকে ছেড়ে থাকতে একফোঁটা কষ্ট হয়নি রামের। একপ্রকার মানিয়ে নিয়েছে নিজের মতো করে। এছাড়া অন্য উপায়ও তো নেই। পিসিমার বাড়ি থেকেই শুরু হল এক অন্য লড়াই। জীবন সংগ্রাম। চিরন্তন দৌড়। লেখাপড়ার অসম প্রতিযোগিতা। জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অচেনা লড়াই।

       

ইতিপূর্বে শুরু হয়ে গেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর পোল্যান্ড আক্রমণ করে জার্মানি। দু-দিন পর ৩ সেপ্টেম্বর ব্রিটেন ও ফ্রান্স জার্মানির বিপক্ষে যুদ্ধ ঘোষণা করল। শুরু হয়ে গেল বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক মারণযজ্ঞ― দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। সময়ের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর অধিকাংশ শক্তিধর দেশগুলো কারণে-অকারণে সেই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। ভাগ হয়ে যায় দু'পক্ষে — মিত্রপক্ষ আর অক্ষশক্তি। ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতবর্ষও তার ব্যতিক্রম ছিল না। মিত্রপক্ষের হয়ে পুরোদস্তুর মহাযুদ্ধে জড়িয়ে গেল ব্রিটিশ ভারত। স্বাভাবিক ভাবেই যুদ্ধ চলাকালে সেনাবাহিনীর জন্য ইংল্যান্ড এই মহাযুদ্ধে প্রয়োজনীয় অধিকাংশ রসদ সংগ্রহ করত তার উপনিবেশভুক্ত দেশগুলো থেকে, বিশেষত ভারত থেকে। যুদ্ধ যত দীর্ঘায়িত হল, ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতের উপর ইংরেজদের নির্ভরতা ও দমননীতি স্বাভাবিকভাবেই তত বাড়তে থাকল। শুরু হল নিত্য নতুন আদেশ জারি। তা রূপায়ণে কঠোর হল প্রশাসন। আর এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ল দেশের যুব সম্প্রদায়ের ক্ষোভ। তার ফল স্বরূপ স্বদেশি আন্দোলনে কাতারে কাতারে যুবক ঝাঁপিয়ে পড়ল এসময়।

হলুদবাড়ি হাইস্কুলে লেখাপড়ার পাঠ আপাত মসৃণ গতিতে এগোচ্ছিল। পড়াশুনার নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে অসুবিধা হয়নি। সয়ে গেছল সবকিছু। স্কুল যাতায়াতের পথে যা কিছু সমস্যা তৈরি হত; বর্ষাকালে। একটানা সারাদিন টিপির টিপির বৃষ্টি। আকাশ জুড়ে কাজল কালো মেঘের ঘনঘটা। জলদ গম্ভীর মেঘের অবিরাম অশ্রু মোচন চলে গোটা বর্ষাকাল জুড়ে। থেকে থেকে বাজ পড়ে। গুরু গম্ভীর আওয়াজে কেঁপে ওঠে সৃষ্টি। তার সঙ্গে অবিশ্রান্ত জলের ধারা। ছেদ নেই বৃষ্টিফোঁটার টানা পতনে। মাঠ ঘাট নদী নালা খাল বিল মেঠো-রাস্তা সব জলে থৈ থৈ। যদ্দুর দৃষ্টি যায়, শুধু জল আর জল। বিলগুলো তখন সমুদ্র মনে যেত। দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশির মধ্যে জেগে থাকত এক একটি গ্রাম। পরস্পর বিচ্ছিন্ন। একাকি। যাতায়াতের সরু আলপথের দেখা নেই, সব জলের তলায়। বড় বড় বাঁধ রাস্তাগুলি জলের ওপরে মাথা তুলে নিজের অস্তিত্ব জানান দেয়। জল কমলে, বৃষ্টি আংশিক থামলে সেই সব মেঠো পথ ধরে স্কুলে যেতে-আসতে বড্ড কষ্ট। এঁটেল মাটির রাস্তা। তায় হাঁটু অব্দি কাদা। গোড়ালি কাদায় ডুবিয়ে ডুবিয়ে হাঁটতে বেশ কষ্টকর। জোরে হাঁটার জো নেই। জোরে জোরে হাঁটতে গেলে মসৃণ রাস্তায় কাদার উপর আছড়ে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা। নিতান্তই পা টিপে টিপে সামনে এগোনো ছাড়া অন্য গত্যন্তর নেই। এভাবেই কাদা ভর্তি সাড়ে তিন থেকে চার কিলোমিটার রাস্তা রাম পায়ে হেঁটে কষ্ট করে পার হত। সেজন্য অনেকটা সময় ব্যয় হয় হলুদবাড়ি হাইস্কুলে পৌঁছতে। হাতে সময় নিয়ে পিসিমার ঘর থেকে স্কুলে বের হওয়ার অভ্যেস। স্কুল ছুটির পর আবার ঘরে ফেরা। সেও এক যুদ্ধ। প্রকৃতির সঙ্গে রীতিমত যুদ্ধ করে ঘরে ফিরতে বেলা গড়িয়ে যায়। এসময় কদাচিৎ সূর্যের দেখা মেলে। সময়ের হিসেব শিকেয় উঠত। ভালোয়-মন্দে এভাবেই চলছিল সবকিছু। বাধ সাধল অন্য রকমের এক সমস্যা। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই একটার পর একটা গণ্ডগোল এসে হাজির। লেখাপড়া টিকিয়ে রাখার শিরে সংক্রান্তি। নাছোড়বান্দা এ সমস্যার সম্মুখীন আট থেকে আশি সকলে। সমস্যাটি মূলত সামাজিক। রাজনৈতিক অস্থিরতার পটভূমি। অস্থির সময়ের রেখাচিত্র। গণবিদ্রোহ।

১৯৪২ সালের আগস্ট মাস। গান্ধীজি 'ভারত ছাড়ো আন্দোলন'-এর ডাক দিয়েছেন। ব্যাস! আগুনে যেন ঘৃতাহুতি পড়ল। লক্ষ নিযুত কোটি ভারতবাসী দেশমাতৃকার শৃঙ্খল মোচনে ঝাঁপিয়ে পড়ে নির্দ্বিধায়। দেশজুড়ে চলে গণসংগ্রাম। ইতিপূর্বে দেশের যুব সম্প্রদায়ের আইডল নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ১৯৪১ সালের ১৬ জানুয়ারি তাঁর এলগিন রোডের বাড়ি থেকে হঠাৎ অন্তর্ধান হয়ে গেলেন। নিরুদ্দেশ কালে কাবুল-ইউরোপ হয়ে তিনি পৌঁছে গেলেন জাপানে। সেখানে রাসবিহারী বসু'র সাহায্যে গড়ে তুললেন আজাদ হিন্দ ফৌজ। তোজো'র জাপানি সেনার সহায়তায় যে কোনও দিন ভারত আক্রমণ করতে প্রস্তুত তাঁর বিখ্যাত ফৌজ। ১৯৪২-এর মাঝামাঝি সময়ে মোটামুটি স্পষ্ট হয়ে যায়― জাপানের সহায়তায় বিদ্রোহী সুভাষচন্দ্রের আজাদ হিন্দ ফৌজ ব্রিটিশ ভারত আক্রমণ করবে। এসময় সিঁদুরে মেঘ দেখল ইংরেজ সরকার। সরকারের আশঙ্কা― জাপবাহিনী বঙ্গোপসাগর অতিক্রম করে প্রথমে উপকূল অঞ্চলে আক্রমণ শানাবে। আক্রমণ প্রতিরোধ করতে সমগ্র মেদিনীপুর জেলায়, বিশেষ করে মেদিনীপুরের দীঘা, কাঁথি, নন্দীগ্রাম, খেজুরী, তমলুক উপকূল অঞ্চলে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করে। সরকারি নির্দেশক্রমে তমলুক ও কাঁথি উপকূল অঞ্চলকে জরুরি অঞ্চল হিসাবে চিহ্নিত করা হয় এবং ওই সব জরুরি অঞ্চলের নৌকা চলাচল ব্যবস্থা একরকম বন্ধ হয়ে যায়। জাপান যাতে যানবাহনের সুবিধা না-পায়, তা আটকাতে কোনও ব্যবস্থাতেই এতটুকু খামতি রাখেনি সরকার পক্ষ। 

নৌকার পাশাপাশি বাস, লরি, ট্রাক, লঞ্চ, এমনকি সাইকেলও অন্যত্র সরিয়ে দেওয়ার আদেশ জারি করা হয়। ১৯৪২-এর ৮ এপ্রিল জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এমন আদেশ জারি করেন যে কাঁথির উপকূল অঞ্চল, তমলুক মহকুমার নন্দীগ্রাম, খেজুরী ও ময়না থানা এবং ডেবরা থানার নৌকা ও লঞ্চ-সহ সবরকম জলযানকে তিন ঘন্টার মধ্যে ঘাটাল মহকুমার রানিচকে সরিয়ে নিয়ে যেতে হবে। অন্যথায় এই নির্দেশ মানা না-গেলে, হয় ওই সব জলযান পুড়িয়ে ফেলতে হবে নতুবা জলে ডুবিয়ে রাখতে হবে। সরকারি এই নির্দেশের কারণে বিশেষ করে গরীব মাঝি-মল্লা ও নৌকা মালিকদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। যাত্রী সাধারণের সহজ ও সুলভ জলপথ ব্যবহার বন্ধ হয়ে যায়। জলপথের পরিবহন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় নিত্য ব্যবহার্য সামগ্রী অগ্নিমূল্য হয়ে ওঠে। ফলে সাধারণ জনগণের দুর্গতি বাড়ে। 
         
স্তব্ধ হয়ে যায় জনগণের গতিবিধি। বন্ধ হয়ে গেল স্কুল কলেজ অফিস আদালত। সর্বত্র অচেনা আতঙ্ক। চাপা ভয়। অজানা আশঙ্কায় ছেলেমেয়েদের স্কুলে যাতায়াত বন্ধ। হলুদবাড়ি হাইস্কুলে কিশোর রামের লেখাপড়ার পাঠ আপাতত সমাপ্ত। সে নিজের গ্রামে ফিরে আসে। তাকে দেখে সারাদিন চিন্তাচ্ছন্ন মায়ের অস্থির মন আশ্বস্ত হয়। কিন্তু দোলাচলে দূরদর্শী বাবার হৃদয়! এক দীর্ঘ আশঙ্কার কালো মেঘ ভেসে ওঠে তাঁর চোখের সামনে। সে-মেঘ দূরে সরিয়ে রেখে কীভাবে মেধাবী ছেলের পড়াশুনার শখ পূরণ হবে— এমন ভাবনা কুরে কুরে খায় অসহায় পিতার বুক। তাঁর হৃদয়ে পাথর চাপা কষ্ট। দিনরাত মাথার মধ্যে কেবল এক চিন্তা। গ্রামগঞ্জের অবস্থা ভালো নয়। পারিপার্শ্বিক সমাজ ব্যবস্থা শিক্ষার পরিপন্থী। সমকালীন কঠোর সময় অধিকাংশ শিক্ষার্থীকে দৈনিক সাংসারিক ক্ষুন্নিবৃত্তির দিকে ঠেলে দেয়। লেখাপড়া সেখানে বিলাসিতা মনে হয়। সর্বোপরি, স্বদেশী ভাবনার মধ্যে গ্রামে পুলিশ আসে। অত্যাচারের মাত্রা বাড়ে। কশাড়িয়া গ্রামে বাস করে ছেলেকে পড়ানো কার্যত অসম্ভব। মহাভারতে পাণ্ডবগণের অজ্ঞাত বাসের মতো তাঁর রামকেও প্রত্যন্ত কোনও গাঁয়ে পাঠিয়ে দিয়ে কঠিন পরীক্ষা নিলে মন্দ কী? গণ্ডগোল বর্জিত অজ পাড়া গাঁয়ের মধ্যে লেখাপড়ায় দুদণ্ড মন বসবে। শিক্ষার  চিরাচরিত বদ্ধ খাঁচার বাইরে মুক্ত পরিবেশ শিক্ষায় গতি আনবে, পড়াশুনায় মন আগ্রহী হবে। কিন্তু কোথায় তেমন গ্রাম? যেখানে পড়াশুনার পরিবেশ পুরোদস্তুর বজায় থাকবে! কশাড়িয়া থেকে কিলোমিটার পাঁচেক দূরে পানখাই গ্রাম। সামাজিক-রাজনৈতিক কোলাহল বর্জিত সে গ্রামে নির্জনে পড়াশুনার দারুণ সুন্দর সুযোগ। খামোখা ঝুটঝামেলা নেই। গোরা সেনার অত্যাচারের‌ ভয় কম। অনেক খুঁজে এমন একখানা গ্রামের সন্ধান পেতে বেশ বেগ পেতে হয়। পাকা সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললেন প্রহ্লাদবাবু। পানখাই গ্রামে রামের নিজের মাসিমার বাড়ি। মাসিমা নিরোদা গায়েন। মাতৃসমা নিরোদা দেবীর জিম্মায় কিশোর রামকে রেখে এলেন প্রহ্লাদবাবু। বাড়িতে গৃহশিক্ষক নিয়োগ করলেন। পানখাই গ্রামের একজন শিক্ষিত যুবক শ্রী দামোদর মণ্ডল। গাঁ-গঞ্জের ছেলে ছোকরার পড়াশুনার অব্যর্থ দাওয়াই। এ হেন দামোদর মাস্টারের জিম্মায় ছেলের লেখাপড়ার যাবতীয় ভার অর্পণ করে বাড়ি ফিরে এলেন প্রহ্লাদবাবু। এখন বেশ নিশ্চিন্ত লাগছে তাঁকে। মানুষের মতো মানুষ হবে তাঁর রাম। দেশ আর দশের মুখ উজ্জ্বল করবে। দশজনের একজন নামকরা মানুষ হবে। আশায় বুক বাঁধে বাবা।
           

ইতিমধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্ব এশীয় রণাঙ্গন ক্রমশ ভারতের দিকে অগ্রসর হওয়ায় ব্রিটিশ সরকার সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। ভীত সন্ত্রস্ত ইংরেজ সরকার জাপবাহিনীকে ঠেকাতে একগুচ্ছ পরিকল্পনা গ্রহণ করে। প্রথমত, মেদিনীপুর থেকে খাদ্যশস্য সরিয়ে ফেলার উদ্দেশ্যে জেলাটিকে উদ্বৃত্ত জেলা হিসাবে ঘোষণা করে দেয়। উল্লেখ্য, জেলা থেকে সংগৃহীত খাদ্যশস্যের সিংহভাগ দানা বিহারে চালান হতে থাকে, ইংরেজ সৈন্যের প্রয়োজনে। অথচ ১৯৪১-এ অজন্মার কারণে মেদিনীপুরে এমনিতেই খাদ্যশস্যের সংকট চলছিল। যেটুকু উদ্বৃত্ত ছিল, তাও সরকার বাহাদুর অন্যত্র সরিয়ে ফেলায় মেদিনীপুরবাসী দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে। তার উপর ব্রম্ভদেশ থেকে যে বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্য অবিভক্ত বাংলাদেশে আমদানি হত, যুদ্ধের কারণে তা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেল। ফলে এসময় খাদ্যশস্যের তীব্র সংকট তৈরি হয়। দ্বিতীয়ত, খেজুরীর একটি প্রাচীন ঐতিহাসিক নিদর্শন লাইট হাউস। বাতিঘর। ১৭৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত পূর্ব ভারতের প্রথম ডাকঘরের অদূরে কাউখালী নদীর তীরে খেজুরী বন্দরে ১৮১০ সালে প্রথম তৈরি হয়েছিল লাইট হাউসটি। নব্বই ফুট উঁচু। পাঁচ তলাবিশিষ্ট লাইট হাউসের মাথায় একটি স্বয়ংক্রিয় সার্চ লাইট বসানো। সার্চ লাইট দিয়ে কাউখালী নদীর মোহনা থেকে বঙ্গোপসাগরের তেইশ কিলোমিটার দূর পর্যন্ত অটোমেটিক আলো ফেলা যায়। অত্যন্ত উজ্জ্বল সে-আলো আধখানা চাঁদের মতো অর্ধবৃত্তাকারে সমুদ্রের জলরাশির উপর ছড়িয়ে পড়ে। রাতের অন্ধকারে কখন জাহাজ আসে মোহনায়, তার খবর ক'জন রাখে? যদি শত্রুর জাহাজ হাজির হয় বঙ্গোপসাগরে, তাকে সহজেই সনাক্ত করে এটি। অথচ এ হেন বাতিঘর নিয়ে ব্রিটিশের চিন্তার অন্ত নেই। ভয় মূলত জাপানি বায়ুসেনা। বাতিঘরের অবস্থান সনাক্ত করে জাপানি বায়ুসেনার গোরা সেনাকে আঘাত হানা ঢের সহজ। এমন চিন্তায় সারাক্ষণ আচ্ছন্ন ইংরেজ। সিঁদুরে মেঘ দেখে ভয়ের শুরু। সেজন্য, ১৯৪২ সালের মাঝামাঝি সময়ে খেজুরীর সুপ্রাচীন বাতিঘর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। ডিনামাইটের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে বাতিঘর ধ্বংস করে দেয় ইংরেজ। সেদিন ডিনামাইটের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয় বন্দরের ইতিহাস। শেষ হয়ে যায় খেজুরীর একটা অধ্যায়।

গোদের উপর বিষফোঁড়ার মত মেদিনীপুরের বুকে আরও এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ এসে হাজির হয়। ১৯৪২-এর শরৎকাল। মেদিনীপুরের আকাশে তখন ছেঁড়া-পেঁজা মেঘের আনাগোনা। কাশফুল জানান দিচ্ছে হিমের পরশ মেখে শরৎ এসেছে দ্বারে। দেবী দূর্গা বোধহয় এবার মুখ তুলে তাকাবেন। মেদিনীপুরবাসীর সমস্ত দুঃখ-কষ্টের হবে অবসান। পঞ্চমী থেকে শুরু হল দেবীর আরাধনা। কিন্তু নাহ, আনন্দ বেশিদিন স্থায়ী হল না। ষষ্ঠী পেরিয়ে সপ্তমী থেকে আরও ভয়াবহ বিপর্যয় যেন অপেক্ষা করে বসে ছিল দক্ষিণবঙ্গে। ব্রিটিশ অত্যাচার ও শোষণের সঙ্গে যুগপৎ হাজির হল প্রাকৃতিক বিপর্যয়― প্রচণ্ড গতির ঘূর্ণিঝড়। উপকূলবর্তী অঞ্চলে তীব্র জলোচ্ছ্বাসের ভ্রুকুটি। উপকূলীয় জেলাসমূহে ৩২০০ বর্গমাইল অঞ্চল জুড়ে প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে সপ্তমীর সকালে। ঘূর্ণিঝড় তো নয়, যেন সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাতছানি। বালিচকের স্বাধীনতা সংগ্রামী বলাইচন্দ্র হাজরা মহাশয়ের কথায়, '১৬ই অক্টোবর, মহাসপ্তমীর দিন সকাল হইতে ঝড় শুরু হয়। সন্ধ্যা হইতে আরও প্রলয়ঙ্করী রূপ নেয় রাত্রি সাড়ে নয় ঘটিকা পর্যন্ত। ঘরবাড়ী গাছপালা সবই প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়। আধঘণ্টা বিরতির পর আবার প্রবল বর্ষণ প্রায় সারা রাত্রি চলিতে থাকে। ৭০ শতাংশ ঘরবাড়ী ধ্বংস, বাকী আংশিক নষ্ট। গবাদি মৃত্যুর হিসাব নাই। সব রকমের ফলের গাছ নির্মুল। শস্য সম্পূর্ণ বিনষ্ট। প্রকৃতির খেয়ালের কবলে পড়িয়া জীবিত মানুষগুলিও বাস্তুহারা এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ়। সরকার পক্ষও নিশ্চেষ্ট। এই দারুণ সমস্যার সম্মুখীন হওয়ার মত শক্তি সেদিন কাহারও ছিল না।'
      

কল্পনায় সারা গা শিউরে ওঠে — পানখাই গ্রামে তখন রামের কী ভয়াবহ অবস্থা চলছিল? সেদিনের কিশোর রামের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার কথা আজকের নব্বই বছর পেরোনো বৃদ্ধ রামের মানসপটে ছবির মতো ভেসে ওঠে। ভঙ্গুর অমলিন স্মৃতির উঠোনে সযত্নে লালিত সেদিনের বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতার কথা তাঁর নিজের উক্তিতে যথার্থতা পায়— '১৯৪২ সালের (১৩৪৯ - এর আশ্বিন) ভয়াবহ বন্যায় ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে কয়েক মাসের মধ্যেই সব কিছু ওলটপালট করে দিল। সকাল থেকে জলদ মেঘের ঘন বর্ষায় সূর্যের মুখ লুকিয়েছিল। দুপুরের দিকে জোয়ারের জল ফুলে ওঠে ভীষণ গর্জন করছে, বঙ্গোপসাগরের উত্তাল তরঙ্গ হুগলী (হলদী) নদীর মোহনায় আছড়ে পড়ে, তালপাটি ঘাটের পথ ধরে চুনপুড়ি খাল অস্বাভাবিকভাবে ভরে উঠতেই একজন পথচারী চিৎকার করে বলে বলে আসছিল — 'সবাই সাবধান হও। নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নাও।''
        
পথচারী লোকটির প্রসঙ্গে টেনে তিনি আরও যোগ করেন — 'তাঁর আর্তনাদের কিছুক্ষণের মধ্যেই ৩ টার দিকে ২-৩ ফুট উঁচু হয়ে জোয়ারের জলস্রোত ছম ছম করে এগিয়ে এসে সামনের পুকুরে ঢুকে ভরিয়ে দিয়ে উঠানে জমতে শুরু করায়, কাঁচা মাটির ঘরের দেওয়াল ডুবতে শুরু করলো। ততক্ষণে মেসোমশায় ও মাসীমা আমাকে নিয়ে ঘরের একটি চালার উপর আশ্রয় নিয়েছেন। মাসীমা আমাকে তাঁর পিঠের ওপর শক্ত করে ধরে খড়ের চালা আঁকড়ে রেখে ধরে রয়েছেন। বর্ষার তীব্র ছাঁট সহ্য করতে হচ্ছে। এদিকে মাটির দেওয়াল ভিজে পড়ে যেতেই খড়ের চালায় বসে বেহুলার কলার মান্দাসের মত অনির্দিষ্টভাবে ধীরে ধীরে ভাসতে ভাসতে পুকুর পাড়ের গাছে চালাটা ঠেকে গেল। সেই চালায় কয়েকজন দীর্ঘক্ষণ কাছাকাছি বসে থাকায় কোমর পর্যন্ত জলে ডুবে যাওয়ায় পা-দুটো অসাড় হতে থাকলো। আর মাথা থেকে কোমর পর্যন্ত তীব্র সূঁচের মত বৃষ্টির ছাঁট। রাত ২-৩ টার দিকে গৃহশিক্ষক দামোদরবাবু লাঠি ঠুকে জল মাপতে মাপতে এগোচ্ছেন অন্ধকারে। আর সবাইকে ডাকছেন — একটা উঁচু জায়গায় যাওয়ার পথ দেখাবার জন্য। আমরা চালা থেকে নেমে কোমর পরিমাণ জলে হেঁটে একটা উঁচু জায়গায় ধানের মরাইতে ঢুকে অন্যদের সাথে বসে গরমে রাত কাটালাম। ভোরবেলায় বেরিয়ে এসে দেখি শুধু ঢিপি, ঘরের কোন অস্তিত্ব নেই। সঞ্চিত ধন-ধান্য ইত্যাদি সবই মাটির তলায়, আর মাঠের উপর দিয়ে জলস্রোত সমুদ্রের দিকে নামছে, প্রচুর মরা গরু -ছাগল, জীবজন্তুকে সঙ্গে নিয়ে, সে এক মর্মান্তিক দৃশ্য!'

এমন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কবলে পড়ে অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার দ্রুত অবস্থার অবনতি ঘটে। ক্ষেতের আমন ধানের বিপুল ক্ষতি হয়। যেখানে যতটুকু শষ্য অক্ষত ছিল, ঘূর্ণিঝড়ের পরে তাও ধূলিসাৎ হবার জোগাড়। কারণ ফসলে ফাংগাস জাতীয় রোগের আক্রমণ শুরু হয়ে গেল। যার পরিণতিস্বরূপ ১৯৪২-এর শেষের দিকে আমন ধান সংগ্রহে ঘাটতি দেখা যায়। এর সঙ্গে বাড়তি যোগ হল কলেরা, বসন্ত-রোগ ও ম্যালেরিয়া মহামারির প্রাদুর্ভাব। 

ঠেকানো গেল না ১৯৪৩ এবং ১৯৪৪― দুই সাল জুড়ে চলা অনাহার, অর্ধাহার ও রোগ ভোগের পর মৃত্যুর মহামিছিল। গ্রামকে গ্রাম একদম নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। জনমানবহীন ধূ ধূ প্রান্তর যেন গ্রামগুলি। ১৩৫০ বঙ্গাব্দে (১৯৪৩ খ্রস্টাব্দ) ঘটে যাওয়া এ হেন দুর্ভিক্ষ-মহামারিই 'পঞ্চাশের মন্বন্তর' নামে অধিক পরিচিত। এ দুর্ভিক্ষ যত না প্রাকৃতিক বিপর্যয়জনিত, তার থেকেও বেশি মনুষ্যসৃষ্ট কৃত্রিম মহামারি। আর এর দায় এড়াতে পারে না ভারতবর্ষ শাসনরত ইংরেজরা। তাদের প্রত্যক্ষ মদতে সেদিন দুর্ভিক্ষের মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল অখণ্ড মেদিনীপুরের বুকে। (ক্রমশ...)


তথ্য সূত্র :
• প্রণম্য বৈজ্ঞানিক ড. রামচন্দ্র মণ্ডল মহাশয়
• শ্রী সুদর্শন সেন বিশিষ্ট শিক্ষক ও আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক
• 'মনীষী ড. রামচন্দ্র মণ্ডল' – সম্পাদনা শ্রী জয়দেব মাইতি ও শ্রী সুব্রতকুমার মাঝি

পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments