আমি আমার মতো
পর্ব ৩
সুকন্যা সাহা
গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু
খুব ছোটো বেলা থেকেই আমি গান শুনি। একেবারে যাকে বলে গানের পোকা । সব ধরণের গান । রবীন্দ্র সংগীত থেকে হাল আমলের হিন্দি ফিল্মের গান পর্যন্ত্। গান শোনার এই অভ্যাস বাবার কাছ থেকে পাওয়া ; আমাদের ছোটোবেলায় রেকর্ড প্লেয়ার দেখেছি ... চাকতির মতো গোল গোল রেকর্ড , মাঝখানটা লাল , বাইরের দিকটা কালো । একটা খামের মতো মোটা কাগজে প্যাকেজিং ... রের্কড কোম্পানি ... HMV , His Masters Voice ... সঙ্গে একটা কুকুরের লোগো । বেশির ভাগ রেকর্ডই ছিল হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আর সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের । বাবার দুই প্রিয় শিল্পী। রেকর্ড প্লেয়ারটা রাখা থাকত আলমারির একেবারে শেষ তাকে কোনার দিকে ।বাবা মাঝে মাঝেই গাইতেন ... কেন দূরে থাকো শুধু আড়াল রাখো... বা আর কত দূর বল মা ...বেশ ভালো গলা ছিল অল্প বয়েসে ... উদাত্ত , দরাজ । আমাদের ছোটোবেলায় তখন খুব লোডশেডিং হত ... খোলা ছাদে মাদুর পেতে বসে কত রাতে যে বাবার গলায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান শুনেছি ইয়ত্তা নেই ...তখন আশে পাশের ফ্ল্যাট বাড়ি গুলো তৈরী হয় নি আর এভাবে ছাদ আর তার মাথার তারা ভরা আকাশটাও এভাবে বেদখল হয়ে যায় নি । হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আর সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় তখন বাংলা ছায়াছবির হিট সঙ্গীতময় জুটি। টিভিতে উত্তম সুচিত্রাএ সাদা কালো সিনেমা আর হেমন্ত -সন্ধ্যা জুটির অনবদ্য প্লেব্যাক। বাংলা সঙ্গীতের সে এক স্বর্নযুগ। ক্লাস এইট কি নাইন তখন। পড়ার ফাঁকে জল খাওয়ার ছুতোয় হাঁ করে গিলতাম উত্তম সুচিত্রার ছবির অংশবিশেষ। মা বলতেন , আজকাল জলও কি চিবিয়ে চিবিয়ে খেতে হয় ? খুব কষ্ট লাগত তখন ... অভিমানে দু চোখ উপচে জল আসত ... আজকের জেনারেশানের যথেচ্ছাচার দেখে মনে হয় আমরা,বাবা মা রা, কতখানি সহনশীল হয়ে গেছি !
অনেক বড় বয়েসে গ্র্যাজুয়েশানের সময় হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান শিখতে শুরু করি । আমার গানের শিক্ষাগুরু শ্রীমতি শিবানী বক্সি । আমি বুবুন পিসি বলেই ডাকতাম ।নাম শুনেই বুঝতে পারছেন সম্পর্কটা ছিল আদর আর আবদারের। তবে রেওয়াজে ফাঁকি দিতাম না কোনোদিন। মূলতঃ ক্লাসিক্যাল শিখলেও রোজই নজরুল গীতি আর আধুনিক গানের চর্চা চলত ।প্রতিটা গান হারমোনিয়ামে বাজিয়ে তুলতাম । তারপর দীর্ঘদিনের বিরতি আর অনভ্যাস । ভুলতেই বসেছি এখন যে একসময় কঠিন কঠিন রাগ সংগীতগুলি গলায় তুলে ফেলতাম অনায়াসেই।
মনে আছে মাধ্যমিকে স্টার মার্কস পেয়ে একটা উপহার চেয়েছিলাম বাবার কাছে ... কিনেও দিয়েছিলেন , একটা সাউন্ড সিস্টেম , স্টিরিও । প্রচুর ক্যাসেট ছিল , একটা ছোটো মিটসেফ ভর্তি । সাতটা volumeএ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গানের অখন্ড collection... “আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে”... লতামঙ্গেশকর , আশা ভোঁসলের , শ্রদ্ধাঞ্জলি প্রথম ক্যাসেটেই শোনা । মনে আছে চাকরি পেয়ে প্রথম মাসের মাইনে দিয়ে কিনেছিলাম ডি ভি ডি প্লেয়ার ... সোনি কোম্পানির । ক্যাসেট ছাড়িয়ে তখন সিডি র যুগ । নিয়মিত শুনতাম মান্না দে ... ও কোকিলা তোরে শুধাই রে ... যদি কাগজে লেখো নাম ...এখনও জীবনের সব অনুভূতিতে গানই একমাত্র বিশ্বস্ত সঙ্গী । এখন মুঠোফোন আর ইউ টিউবের দৌলতে রাস্তায় ঘাটে চলতে ফিরতে সব সময় ইচ্ছে করলেই যে কোনো গান হাতের মুঠোয় ... আগে কিন্তু গান শোনার একটা ambience তৈরী করতে হত ...বাইরে ঝড় বৃষ্টি , এলো মেলো হাওয়া দিচ্ছে বসার ঘরে জ্বলছে হালকা নীল আলো ... স্টিরিও তে বাজছে একের পর এক জগজিত সিং জির গজল ...
একেক দিন এমন হয় সকাল থেকেই একটা গান আমায় পেয়ে বসে , একটা সুর , একটা কলি গুন গুন ভাঁজতে থাকে মাথার মধ্যে ... বুঝতে পারি আজ এই গানটা আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকবে ... সারাদিন । ঘুম থেকে উঠে ওই গানটা আমায় শুনতেই হবে। না হলে নিস্তার নেই ...সারাদিন সব কাজের ফাঁকে গানটা ফিরে ফিরে আসতে থাকে কেবলিই ...
(ক্রমশঃ)
2 Comments
বাঃ খুব স্বতঃস্ফূর্ত লেখা। এগিয়ে চলো
ReplyDeleteThank u di
ReplyDelete