জ্বলদর্চি

খ্রিষ্টোৎসব /ভাস্করব্রত পতি

পশ্চিমবঙ্গের লৌকিক উৎসব, পর্ব - ৫২

খ্রিষ্টোৎসব

ভাস্করব্রত পতি 


বাঙালির নিজস্ব ঘরানাকে মিশ্রিত করে প্রভু যীশুকে নিয়ে পৃথক এক লৌকিক উৎসবে মেতে ওঠে বিশ্বকাপের নায়ক ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোদের দেশের বংশধরগণ। সদ্য সমাপ্ত বিশ্বকাপের গন্ধ এখনও যায়নি এঁদের মন থেকে। মেসি, মার্টিনেজ, এমবাপে, ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোদের লড়াই শেষ হলো সবেমাত্র। এতোদিন রোনাল্ডোদের হয়ে গলা কাঁপানো সেই বাঙালি পর্তুগীজরা আজ গাইবে প্রভু যীশুর বন্দনা গান। যে উৎসবে খ্রীষ্টান লোকাচারের পাশাপাশি মিশে গিয়েছে বাংলার লৌকিকতা। বাঙালির আবেগ, সৌন্দর্য এবং দিনযাপনের খুঁটিনাটি। এক অনন্য লৌকিক উৎসব খ্রীষ্টোৎসবে মেতে ওঠেন পূর্ব মেদিনীপুরের মীরপুরের বাঙালি পর্তুগীজ মানুষজন।

মীরপুরের খ্রীষ্টোৎসবে উত্তাল হয় বড়দিনের দিন। উৎসব চলে ১ লা জানুয়ারি পর্যন্ত। সাড়ম্বরে পালিত হয় প্রভু যীশুর জন্মদিন। সেদিন এখানকার প্রতিটি খ্রীষ্টান পরিবারে যীশুর মূর্তি সেজে ওঠে। আর উৎসবের ৮ দিনই এখানকার খ্রীষ্টানরা খোল নিয়ে নগর কীর্তন করতে বের হন। প্রতি বাড়ি বাড়ি যাওয়া হয়। যিনি প্রথম এই কীর্তন দল চালু করেন তাঁর নাম হল রবিনসন তেসরা। তাই বড়দিনের সময় কীর্তন দল তাঁরই বাড়ি থেকে প্রথম কীর্তন গান শুরু করেন। এই পরম্পরা চলছে চার পুরুষ ধরে। যেসময় এই কীর্তন দলের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল তখন মহামারীর প্রকোপ চলছিল। সম্ভবত সেই মহামারীর হাত থেকে মানুষকে বাঁচাতে কীর্তন গান ও কীর্তন দলের প্রচলন হয়। এই কীর্তন গানের মূল বিষয় হল যীশু বন্দনা। যীশুর জীবনের নানা দিক গানের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়। বাঙালি খ্রীষ্টানদের খ্রীষ্টোৎসব পালিত হয় এখানেই। 
মূলতঃ মীরপুরের খ্রীষ্টান বলতে রোমান ক্যাথলিক এবং প্রোটেস্ট্যান্ট বা সি. এন. আই.। একসময় বড়দিনের দিন এই দুই গোষ্ঠী একত্রে উৎসব করতেন। এখন আলাদা আলাদা করেন। আগে গেঁওখালি বাজার পর্যন্ত কীর্তন দল কীর্তন করতে আসতো। এখন অবশ্য কেবল গ্রামের মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ। আর তা হয়ে উঠেছে সর্ব ধর্মের মানুষের কাছে মিলনমেলা।

মীরপুরের খ্রীষ্টান মহিলারা হিন্দুদের মতোই শাঁখা সিঁদুর পরেন। ২৫ শে ডিসেম্বরের সময় এখানকার লোকজনেরা নতুন জামাকাপড় পরেন। তাঁদের কাছে এটি এক অনন্য উৎসব। যা বাঙালিরা দুর্গাপূজার সময় পরে থাকেন। শুধু বড়দিন নয়, মীরপুর মেতে ওঠে দুর্গাপূজা কিংবা ঈদ মহরমেও। বাঙালি যেমন সব ধর্মের উৎসবে মাতোয়ারা হয় ওঠে, মীরপুরের বাঙালি পর্তুগীজরাও তার অন্যথা হবেন কেন? অতীতেও কোনও দিন হননি। মীরপুরে দুটি গীর্জাতেই (রোমান ক্যাথলিক এবং সি.এন.আই) শ্রদ্ধায় পালিত হয় বড়দিনের উৎসব - খ্রীষ্টোৎসব। বছরের বাকি সময়েও উপাসনা করা হয় যীশুর। কিন্তু সব ক্ষেত্রেই যেন হিন্দু সংস্কৃতির ছোঁয়া মেলে সেখানে।

এখানে এখন 'মিক্সড ম্যারেজ' চালু হয়েছে। ক্যাথলিকে ক্যাথলিকে বিয়ে হলে ফর্ম আলাদা রয়েছে। বিয়ের সময় ধুতির চল ছিল। এখন নেই। বর এখন স্যুট পরেন। আগে ধুতি পাঞ্জাবি যখন পরার চল ছিল তখন মেয়ের ঘর থেকে পাত্রকে পাঞ্জাবির বোতাম (সোনার) দিতে হত। এখন গলার চেন কিংবা আংটি দিতে হয়। এখানকার পর্তুগীজরা আজ বিয়ে করছেন বাঙালি হিন্দু মহিলাকেও। ফলে তাঁদের দৈহিক অবয়বে পরিবর্তন ঘটছে। একটা মিশ্র গড়ন লক্ষ্য করা যাচ্ছে তাঁদের দেহের মধ্যে। সাগর চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, "অ্যান্টনির পূর্বজদের প্রত্যেকেরই বিবাহ বন্ধন হিন্দু বাঙালি মেয়ের সঙ্গে। নৃতত্ত্বের দৃষ্টিকোণে উত্তরসুরিদের মধ্যে ক্রমশ প্রাধান্য পেয়েছে বাঙালি আদল। মুছে গেছে পর্তুগীজ অবয়ব। আংশিক নীল চোখ আর সাহেবী উপাধিটুকু বাদ দিলে মীরপুরের পর্তুগীজরা সবাই আজ নিপাট বাঙালি"।
বিয়ের সময় মেয়েদের ১৮ বছর এবং ছেলেদের ২১ বছর হয়েছে কিনা দেখা হয়। চার্চের নিয়মে এক থেকে দেড় মাস আগে কথাবার্তা চলে। বিয়ের ফর্ম পূরণ করার পর কলকাতায় আর্চ বিশপ্ থেকে অনুমতি নিতে হয়। রবিবার দিন কোনও বিয়ের রীতি নেই। বাকি দিনগুলিতে বিয়ে হয়। বিয়ে হয় হিন্দু মতে। মালাবদল, সিঁদুর দান সবই হয়। কিন্তু কেবল পুরুত ব্রাহ্মণের বদলে চার্চের ফাদার এসব করান। ভিন্ন কাস্টের সাথেও বিয়ে হচ্ছে এখন। মৃত্যুর তিন দিনের দিন বাড়িতে প্রার্থনা ও কীর্তন হয়। এই ধর্মীয় প্রথার সাথে হিন্দুদের খোল করতাল সহ কীর্তনের সাদৃশ্য আছে। তবে মীরপুরের খ্রীষ্টানদের পৃথক কবরস্থান রয়েছে। এঁদের পোড়ানো হয়না। গ্রামের পশ্চিমপ্রান্তে ধান জমির পাশে এই কবরখানা প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। সেখানে মাটির তৈরি কবরগুলিতে মৃত ব্যক্তির মৃত্যু দিনের আগে তাঁর আত্মীয়রা ভালো করে নিকিয়ে দেন। প্রতিটি কবরে ক্রুশ চিহ্ন পোঁতা থাকে। মৃত্যুর ৪০ দিনের পর আয়োজিত হয় পারলৌকিক ক্রিয়া। সেসময় আত্মীয় স্বজন সহ যাঁরা কবর দেওয়ার সময় কাজ করছিল (হিন্দুদের পরিভাষায় বলে ‘কাঁধকেট্যা’) তাঁদের নিমন্ত্রন করে খাওয়ানো হয়। হিন্দুদের শ্রাদ্ধবাসর যেমন পালিত হয়, এ ঠিক তেমনই। বিধবারা রঙিন কাপড় পরেননা। যখন কোনও ব্যক্তি মারা যান তখন তাঁকে নতুন জামা কাপড় পরিয়ে কফিনে পুরে কবর দেওয়া হয় এক মানুষ মাপের গর্ত করে।

নবজাতক শিশুর নামকরণ হয় চার্চে এনে। জন্মের দুসপ্তাহ পরে। এখানে মা-বাবার কোনও ভূমিকা থাকে না। হিন্দুদের যেমন ষষ্ঠীপূজা বা ষেটেরা উৎসব, মীরপুরের খ্রীষ্টানদেরও তেমনই ধারার উৎসব হয় চার্চে। নামকরণের দিন বাইরের দুজনকে ধর্মপিতা ও ধর্মমাতা করা হয়। এঁদের সাক্ষী করা হয়। এসময় চার্চের ফাদার প্রশ্ন করে – ঐ ধর্মপিতা ও ধর্মমাতাকে যে, এই নতুন নামকরণ করা নবজাতক শিশুর যাবতীয় দেখাশুনা তাঁরা করবে কিনা। অর্থাৎ আসল বাবা মার বদলে এই নতুন 'বাবা-মা'কে জিজ্ঞাসা করা হয়। অনেকটা ঠিক হিন্দু ব্রাহ্মণদের পৈতে বা উপনয়নের সময় যেমন ধর্মবাবা এবং ধর্মমা-এর রীতির প্রচলন রয়েছে। এই মীরপুরে অন্নপ্রাশন বা মুখে ভাতের অনুষ্ঠান হয় জন্মের ছয় মাসের মাথায়। যেমনভাবে হিন্দুদের মুখেভাত আয়োজিত হয় তেমনই।

কিন্তু মীরপুরে পর্তুগীজ কলোনী গড়ে ওঠার নেপথ্যে ইতিহাসটা কী? সুদূর পর্তুগাল থেকে ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোদের পূর্বসুরীদের আগমন এই বাংলার বুকে ঘটলো কিভাবে? সেই ইতিহাসের কথা জানিয়েছিলেন প্রয়াত অ্যান্টনি রথা। আজ তাঁরা বাঙালি পর্তুগীজ। রক্তের মধ্যে পর্তুগীজ জাতির ছোঁয়া থাকলেও এখন তাঁরা পুরোদস্তুর বাঙালি। হিন্দু নয়, খ্রীষ্টান। কিন্তু হিন্দুদের মতোই অনেক আচার আচরণে পরিপুষ্ট তাঁদের জীবনধারা।

বাংলায় তখন বর্গী হামলা চলছে। লুঠতরাজ, হামলা, খুনোখুনি চলছে বিভিন্ন এলাকায়। মারাঠা দস্যুদের আক্রমনে গ্রামের পর গ্রাম জুড়ে তখন হাহাকার। অনবরত হত্যালীলা বাংলার গ্রাম গ্রামান্তরে। সেসময় বাংলার কোনও জমিদার বা ছোট ছোট রাজাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছিলনা এই বর্গী আক্রমন প্রতিহত করার।

বর্গী আক্রমনে দিশাহারা অবস্থা ছিল মহিষাদলের রাজ পরিবারেও। সেসময় মহিষাদলের রাণী ছিলেন জানকী দেবী। ১৭৬৯ সালে অপুত্রক অবস্থায় মারা যান আনন্দলাল উপাধ্যায়। ১৭৭০ সালে তখন মহিষাদলের রাণী হন তাঁর বিধবা স্ত্রী জানকী দেবী। তিনি অত্যন্ত কর্মকুশলী এবং মহীয়সী নারী ছিলেন। ১৮০৪ সালে (১২১১ বঙ্গাব্দ) তাঁর মৃত্যু হয়। কিন্তু তাঁর এই রাজত্বকালে (১৭৭০- ১৮০৪ খ্রীষ্টাব্দ) তিনি যে কয়টি কাজ করেছিলেন তার মধ্যে অন্যতম বর্গী দমন। তিনিই পর্তুগীজ সৈনিক নিযুক্ত করেছিলেন। সেসময় মীরপুর গ্রামটিতে তাঁদের বসবাসের জন্য এবং কৃষিকাজের জন্য নিষ্কর জমি দান করেছিলেন। অনেকে বলেন, সেসময় নাকি রাণী জানকি নিজেও যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। গড়কমলপুরে একদল বিদ্রোহী সৈন্য দ্বারা আক্রান্ত হলে রাণী জানকী নিজেই নিজের সৈন্যদের সামনে থেকে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করেছিলেন। তাড়িয়ে দেন বিদ্রোহী সেনাদের।

সেই রাণী জানকী দেবীই মাথায় প্যাঁচ কষলেন যে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে হবে। দস্যুবর্গীদের তাড়াতে হবে দস্যু পর্তুগীজদের এনে। এরকমই ঘটনা ঘটিয়েছিলেন রাজা প্রতাপাদিত্যও। মোঘলদের তাড়াতে তিনি দুর্ধর্ষ পর্তুগীজ জলদস্যু অগাস্টাস পেড্রো, ফেডেরিখ ডুডলি, ফ্রান্সিসকো রড্ডাদের এনেছিলেন। সফলও হয়েছিলেন। রাজা প্রতাপদিত্যের মতোই মহিষাদলের রানী জানকী দেবী হাত বাড়ালেন গোয়ার দিকে। সেখানকার পর্তুগীজ সরকারের কাছে আর্জি জানালেন। যদিও এখানে দ্বিমত আছে। অনেকের অভিমত যে রাণী জানকী গোয়াতে নয়, বরং হুগলীর ব্যান্ডেলে গীর্জা সংলগ্ন পর্তুগীজ ঘাঁটির প্রধানকে আর্জি জানান। কি সেই আর্জি? ঘাঁটি থেকে অবিলম্বে কিছু সমর বিশেষজ্ঞ এবং অস্ত্রবিদ্যায় পারদর্শী পর্তুগীজ যুবককে পাঠানো হোক। আমার মতে এই আর্জি জানানোর কাজটি গোয়ার তুলনায় ব্যান্ডেলে করার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। যদিও অ্যান্টনি রথা জানান, রাণীর আর্জি শুনে গোয়া দমন দিউর পর্তুগীজ সরকার এরপর পাঠিয়েছিল ১৫ জন দুর্ধর্ষ জলদস্যুকে। এঁদের মধ্যে ১২ জন এসেছিলেন মহিষাদলে রাণীর দরবারে। অ্যান্টনি রথার দাদুর বাবা সিমসেম রথা সেই ১২ জনেরই একজন।

রাজবাড়ীর প্রতিরক্ষায় নিযুক্ত হলেন সিমসেম রথা সহ আরও ১১ জন। তাঁদের সাথে যুক্ত হল শক্তিশালী অস্ত্র। বলাবাহুল্য এঁদের দাপটে বর্গীদস্যুরা ভয় পেয়েছিল। আক্রমন করার সাহস হয়ে ওঠেনি তাঁদের। রাণী জানকী এরপর খুশি হয়ে ঐ ১২ জন পর্তুগীজ জলদস্যুকে মীরপুরে ১০০ বিঘা নিষ্কর জমি দেন বসবাসের জন্য। সেই থেকে মীরপুর গ্রামে আজও রয়েছেন ঐ পর্তুগীজদের বংশধররা। মোটামুটি বলা যায় ১৭৭০ থেকে ১৮০৪ এর মধ্যে কোনও এক সময়ই এঁরা এখানে বসতি স্থাপন করেছিলেন। সেই থেকে এখানে তাঁরা শুরু করেন বাঙালি সংস্কৃতির সাথে আত্মীকরণ। যার ফলশ্রুতি এখান অন্য ধারার খ্রীষ্টোৎসব।

কিন্তু মহিষাদলের রাণী কেন এঁদের রাজবাড়ি থেকে কয়েক কিমি দূরে থাকার ব্যবস্থা করলেন? নিশ্চয় কোনও দূরভিসন্ধি ছিল। আসলে তখন গেঁওখালি হয়ে উঠেছে গুরুত্বপূর্ণ একটি বন্দর। স্বভাবতই প্রতিরক্ষার বিষয়টি অনুধাবন করেই বন্দর সংলগ্ন গ্রামে তাঁদের ঠাঁই দেওয়া হয়। এই বন্দর দিয়েই বিভিন্ন স্থান থেকে পণ্য আসতো মহিষাদল রাজার কাছে। তাই সেই বিষয়টি মাথায় এসেছিল রাণী জানকী দেবীর।
এল. এস. এস. ও ম্যালির 'বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার মিডনাপুর'-তেও মেলে এখানকার পর্তুগীজদের কথা -  "After these thanas most are found in thana Maslandpur (Mahisadal), where there is a curious colony of Christians near Geonakhali. They say that they are descendants of some Portuguese artillerymen, whom the Raja of Mahishadal imported to protect his estates from the Maratha raids. Except that, they are Christians and that some have Portuguese names, they can not be distinguished from their neighbours, indeed, in the same family one man may have a Portuguese name, such as Pedro and another a Hindu name, such as Gopal"।

মীরপুরে এলেই প্রথমে পড়বে গীর্জা। ১৯৭৫ সালে প্রতিষ্ঠিত এই রোমান চার্চটির দেখাশুনার দায়িত্ব পড়ে অমর তেসরার কাঁধে। যদিও চার্চের জন্য 'ফাদার' রয়েছেন আলাদা করে। মীরপুরে দু ধরনের খ্রীষ্টান পর্তুগীজ বসবাস করেন। যাঁরা মাদার মেরীর উপাসনা করেন তাঁরা হলেন রোমান ক্যাথলিক। এঁরা ভাটিকান সিটির পোপের অধীনে চলেন। প্রায় ৯০ টি রোমান ক্যাথলিক পরিবার এখানে আছেন। অন্যটি সি.এন. আই. বা প্রোটেস্ট্যান্ট। এঁরা আছেন প্রায় ৫০ টি পরিবার। দুটি শিবির মিলিয়ে মীরপুরে খ্রীষ্টান পর্তুগীজদের সংখ্যা প্রায় ৮০০ জন। যদিও পাশাপাশি হিন্দু পরিবারের মানুষজনও বসবাস করেছেন বহাল তবিয়তে। বাঙালীয়ানা এখন মীরপুরের পর্তুগীজদের সাথে সমর্থক। 

এখানে মিলবে যেসব পর্তুগীজ পদবি তা হল— তেসরা, রথা, লোবো, নুনিস, রোজারিও, এলারি, ডিকোস্টা, ডিক্রুস, গোমস, পেরেরা ইত্যাদি। যদিও এখন মিত্র, বিশ্বাস, মল্লিক, পাত্ররাও খ্রীষ্টান হচ্ছেন পর্তুগীজ মহিলাদের বিবাহ করে। এই 'রথা' কোনও পর্তুগীজ পদবী নয়। এটি আসলে [ROCCHHA বা 'রচা'-র অপভ্রংশ 'রতা' থেকে হয়েছে ‘রথা’। তবে পরবর্তীকালে বেশ কিছু পর্তুগীজ পদবীধারী মানুষ এখানে এসেছেন। যেমন— গোমস, ডিসুজা ইত্যাদি। মীরপুরে প্রথম যে ১২ জন পর্তুগীজ পদার্পণ করেছিলেন - তাঁদের মধ্যে কেউ এঁরা ছিলেননা।
গ্রামে ঢোকার মুখে দেওয়ালে স্পষ্ট করে লেখা আছে এখানকার পর্তুগীজদের বাঙালি হয়ে ওঠার কথা। বিদেশী সংস্কৃতির সাথে বাঙলার লৌকিক সংস্কৃতির মিশ্রনের কথা। সে ইতিহাস আজ বড়ই গৌরবজনক -- "আজ থেকে বিগত ১৭ই শতাব্দীর শুরুতে যখন মোঘল সম্রাট এবং পর্তুগীজ একত্রে বসবাস করতেন তখন এই ঘটনার সূত্রপাত। বহু খ্রীষ্টান গোয়া থেকে আসেন এবং হুগলী নদীর তীরে বসবাস করেন। মীরপুরে বহু ক্যাথলিক খ্রীষ্টান ভক্ত বসবাস করেন। যার ইতিহাস হল — একসময় মহিষাদলের রাজা। বর্গীদের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য গোয়া থেকে পর্তুগীজদের আনেন এবং জমি জায়গা দিয়ে বসবাস করার সুব্যবস্থা করেন। ১৮৩৮ সালে একজন পুরোহিত আসেন, ১০৮ পরিবারকে তাঁদের ভাষা সংস্কৃতি প্রভৃতি দেখাশোনা করেছিলেন। ১৫০ বছর আগে বহু পরজাতীয় সম্প্রদায় স্বেচ্ছায় খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ করেন। খ্রীষ্ট প্রচারকগণ বিশ্বাসীদের বিশ্বাস বৃদ্ধির জন্য ধর্মপ্রচার করেন। বর্তমানে যে ক্যাথলিক গীর্জাটি আছে তাহা শ্রদ্ধেয় ফাঃ সি. মিগনন. এস. জে. শ্রদ্ধেয় এল. টি. পিকাচি. এস. জে. (কার্ডিনাল) মহোদয়ের সম্পূর্ণ সহযোগিতায় ১৯৭৫ সালে ২০শে এপ্রিল শান্তনাদায়িনী মা মারীয়া গির্জা স্থাপিত হয়। গির্জার প্রবেশ দ্বারের সম্মুখে প্রভু যীশুর ক্রুশ আছে। রবিবার এবং অন্যান্য দিনে উপাসনা হয়। ক্যাথলিক ভক্তগণ মা মারীয়া এবং অন্যান্য সাধু সাধ্বীদের পর্ব খুবই আনন্দের সঙ্গে পালন করে থাকে। এবং শুভ বড়দিন ও পুণ্য শুক্রবার খ্রীষ্টান ভক্তগণ কীর্তন গানের মধ্য দিয়ে খ্রীষ্টকে প্রচার করে থাকে"।
এখানে হয়তো তুলসীতলা নেই। এখানে হয়তো খ্রীষ্টান লোকাচারের আতিশয্য। কিন্তু মীরপুরের পরতে পরতে বাঙালি সংস্কৃতির ছায়া। বাঙালিয়ানার আবেশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে গ্রাম জুড়ে। পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য এলাকার খ্রীষ্টান ধর্মাবলম্বীদের পালিত বড়দিনের উৎসবের তুলনায় এখানকার উৎসব অন্য ধারার। অন্য মাত্রার। যার ছত্রে ছত্রে বাঙালি হিন্দু সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটেছে। আর ইতিহাসের পাতায় তা হয়ে উঠেছে পশ্চিমবঙ্গের অনন্য লৌকিক উৎসব 'খ্রীষ্টোৎসব'।

 পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments