জ্বলদর্চি

হাতিঠাকুরের পূজা /ভাস্করব্রত পতি

পশ্চিমবঙ্গের লৌকিক উৎসব, পর্ব -- ৫০

হাতিঠাকুরের পূজা

ভাস্করব্রত পতি

সেটা ১৯৯৮ এর ৩১ অক্টোবরের ঘটনা। ঝাড়গ্রামের বরাগুলির জঙ্গলে দুই মর্দা হাতির তুমুল লড়াই। সে এক ভয়ানক যুদ্ধ। টানা ১৮ ঘন্টার হাড়হিম করা বৃংহন। অবশেষে এক পুরুষ দাঁতালের পরাজয় ঘটে প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। মৃত্যু হয় গজপতির। সেই ঘটনার স্মৃতি চাগিয়ে রাখতে শুরু হয় হাতিঠাকুরের মূর্তি তৈরি এবং তাঁদের দেবতাজ্ঞানে পূজা। 'হাতি'র সাথে 'ঠাকুর' শব্দ যুক্ত করে 'হাতিঠাকুর' সৃষ্টি। আসলে হাতির প্রতি চরম ভয় এবং ভক্তির মিশেলে এহেন নামকরণ।


N.H. 16 এ বালিভাসা চক থেকে উত্তরে মানিকপাড়া আর দক্ষিণে পাঁচ কিলোমিটার দূরেই বরাশুলি গ্রাম। কিছুটা পিচ রাস্তা ধরে দক্ষিণে গেলে পড়বে মোরাম বিছানো পথ। অবশেষে মিলবে রাস্তা হারিয়ে ফেলার এক গোলোকধাঁধা। সামনে তখন ব্রিটিশ আমলের পরিত্যক্ত বিমানবন্দরের কংক্রিটের রানওয়ে। চারিদিকে অবিন্যস্ত শালগাছ। রানওয়ের সেই চওড়া ঢালাই রাস্তায় যথাযথ দিশা খুঁজে কিছুটা এগোলেই বরাশুলি গ্রাম। মোরাম রাস্তার ডানদিকে বড় একটা পুকুরের পাড়ে হাতি ঠাকুরের থান। বন দফতরের উদ্যোগে বাঁধিয়ে দেওয়া হয়েছে হাতিপুকুরের পাড়। রীতিমত নয়নাভিরাম দৃশ্য। সেখানেই নিম গাছের গোড়ায় মাকড়া পাথরের চাঙড়ের ওপর সেদিনের মহাযুদ্ধের নিহত হাতির কংক্রিটের অবয়ব। গ্রামবাসীদের হাতিঠাকুরের থান। বৎসরান্তে পূজা হয় এখানে। ফি বছর ৩১ শে অক্টোবরেই বসে হাতিঠাকুরের পূজা। হাতির মৃত্যুর তিন বছর বাদে ২০০১ সালে এই বরাশুলি গ্রামের পরমেশ্বর মাহাতো তৈরি করেন হাতিঠাকুরের মূর্তি। তাঁর মনের কোনে যায়গা ধরে নিয়েছিল ঐ মৃত হাতির কান্না। এই মূর্তিটি বানান ক্ষেমাশূলির মহাদেব রাণা। বরাশুলির পাশাপাশি থাকা বালিভাসা, দুধকুণ্ডি, হরিয়াধরা, বাদিনা, সগড়ডাঙা, ইন্দখাঁড়া, বলদমারা, বারডাঙা, কলসিভাঙা, গহিরা, চৌকিচটির মতো গ্রামগুলির মানুষ এই হাতি ঠাকুরের মেলায় অংশগ্রহণ করে। আগত পুণ্যকামী মানুষজন তাঁদের মনোস্কামনা পূরণের জন্য পূজা দেন হাতিঠাকুরের পায়ের কাছে। কোনো প্রথাসিদ্ধ মন্ত্র নেই। কোনো বাহুল্য নেই। নারকেল, ধূপ, সিঁদুর আর বাতাসাই পূজার মূল উপকরণ। হাতি ঠাকুরের থানে যে যাঁর নিজের মনোবাঞ্ছা পূরণে মনে মনে তা কামনা করে উপকরণ হিসেবে নিয়ে আসা নারকেল ফাটিয়ে দিলেই পূজার্চনা শেষ। সারাদিন ধরে মেলা উপলক্ষে বসে জঙ্গলমহলের নিজস্ব ঝুমুর গানের আসর, ফুটবল প্রতিযোগিতা, যাত্রার আসর সহ নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
ঝাড়গ্রামের বিনপুর ব্লকের সাতবাঁকি গ্রামে ২০১৯ এর জুলাইতে যখন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যু হয় পাঁচটি হাতির, সেদিন মৃত হাতিদের স্মরণে ১১ দিনের মাথায় শ্রাদ্ধবাসর বসে এলাকায়। পঙতিভোজনের আয়োজনও করা হয়েছিল। এ এক অনন্য লৌকিক উপচার। এখানে দৈবশক্তির প্রতি নয়, বন্যপশুর প্রতি মানুষের সহমর্মিতা এবং আন্তরিকতা প্রাধান্য পেয়েছে সম্পূর্ণ মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে। আসলে পশুদের প্রতি মানুষের ভালোবাসা চিরন্তন। এই উপচার তারই ফলশ্রুতি। তেমনি পশ্চিম মেদিনীপুরের এনায়েতপুরের কাছেও রয়েছে বিখ্যাত হাতিধরা মন্দির। 

আরও একটা ঘটনা ঘটে ১৪১৯ বঙ্গাব্দের ৩ রা ফাল্গুন। সেদিন গভীর জলে তলিয়ে গিয়েছিল মা হাতি সহ তাঁর দুই বাচ্চা। এরপরেই এহেন মর্মন্তুদ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গ্রামের মানুষ পাথরাজুড়ি ও চন্দনকাঠ গ্রামের মধ্যবর্তী স্থানে ঐ মৃত হাতিদের মূর্তি বানিয়ে পূজা করা শুরু করে 'হাতিঠাকুর' হিসেবে। প্রতি বছর দুদিন ধরে (৪ - ৫ ফাল্গুন) চলে মেলা। বরাশুলির মতো এখানে এই উপলক্ষে আয়োজিত হয় ঝুমুর, মুরগি লড়াই সহ নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। গ্রামবাসীরা হাতিঠাকুরকে পূজা দেন নারকেল, ফুল, কলা, বাতাসা, ধূপ, সিঁদুর দিয়ে। গ্রামের গরিব গুর্বো খেটে খাওয়া মানুষদের একান্ত নিজস্ব ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধার পরিস্ফুটনেই অবলা জন্তুর মৃত্যুতে তাঁকে দেবতা বানিয়ে পূজার্চনা। 

জঙ্গলমহলের বহু এলাকায় বন্য নানা দেবতার থানে দেওয়া হয় হাতি ঘোড়ার ছলন মূর্তি। আসলে বিশ্বাস যে দেবতার থানের রক্ষাকর্তা এই হাতি। আর দেবতারা এই হাতির পিঠে চেপেই গ্রাম থেকে গ্রামে ঘোরাঘুরি করেন। আর বহু এলাকায় স্বয়ং হাতিকেই দেবতার আসনে বসিয়ে পূজার্চনা করা হচ্ছে। বিশিষ্ট শিক্ষক এবং প্রকৃতিপ্রেমিক রাকেশ সিংহ দেব 'ঠাকুর' ও 'দেবতা'র মধ্যে যে সামান্য পার্থক্য রয়েছে তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন। তিনি জানান, "জঙ্গলমহলে ঠাকুর বলতে দেবতার প্রতিনিধিত্বকারী ব্যক্তি, বস্তু বা শক্তিকে উল্লেখ করা হয়। এককথায় উপ দেবতা। হাতিও সেরকম হাতি ঠাকুর। গ্রামের প্রান্তে গরাম থানে গ্রাম দেবতা বা গরাম গোঁসাই এর বাহন হিসাবে পোড়ামাটির ছলনে হাতি ঠাকুরের পূজা হয়। এর পূজার উপকরণ - পোড়ামাটির হাতি ঘোড়া, ধূপ, সিন্দুর, ফুল মালা, ঘট চাঁদমালা, নারকেল, বাতাসা। হাতি ঠাকুরের পূজার কোনও মন্ত্র নেই। করজোড়ে নিজের মানত জানিয়ে নিজের হাতে নিজের পূজা দেওয়ার নিয়ম। গরাম পূজার আচার নিয়ম এখানে মানা হয়। এই পূজা পুরোটাই ভক্তিমূলক। আচার সর্বস্ব নয়"।
হাতি ফসলের ক্ষতি করে। মানুষের ক্ষতি করে। তবুও সাধারণ মানুষের কাছে 'হাতিঠাকুর' শিরোপা পায়। বন্য এই জন্তুটি বেশিরভাগ সময় এতদঞ্চলের মানুষের কাছে ত্রাসের সঞ্চার করলেও মানুষ কিন্তু হাতিকে ঠাকুরের মর্যাদা দিতে কার্পণ্য করেনা। অনেকেই ভাবেন হাতি হল সাক্ষাৎ গনেশ দেবতা। কারোর কাছে হাতিঠাকুর এই জঙ্গলের রক্ষাকারী সৈনিক। জঙ্গলমহলের নিজস্ব পরিচায়ক এই হাতি। পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিমপ্রান্তের জেলাগুলির পরতে পরতে লুকিয়ে আছে হাতি কেন্দ্রিক মিথ। খাবারের খোঁজে গ্রামের ক্ষেত খামারে চলে আসা হাতির পালের কাহিনী এবং অভিজ্ঞতা সেই এলাকার মানুষের কাছে বিভীষিকাময় হলেও নিজেদের সুস্থ এবং নির্বিঘ্ন জীবনের আশায় সেই দুর্দমনীয় হাতিকেই প্রনম্য দেবতার স্থানে আসীন করেছে এক শ্রেনীর ভয়াতুর মানুষ। তাই যুগের পর যুগ ধরে আদিবাসীদের কাছে হাতি প্রাধান্য পেয়েছে নানা ভাবে। 

হাতি এঁদের দৈনন্দিন জীবনের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে রয়েছে। তাই হাতি হয়ে উঠেছে লৌকিক ধর্মচারণের প্রতিভূ। তাই বিভিন্ন থানে পোড়ামাটির হাতি দেওয়ার চল রয়েছে। রীতি রয়েছে। উল্লেখ্য যে, জঙ্গলমহলের কুড়মিদের উল্লিখিত ৮১ টি গোষ্ঠীর একটি ‘বানুআর’ গোষ্ঠীর লোকজনের টোটেম হলো 'হাতি'। আর 'টোটেম' নির্ভর করে জনজীবনের সঙ্গে জীবনযাত্রার ওতোপ্রোত সংস্পর্শ থেকে। বিভিন্ন থানে পোড়ামাটির হাতি ঘোড়া দেওয়ার চলন সম্পর্কে তথ্য সমৃদ্ধ বিশ্লেষণ করেছেন গবেষক শিক্ষক রাকেশ সিংহ দেব। তিনি লিখেছেন, "হাতি ঘোড়ার উপর অদ্ভুত সৌন্দর্যময় টেরাকোটার কাজ শুরু করেন শিল্পীরা। বিশেষ আকারের এই হাতিদের বলা হয় 'বোঙা হাতি'। 'বোঙা' শব্দের অর্থ হল অশরীরী শক্তি। দেবতা ও অপদেবতা দুই অর্থেই এটি ব্যবহার হয়। 'বুরু বোঙা' হলেন পাহাড় দেবতা, 'ডহর বোঙা’ হলেন পথদেবতা, 'অড়া বোঙা' হলেন গৃহদেবতা। আদিবাসীদের ধারনায় সর্বত্র বোঙা বা ঐশ্বরিক শক্তির আবাস স্থান। মল্লভূমে সাঁওতাল উপজাতির বহু মানুষ বসবাস করে। তারা পোড়ামাটির কাজে খুবই দক্ষ। টেরাকোটার হাতি বানিয়ে সাঁওতালরা তাঁদের উপাস্য সূর্য দেবতা 'সিঞ বোঙা'-র কাছে উৎসর্গ করে। সেখান থেকেই 'বোঙা হাতি' নামটা এসেছে। শুঁড়ের দৃপ্ত ভঙ্গি, শরীরের কাঠামোয় আশ্চর্য সামঞ্জস্য, গায়ে গয়নার কারুকার্য সব মিলিয়ে এক বিমূর্ততার ছোঁয়া বোঙা হাতিকে অনন্য করে তুলেছে। আটপৌরে ঘরানায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে অভিনব হাতির অবয়ব। লোকশিল্পে বোঙা হাতির জন্ম তাই আঞ্চলিক আদিম আরণ্যক শিল্পকলার স্মৃতিবাহী। মৃৎশিল্পের এই উৎকর্ষতা সম্ভব হয়েছে লোকধর্মের কারণেই"।

মানুষের বিশ্বাস যে, হাতির মৃত্যু আসলে দেশের ও দশের অমঙ্গল ডেকে আনে। হাতির দল গ্রামে এলে যতটা ফসলের ক্ষতি করে তার থেকে বেশি বেশি মঙ্গলজনক গ্রামে হাতিদের দৃপ্ত পদচারণা ঘটলে। এই সহজ সরল বিশ্বাসকে পাথেয় করেই হাতিদের বিচরণক্ষেত্র এলাকায় এক অভিনব লৌকিক উৎসবের ধারনা গড়ে উঠছে প্রতিদিন। হাতির মৃত্যুতে হাতির স্মরণে সকলের মঙ্গল কামনায় আয়োজন করা হচ্ছে শান্তিযজ্ঞ ও পূজাপাঠ। ঠিক একই ভাবে কোনো এলাকায় হনুমানের মৃত্যুতে যেমন হনুমান মন্দির গড়ে উঠছে, তেমনি হাতির মৃত্যুতেও হাতিঠাকুরের মন্দির গড়ে উঠছে। কোনো বাগড়াম্বরী নেই। কোনো শাস্ত্রীয় নিয়ম নেই। গ্রামের নিপাট নিরীহ মানুষের একান্ত ভালোবাসার Soft Corner থেকে এই বিরল লৌকিক উৎসব কিংবা উপচার হাতিঠাকুরের পূজা।

পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments