জ্বলদর্চি

যেতে যেতে পথে -৪৯/রোশেনারা খান

যেতে যেতে পথে
রোশেনারা খান
পর্ব ৪৯

দীপ ১০ দিনের ছুটি নিয়ে এসেছিল। তাই ফিরে গেছে। বাবলি এখন আরও দিন  কুড়ি থাকবে। ওকেও আমাদের মত একই সমস্যায় পড়তে হল। এসেছিল ডিরেক্ট হিথরো থেকে দমদম এয়ারপোর্ট। কিন্তু ফিরতে হবে ব্রেক জার্নি করে। আবার  দমদম থেকে হিথরো উড়ান বন্ধ হয়ে গেছে। ওকে দিল্লি হয়ে যেতে হবে। একা  বাচ্চা, লাগেজ নিয়ে কী ভাবে যাবে জানিনা। যাইহোক ওরা কলকাতায় একটা ফ্ল্যাট কেনার কথা ভেবেছে। তাই আমার এক খুবই পরিচিত বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ করে আমরা তিন  মা-মেয়ে পুরুলিয়া এক্সপ্রেসে কলকাতা যাচ্ছিলাম, খড়গপুর আই আই টি (IIT)র ইলেক্ট্রনিক্সের অধ্যাপিকা স্বপ্নাদির (স্বপ্না ব্যানারজি)কল পেলাম। বললেন, ‘রোশেনারা তোমার তো অনেক চেনাজানা, তুমি এমন কারো খোঁজ দিতে  পার? যিনি আবুল কালাম আজাদ সম্বন্ধে ইংলিশে একঘণ্টা বক্তব্য রাখতে  পারবেন? আজকালের মধ্যেই জানাতে হবে’। আমি তখন একটা প্রয়জনে কলকাতা যাচ্ছি।আমার সময় হবেনা বলে, অঞ্জনকে বলে স্বপ্নাদির সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিলাম। আঞ্জন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ব বিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা রাজশ্রী বসুর সঙ্গে কথা বলিয়ে দেন। পরে দেখা হতে সবপ্নাদি আমাকে বলেছিলেন উনি খুবই সুন্দর বক্তব্য রেখেছিলেন। আমাদের সংস্থার অনুষ্ঠানে ওনাকে নিয়ে আসব।এই বছরেই ১৮ ডিসেম্বর রাঙামাটির কল্যাণপীঠে আয়োজিত আমাদের একটি মহিলা সম্মেলনে উনি  এসেছলেন। এই সম্মেলনে আমিও বক্তা ছিলাম। প্রথম পরিচয়েই আমরা বন্ধু হয়ে উঠলাম। আমাকে বললেন, ‘তোমাকে চিন্তাম। তোমার বেশ  কয়েকবার টিভিতে দেখেছি। আজ সামনা সামনি আলাপ হয়ে ভাল লাগছে’।এই সম্মেলনে মিরাদিও (মিরাতুন নাহার)ছিলেন। কৃষ্ণাদিকে(কবি কৃষ্ণা বসু) এই সম্মেলনটি পরিচালনা করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।কিন্তু উনি শেষ মুহূর্তে উনি জানিয়ে দেন, আসতে পারবেন না। সারদা কল্যাণ ভাণ্ডারের অন্য একটি অনুষ্ঠানে আমিই কৃষ্ণাদিকে আনিয়েছিলাম। যাই হোক, এই সংস্থার মেম্বার নেহেরু যুব কেন্দ্রের আধিকারিক নন্দিতা ভট্টাচার্য খুব সুন্দরভাবে এই সম্মেলনটি পরিচালনা করেন
    বাবলি ইংল্যান্ড ফিরে গেছে। সকালে ফ্লাইট থাকায় আমি আর ওর বাপি আগেরদিন গিয়ে এয়ারপোর্টের কাছে ‘O2’ হোটেলে রাত্রিবাস করে ওকে পৌঁছে দিতে যাই। আমার কোল থেকে বাবলি যখন জারাকে নিয়ে নিল। আমার যেন বুকটা  খালি হয়ে গেল। কিন্তু কিছু তো করার ছিলনা।
    ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। তখন বাংলাদেশের মত এখানেও খুবই সমারোহের সঙ্গে মাতৃভাষা দিবস উৎসবের আকার নিয়েছে।রবীন্দ্রসদন চত্বরে আগেরদিন রাত থেকে শুরু হয়ে যায় নানা অনুষ্ঠানের  মাধ্যমে মাতৃভাষা দিবস পালন। আমন্ত্রণ থাকলেও যাওয়া সম্ভব হয় না। ২০ ফেব্রুয়ারি অধ্যাপক ইমানুল হক ফোন করে বলে, দিদি কলকাতা না আসতে পারলেন, তাম্রলিপ্ত কলেজে আসতে পারবেন তো? সব শুনে আমি রাজি হলে কলেজের বাংলা ও সাহিত্যের বিভাগীয় প্রধান  শ্রাবণী সিংহ রায় ফোনে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পাঁশকুঁড়া পর্যন্ত ট্রেনে যেতে হবে। স্টেশনে উনি গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করবেন। ওভার ব্রিজ দিয়ে নামার সময়ই উনি আমাকে চিনে ফেলেন। ইমানুল তার পরে এসে পৌঁছাল। আমাকে চিনতে পারা নিয়ে হাসাহাসিও হল।আমি বললাম, তুমি আমার একেবারে সঠিক বর্ণনা দিয়েছ, তাই উনি দেখেই চিনে নিয়েছেন। ইমানুল হেসে বলল, শুধু সঠিক নয়, ‘স্বটিক’ বর্ণনা দিয়েছি। তাই শুনে সবাই হাসতে শুরু করলাম। অনুষ্ঠান শেষে আমাদের মেছেদা স্টেশনে পৌঁছে দেওয়া হল। ইমানুলের ওখান থেকে ট্রেন পেতে সুবিধা হবে বলে।ওর ট্রেন আগে আসাতে, ও চলে গেল। থাকতে চেয়েছিল, আমিই চলে যেতে বললাম। মেদিনীপুর লোকাল বেশ দেরি করে এল। বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে গেল।
        বাড়ি ফিরেই একটি অচেনা নাম্বার থেকে ফোন পেলেম। আমি রোশেনারা খান, জানার পর বললেন, আমি অরুনাভ ঘোষ।রবীন্দ্রভারতী  বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্র বিজ্ঞানের বিভাগীয় প্রধান। আমরা একটি সেমিনার করতে চলেছি চারটি বিষয়ের ওপর। বিষয়গুলি হল, তৃতীয় লিঙ্গের সমস্যা, মুসলমান মহিলাদের সমস্যা, দলিত মানুষের সমস্যা ও আদিবাসী মানুষদের সমস্যা। আমরা আপনাকে ‘মুসলমান মহিলাদের সমস্যা’ নিয়ে বলার জন্য চাইছি। আরও কিছু কথা  হয়ার পর আমি সম্মতি দিলাম। ২০০৯ এর ২৩ মার্চ সোমবার দুপুর ১২ টাতে সেমিনারটি অনুষ্ঠিত হয়। আমার পক্ষে একা হাওড়া স্টেশন থেকে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় যাওয়া সম্ভব ছিল না। তাই অরুণাভ বাবু দুজন ছাত্রকে হাওড়া স্টেশনে অপেক্ষা করতে বলেচ্ছিলেন। ওরাই আমাকে ট্যাক্সিতে করে নিয়ে যায়। প্রথমে উপাচার্য করুণাসিন্ধু দাস মহাশয়ের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেওয়া হয়। তারপর অন্য একটি রুমে বসি। আমার খাওয়ার জন্য অরুণাভ বাবু ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। তখনো ক্যান্টিনে ভাত হয়নি। এদিকে রাজশ্রী এসে কয়েকজন অধ্যাপিকার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেয়। এর মধ্যে ছিলেন বাসবি চক্রবর্তী। উনি জানালেন, আমার  লেখার মাধ্যমে উনি আমাকে অনেকদিন ধরে চেনেন। উনি এবং রাজশ্রীই আমার বিষয়ে অরুণাভ বাবুকে জানিয়ে ছিলেন।
      আমার জন্য চিকেন চাউমিন নিয়ে আসা হলে আমি খুব সামান্যই মুখে দিলাম। আমি তখন একটা জিনিসই ভাবছি, এত বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে বলতে এসেছি, সবকথা  গুছিয়ে বলতে পারব তো? আমন্ত্রণ পত্রে ৪ টি বিষয়ে যারা বলবেন তাঁদের নাম যথাক্রমে রাজশ্রী মুখোপাধ্যায়(তৃতীয় লিঙ্গের সমস্যা), রোশেনারা খান(মুসলিম মহিলাদের সমস্যা), কান্তি বিশ্বাস(দলিত মানুষের সমস্যা), অরুণাভ  ঘোষ(আদিবাসী মানুষের সমস্যা), সভাপতিত্ব করবেন বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের    প্রাক্তন উপাচার্য মোহিত ভট্টাচার্য। রাজশ্রী এসেছেন এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে,কান্তি  বিশ্বাস প্রাক্তন মন্ত্রী, অরুণাভ ঘোষ অধ্যাপক, রোশেনারা খানের তেমন কোনো বিশেষ পরিচয় ছিলনা। তিনি একজন সমাজকর্মী ও লেখিকা। যাইহোক  রাজশ্রী আমাকে সঙ্গে করে সারদা ভবনে নিয়ে গেলেন। তখনো সবাই এসে পৌঁছাননি, তবে ১০ মিনিটের মধ্যে এসে গেলেন। শুরুতে রাজশ্রী বসু সঞ্চালনা করছিলেন। প্রথমেই স্বাগত ভাষণ দিলেন উপাচার্য কৃপাসিন্ধু দাস মহাশয়। এরপর মাইক্রোফোন হাতে তুলে নেন অরুণাভ ঘোষ। প্রথমে রাজশ্রী মুখোপাধ্যায় কিছুটা বেশি সময় নিয়েই বললেন। তারপর আমি আমার নির্ধারিত সময়েই বক্তব্য শেষ করলাম। আমার পর কান্তিদা, শেষে বলতে উঠলেন অরুণাভ বাবু নিজে। আমার বক্তব্য সবাই বেশ মন দিয়ে শুনছিলেন বলেই মনে হল। কারণ থেকে থেকে হাততালি পড়ছিল। প্রশ্ন-উত্তর পর্বে সবথেকে বেশি প্রশ্ন এসেছে আমার দিকে। শুধু ছাত্রছাত্রীরা নয়, কলকাতার বিভিন্ন কলেজ ও ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক  অধ্যাপিকারাও উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা জানালেন, মুসলিম মহিলাদের এত বঞ্চনা শোষণ পীড়ন ও বৈষম্যের বিষয়ে কিছুই জানতাম না। একজন অধ্যাপকের স্বামী লালবাজারে  কাজ করেন, আমাকে স্টেশনে পৌঁছে দেবার জন্য পুলিশ অফিসার স্বামীকে গাড়ি পাঠাতে বললেন(যদিও যাতায়াত খরচ বিশ্ববিদ্যালয় দিয়ে ছিল)। উনি যাবেন বর্ধমান। আরও কয়েকজন অধ্যাপিকা আমার সঙ্গে হাওড়া স্টেশন এসে যে যার পথ ধরলেন। সাম্মানিক হিসেবে ৫০০/= টাকা পেয়েছিলাম। সব মিলিয়ে ১০০০/= টাকা পেয়েছিলাম। খুব আনন্দ হয়েছিল। সে যাইহোক পরদিন রাজশ্রী বসু ফোন করে বলে, মহিত স্যার তোমার কথা বলতে গিয়ে বলছিলেন, এই অগ্নি স্ফুলিঙ্গকে কোথায় পেলে? আরও বলল, ‘কাল নিশ্চয় ফিরে যেতে তোমার খুব কষ্ট হয়েছে? আমার খুব আফসোস হচ্ছিল এই ভেবে যে কেন তোমাকে গেস্টরুমে থাকার ব্যবস্থা করে দিলাম না’! তবে আমি একা গেস্টরুমে থাকতে পারতাম না।
      পরবর্তী কালে আমি আর রাজশ্রী খুব ভাল বন্ধু হয়ে উঠেছিলাম। ও ওর সব কাজের কথা আমার সঙ্গে সেয়ার করত। একদিন মুর্শিদাবাদ জেলা ঘুরে এসে ওখানকার মহিলা বিড়ি শ্রমিকদের যন্ত্রণাময় জীবনযাত্রার কাহিনী শুনিয়ে ছিল। এরকম অনেক বিষয়ে ওর সঙ্গে আমার প্রায় কথা হত। সেই জয়শ্রীর এমন  ভয়ঙ্কর পরিণতি হবে, কেউ জানতাম না। বেশ কয়েক বছর আগের ঘটনা। রাতে টিভির  খবর চলছিল। দূর থেকে কানে এল কারা যেন লাদাখ বেড়াতে গিয়ে বরফ চাপা পড়ে মারা গেছেন। পরদিন সকালে পেপার খুলতেই প্রথম পাতার খবর রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা রাজশ্রী বসু স্বামী পুত্রের সঙ্গে লাদাখ বেড়াতে গিয়েছিলেন। সেখানে বরফের ধস নেমে ওদের গাড়ি ঢেকে দেয়। দূর থেকে কেউ দেখেছিলেন। উধারকারি দল  গাড়ি খুঁজতে খুব বেগ পেয়েছিল।  খুঁজে পাওয়ার পর গাড়ির ভিতর থেকে যখন ওঁদের বের করা হয়, তখন রাজশ্রী ও ওর ছেলের দেহে প্রাণ ছিলনা। শুধুমাত্র রাজশ্রীর স্বামী বেঁচে গিয়ে ছিলেন।
                                  ক্রমশ

 পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments