জ্বলদর্চি

পঞ্চক ব্রত /ভাস্করব্রত পতি

পশ্চিমবঙ্গের লৌকিক উৎসব, পর্ব -- ৪৯

পঞ্চক ব্রত

ভাস্করব্রত পতি 

ওড়িশার পুরীর জগন্নাথদেবের মন্দিরের প্রধান সেবকের কন্যা রাই নিজের মনে প্রভু শ্রীজগন্নাথ দেবকে তাঁর পতি রূপে স্বীকার করে নেয়। তেমনি শ্রীজগন্নাথদেবও প্রীতচিত্তে রাইকে বিয়ে করেন। কিন্তু রাই উপেক্ষিতা হন। স্ত্রীর সম্মান থেকে বঞ্চিত হন। তখন রাই জগন্নাথদেবের প্রধান স্ত্রী লক্ষ্মী দেবীকে সেবাযত্নে তুষ্ট করলে লক্ষ্মীদেবী রাইকে পাঁচদিনের জন্য নিজের সঙ্গে পূজিতা হওয়ার বরদান করেন। কার্তিকী শুক্লা একাদশী তথা উত্থান একাদশী থেকে কার্তিকী পূর্ণিমা পর্যন্ত এই পাঁচদিন ধরে পূজিতা হন। টানা পাঁচদিন ব্যাপী পূজা হয় বলেই 'পঞ্চক ব্রত'। 

প্রথমত, পঞ্চ তথা পঞ্চপরিমাণ। পাণিনি লিখেছেন, “পঞ্চকাঃ শকুনয়ঃ"।
পঞ্চক বিণ [ পঞ্চন্ + ক ( কন্ ) ] 
দ্বিতীয়ত, পঞ্চ দ্বারা ক্রীত। তৃতীয়ত, প্রতি শতে দেয় পঞ্চবৃদ্ধিযুক্ত (শতকরা পাঁচ টাকা সুদ সহিত)। মনুসংহিতা অনুসারে, “পঞ্চকঞ্চ শতম্"। চতুর্থত বলা যায়, পঞ্চাংশযুক্ত বা পঞ্চবেতনযুক্ত হল 'পঞ্চক'। এক কথায় পঞ্চের বর্গ বা সমবায় হল 'পঞ্চক'। গ্রামবাসীর মঙ্গল কামনায় কোনো পর্যায় বা পালা হল 'পঞ্চক'। কাশীদাসী মহাভারতে পাই, "কালিকার ভোজ্য যার আছিল পঞ্চক। / সেই সে জানিবে ইহা বকের অন্তক"। আবার বিজয় পণ্ডিতের মহাভারতে পাই, "বার বৎসর অন্তে পঞ্চক একবার"। কোথাও কোথাও রাজা বা জমিদারগণ নিজেদের মালিকানার চিহ্নস্বরূপ যে অল্প পরিমাণ জমি বিলি করেন, সেই করকে বলা হয় 'পঞ্চক'। অর্থাৎ পঞ্চকী জমি বা খুব কম পরিমাণ করের জমি বা জাইগির আয়েমা। কবিকঙ্কন চণ্ডীতে পাই, “পার্ব্বণী পঞ্চক যত (না লইব)"। তবে পঞ্চক ব্রত হলো পাঁচ সংখ্যার নিয়মকানুন মেনে চলা। কোথাও কোথাও ব্রতের শেষদিন পাঁচটি কড়ি নিয়ে কড়িখেলা হয়। এই কড়িখেলার 
বিষয় উল্লিখিত আছে ছড়ায় -- "এ বিপদে কর পার / দুধ গুড় দিয়ে খাও / দামোদর কাই পাইবি। / পদরী গাছের ভড়া / তোগর ঘিঅ কে নিলা / বালিকা পুজিতে গেলা। / তোগর কদলী কে নেলা বালিকা পুজিতে গেলা"। আর কড়িখেলার সময়ে গাওয়া হয় - "এক মুঠা ভৌ (কড়ি) পড়িলা কৃষ্ণ জিনি ন পারিলে রাধিকা / কৃষ্ণ হইলে ধন্ধা / মুকুট রাখিলে বন্ধা। / কৃষ্ণ হইলে বন্ধা। / তিন মুঠা জৌ পড়িলা / নিজে রহিলা বন্ধা / জিনি না পারিলে রাধিকা"। এই উৎসব ভীষ্মপঞ্চক, বিষ্ণুপঞ্চক এবং বকপঞ্চক নামেও পরিচিত। 

যখন শরশয্যাতে শুয়ে আছেন ভীষ্ম, তখন একদিন তাঁর তেষ্টা পায় খুব। সেদিনটি ছিল কার্তিকী শুক্লা একাদশী তিথি। তখন অর্জুন তীরনিক্ষেপ করে পাতাল থেকে গঙ্গার জল এনে ভীষ্মের তৃষ্ণা নিবারণ করেন। সেসময় কৃষ্ণ জানান, যে ব্যক্তি সেইদিন থেকে পূর্ণিমা পর্যন্ত পাঁচদিন ধরে ভীষ্মকে জলদান করবে সে আসলে পক্ষান্তরে শ্রীকৃষ্ণ তথা বাসুদেবকেই তৃপ্তি দেবে। তাই এই পঞ্চক ব্রতকে ভীষ্মপঞ্চকও বলে। পদ্মাপুরাণের উত্তরখন্ডে রয়েছে -- "ভীষ্মেণৈতদযতঃ প্রাপ্তং ব্রতং পঞ্চদিনাত্মকম্ / সকাশাদ্বাসুদেবস্য তেনোক্তং ভীষ্মপঞ্চকম্"। অর্থাৎ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কাছ থেকে ভীষ্মদেব এই পঞ্চদিনাত্মক ব্রত প্রাপ্ত হয়েছেন, তাই তা ভীষ্মপঞ্চক ব্রত নামে অভিহিত। ভীষ্মপঞ্চক পালনে প্রথমদিন শ্রীকৃষ্ণকে পদ্মফুল, দ্বিতীয় দিন বেলপাতা, তৃতীয় দিন গন্ধদ্রব্য, চতুর্থ দিন জবাফুল এবং পঞ্চম দিন মালতী ফুল দিয়ে আরাধনা করতে হয়। আবার শঙ্খাসুরকে বধ করে শ্রীবিষ্ণুর চারমাসের যোগনিদ্রা ভেঙে উত্থান হয়েছিল এই কার্তিকী শুক্লা একাদশীতে। তাই এটি উত্থান একাদশী। এই পাঁচদিন বিষ্ণুর পূজা করলে বরাভয় মেলে। ফলে এটি বিষ্ণুপঞ্চক নামেও খ্যাত। তেমনি এ সময় বকেরাও নিরামিষ আহার করে বলে 'বকপঞ্চক'ও বলা হয়।

পঞ্চকব্রত সূচনার কাহিনী এবং এটি পালনের উপকারিতা সম্পর্কে লিপিবদ্ধ করেছেন শ্রীকালীকিশোর বিদ্যাবিনোদ -- "এক সময় দেবর্ষি নারদ, পৃথিবীতে এসে চতুর্দিকে বেড়াতে বেড়াতে দেখতে পেলেন যে, পৃথিবীর মানুষের দুঃখের শেষ নেই। নিজের নিজের কর্মফলের জন্যে তাঁরা নানাভাবে দুঃখ কষ্টে একেবারে জর্জরিত হচ্ছে। এইসব দেখে নারদের মনে খুব কষ্ট হল, অথচ কি করে এঁদের এই দুঃখ দূর করা যেতে পারে তাও কিছু ঠিক করতে পারলেননা। এইসব কথা ভাবতে ভাবতে তিনি গোলোকে গিয়ে উপস্থিত হলেন। গোলোকে গিয়ে ভগবানকে প্রণাম করে বললেন, “প্রভু, পৃথিবীতে গিয়ে নানা দিকে ঘুরতে ঘুরতে দেখলুম, পৃথিবীর মানুষ নানা রকম দুঃখ কষ্ট আর অশেষ দুর্দশা ভোগ করছে। ওই মানুষদের ওইসব দুঃখ কষ্টের হাত থেকে বাঁচাবার কি কোনো উপায় হতে পারেনা"? এই কথা শুনে গোলোক পতি বললেন, “হ্যাঁ, পৃথিবীর মানুষ যদি বক পঞ্চক ব্রত পালন করে, তাহলে তাঁদের সমস্ত পাপমোচন হয়ে দুঃখ কষ্ট থেকে তাঁরা নিষ্কৃতি পেতে পারে। কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের একাদশী থেকে পূর্ণিমা পর্যন্ত এই ব্রত করা প্রয়োজন। ত্রিভুবনে, এর মত আর কোনো ব্রত নেই"। নারদ বললেন, “এই ব্রত কি রকম ভাবে করতে হয়, এর কি কি নিয়ম আমায় সব বুঝিয়ে বলুন"।

বৈকুণ্ঠপতি তখন বললেন, “শোনো তবে মন দিয়ে, আমি যা বলি। সত্য যুগে সরযূ নদীর তীরে একটা বিরাট বটগাছ ছিল। আর একটা বক সেই গাছে বাস করত। বকটার খুব অসুখ করায় সে প্রায় মর মর হয়ে পড়ল। অসুখে পড়ার দিন থেকে সে কিছুই খায়নি। এখন যেদিন সে খাওয়া বন্ধ করেছিল, সে দিনটা ছিল শুক্লপক্ষের একাদশী তিথি। সেই দিন থেকে পূর্ণিমার দিন পর্যন্ত সে কেবল একটি করে বটফলই খাচ্ছিল, এই অবস্থায় মারা গেল। মরবার সময়ে কেমন করে যেন মাংসখেকো এই বকের মনে একটু ধর্মভাব দেখা দেওয়ায়, সে শ্রীহরিকে প্রার্থনা করে বলল, “হে ভগবান! আমার এই শেষ সময়ে তুমি আমায় উদ্ধার করো। আমায় যমদূতেরা যেন কোনো কষ্ট না দেয়"। এতে সেই বকের ওপর ভগবানের দয়া হল। বকটা মারা যাওয়ার পর যমদূতেরা তাঁকে যখন নিতে এল, সেই সময় বিষ্ণুদূতেরাও এসেছে তাঁকে নিয়ে যাবার জন্যে। তাঁরা যমদূতদের বাধা দিল। তখন আরম্ভ হল তাঁদের মধ্যে যুদ্ধ। আর যমদূতেরা হেরে গিয়ে পালিয়ে গেল। তখন বিষ্ণুদূতেরা বককে রথে করে গোলোক পুরীতে নিয়ে গেল। এইবার ভগবান নারদকে জানালেন, “পাখীটা বকপাখী বটে, কিন্তু কার্তিক মাসের শুক্ল পক্ষের একাদশী থেকে পূর্ণিমা পর্যন্ত কিছু না খেয়ে ভগবানের শরণ নেওয়ায় তাঁর পর্যাপ্ত পূণ্য সঞ্চয় হয়। আর সেই জন্যেই বক পঞ্চক ব্রত পালনের ফলেই তাঁর সমস্ত পাপ কেটে যায়। আর সে গোলোকপুরীতে থাকতে পায়। মানুষ যদি এই ব্রত পালন করে, তাহলে তাঁদেরও মহাপূণ্য সঞ্চয় হবে। ফলে তাঁরাও গোলোকে এসে থাকতে পারবে"। দেবর্ষি নারদ, এইভাবে মানুষের পাপ মোচন হওয়ার কথা শুনে খুব সন্তুষ্ট হলেন আর গোলোকপতিকে প্রণাম করে চলে গেলেন"।

উল্লেখ্য যে বিধবা নারীরা লক্ষ্মীর সঙ্গে দামোদরকেও পূজা করে। পঞ্চক ব্রত 'রাই দামোদর ব্রত' নামেও সুপরিচিত। ব্রতের ছড়ায় মেলে 'দামোদর' প্রসঙ্গ -- "দামোদর গো দামোদর ভাত যদি নাহি হয়। / কার্তিক মাস চলি গেলা / হে দামোদর নোড়া / ওগো বামুনী ওগো বামুনী ক্ষীর সমুদর উদিয়া নারী / ক্ষীর সমুদর উদিয়া নারী / ওগো বামুনী ওগো বামুনী"। সে সময় ব্রতকারিনীরা নিরামিষ আহার এবং আতপ চাল ফুটিয়ে হব্বিষ্যি করে। এমনকি মাছ খেকো বকেরাও নাকি মাছ ছোঁয়না। আর সধবা নারীরা পূজোর স্থানে বিভিন্ন ভেষজ সামগ্রী, গাছ, পাতা দিয়ে সাজায়। এই লৌকিক উৎসবে প্রয়োজন একটি করে শাড়ি এবং ধুতি, দু'টি করে নৈবেদ্য, মধুপর্কের বাটি, আসন, অঙ্গুরীয় এবং কুশ, তিল ও গন্ধদ্রব্য। এই লৌকিক উৎসব পালনের বিধিতে বলা হয়েছে -- "পঞ্চ দিনরে উপবাস। / করিব পঞ্চগব্য গ্রাস। / যদি অশক্ত উপবাসে। / হবিষ্য কবির দিন শেষে। / বক ন করে মৎস্যগ্রাস। / পঞ্চ দিবস উপবাস। / তেনু কহন্তি সর্বলোক। / তা নাম যে বক পঞ্চক"।

এদিন সকালে স্নান করার পর নদীর চরে, পুকুরপাড়ে বা বাড়ির নিকোনো উঠোনে বালি বা কাদা দিয়ে পাঁচটি গোলাকার ঢিপি বানায়। সেখানে রাখা হয় একটি হরিতকী বা আমলকি। আর ঢিপিকে ঘিরে আলপনা আঁকা হয়। সেই আলপনায় থাকে ভগবান বিষ্ণুর শঙ্খ, চক্র, গদা এবং পদ্ম ছাড়াও একজোড়া বক ও বকিনীর চিত্র। এই ব্রতে বক পাখির আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। তা পঞ্চক ব্রতের গানেও প্রস্ফুটিত -- "বগ মুহু চাই বগলি বসে / আরে বগলি মুহরি হাসে। / মুই যে ঘুরিমু ফেরি কার্তিক মাসে। / কার্তিক মাসরে যে মুগ গজা / সন্তোষ কর গো বালিকা পুজা / বালিকা পুজিলি ষোল কাহন / বালিকা আনরে মৌ বাহন"। এবার সেই আলপনার মধ্যভাগে স্থাপন করা হয় মঙ্গলঘট এবং তুলসী গাছ। কাঁচা মুগ কলাই, ছোলা, পাকা কলা দিয়ে সূর্য, লক্ষ্মী, শিব, তুলসীর পূজা সম্পন্ন হয়। প্রতিবারে এক একজন দেবতার নামোল্লেখ করে ফল দেওয়া হয়‌। সেসময় মহিলারা গানের সুরে বলেন-- "পর্বত কুলে কুলে বাবুই মুঠিমুঠি / মৃগমানে চরি বুলি খায়। / সোনার আঁকুড়ি, রুপার চাগুড়ি / ঘনশ্যাম পুষ্প তুলি যায় / কি পুষ্প তুললো সিয়া মালিনী / পুষ্পের নাম গোটি কলা। / সে পুষ্প ঘেনি মু লক্ষ্মী নারায়ণ / পুজে কুশলে থাউ মোর কুলর বালা"।

পুজোর শেষে এই বালিকাদার ঢিপিটি জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। এটি অনেকটা মহিলাদের গঙ্গাপূজার মতো। এরপর বাড়িতে এসে কার্তিক মাহাত্ম্য শ্রবণ করে। এইভাবে আরো তিন দিন অর্থাৎ মোট চার দিন উপচার পালনের পর পঞ্চম দিন তথা শেষ দিন তথা কার্তিক পূর্ণিমায় ব্রত সাঙ্গ হয়। তবে এদিনের নিয়মকানুন একটু আলাদা। এদিন যাবতীয় আচার অনুষ্ঠানের শেষে মহিলারা কলাগাছের কাঁচা থাকল কেটে ভিঙা বা ভেলা বানিয়ে তাতে ব্রতীদের সংখ্যা অনুযায়ী বাতি জ্বেলে তা জলে ভাসিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে শেষ হয় পঞ্চক ব্রতের কাজ। এই ভেলা ভাসানোর প্রসঙ্গে শিক্ষক গবেষক তরুণ সিংহ মহাপাত্রে মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি লিখেছেন, "ব্রতের শেষে ভিত্তি ভাসানোর আচারটি হয়তো আদিতে মূল ব্রতে ছিলনা। অনেকে এটিকে প্রাচীন নৌবাণিজ্যের স্মৃতিচিহ্ন মনে করেন। পুরাকালে রাসপূর্ণিমার দিনেই বণিকেরা নৌবাণিজ্যে পাড়ি দিতেন। অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত সূবর্ণরেখার মোহনায় পিপলি ছিল গুরুত্বপূর্ণ বন্দর। ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে ভ্যান ডেক ব্রুকের মানচিত্রে দাঁতন গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য নগরী। নৌ বাণিজ্যের সেই স্মৃতিও পঞ্চক ব্রতের অনুষঙ্গে যুক্ত থাকতে পারে"। উল্লেখ্য যে, এতদঞ্চলের একটি উল্লেখযোগ্য উৎসব 'বালিযাত্রা'। যার সাথে ইন্দোনেশিয়ার বালি শহরের সংস্পর্শ রয়েছে। যা আসলে এক ধরনের নৌ বানিজ্য যাত্রাকে সামনে রেখেই প্রচলিত।

ওড়িশা সীমান্তবর্তী সূবর্ণরৈখিক এলাকায় পঞ্চক ব্রত পালনের পশ্চাৎপট বর্ণনা করতে গিয়ে গবেষক, প্রাবন্ধিক অতনু নন্দন মাইতি জানিয়েছেন, "সুবর্ণরেখা নদী বিধৌত এই এলাকার জমিতে কীটনাশক ও রাসায়নিক সার আসার আগে সমগ্র বর্ষাকাল জুড়ে ধানচাষের মাঠে প্রচুর মাছ জন্মাত। কার্তিক মাসে বর্ষা বিদায়ের ফলে জল শুকিয়ে মাঠের মাছ ধরা পড়তো। ধানের ঝরাফুল খাওয়া মাঠের মাছ খাওয়ার সময়ে বিস্বাদ লাগতো। দরিদ্র মানুষ এইসময়ে মাছকে রোদে শুকিয়ে শুটকি করে রাখার কাজে ব্যস্ত থাকতেন। বড় চাষী পরিবারগুলি বড় গর্ত করে কৈ, মাগুর, শোল মাছকে পরের মাসে ধান কাটায় খাওয়ার জন্য সঞ্চয় করতেন। পঞ্চক ব্রতকে কেন্দ্র করে এই নিরামিষ পালন খাদ্য গ্রহণে বৈচিত্র্য ও তৃপ্তি এনে দিত। বাড়ির মেয়েরা যারা এই কার্তিকের ভোরে স্নান করে পুজার সময় পাঁচদিন প্রচুর তুলসীপাতা চিবাতেন"।

ড. শীলা বসাক পঞ্চক ব্রতের সঙ্গে মেদিনীপুরের মেয়েদের বালুকা ব্রতের সাদৃশ্যের উল্লেখ করে লিখেছেন, "উভয় ব্রতের দিনক্ষণ, রীতিপদ্ধতি, আলপনা, কড়িখেলা অনুষ্ঠানের মধ্যে কোনো ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায় না, অনুষ্ঠান উভয়ের একই। মেদিনীপুর ও ওড়িশা পাশাপাশি রাজ্য। তাই নানা সংস্কৃতি উভয় রাজ্যের অধিবাসীদের মধ্যে কালে কালে প্রবেশ করেছে। আবার প্রতিবেশী রাজ্য বিহারের বহড়াগোড়া, পাটপুর প্রভৃতি অঞ্চলেও এই পঞ্চক ব্রত পালন করতে দেখা যায়। এইভাবেই বালুকা ব্রত ও পঞ্চক ব্রত মিলেমিশে এক হয়ে গেছে"। তেমনি গবেষক তরুণ সিংহ মহাপাত্র মন্তব্য করেছেন, "নানা ভাবধারার সমন্বয়ে আজ পঞ্চক ব্ৰত যেভাবে পালিত হয় তা থেকে এর আদিরূপটি খুঁজে পাওয়া, গবেষণা সাপেক্ষ। তবে অনুমান করা যায়, বালুকা পুজো আদিতে হয়তো শিব পুজোই ছিল। বালি দিয়ে লিঙ্গ মূর্তি তৈরি করে স্বল্প উপাচারে কুমারীদের শিব পুজো। সুবর্ণরেখার এই নিম্ন অববাহিকা বহুদিনের শৈবভূমি। পরে এদিনের শিব আরাধনা পঞ্চকের সঙ্গে মিশে গিয়েছে"।

পঞ্চক ব্রতে মিশে থাকে গভীর শ্রদ্ধা এবং দেবতার প্রতি ভক্তের চরম ভালোবাসা। তেমনই একটি ছড়ায় মেলে সেই শ্রদ্ধার দৃষ্টান্ত -- "ভাতুনি বলি দেই অছি পইড়র পানি / জ্বাল বলি জ্বালি দেনি চন্দন কাঠ আনি। / তুষ বলি ঝিটায়ি দেনি জিরা মেথি লেই / ভাত যে রাঁধিছি প্রভু তুম্ভে থিল কাঁহি। / উঠাইলা কাল মেঘ বরষিলা মউ। / অর্থ দিতে বাহির হইছে রাজার ঘরের বউ"। ওড়িয়া ভাষার এই কবিতার বাংলা অর্থ করলে হয়, ভাতের হাঁড়িতে জলের বদলে ডাবের জল দিলাম। উনুনে কাঠের বদলে চন্দন কাঠ জ্বাললাম। ধানের তুঁষের বদলে উনুনে মেথি ও জিরা দিলাম। এইসব করে যে অন্ন রাঁধলাম, সেটা গ্রহণ করার জন্য ভগবান তুমি কোথায় রয়েছো? এভাবেই ভক্ত ও ভগবানের মধ্যে মেলবন্ধন গড়ে ওঠে। ভক্তের আকুল আর্তি ভগবানের জন্য প্রকাশিত পঞ্চক ব্রতের গানে।

ছবি -- তরুণ সিংহ মহাপাত্র

পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments