জ্বলদর্চি

যেতে যেতে পথে-৫৪/রোশেনারা খান

যেতে যেতে পথে
রোশেনারা খান
পর্ব ৫৪

২০১২ সালে অজান্তে আমরা আমাদের পরিবারে বিষবৃক্ষ রোপণের ক্ষেত্র তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে উঠলাম। ছেলের বিয়ে ঠিক করে ফেললাম। ঘটক একটি মেয়ের ছবি ও বায়োডাটা দিয়ে গেছলেন, মেয়ের আদি বাড়ি পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার রোড চন্দ্রকোনায়। বাবা হলদিয়াতে ঠিকাদারি করেন, মেয়ে ওখানেই পড়াশোনা  করেছে। মেয়ের দাদার সঙ্গে যোগাযোগ করতে, কিছুক্ষণ পরে জানাল ওর বোন আজই রোড চন্দ্রকোনা আসবে। আমরা আগামিকাল দেখতে গেলে ভাল হয়। পরদিন আমরা  দুজনে গেলাম। অবস্থাপন্ন পরিবার। আপ্যায়নে ত্রুটি রাখেনি। মেয়েটির যমজ বোনের কয়েকবছর আগে বিয়ে হয়ে গেছে।বছর তিনেকের একটি বাচ্চা আছে। সে ও এসেছে। পাত্রী একাই আমাদের সামনে এসে বসল। মেয়ে দেখতে মোটামুটি,  বাংলায় মাস্টার ডিগ্রী করেছে। বয়স জানালো ২৮ বছর। বাবা হাজি শুনে, সব মিলিয়ে ভাবলাম, মেয়ে বিনয়ী হবে, আদব কায়দা জানবে, ছেলার সঙ্গে মানিয়ে  নিতে পারবে। ওদের পীড়াপীড়িতে আমার বকুলও গিয়ে মেয়ে ধেকে এল। আসলে মেয়ে ও দেখেনি,  ওরা পাত্র দেখেছে। সুপুরুষ বলতে যা বোঝায়, আমার ছেলে তাই। আগেই জানিয়ে দিয়েছিলাম, আমাদের কোনো দাবি নেই। ওরা স্বেচ্ছায় দিতে চাইলেও নেব না।
      একমাত্র ছেলের বিয়ে, একমাত্র মেয়ে জামাই উপস্থিত থাকবেনা তা কি করে হয়? ওরা ফেব্রুয়ারির আগে আসতে পারবেনা। তাই ঠিক হল আমারা কয়েকজন মিলে গিয়ে আপাতত ‘কাবিলনামা (ইসলামি মতে সরকার নিয়জিত কাজির দ্বারা রেজিস্ট্রি বিয়ে)’করে রেখে দেব। ফেব্রুয়ারি মাসে আনুষ্ঠানিক বিয়ে  হবে। সেইমত দিন ধার্য হল। ছেলের আপত্তি স্বত্বেও এক পাপাত্মা কে আমার সুখের সংসারে থাকার ছাড়পত্র দিলাম। শুধু কাবিলনামার কথা হয়ে থাকলেও ওরা গায়েহলুদের  তত্ব পাঠাতে বলল। ওর ছোটমামা গিয়ে দিয়ে এল। কাবিলনামার জন্যও বাজার করলাম। জুলাই এ আমরা আর ছেলের কয়েকজন বন্ধু(?)ওদের বাড়িতে গেলাম। মেয়েক দেখি গা’ভর্তি গহনা, ল্যাহেঙ্গে পরে মেকআপ করে বসে আছে। যেটা আমাদের বিয়েতে চলেনা। বিয়ের ওই সময়টুকু মেয়ে ও ছেলেকে পাক গোসল (পবিত্র স্নান)করে উজু করে বিয়ের আসনে বসতে হয়। কোনও মেকআপ  চলে না। হাজির বাড়িতে এসব কাণ্ড দেখে আশ্চর্য হলেও কিছু বললাম না। ওরা কাবিলনামা ছাড়াও মৌখিক বিয়েও দিল। ছেলেকে হিরে বসানো আংটি দিয়ে আশীর্বাদ করল। আমি আগেই কানের দুল দিয়ে আশীর্বাদ করেছিলাম। সেদিনের মত সব মিটে গেল। আসলে মিটল না, ভিতরে ভিতরে মারাত্মক এক বিপর্যয়ের সূত্রপাত ঘটল।
    ২০১৩ র ফেব্রুয়ারি মাসে ইংল্যান্ড থেকে মেয়ে জামাই নাতনি এল। আগেই কলকাতা থেকে বিয়ের বাজার করে রেখেছিলাম। আমাদের বিয়েতে কনের সাজপোশাক, প্রসাধন সামগ্রী ছেলের বারি থেকে দিতে হয়। মোহিনীমোহন কাঞ্জিলাল থেকে দু’জনে গিয়ে কনের বেনারসি ও অন্যান্য জিনিস কিনে এনেছি। আমার সব থেকে পছন্দের ময়ূর নেকলেস কানের দুল আংটি রেখেছি আমার একমাত্র ছেলের বৌয়ের জন্য। ওর দিদিও টাকা পাঠিয়ে ছিল ভাইয়ের বৌয়ের নেকলেস কেনার জন্য, সেটাও কিনে রেখেছি। ওর জন্ম ১৪ ফেব্রুয়ারি বলে ১৫ ফেব্রুয়ারি আমরা জনা ৩০ বরযাত্রী নিয়ে গিয়ে নতুন বৌকে বাড়ি নিয়ে এলাম। ১৬ ফেব্রুয়ারু আমরাও বৌভাত করলাম। বকুল পরিস্থিতিটা  স্বাভাবিকভাবে মানিয়ে নিতে পারছে না, বুঝতে পারছিলাম, তাই ও রামপুরহাট (ওর কর্মস্থল) চলে যেতে চাইলে,  বাধা দিলাম না। ওরা সম্ভবত ১৮  ফেব্রুয়ারি রামপুরহাট যাওয়ার সময় রোড চন্দ্রকোনায় শ্বশুরবাড়িতে দেখা করে গেল। বকুল আগেই বাড়িভাড়া নিয়ে একটা সংসারে যা যা প্রয়োজন হয়,  খাট আলমারি টিভি ফ্রিজ,বাসনপত্র আরও অন্যান্য জিনিস কিনে সাজিয়ে রেখেছিল। যাতে কোনো সমস্যায় পড়তে না হয়। কিন্তু ভাগ্যের  লিখন খণ্ডাবে কে? পরদিন থেকে বকুল অসুস্থ হয়ে পড়ল। দীপ বলল,  ভয়ের কিছু নেই। এটা অনেক সময় হয়, আপনা থেকে সেরেও যায়।


জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


জ্বলদর্চি তিরিশ পেরিয়ে... 
      মার্চের মাঝামাঝি সময়ে আমরা দু’জন ছেলে-বউয়ের নতুন সংসার দেখতে গেলাম। বকুল একটু রোগা হয়ে গেছে, ঠিকমত খাচ্ছে না। এখানে ডাক্তার দেখিয়েছে। ডাক্তার কতকগুলো টেস্ট দিয়েছিলেন, আমরা থাকা কালে রিপোর্ট এলে  দেখলাম সবই প্রায় নর্মাল। এক সপ্তাহ থেকে ফিরে এলাম। এদিকে খান সাহেবের কিডনির সমস্যর সঙ্গে নানারকম শারীরিক সমস্যা শুরু হল। আমি ওনাকে মেদিনীপুরের জোসেফ হাসপাতালে একজন  বিশেষজ্ঞকে দেখালাম। ওনার মনের সন্দেহ দূর করতে ডাক্তার কোলোনোস্কোপি করলেন। কিছুই পাওয়া গেল না। আসলে ওনার ঠিকমত ‘বাওল পাশ’ হচ্ছিল না, তাই উনি সন্দেহ করছিলেন ভিতরে কিছু আছে (টিউমার)। ডাক্তার বললেন, কোনো কারণে এই প্রক্রিয়াটি স্লো হয়ে গেছে।
      ছেলেকে ওর শ্যালক এপোলো নিয়ে গেল চেকআপের জন্য। ওরা কলকাতায় মেয়ের ফ্ল্যাটে থাকল। আমাদের বাড়িতে এসে ছেলেরবৌ থাকতে চাইত না। তাই কলকাতায় থাকছে। এখানে যে কয়েকটা দিন থেকেছে, তাতে ওর হাবভাবে বোঝা গেছে আমাকে সহ্য করতে পারছে না। সেটা আরও পরিস্কার হয়ে গেল ছেলের বন্ধু যখন বলল, ‘কাকিমা আপনি এখন আসবেন না, পারভেজের স্ত্রী চাইছে না’। আমার রাগ ও কষ্ট দুটোই হলেও চুপ থাকলাম, পরে গেলাম। এভাবেই বেশ কয়েকমাস কেটে গেল। এদিকে খান সাহেব ক্রমশ অসুস্থ হয়ে পড়তে লাগলেন। আমার দিশাহারা অবস্থা। দীপ ইংল্যান্ড থেকে ডাক্তারের খোঁজ করতে শুরু করল। ওর এক বন্ধু রাজেশ সেইসময় রেডিওলজিস্ট হিসেবে কলকাতার ফরটিস  হাসপাতালে কাজ করত। রাজেশ সুচন্দ দাস নামে এক নেফ্রোলজিস্টের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেয়। খান সাহেবকে আমি ফরটিসে  চেকআপে নিয়ে গেলাম। উনি কিছু টেস্ট করতে দিলেন না। ওষুধ লিখে দিলেন। আর কী খাবেন,  কি খাবেন না, সেটা বলে দিলেন। ছেলে নিয়মিত খবর নেয়, কিন্তু বুঝতে পারিনি ছেলে আমার থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। ওকে বাড়ি আসতে বলাতে যা উত্তর পেলাম, তা কখনও আশা করিনি। কিছুদিন পর ও একা এসেছিল। একরাতের জন্য। তারপর ‘আনলাকি থার্টিন’ সব তছনছ করে দিল। ২০১৪র ১৪ ফেব্রুয়ার,  ওর জন্মদিনে বাড়ি আসতে বলেছিলাম। ও আসতে পারেনি, আসতে দেওয়া হয়নি। পরের ইতিহাসটুকু থাক।সম্ভব হলে কোনো একদিন শোনাব।
    ২০১৪তে জীবনটা একেবারে বদলে গেল। জীবন এভাবে অন্ধকারে পথ হারাবে, স্বপ্নেও ভাবিনি। জীবনের এক নতুন অধ্যায় শুরু হল। আমি সবকিছু মেনে নিয়ে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলাম। এটা আমাকে পারতেই হবে, না হলে এই অসুস্থ মানুষটাকে কে দেখবে? শুরু হল নতুন করে লড়াই, এ লড়াই আমার একার। লেখালেখি আর হয়ত হবে না। তাই যে লেখাগুলি আছে, হারিয়ে যাওয়ার আগে সেগুলিকে মলাট বন্দি করার কথা ভাবলাম। কিন্তু আমি তো সেরকম কোনো প্রকাশককে চিনিনা! এখানে অনেক প্রকাশক আছেন, কিন্তু আমি কলকাতায় আমার বইটি করতে চাই। ভাবতে ভাবতে মনে পড়ল, ‘প্রদীপ ভট্টাচার্যর কথা। বাসবি চক্রবর্তীর ‘নারী পৃথিবী বহুস্বর’ গ্রন্থটি প্রদীপবাবুর প্রকাশনা ‘একালের রক্তকরবি’ থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। আমার লেখাটি সরাসরি ওনাকেই পাঠিয়েছিলাম। উনি আমার লেখার খুব প্রশংসা করেছিলেন। তাই ওনাকেই ফোন করে বই প্রকাশের ইচ্ছের কথা বললাম। উনি রাজি হলেন এবং জানালেন ২০১৫ র বই মেলায় আমার বইটি প্রকাশ করবেন। টাকার অঙ্কটা বেশিই বললেন। কিন্তু  আমার এবিষয়ে কোনো ধারণা নেই। তাই রাজি হয়ে গেলাম। হাতে লিখেই পাণ্ডুলিপি পাঠালাম। গ্রন্থটির নাম ঠিক হল ‘আমি নারী’ আর একটি ছড়া সঙ্কলন প্রকাশের দায়িত্ব মেদিনিপুরের ‘কবতিকা’র প্রকাশক কমলেশ নন্দকে দিলাম।
    সমস্ত কষ্ট, যন্ত্রণা, অন্যায়, অত্যাচার ভুলে থাকতে লেখায় মন দেবার চেষ্টা করতে লাগলাম। বাবলি প্রায় প্রত্যেক দিন ফোন করে নটিংহাম যাওয়ার জন্য বলছে। খান সাহেব প্রথমে রাজি হচ্ছিলেন না। আমার কাকুতি মিনতিতে শেষ পর্যন্ত রাজি হলেন। আবার ভিসা ও টিকিটের জন্য এজেন্ট অসিত রায়ের সংগে যোগাযোগ করা হল। পয়সাতে কী না হয়। অসিত দাস বললেন ভিসার জন্য একদিন কলকাতা ভিসা অফিসে যেতে হবে। টিকিত উনি বাড়িতে পৌঁছে দেবেন। আমি ব্যাগ-সুটকেশ  গুছতে শুরু করলাম।
                                ক্রমশ

 

Post a Comment

0 Comments