জ্বলদর্চি

কবিতা অ্যাভিনিউ/ পর্ব -২৫ /বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়

কবিতা অ্যাভিনিউ 
পর্ব -২৫ 
বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায় 

 আগের পর্বে কবি মোহিনীমোহন গঙ্গোপাধ্যায়ের  কবিতায় প্রেম প্রকৃতিচেতনার কথা বলা হয়েছে। আমরা জানি কবির ভেতরে থাকে আরও একজন কবি। যার  মনের মধ্যে ভাবনাগুলো ক্রমাগত সাঁতার কেটে চলে। এই আণবিক সাঁতার থেকে একজন কবি তুলে আনেন অনুভূতির ক্রমিক বিচ্ছুরন । শব্দের বুননে অনুভবের জাগরণে । সেই অমিয় শব্দরেণুর স্বাদ পাই আমরা । অনিরুক্ত হাওয়ায় বাতাসে উড়ে বেড়ায় তার পরাগ। এই ধারাবাহিক প্রক্রিয়া চলতেই থাকে চলতেই থাকে সারাজীবন । তার পাশাপাশি চলতে থাকে আত্মিক সংলাপ। ব্যক্তি মানুষ আর কবি দুটো আলাদা সত্ত্বা । বিচ্ছিন্ন না কি একই ? না কি এক সত্ত্বা থেকে কখনও কখনও বেরিয়ে আসে অবচেতনার ফ্রাগমেন্টস ? প্রস্তাবহীন সমর্পন । চেতনা এবং চেতনার সারফেস থেকে তৈরি হয়ে যায় অসংখ্য ছায়াবলয় । কবি আসলে নির্জন । সৃষ্টির প্রবল তাড়নায় সে এক নির্জন ঈশ্বর । স্মৃতির সম্ভোগ থেকে তৈরি করেন নিজস্ব বিশ্ব । এক মগ্নপৃথিবী । বাইরের আমি অন্তরের আমিকে পর্যবেক্ষণ করে চিন্তার আচ্ছন্নতা দিয়ে । সারাদিন ধরে , সারাজীবন ধরে । সে চা খাওয়া দেখে , বিড়ির ধোঁয়া থেকে খুঁজে নেয় বিষাদবিলাপ। চুপচাপ পাশে দাড়িয়ে সব কথা শোনে । কবির অ্যানাটমির সাথে তার সামগ্রিক লিপ্ততা । এফোঁড় ওফোঁড় করে দেখে কবিকে । কিছুই গোপন থাকেনা চৈতন্যদ্যুতির বাইরে এক পরিদৃশ্যমান জগতের কাছে । এই সমান্তরাল সম্পর্ক বন্ধুত্বের প্রতিশব্দ হয়ে ওঠেনা । অংশীদার হয়ে ওঠেনা । হয়ে ওঠেনা বলেই দৃষ্টির বহুস্তররীয় বিস্তার ঘটে । সম্মোহন এবং আচ্ছন্নতার পরিসর অতিক্রম করে নিরীক্ষন সম্ভব হয় । “ who was it that imparted form to man gave him majesty movement , manifestation and character , inspired him with wisdom music and dancing ? when this body was raised upwards he found also the oblique sides of the other directions in him – he who is person , the citadel of the infinite being . 
 
 ছায়াসঙ্গী

আমার ছায়ার সঙ্গে সারাদিন ঘুরে ফিরে বাড়ি ফিরতাম ...

প্রতিদিন রাস্তার মোড়ে আড্ডা দিই চা দোকানে চা খাই বিড়ি টানি
রাজনীতির গল্প বলি স্ফূর্তি উড়াই
ছায়া শোনে চুপচাপ পাশেই দাঁড়িয়ে থাকে
সব কিছু দেখে শুনে মুখ ফুটে কিছুই বলে না ।

ছায়ার কি ভয়ডর আছে? কিছুই গোপণ নেই গোপণ থাকে না
আমি ও আমার ছায়া পাশাপাশি সমান্তরাল
আমার প্রেমিকা জানে তাই কোন চোখমুখে লাজলজ্জা নেই
প্রাণ খুলে কথাবার্তা হয়।

আমি ও আমার ছায়া একসঙ্গে থাকলেও
দুজনের মধ্যে কোন বন্ধুত্ব হলো না
ছায়া সে ছায়ার মত, আমিও আমার মত আছি
প্রতিবিম্বে দোল খায় ফুটে থাকা ফুল ।

প্রতিদিন প্রতিটি মূহুর্ত যায় ছায়া দেখে আমার মধ্যে শুরু
ক্রমাগত যুদ্ধ তুমুল ।
 তাহলে নিজের সাথে নিজের যুদ্ধ হচ্ছে কেন ? কেনই বা এই তুমুল যুদ্ধের প্রাসঙ্গিকতা ? দ্বন্দ্ব ছাড়া ফালাফালা করে চিরে দেখা ছাড়া ক্রমাগত আঘাত প্রত্যাঘাত ছাড়া বেষ্টনীর সীমা আর বক্রতাকে অতিক্রম করা সম্ভব নয় । আসলে এভাবেই একটা জায়গা চিহ্নিত হয়ে উঠছে এক স্বতন্ত্র পরিসর ।অনিবার্য আলোর বন্ধুতা । শাব্দিক ফ্রেম থেকে স্থিরচিত্রও সচল হয়ে উঠছে । আলোর ভেতর এক দৃশ্যমান মানুষ আবার আলোর বৃত্তের বাইরে ছায়ার অবতলে আলাদা মানুষ । স্মৃতি থেকে স্পর্শময়তার দিকে এবং পরিশেষে স্বপ্নের অবচ্ছায়ায় তা মিশে যাচ্ছে । শুধু কিছু ঘটনাপুঞ্জ যা ফুলের মত এই ছিল এই মাত্র ঝরে গেছে । কিন্তু প্রতিবিম্বের ভেতর দোল খাচ্ছে ক্রমাগত । সেই ফুলের উপর গান গেয়ে উড়ে এসে বসছে ভ্রমর । এই আকণ্ঠ তৃষ্ণা একে কি আমরা জীবনের লিপ্ততা বলব না ? আগুনের ডানা মেলে ডিম পেড়ে উড়ে যাচ্ছে কোথায় ডাহুক । জীবন তো কেবল রূপান্তরের ছবি । নিজেকে অতিজীবিত করে তোলার নিরন্তর প্রয়াস । নতুন পাঠক্রম । এক অস্পষ্ট সমারোহ থেকে চিন্তার ক্রমিক মাইটোসিস । এই জারনচিহ্নগুলিই তো সমস্ত নিয়ম ভেঙে ক্রমিক অস্ত্রোপচারের মধ্য দিয়ে কবির মায়াবন্দরে ঢুকে পড়ে । আকণ্ঠ তৃষ্ণা উসকে দিয়ে যায় । শব্দের ভাষামাটি দিয়ে তৈরি হয় পথ । সে পথের পাথরে আগুনের আভাস । তবু শিল্পময় মানচিত্র আগুন থেকে গোলাপের নির্যাস টেনে আনে । এই রূপ রস গন্ধের আবেষ্টনী ভ্রমরকে গতিশীল করে । ময়ূরী নৃত্য ভুলে যায় । অনুভূতির রঙ এভাবেই নতুন দুনিয়ার জন্ম দেয় । 

নতুন পাঠক্রম

পাথরে আগুন জ্বলছে যে আগুনে ফুটেছে গোলাপ

গান গেয়ে গোলাপেও উড়ে এসে বসেছে ভ্রমর 
ময়ূরী নৃত্য ভুলে থমকে দাঁড়াল
কে যেন আকণ্ঠ তৃষ্ণা উস্কে দিয়ে গেল 
তুলে নিল খুচরো কিছু সুখ ।

পাথরে আগুন জ্বলছে যে আগুনে ফুটেছে গোলাপ
পাথরে গোলাপ ফুলে বসেছে ভ্রমর
আগুনের ডানা মেলে ডিম উড়ে গেছে কোথায় ডাহুক ?

তাহলে কি নতুন পাঠক্রম শুরু হল নিয়ম ভাঙার ? 
এই যে এত এত ঘটনা । এই যে কোটি কোটি বছর ধরে বয়ে চলা সভ্যতা । নিঃশব্দে ছায়ার মত কেউ আমার সাথে হেঁটে চলেছে অনাদিকাল থেকে আজও । আর আমি দেখে যাচ্ছি সেই প্রাগৈতিহাসিক অ্যামিবার চলন । আগুনের পৃথিবীতে ডিম রেখে সে শুধু চলে যাচ্ছে চিকচিহ্নহীন এক বিলের দিকে । অনন্তের দিকে । এক নিঃশব্দ পথিকসত্ত্বা ছাড়া আর কিছু নেই তার । অতীত থেকে বর্তমান । আলো আর ছায়া । এই সমন্বয় এবং সংশ্লেষ । রাস্তার ক্লোজ শর্টে কি আমরা এটাই দেখতে পাচ্ছি না ? আর তা নিয়ে যাচ্ছে এক চির ভ্রাম্যমানতার দিকে । জীবনের আর্জি নিয়ে উড়নপিপাসা নিয়ে বিশ্লেষিত হয়ে পড়ে ব্যপ্তির বিসর্গে । পাহাড়ি নদীর স্রোতে পালতোলা নৌকা ভাসিয়ে । জলের আবর্তের মধ্যে ঘুমন্ত প্রাণের আকণ্ঠ পিপাসা রেখে আবার সমুদ্র থেকে উঠে আসছে মেঘ । গন্ধে গন্ধে জীবনের ছন্দময় উৎস সন্ধানই পার্থিব স্পষ্টতার মধ্যে দাঁড়িয়ে দৃশ্যক্রমের সীমা অতিক্রম করে যাওয়া অপসারী দৃষ্টি । আর্ট অফ ইমাজিনেশনেশ যা ভিস্যুয়ালিটির কিয়ক্সগুলো ভেঙে বিলুপ্ত অনুরণন থেকে চৈতন্যে পৌঁছানোর অর্গল খুলে দেয় । দেরিদার মতে - Nothing is identical with itself , the moment something is thought, said , written or intended , it becomes a trace of itself , no longer present . সত্যের কোন পূর্ণচ্ছেদ নেই । স্বর থেকে ভিন্নস্বরে এক দৃষ্টি থেকে দৃষ্টান্তর - এর অন্বয় এবং মহাসমন্বয়ের মধ্যেই অনন্তসম্ভাব্যতা যা লিনিয়ারাইজেশনের যুক্তিফাটল অতিক্রম করতে পারে । ভুল ভেঙে গেলে মরা ডালে ডেকে ওঠে কোকিল । সে গান শোনায় । অন্য এক ভুবনের গান । 

ভুল ভেঙে গেলে

ভুল ভেঙে গেলে ফুল কুড়াতে যাই
যে ফুলে বসন্ত এসে বাঁশি বাজায়
গন্ধে গন্ধে জীবনের ছন্দময় জীবনের উৎস সন্ধান

ভুল ভেঙে গেলে
মরা ডালে ডেকে ওঠে কোকিল
পাহাড়ি নদীর স্রোতে পাল তোলা নৌকা ভেসে যায়
দাঁড়ের শব্দ শুনি
অন্য এক ভুবনের গান
আমার সমস্ত ভুল একসময় ফুল হয়ে গেলে
সময়ের রঙ পাল্টায় । 

দার্শনিক লাঁকার কি বলেছিলেন । আমরা স্মরণ করে নিতে পারি তাঁর কথাগুলো - a child only arrives at a sense of selfhood when it sees itself as a whole in a mirror for the first time . in what is known as the mirror stage . It recognizes this whole as a something it wants to be , but because the child’s own perception of the self does not provide this sense of unity in identity from the moment onwards it has to look to significant others and society as a whole to act as mirrors that reflected back a unified image of the self . কঠিন রাস্তার উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ঝড় বৃষ্টির কনশাস এফেক্ট থেকে সে একটু একটু করে শনাক্ত করে নিতে শেখে সমুদ্র শাসনের উল্লাস । হ্যাঁ । এই সেই রাস্তা যার উপর মেগাস্থিনিস বুদ্ধ অশোকের পায়ের ছাপ স্পষ্ট । যেখানে ইতিহাসের পদধ্বনি সচেতন কম্পাঙ্কে ধ্বনিত হচ্ছে । রাস্তার ভেতরে রাস্তা । জীবনের ভেতরে জীবন । শ্যাডো থিয়েটার । এই ছায়া নাটক জীবনের সমস্ত বাইনারির রাইজোম্যাটিক স্ট্রাকচারে । এর মধ্য থেকেই নিজেকে চিনতে শেখা । দেখতে শেখা । পারিপার্শ্বিক আয়নার ভেতর থেকে উঠে আসে সামগ্রিকতার নির্যাস । ব্যক্তিগত স্বরবর্ণ পেরিয়ে এভাবেই সামষ্টিক ব্যঞ্জনবর্ণে দীক্ষিত হয়ে ওঠা । কঠিন রাস্তার সুলুক সন্ধান । যেখানে ঝড় ও বৃষ্টিপাতের পথ অবরোধ । তবু সেই প্রাণনার অনুসন্ধান । মেরুদণ্ড সোজা রাখার দৃপ্ত শপথ নিয়ে খুঁজে দেখা জ্যোৎস্নাময় প্লাবিত জীবনপথ । নিয়মতান্ত্রিকতা কখনই একজন সচেতন যোদ্ধাকে তাঁর চিন্তন প্রণালীগুলোকে বিপথগামী করতে করতে পারে না । নতজানু করতে পারেনা তাঁর স্বয়ংক্রিয় অনুচিন্তার বলয় । নিয়ন্ত্রন করতে পারেনা তাঁর শাব্দিক ভ্রমণ পথ । 

এ হাঁটার প্রত্যাহার নেই 

আমি কখনও কারো কাছে নতজানু নই তাই ঝড় বৃষ্টির মধ্যে
হেঁটে হেঁটে যাই কঠিন রাস্তায়
রাস্তা আমাকে রাস্তার ভেতরে রাস্তা দেখায়  
যে রাস্তায় হেঁটে গেছে মেগাস্থিনিস বুদ্ধ অশোক আলেকজান্ডার 
ইতিহাস কাঁপানো পদধ্বনি আজও শুনতে পাই 

আমার পায়ে পায়ে পাহাড় পাথর সমুদ্র শাসনের উল্লাস ।

রক্ত মাখা সংবিধান সরে দাঁড়ায় 
ক্রুশবিদ্ধ গণতন্ত্র চিৎকার করে ওঠে 
দাসত্বের পোশাক পরা স্বাধীনতা কান্নায় আকাশ ভেজায়
আমি ধর্ম নিরপেক্ষতার মুখোশ পরা দালালদের লাথি মেরে
শক্তি পরীক্ষা করি ।

ছেঁড়া খোঁড়া আমার ভারতবর্ষ ভাতের থালায় দেখতে পায়
ভয়ঙ্কর বন্দুকের ছায়া 
আমি সেই সন্ত্রাসের ছায়া থেঁৎলে দিয়ে ঝড় বৃষ্টি বজ্রপাতের ভিতর
পথ হাঁটি 
এ হাঁটার প্রত্যাহার নেই
জেনে গেছে সমগ্র বিশ্ব ভূমণ্ডল ।

সাম্প্রতিক চিত্রগুলির পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে দেখা যায় ক্রুশবিদ্ধ গণতন্ত্রের চিৎকার । দাসত্বের পোশাক গায়ে দিয়ে মর্মভেদী কান্নায় ভেঙে পড়া বিধ্বস্ত স্বাধীনতা আর ধর্মনিরপেক্ষতার মুখোশ । সারা দুনিয়া জুড়ে অকল্পনীয় ভাঙচুর , স্বপ্ন এবং প্রত্যয়ের উপর প্রবল ধাক্কা । যা পরিশীলিত ভাবনাকে বেপথু করে দিতে চায় । কিন্তু এ হাঁটার প্রত্যাহার নেই বলেই মানুষের দেশ ভাষা আর সময়ের মানচিত্র পেরিয়ে সন্ত্রাসের ছায়া থেঁতলে এভাবেই তো বজ্রসন্ধানী হয়ে ওঠেন একজন শব্দশিল্পী । কালের সীমারেখা ভেঙে চিরকালীন হয়ে ওঠে তাঁর বিহ্বল মুহূর্তগুলি । অনন্য উদ্ভাসনে তৈরি হয় আশ্চর্য সম্ভাবনার বহুমাত্রিক বিচ্ছুরণ । মুছে যায় প্রান্তিকায়িত ছায়াঞ্চল । সত্যের সন্ধানে কোথায় যেতে হয় একজন শব্দের যাদুকরকে ? ব্রহ্মকমল আনতে । ব্রহ্মবিদ ব্রহ্মের ভবতি । কায়ার ধারণা থেকে অতিকায় সর্বব্যপ্তিতার প্রান্তদেশ যেখান থেকে শুরু হয় অতিজাগরের মানচিত্র । অনির্দেশ্য ভগ্নাংশ থেকে পূর্ণতার অভিযাত্রা । এক ধ্রুপদী মেটাফোরে এই এই পরিমার্জন সমূহ গেঁথে নিতে চান কবি । শৃঙ্খলিত তাৎক্ষনিকতা থেকে আবহমানের যোগসূত্র । তার নিরেট শুভ্রতা আবিস্কার করেন । চিরপ্রবাহিত কবিতাকল্পে ডুবুরির মত ডুবে যান , তুলে আনেন অমুদ্রিত সাদা পাতাটি । যেখানে শব্দ চুরি গেছে । মন্ত্র নেই । শ্লোক নেই । নিথর সেই সুড়ঙ্গলোকের ভেতর আততায়ী ত্রাস । প্যারাবলিক শূন্যতা । প্রতিকারহীন যে দুঃখ আর অসুখগুলো রয়ে যায় প্রতিদিন । যারা উপশম প্রত্যাশী । আত্মেন্দ্রিয়ের ভেতর যারা নির্বাক অথচ বেদনাপ্রবন এবং নিরাময় সন্ধানী । মনোজগতের সেই দুষ্প্রবেশ্য সত্য যার অস্পষ্ট স্থানিকতা নিরূপণ করা সকলের সাধ্য নয় । শুধু কবি পারেন । কেবলমাত্র কবিই পারেন সমস্ত মন্ত্র চুরি গেলেও সেই অমোঘ অশ্রুত ধ্বনির সন্ধান আনতে । ব্রহ্মকমল । 


 ব্রহ্মকমল

ব্রহ্মকমল আনতে সে গেছে কোথায় ?


সে কি তার ঠিকানা জেনেছে ?

এখানে দাঁড়িয়ে একা আদিভূতা সত্য সনাতনী
পুজা চায় , পুজার মন্ত্র নেই কোনও 
সব শব্দ চুরি হয়ে গেছে । 


পুজারি নিঃশব্দে কাঁদে তার
দুচোখের শুকনো জল মায়ের চরণে পড়ে
হয়ে গেল ব্রহ্মকমল। 

এভাবেই বুনিয়াদী হট্টগোল পেরিয়ে চোখের জলের মত নিঃশব্দে ঝরে পড়ে স্বাপ্নিক সেই স্বর । ব্রহ্ম । যা ইম্পসিবলের অরিজিনালিটি নিয়ে চিত্রিত আকাশ পেরিয়ে অন্তরের অন্তরীক্ষে বেজে ওঠে । আর অস্পষ্ট কপাটগুলো খুলে যায় এবং আবহমানের ভেতর এক একটি ফুল ফুটে ওঠে । পাথরে আগুন জ্বলছে যে আগুনে ফুটেছে গোলাপ । তৈরি হয় মাল্টিপল ইমপালস । বোধরঙে আরক্তিম হয়ে ওঠে অনির্বচনীয় অসংজ্ঞাত এক স্তব্ধলোক। 
কিংবা আমরা যখন কবির প্রতিবাদী স্বরের দিকে কান পাতি তখন শুনতে পাই, পশ্চিম সীমান্ত বাংলার অগণিত মানুষের কণ্ঠস্বর। আমার যখন লফরা মাহাতর জবানবন্দী কবিতার সামনে  এসে দাঁড়াই । যখন দেখি মজুরবৃদ্ধির আন্দোলনে সামিল হতে গিয়ে মিছে মামলায় পাঁচ বছরের জেল হয়ে যায় লফরার। জেল থেকে ফিরে সে দেখে " বউট নাই ছিলাটা নাই ভখে শুকাই শুকাই মইরে শ্যাষ হইয়ে গেইছে উয়ারা ঘরট ধইসকে গেছে ঝইড়্যায় " তখন তার মধ্যে প্রতিধ্বনিত হয় বিদ্রোহী জিজ্ঞাসা " আমি ইখন কুথায় যাব , কাকে ডিংলা ফাড়া কইরে পুড়া গায়ের জ্বাল মিটাব ?" এই জিজ্ঞাসা বিদ্রোহের আকার নেয় " যারা আমার বউটকে ছিলাটকে ভখে মাইল্য আমার ভিটামাটিতে বেনাহক ঘুঘু চরাল্য তারাকে শিকড়বাকড় শুদ্ধু উখড়াই ফেইলব আছড়াই মাইরব্য চাট্টান পাথরে তাথে যদি আমাকে আরও একশবার জেল যাইত্যে হয় তাও যাব" সব শেষে দাঁড়াই সেই নিমগ্ন উচ্চারণের কাছে " ই আকাশ সবার ই মাটি সবার সবার লাইগে সমান বিচার না হইল্যে কাল্লায় কাল্লায় শোধ লিব আইজ্ঞা ই কনহ অন্যায় লয় " যা এক সাম্যবাদী চেতনার ভেতর মানবিক অন্তর্লোকের দরজা খুলে দেয়। মহাজনী শোষন এবং সামন্ততান্ত্রিক নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে জেহাদ হয়ে উঠে তার কবিতা 
ই হাত গুলা আর হাত লয় আইজ্ঞা
মিশিন কাটা করাত বটে 
কাজ না পাইল্যে ভাত না পাইল্যে  
মিশিনগুলা বেকল কইরে দেশ দুনিয়া ফুঁটাই দিয়ে
দুনিয়াদারির দখল লিবেক ( দখল) 
 গ্রাভিল হিকসের মতে – একজন প্রগতি লেখক তাঁর রচনার মধ্য দিয়ে প্রলেতারীয় পাঠককে শ্রেনী সংগ্রামে তাঁর ভূমিকা ও অংশগ্রহণ সম্পর্কে অবহিত করেন,  তাই যে অঙ্গীকারের মধ্যে দখল   কবিতার সমাপ্তি  সেই অধিকারই একদিন বাস্তব রূপ পায় ইস্ট্রাইক কবিতায় ।
 মরদের বেটা মরদ বটে ডমরু 
বাবুদের পাঁজরা গুল্যান হিলাই দিলেক ( ইস্ট্রাইক) 
এই কবিতায় ডমরু বাগদি মরদের বেটা মরদ। তার হিম্মত সে নিজের নাহ্য অধিকার কায়েক করতে পারে। তার স্পর্ধার কাছে বিনম্র হয় সমাজের উপরের তলার মানুষেরা। 
 মাড় ভাতের লড়াই  গ্রন্থটির  ভূমিকায় ডঃ সুধীর করণ বলেছেন “  এখানে তিনি শুধু কবি নন , সংগ্রামের অংশীদার হয়ে দাঁড়িয়েছেন পুরুলিয়া আর সারা সীমান্ত বাংলার বাইদ বহাল  টাইড় টিকরের  বিস্তৃত পরিসরে খেঁটে খাওয়া কুঁকড়ে পড়া  মানুষের একান্ত আত্মীয় রূপে। 
তাই খুব সঙ্গত কারণেই তিনি মোহিনীমোহনের এই আবির্ভাবকে দুহাত তুলে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন – ‘এ কবিতার ভাষা পুরুলিয়ার উন্মুক্ত প্রান্তরের  মতোই নিরাবরণ নিরাভরণ কিন্তু পাথরের মতো ঋজু, নদীর স্রোতের মতো বেগবান। এ কবিতা তাই জনগণের কবিতা। বস্তুত গ্রন্থটি মোহিনীমোহনের  নামে প্রকাশিত হলেও এর মধ্যে ধ্বনিত হয়েছে হাজার হাজার মানুষের কণ্ঠ । কখনও শোনা যায়  সংগ্রামের শপথ কখনও দেখা যায় দৈনন্দিন চালচিত্র এবং তারই মধ্যে অনায়াস প্রকৃতি চিত্রণ” 
  এই কাব্যগ্রন্থের পটভূমি “ যেখানের মানুষ দশরথ সিং সর্দ্দার, ছিদাম বাগদী, পাথুরে মাটির বুক চিরে ফসলের সুঘ্রাণ সৃজন যেখানে অসম্ভব, সেখানে মরদের হিম্মত প্রয়োজন। তৃষ্ণার প্রত্যেক ফোঁটা জলের জন্য সেখানে মাটির তলদেশ পর্যন্ত তোলপাড় করতে হয় মদনা কাঁহার কিংবা মধু বাউরীদের। রোদ আর নিষ্করুণ প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে সঙ্গে মহাজন মোড়লে ভরা সামন্ততন্ত্র দাঁত বসায় খেটে খাওয়া মানুষের অনার্য চামড়ায়’
 খুব স্বাভাবিক ভাবেই এই প্রেক্ষিতের ভেতর প্রতিবাদী সত্তার জাগরণচিহ্ন জেগে উঠেছে বিভিন্ন কবিতার মধ্য দিয়ে।ফুটে উঠেছে মর্মস্পর্শী অন্ধকারের ভয়ংকর নারকীয়তা, ভগ্নস্তুপ সমাজের জীর্ণ পোতাশ্রয়ে রক্তের পুঁটুলি বাঁধা নিদারুণ দগ্ধজীবন।এসব নিয়েই আমাদের সমাজব্যবস্থার গভীর গভীরতর অসুখ আজ। সেই অসুখ থেকে নিরাময়ের দিগন্ত নির্দেশ উঠে এসেছে তাঁর কবিতায়।  
১ ই পোস্টার গুলান কারু বুকের ভিতরে হাড় কাঁপায় 
গরীব লকের মুণ্ডুটাকে ছিঁড়ে খাত্যে বতর খুঁজে 
রাগের মাথায় গরগরায়।
কিন্তুক খাড়া শিরদাঁড়া টান টান বুকে 
আমরা সবাই বুধন সদ্দারের এক একটো কাঁড় বাঁশ ( ই পোস্টার গুলান )
২  লিখাপড়াই আসলি চইখ  আঁধার ফাঁড়া সুজ্জি বটে ( পুরুল্যার বইমেলায় কুড়ুকতুপার ছিদাম বাগদী )
৩  স্বাধীনতা কি না খাত্যে পাওয়া মানুষের পেটে বন্দুকের গুঁতা ? ( কইলকাত্তার লে দিল্লী কদ্দুর) 
৪ বাপের বেটা মরদ যদি লড়াই করার মাঠে ইবরে দেখা হবেক ( বাপের বেটা মরদ যদি) 
৫ সুখ আইসবেক ঢেঁড়রা পিটে 
৬ ভোগার কানি পইড়ছে খইসে নাইখ জুটে মাড়
দেনায় দেনায় বিকাই গেল বুকের কটা হাড়
ই বতরে লিলেক কাইড়ে ভিটার মাটি ভুঁই 
মু নুহায়্যে  ঘর বাছুর‍্যা বাঁচবি কদিন তুই? ( ঘর বাছুর‍্যা)
মাড় ভাতের লড়াই কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলি  তার নান্দনিক অভিব্যক্তিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। একটি ভাবাদর্শের সংরূপ প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি প্রাকরণিক শৈলীর কথাও বিশেষভাবে বলা দরকার। কবিতার যে দীপ্তি , মহিমা এবং সম্পন্নতা বিদ্যায়তনিক প্রতর্কের বাইরে বেরিয়ে সেই শৌর্যের কথা শুধুমাত্র উদ্ধৃতি দিয়েই অনুভব করা যাবে। 
  কী নাম বেটে ? কুন গাঁয়ে ঘর?
কিষ্টা কাঁড়ার নাম টো শুনি 
গাঁয়ের নাম টো উদলবনী 
একলা থাকে ঝুপড়ি ঘরে
কেও কুথা নাই বইলতে লিজের 
রোজ হাঁইটে যায় ই পথ দিয়ে ডহর ডাঙা ডুংরি পিরাই
সকাল বেলি হুই সহরে। ( লকটা সাচ্চা কমিউনিষ্টি ) 
২ 
 ধামসা এবং মাদলে
হুর গিজা ধিন গা দলে
পাহাড়তলি ভইরে গেলেক
মহুল রসের বাদলে ( অযুধ্যা পাহাড়ে )
  কাঁদিস কেনে হাত পা লাইড়ে কালাহান্ডির মা? 
ভাত নাই ত কী হইয়েছে , ছিলার মাথা খা । (কালাহান্ডির মা)
৪ 
 ইস্ত্রি করা জামা পরা আপনারা সব বাবু আছেন
ট্যাঁইড় টিকরে চইলতে গেলে লরম পায়ে ফুইটবে কাঁটা 
তাই ত বলি ডহর ডাঙা ডুংরি পিঁরাই যাবেন কেনে ?
ডি ডিহালী অমন গাঁয়ে? গটা গায়ে লাইগল্যে ধুলা 
ধুলুক ধূসর হইয়ে যাবেন ভাইল্যে থাকা সবার ঠেনে। 

ছুটু লকের ছেঁদা কথায় বাবুগুলান যাবেক কেনে ? ( বাবু গুলান যাবেক কেনে ) 
 আষাঢ় মাসে টাটা রোদে আফর পুড়া পুড়া 
জল কাদা নাই কদ্যাল দিয়ে টাইড়ের মাটি খুঁড়া 
টুগদুখানি ছাচাগড়্যা জল নাই – ধ্যুৎ 
জল ই ত লয় ঘরবাছুর‍্যার ছুরুক ছুরুক মুত ( ঘর বাছুর‌্যা) 
এই কবিতা সমূহের ভেতর রয়েছে সহজ এবং সরল ভাবনায় বৃহত্তর অংশের মানবমুক্তির কথা, তাদের চেতনা- জাড্যের বলয় থেকে নিষ্ক্রমণের আন্তরিক তাগিদ এর পাশাপাশি কবিতানির্মাণের ক্ষেত্রে নতুন এক পথের উদ্ভাসন। বিখ্যাত সমাজচিন্তক শ্লেগেলের কিছু কথা এ প্রসঙ্গে বলা যেতেই পারে -  poetry is the expression of secret longing for the chaos which is perpentually striving for new and marvelous births, which less hidden in the very womb of orderly creations . 
মাড় ভাতের লড়াই শুধু নয় মোহিনীমোহনের কবিতার সমগ্রতল জুড়ে রয়েছে  লোকায়ত জীবনের সমৃদ্ধ অনুভবের শাব্দিক প্রকাশ। গ্রামীণ অর্থনীতি মহাজনী শোষণ জোতদার মোড়ল এবং সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা থেকে আরম্ভ করে সাম্প্রতিক কালের ক্ষমতাশীল মানুষের লোভ প্রতারণা নিরন্ন মানুষগুলিকে কীভাবে আরও বিপন্নতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে বিভিন্ন চিত্র এবং তা থেকে নিষ্ক্রমণের পথ।  মননবিশ্ব এবং জীবনবোধের সামগ্রিক পরিসর উঠে আসে তার কাব্যিক বৈচিত্রে। প্রান্তিক  মানুষের প্রতিদিনের লড়াই এর সাথে পুঁজিবাদ উপনিবেশবাদ সামন্ততন্ত্র  মৌলবাদ   এবং সাম্রাজ্যবাদী  আগ্রাসন কীভাবে জড়িয়ে থাকে,  রাষ্ট্রীয় প্রতাপে কীভাবে মদতপুষ্ট হয়ে উঠে তাদের চেহারা সময়ের সেই কূটাভাসই মূর্ত হয়ে উঠে  দায়বদ্ধ কবির চেতনায়।

পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments