জ্বলদর্চি

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা--৫৪ / প্রীতম সেনগুপ্ত

পর্ব ৫৪

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা

প্রীতম সেনগুপ্ত

 ক্রন্দনরত ব্রহ্মানন্দজীর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে বিজ্ঞানানন্দজী বললেন, “মহারাজ আমি দুঃখিত, আজ আমার জন্য আপনাকে কষ্ট পেতে হল।” ব্রহ্মানন্দজী বললেন, “ভাই, তুমি আমায় বলতে পার আজ কী অন্যায় আমি করেছি যার জন্য স্বামীজীর কাছে এত কড়া কথা শুনতে হল? একেক সময় মনে হয় সবকিছু ছেড়েছুড়ে আমার পাহাড়ে চলে যাওয়া উচিত।”
 ব্রহ্মানন্দজীর ঘর থেকে ফিরে এসে স্বামীজীকে একথা জানালেন বিজ্ঞানানন্দজী যে তিনি কাঁদছেন। একথা শোনামাত্র স্বামীজী তড়িঘড়ি ব্রহ্মানন্দজীর ঘরে ছুটে গেলেন এবং সেখানে গিয়ে তাঁকে আলিঙ্গন করে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “রাজা, ভাই আমার, আমায় ক্ষমা কর। এটা আমার অন্যায়। আমার এত মাথা গরম যে তোকে যা নয় তাই বলে দিলাম। আমায় ক্ষমা কর ভাই।” ব্রহ্মানন্দজী ততক্ষণে অনেকটাই আবেগ সংবরণ করে নিয়েছেন, স্বামীজীকে কাঁদতে দেখে বিচলিত হয়ে পড়লেন। বললেন, “কী হয়েছে? তুমি আমায় বকাঝকা করেছ কারণ তুমি আমায় ভালোবাস, এই তো ব্যাপার।” তবু স্বামীজী ক্রন্দনরত অবস্থায় বলে চললেন, “ভাই আমায় ক্ষমা করে দে। ঠাকুর তোকে কত ভালোবাসতেন সে তো জানি, কোনওদিন কোনও কড়া কথা বলতেন না। আর আমি কী সব হাবিজাবি কাজের জন্য তোকে কত বাজে কথা বললাম। কষ্ট দিলাম। তোর সঙ্গে বসবাসের যোগ্য নই আমি। আমি হিমালয়ে চলে যাব, নিঃসঙ্গ দিনযাপন করব।” ব্রহ্মানন্দজী তখন বললেন, “এরকম বোল না স্বামীজী। তুমি আমাদের নেতা। তোমার তিরস্কার আমাদের কাছে আশীর্বাদ। আমাদের ছেড়ে কোথাও যেতে পার না তুমি। তোমাকে ছাড়া আমরা কাজ করব কী করে?” এইভাবে ধীরে ধীরে দুই গুরুভ্রাতা শান্ত হলেন। 
 এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তী সময়ে বিজ্ঞানানন্দজী মন্তব্য করেছিলেন, “জীবনে সেই দৃশ্য আমি ভুলতে পারব না। স্বামীজীকে এমনভাবে কোনওদিন কাঁদতে দেখিনি। তাঁদের মধ্যে কেমন ভালোবাসার সুদৃঢ় বন্ধন ছিল! গুরুভাইদের মায়ের মতো স্নেহ করতেন স্বামীজী। সেজন্য তাঁদের কোনওরকম ত্রুটিবিচ্যুতি সহ্য করতে পারতেন না। তিনি চাইতেন তাঁরা সকলেই তাঁর মতোই বড় হোক,এমনকী তাঁকেও ছাপিয়ে যাক। তাঁর ভালোবাসা ছিল অতুলনীয়।”
 এক প্রবল গ্রীষ্মের দিনে বেলুড় মঠে গঙ্গার ধারে বাঁধ নির্মাণের কাজ দেখাশোনা করার সময় বিজ্ঞানানন্দজী প্লবল তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়লেন। তিনি লক্ষ্য করেছিলেন স্বামীজী তাঁর ঘরের উপরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ঠাণ্ডা সরবত পান করছেন। কিছুক্ষণ পরে স্বামীজীর এক সেবক একটি গ্লাস নিয়ে এসে বিজ্ঞানানন্দজীকে বললেন, “স্বামীজী আপনার জন্য এই ঠাণ্ডা সরবত পাঠিয়ে দিয়েছেন।” বিজ্ঞানানন্দজী গ্লাসটি হাতে নিয়ে দেখলেন গ্লাসের একেবারে তলদেশে কয়েক ফোঁটা সরবত অবশিষ্ট আছে। তিনি রীতিমতো হতাশ হলেন এবং স্বামীজীর এই রসিকতা বাস্তবিকই বিরক্তি উদ্রেক করল তাঁর মনে। যাই হোক, প্রসাদ বিবেচনা করে সেই কয়েক ফোঁটা সরবতই পান করলেন এবং আশ্চর্যজনকভাবে তাঁর তৃষ্ণা নিমেষেই প্রশমিত হয়ে গেল! হতবাক হয়ে গেলেন। সন্ধেবেলায় স্বামীজী স্মিত হেসে তাঁকে বললেন, “ঠাণ্ডা সরবত পান করেছিলি?” “হ্যাঁ, পান করেছিলাম”, বিজ্ঞানানন্দজী উত্তর দিলেন। পান করার পর তাঁর কী অভিজ্ঞতা হয়েছিল সেটিও স্বামীজীকে জানালেন। সব শুনে স্বামীজী প্রীত হলেন।
 বেলুড় মঠে স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গে কাটানো সেই দিনগুলির কথা স্মরণ করেছেন বিজ্ঞানানন্দজী বারংবার। স্মরণ করতে গিয়ে বলেছেন -- “স্বামীজী আমাকে আদর করে ‘পেসন’ ( হরিপ্রসন্ন-র সংক্ষিপ্ত রূপ ) বলে ডাকতেন। একদিন বেলুড় মঠে উপরের বারান্দায় বসে মুড়ি খাচ্ছিলাম। সেই সময় স্বামীজী সেখান দিয়ে যাচ্ছিলেন। হঠাৎই আমার বাটি থেকে একমুঠো মুড়ি তুলে নিয়ে একেবারে বালকের মতো খেতে শুরু করে দিলেন। প্রবল আপত্তি জানিয়ে বললাম -- স্বামীজী অন্য একটি বাটিতে মুড়ি না নিয়ে আমার এঁটো মুড়ি নিয়ে আমাকে দোষের ভাগী করলেন কেন?” একথা শুনে স্বামীজী হাসতে হাসতে চলে গেলেন।
 আমার নস্য নেওয়ার অভ্যাস ছিল। একবার স্বামীজী কলকাতা থেকে আমার জন্য প্যাকেটে করে নস্য কিনে নিয়ে এলেন। প্যাকেটটি আমার হাতে দিয়ে বললেন, এটায় তোর জন্য চমৎকার উপহার এনেছি। প্যাকেটটি খুলে দেখি নস্য। আমাকে খুশি দেখে তিনিও খুশি। কিন্তু তিনি যখন গম্ভীর হয়ে থাকতেন তখন তাঁর কাছে ঘেঁষবার সাহস হত না। একমাত্র রাজা মহারাজ ( স্বামী ব্রহ্মানন্দ ) তাঁকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে পারতেন।”
 বেলুড় মঠে স্বামীজীর ঘর সংলগ্ন একটি ছোট ঘরে থাকতেন বিজ্ঞানানন্দজী। একদিন রাত দু'টোর সময় স্বামীজীকে দ্রুত পশ্চিমের বারান্দার দিকে যেতে দেখলেন। তিনি তাড়াতাড়ি ঘুম থেক উঠে স্বামীজীর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কেন তিনি ঘুমোতে পারছেন না। স্বামীজী উত্তর দিলেন, “দেখ পেসন, আমি চমৎকার ঘুমোচ্ছিলাম, কিন্তু হঠাৎই একটা প্রবল ঝাঁকুনিতে ঘুম ভেঙে গেল। মনে হচ্ছে কোথাও ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা হয়েছে এবং বহু মানুষ বিপন্ন হয়ে পড়েছে।” সেদিন রাত্রে স্বামীজীর এই কথার অর্থ অনুধাবন করতে পারলেন না বিজ্ঞানানন্দজী। পরদিন সকালে উঠে তাঁর অভিজ্ঞতা বিষয়ে বললেন --“পরদিন সকালে খবরের কাগজে দেখলাম, স্বামীজী রাতে যে সময়ে উঠে পড়েছিলেন ঠিক তখনই ফিজি দ্বীপপুঞ্জের কাছে আগ্নেয়গিরির ভয়ঙ্কর অগ্ন্যুৎপাতে বহু মানুষ নিহত হয়েছে। এই সংবাদ পাঠ করে বিস্ময়াভিভূত হয়ে পড়ি। বুঝলাম স্বামীজীর স্নায়ুতন্ত্র মানুষের দুঃখকষ্টে সিসমোগ্রাফ যন্ত্রের চেয়েও অধিকতর সংবেদনশীল!”
 আরেকদিনের ঘটনা। বেলুড় মঠে মাঝরাতে স্বামীজীর ঘর থেকে আর্ত ক্রন্দন শুনতে পেলেন বিজ্ঞানানন্দজী। ভাবলেন স্বামীজী বোধহয় অসুস্থতার কারণে এইরকম কাঁদছেন। স্বামীজীর ঘরে নীরবে ঢুকে জিজ্ঞেস করলেন, “স্বামীজী আপনি ভালো আছেন তো?” সঙ্গে সঙ্গে স্বামীজী কান্না থামিয়ে বললেন, “ও পেসন তুই, ভাবলাম ঘুমিয়ে পড়েছিস।” কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করলে অশ্রুপূর্ণ নয়নে স্বামীজী উত্তর দিলেন, “মানুষের দারিদ্র দুঃখকষ্টের কথা ভেবে আমি ঘুমোতে পারছিলাম না। আমার মন দুঃখে কাতর হয়ে উঠেছে। ঠাকুরের কাছে তাই প্রার্থনা করছিলুম, আমাদের দেশের মানুষের দুঃখকষ্ট নিবারণ কর, তাদের মঙ্গল কর।” বিজ্ঞানানন্দজী স্বামীজীকে সহানুভূতি জানিয়ে শুয়ে পড়তে বললেন। সেদিন রাতের এই ঘটনা তাঁর মনে গভীর রেখাপাত করল। দেশের মানুষের দুঃখকষ্টে স্বামীজীর প্রাণ কীভাবে কাঁদত!
 
পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments