জ্বলদর্চি

যেতে যেতে পথে /রোশেনারা খান /পর্ব ৪৮

যেতে যেতে পথে
রোশেনারা খান
পর্ব ৪৮

আমার শাশুড়িমা বলতেন, মানুষ পাখির জাত, আজ এখানে তো কাল সেখানে। ভেবে দেখলে সত্যিই তাই, পাখি ছাড়া একমাত্র মানুষই পারে এক দেশ থেকে আর এক দেশ উড়ে যেতে বা পাড়ি দিতে। আগামিকাল দুপুরে হিথরো রওনা হব। জাভেদই আমাদের নিয়ে জাবে।আজ সকাল থেকেই ওয়েদার খারাপ, তবে সকালের দিকে বৃষ্টি ছিলনা। তাই দুজনে জিপসি মার্কেট গেছলাম। গ্রীসের তৈরি ২৪ ক্যারেট সোনার জলে অপূর্ব নক্সা আঁকা একটি প্লেট কিনেছি।

            আজ বিশেষ কিছু রান্না করতে হবে না। গতকালের রান্না করা মাংস রয়েছে।চিংড়িমাছ আলু বেগুন দিয়ে করলাম,আর বিনভাজা। বিকেলে বনির মাসি পাটিসাপটা বানিয়ে এনেছিলেন। ভদ্রমহিলা খুব হাসিখুশি, মিশুকে। আজ জারা কিছুতেই বিছানায় শুতে চাইছেনা। জানিনা বাবলি ওকে একা সামলাবে কী করে? শুধু তো বাচ্চা সামলানো নয়। সংসারের অন্যান্য কাজও তো রয়েছে। মেয়েটার খুব কষ্ট হবে। এসব ভেবে মন আরও খারাপ লাগছে।শাড়ির আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে এটা সেটা করে চলেছি। কিছু ভাল লাগছে না।কিন্তু ফিরতে তো হবেই। এদেশে জানলাম ‘ব্রিটিশ কালচার’ কাকে বলে। আরও অনেক কিছুই দেখলাম জানলাম।

    আজ সেই দেশে ফেরার দিন।দুপুরে জাভেদের গাড়িতে নটিংহাম থেকে হিথরো এয়ারপোর্ট রওনা হলাম। দেশে ফেরার আনন্দকে ম্লান করে দিয়েছে বিচ্ছেদ বেদনা। মেয়ে-জামাইকে ছেড়ে যাওয়ার থেকে শতগুণ বেশি কষ্ট হচ্ছে আমার অতি আদরের নাতনি জারা সোনাকে ছেড়ে যেতে। জন্ম থেকে ও মা আর নানিকেই বেশি চেনে। সিঁড়ি থেকে আওয়াজ দিলে ওর চিৎকার থেমে যায়। প্রতিদিন সকালে ওর হাসিমুখ দেখার জন্য ওর ঘুম ভাঙ্গার অপেক্ষায় থাকতাম। হয়ত আরও কয়েকটা দিন থাকা যেত,তাতে কষ্টটা কয়েকদিন পরে পেতাম, এটুকুই। বাবলি একদিন বলছিল, জানো মা, মনে হচ্ছে তোমরা প্রথম থেকেই আমাদের সঙ্গে আছ। তোমরা তো বছরের ছ’মাস এখানে থাকতেই পার। অর্ধেকটা প্রাণ যে রেখে এসেছি। সে যে মা ছাড়া কিছু বোঝে না। তার বিয়ে দিয়ে, সংসার গুছিয়ে দিতে না পারা পর্যন্ত শান্তি নেই। আজ খুব ভোরে উঠে মাছের ঝোল, একটা সবজি আর ভাত করেছি। নিজেদের জন্য পরটা আলুভাজা করেছি, সঙ্গে নেওয়ার জন্য।আছাড়াও বিস্কুট, চিপস, ফল আর ফ্রুটজুস নিয়েছি। দীপ সকালে বেরিয়ে হাসপাতালে এক রাউণ্ড দিয়ে এসেছে। আবার লাঞ্চ করে একটার সময় বেরিয়ে গেছে। খান সাহেবকে আগেই খাইয়ে দিয়েছিলাম। বাবলি খেতে চাইল না। আমি একটুখানি খেলাম।খাব কী? বুক ঠেলে কান্না আসছিল। এখনও একই অবস্থা।
      একসময় হিথরো এয়ারপোর্টে পৌঁছালাম। জাভেদকে বল্লাম, ওদের যেন খোঁজখবর রাখে। ৬ নাম্বার গেটের বাইরে বসে রইলাম।অনেকেই বসে আছেন। গেট খুলতে ভিতরে গিয়ে বসলাম। চারিদিকে তাকিয়ে দেখছি,কত রকমের মানুষ। গায়ের রং, ভাষা, পোশাক, সবকিছুর মধ্যেই পার্থক্য রয়েছে। এই ভিন্নতা বিভিন্ন দেশ ও ধর্মকে চিনিয়ে দিচ্ছে। মেশিনে সমস্যা হওয়ার কারনে চেক ইন শুরু হয়নি।মানুষ বিরক্ত হয়ে উঠেছে। শেষ পর্যন্ত চেকইন সুরু হল। সবকিছু হয়েগেলে আমরা ওপরে গিয়ে বসলাম। সম্ভবত রাত ৯ টায় ফ্লাইটে ঢুকে বসলাম। একসময় ফ্লাইট রানওয়েতে ছুটতে ছুটতে উড়তে শুরু করল। আমার উইন্ডসাইড সিট, বাইরে  অন্ধকারের  ওপর আলো ঝিকমিক করছে। একসময় চারিদিক অন্ধকারে ঢেকে গেল। এয়ারহোস্টেস ডিনারের আগে কিছু হাল্কা খাবার পরিবেশন করে গেছে। ডিনারের পর কে  জেগে, কে ঘুমিয়ে বোঝা যাচ্ছে না।কারণ ভিতরেও এখন অন্ধকার, লাইট অফ করে দেওয়া হয়েছে। খান সাহেবও ঘুমিয়ে পড়েছেন। কিন্তু আমার ঘুম আসছে না। মেয়ে, নাতনি, ওদের সবার কথা ভাবতে ভাবতে কখন  যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানিনা।
      মুম্বাই পৌঁছালাম সম্ভবত পরদিন সকাল ১০ টাতে। ইন্টার ন্যা্শানল  থেকে ডোমেস্টিক এ বাসে করে নিয়ে এলে আমরা ভিতরে ঢুকে পরলাম। কিন্তু জানতাম না আমাদের আর বাইরে বের হতে দেওয়া যাবে না। ভিতরে খাবারের অসম্ভব দাম, তাই কিনে খেতে বাধ্য হলাম। সেইসময়(২০০৮) এক লিটার জলের দাম নিয়ে ছিল ৬০ টাকা। যাইহোক অনেকটা সময় ওখানে বসে কাটাতে হল। সম্ভবত দুই বা তিনটের সময় আমাদের ফ্লাইট ছিল। সিকিউরিটি চেকের সময় এমন একটি ঝামেলা বাধল যা মনে হলে আজও হাসি পায়। আমার সামনে খান সাহেব ছিলেন, ওনার নির্বিঘ্নে হয়ে গেল। গোল বাধল  আমার হ্যান্ড ব্যাগ এক্সরে মেশিনে  ঢুকিয়েই বের করে দিয়েছে,ব্যাগে নাকি লাইটার আছে। যে মেয়েটি সাহায্য করছিল, সে এবং আমি দুজনের মধ্যে কেউই ব্যাগে লাইটার খুঁজে পেলাম না। আমি বেশ রাগের সঙ্গেই বলছি, আমি কি সিগারেট খাই যে আমার ব্যাগে লাইটার থাকবে? কিন্তু আবার এক্সরে করে লাইটার দেখা যাচ্ছে দেখে ব্যাগটা ছুঁড়ে দিতে ট্রেতে না পড়ে মেঝেতে পড়ে, চেন খোলা ছিল, লাইটার ছিটকে বেরিয়ে আসে। আমি অপ্রস্তুত! খুব রাগ হচ্ছিল খান সাহেবের ওপর। আসলে স্কটল্যান্ড বেড়াতে গেছলাম যখন, তখন উনি আমার ব্যাগে ওটা রেখেছিলেন। পরে আর খোঁজ করেননি। তবে আমি আশ্চর্য হয়েছিলাম আই ভেবে, হিথরো এয়ারপোর্টে সিকিউরিটি চেকের সময় কেন ধরা পরল না!

      দমদম এয়ারপোর্টে আমার ভাই মনি এসেছিল। তখন দিনের আলো নিভে গিয়েছে। আমরা ট্যাক্সি করে বেহালার ভাড়া বাড়িতে গিয়ে রাতে থাকলাম।সকালে হাওড়া স্টেশনে এসে মেদিনীপুর লোকাল ধরলাম। বকুল স্টেশনে অপেক্ষা করছিল আমাদের জন্য। প্রায় ৫ মাস পর বাড়ি ফিরলাম। কয়েকদিন আগে বোন এসে কাজের মেয়েকে দিয়ে ঘরদোর, বিছানা-বালিশ, বাসনপত্র সব পরিস্কার করিয়ে রেখেছিল। ঘুমের টাইম এডজাস্ট করতে কয়েকদিন সময় লাগল। একের পর এক সব দেখা করতে আসছে, সবার জন্যই কিছু না কিছু এনেছি, গিফট পেলে কে না খুশি হয়? আবার ফরেনে জিনিস হলে তো কথা নেই, ওরাও তাই খুব খুশি হল। আমিও ধিরে ধিরে আমার পুরনো রুটিনের খোপে নিজেকে সাজিয়ে নিতে লাগলাম।

      প্রায় দিনই বাবলির সঙ্গে কথা হয়, বেশিরভাগ কথাই জারাকে নিয়ে। ওরা অক্টোবরে আসবে সেইসময় জারার মুখেভাত হবে মামাবাড়িতে। একদিকে তার প্রস্তুতি নিতে শুরু করলাম। জারার জন্য সোনার চেন বানালাম। একভরি সোনার দাম ১৩০০০/=টাকা। বকুল আংটি কেনার জন্য টাকা দিল। আর একদিকে ভ্রমণ কাহিনী লেখায় মন দিলাম। আর একটা কথা বলা হয়নি। যেদিন বাড়ি পৌঁছালাম, সেদিন দুপুরে ল্যান্ডফোনে একটা কল এল। আমিই কল রিসিভ করলাম। ওপ্রান্ত থেকে এক ভদ্রলোকের কণ্ঠস্বর ভেসে এল, আমি রোশেনারা জানার পর বললেন আমি সাংবাদিক অঞ্জন মুখারজি বলছি। আমাকে চেনেন? বললাম, কেন চিনব না? আপনার সঙ্গে টিভিতে প্রোগ্রাম করেছি!- তিনি তো অঞ্জন ব্যানারজি। আমি কলকাতা দূরদর্শনের সাংবাদিক অঞ্জন মুখারজি। আজকাল’ এর অফিস থেকে আপনার নাম্বার পেয়েছি। দূরদর্শনে নির্যাতিত পুরুষদের নিয়ে একটা প্রোগ্রাম করতে চাই। সেই প্রোগ্রামে আপনাকে চাইছি। আমি রাজি হলাম না। তবে ওনার সঙ্গে যোগাযোগ রইল। পরে আমি ওনাকে পুজোর সময় একটি নতুন প্রোগ্রামের আইডিয়া দিয়েছিলাম। সেটা হল, বাঙ্গালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপুজো, এই উৎসব অন্য সম্প্রদায়ের মানুষ কিভাবে উপভোগ করে? উনি অংশগ্রহণ করার জন্য আমাকে কলকাতা যেতে বলেছিলেন, কিন্তু তখন আমার পক্ষে জাওয়া সম্ভব হয়নি।  কলকাতারই কয়েকজন মুসলিম ছেলেমেয়েদের নিয়ে উনি অনুষ্ঠানটি করেছিলেন।
    অক্টোবরে মেয়ে,জামাই ও নাতনি এসে পৌঁছাল। প্রতিবারের মত এবারেও আমাদের গাড়ি এয়ারপোর্ট থেকে ওদের নিয়ে আসে।দুটি পরিবারের মধ্যে যে দূরত্ব ছিল, জারার আগমন সেখানে সেতু রচনা করল। আমাদের বাড়িতেই জারার মুখে ভাত দেওয়া হল। আমন্ত্রিত আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের আপ্যায়ন করার ব্যবস্থা হল ‘গ্রিন প্যালেসে। দীপের বাড়ি থেকে জারার গ্র্যান্ডমা ছাড়া সবাই এসেছিলেন। এর আগে অবশ্য জারা ওবাড়িতে দু’দিন কাটিয়ে এসেছে।
                                      ক্রমশ

 পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments