জ্বলদর্চি

দেশান্তরীর ইতিকথা /হিল্লোল রায়

দেশান্তরীর ইতিকথা

হিল্লোল রায়


হৃদয়ের কথা বলি আজ হেথা

রামধনুর পরশ পাওয়ার স্বপ্নে গোধূলী লগ্নে গন্ড গ্রাম হাবড়ার অন্তর্ভুক্ত অজ পাড়া-গাঁ হিজলপুকুর-এ আমার জন্ম। পশ্চিমবঙ্গ স্টেট- এর উত্তর চব্বিশ পরগণায় হাবড়া-হিজলপুকুর এর অবস্থান। এখানেই গড়ে উঠেছিল আমার বাল্য-কৈশোর জগৎ। পড়াশোনা হাবড়া উদ্বাস্তু প্রাথমিক শিক্ষানিকেতন এবং হাবড়া হাইস্কুল(মাল্টিপারপাস)। পৃ্থিবীটাকে চেনার ঠিক মুহূর্তেই পিতৃহারা হলাম। ভাগ্যের পরিহাসে মানুষ হতে লাগলাম মাতামহ-র আশ্রয়ে। দৈনন্দিন পারিবারিক ঝড়ঝাপ্টা শৈশবের কচি মনটাকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিল। উপযুক্ত পোশাকের অভাবে স্কুলের সহপাঠীদের বিদ্রুপ পরিহাস মনটাকে বিষাক্ত করে দিচ্ছিল। একটা প্রবল জেদের বশবর্তী হয়ে পড়েছিলাম। পড়াশুনার সময় ছাড়া বাকি সময় খালি নিজের পায়ে দাঁড়াবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যেতাম। আর এই চেষ্টাই আমাকে পথ দেখাতো ক্লাসের সেরা ছাত্র হওয়ার। সমস্ত পরীক্ষায় প্রথম হওয়ার আনন্দ আমার সামনে এগিয়ে যাওয়ার রাস্তা মসৃণ করে দিত।

আমি যখন সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র, তখন হাবড়া হাইস্কুল- এর ভূগোল শিক্ষকমহাশয় পড়াবার সময় ক্লাসের ছাত্রদের বলতেন, “পৃ্থিবীতে এমন একটা দেশ আছে যার সংগে আমাদের দেশ ভারতবর্ষের সময়ের ব্যবধান বারো ঘণ্টার কাছাকাছি, অর্থাৎ ভারতবর্ষে যখন রবিবারের সকাল এগারোটা, আমেরিকায় তখন শনিবার রাত সাড়ে এগারোটার কাছাকাছি।” প্রথম প্রথম সময়ের এই তারতম্য শুনে বিশ্বাস হত না। ভাবতাম সেটা কি করে সম্ভব। সন্দেহ নিরসনের জন্য শ্রদ্ধেয় শিক্ষক শ্রীযুক্ত রমেন্দ্র নাথ দত্ত-র কথায় স্কুলের লাইব্রেরীতে গিয়ে নানারকম বই ঘাঁটাঘাঁটি করে সুনিশ্চিত হলাম। বড় হবার সাথে সাথে বারো ঘন্টার সময় ব্যবধান রহস্য নিজের চোখে উপলব্ধি করার ইচ্ছেটা প্রবল থেকে প্রবলতর হতে শুরু করে। স্কলারশীপ নিয়ে কৃ্তিত্বের সাথে হায়ার সেকেন্ডারী পাশ করলাম। তারপর সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার জন্যে ভর্ত্তি হয়েছিলাম বেংগল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ (বি.ই. কলেজ, শিবপুর)। আমি যখন বি.ই.কলেজ-এর চতুর্থ বর্ষের ছাত্র, তখন স্যানিটারী ইঞ্জিনিয়ারিং এর অধ্যাপক শ্রীযুক্ত দীপক ঘোষ আমাকে ভীষণ ভাবে উৎসাহিত করেন। আমি যেন আমেরিকায় গিয়ে এনভায়রণমেণ্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ হায়ার স্টাডিজ করবার জন্য যোগদান করি। আমারও ঝোঁক চেপে বসল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমেরিকায় গিয়ে পড়াশোনা করার জন্য।

হাবড়া হাইস্কুল থেকে পড়াশোনা শেষ করে ভর্তি হয়েছিলাম শিবপুরের বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ। কোর্স ছিল পাঁচ বছরের। সেখানে পড়াকালীন চতুর্থ বর্ষে যখন ছাত্র ছিলাম তখন রোড ইঞ্জিনিয়ারিং এর উপর একটি ক্রসওয়ার্ড পাজেল(puzzle) লিখেছিলাম। আর বলতে গেলে এটাই ছিল আমার দূর্গে প্রবেশ করার প্রথম চাবিকাঠি। কারণ এটি সায়েন্স রিপোর্টার ম্যাগাজিনে(Rafi Marg, New Delhi, India) প্রকাশিত হওয়ার জন্য নির্বাচিত হয়েছিল। এই ম্যাগাজিনটি কাউন্সিল অফ সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ (সিএসআইআর) কর্তৃক প্রকাশিত হত। এটি ছিল নয়াদিল্লির রফি মার্গে। এরপর আমেরিকা, রাশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা এই সমস্ত দেশ থেকে হঠাৎ করে আমার কাছে চিঠি আসে ফেলোশিপ এবং উচ্চশিক্ষার জন্য। কিন্তু কলেজে পড়াশোনা তখনও শেষ হয়নি। তাই চিঠি মারফত সকলের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলাম।

ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করার পর কলকাতায় কিছুদিন প্ল্যাকন লিমিটেড নামে একটি ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মে কাজ পাই। তখন মাইনে ছিল ২৫০ টাকা। সেই সময়-ই ঠিক করেছিলাম কিছুটা টাকা সঞ্চয় করা প্রয়োজন আমার। কারণ বিদেশ যাওয়ার আগে মা, ভাইদের জন্য অল্পবিস্তর কিছু ব্যবস্থা করে রাখা উচিত। এরই সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম ন্যাশানাল সায়েন্স ফাউন্ডেশন-এর সঙ্গে। নিজের যোগ্যতায় সেখান থেকে ফেলোশিপ এবং গ্রিন কার্ড পেয়েছিলাম। সালটা তখন ১৯৭৪। বলার অপেক্ষা রাখে না, এর সঙ্গে সঙ্গে সেদিন স্বপ্নের উড়ানে পাড়ি দেওয়ার ছাড়পত্র পেয়ে গিয়েছিলাম। অবশেষে আমেরিকা যাওয়ার স্বপ্ন পূরণের প্রথম ধাপ পাড় হলাম। সাল তখন ১৯৭৫। আমেরিকা যাওয়ার ছাড়পত্র তো পেলাম কিন্তু উপযুক্ত টাকা কোথায়? তাই হিজলপুকুর গ্রামের সকলে চাঁদা তুলে দিলে বেশ কিছু অর্থের জোগাড় হল।

এরপর কলকাতা থেকে নিউইয়র্কের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিলাম। সঙ্গে ছিল তিন ডলার, ছোট্ট একটি স্যুটকেস। অবাক করার মত বিষয়টি এখনও বাকি আছে। সেদিনই জীবনে প্রথম জুতো পায়ে দিয়েছিলাম। তার আগে জুতো কিনে পড়ার মতও সামর্থ্য ছিল না। কয়েকটা ভালো জামাকাপড়, প্লেনের ভাড়া, আর জুতো কিনেছিলাম গ্রামের লোকেদের সাহা্য্যার্থে। পৌঁছোলাম স্বপ্নের দেশে। সেখানে পৌঁছে প্রথমেই মনে হয়েছিল যেন স্বর্গের উপবনে ঢুকলাম। চারিদিক থেকে যেন রঙিন স্বপ্নেরা হাতছানি দিচ্ছিল। সেখানে গিয়ে শুরু করলাম নতুন ভাবে পথ চলা।


ইতিমধ্যে (১৯৭০-৭১ সালে) পশ্চিম বাংলার বিভিন্ন স্থানে ও বি.ই. কলেজ-এ নকশালী হামলা ও অরাজকতা শুরু হয়ে গেল। বিপর্য্যস্ত হয়ে উঠল বি.ই. কলেজ এর ছাত্র জীবন; ক্যাম্পাসে ছাত্রদের মধ্যে দলাদলি, সংঘর্ষ, ভাঙচুর, আগুন লাগানোর ব্যাপারগুলো মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। এমন কি ব্যক্তিগত নিরাপত্তাও ভয়াবহ হয়ে পড়ল। পরীক্ষাগুলোও পিছিয়ে যেতে লাগল এক থেকে দেড় বছর। বেশ কিছু ছাত্রের প্রাণহানি হল। মানসিক অস্থিরতা ও ভবিষ্যৎ চিন্তা করে আমেরিকায় যাওয়া ব্যাপারটাকে ধ্যান জ্ঞান হিসাবে নিয়ে নিলাম কলেজের পঞ্চম বর্ষের ছাত্র হতে না হতেই। ১৯৭৩ সালে বি.ই. পাশ করলাম প্রথম শ্রেণীতে। তারপর স্ট্রাকচারাল ও স্যানিটারী ইঞ্জিনিয়ারিং প্রজেক্টগুলোতে অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য প্রাইভেট কনসাল্টিং (ইঞ্জিনিয়ারস এ্যান্ড আর্কিটেক্টস) ফার্ম “প্ল্যাকন লিমিটেড” এ যোগ দিই।

প্ল্যাকন লিমিটেড এ দৈনন্দিন অফিস যাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে আমেরিকায় হায়ার স্টাডিজ এর ব্যাপারে খোঁজ-খবর নিতে শুরু করলাম। তার সাথে ইমিগ্র্যান্ট ভিসার(গ্রীণ কার্ড)ও প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে শুরু করি। ১৯৭৩-৭৪ সাল নাগাদ আমেরিকায় গ্রীণ কার্ড নিয়ে স্থায়ী বাসিন্দা হিসাবে ভিসার অনুমোদন পাওয়া পুরোপুরি বন্ধ ছিল। কলকাতার হো চি মিন সরণীতে অবস্থিত মার্কিণ দূতাবাসে ঘন ঘন হাজিরা দিতে লাগলাম, কবে থেকে “ইমিগ্র্যান্ট ভিসা” দেওয়া শুরু হবে, সেই বিষয়ে সঠিক খোঁজ খবর পাওয়ার জন্য। ধর্মঘট, বনধ, যানবাহন চলাচলে অবরোধ ও বিশৃঙ্খ্লার জন্য অফিসে নিয়মিত হাজিরা দেওয়া ও দূতাবাসে খোঁজখবর নেওয়া ক্রমশ:ই কঠিন হয়ে পড়ছিল। পারিবারিক ও পারিপার্শিক দূরবস্থা দেখে আমেরিকায় পাড়ি দেওয়াটাই একমাত্র মুক্তি লাভ এর সহজ উপায় বলে মনে হল। এপ্রিল ১১, ১৯৭৪ সালে সর্বপ্রথম পদার্পণ আমেরিকান কনস্যুলেট-এ। সেখানে খোঁজ নিয়ে জানলাম শুধুমাত্র এক সপ্তাহের জন্য "ইমিগ্র্যান্ট ভিসা” এ্যাপ্লিকেশন গ্রহণ করা হবে। আমি ও 'মা ভৈঃ' বলে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। ফর্ম(FS 497) জমা দিয়ে দিলাম কলকাতার আমেরিকান কনস্যুলেট অফিসে।

ছোটবেলা থেকেই আমার একটা বদ অভ্যাস জন্মেছিল অজানাকে জানার, অদেখাকে দেখার। নিজে নিজেই হারিয়ে যেতাম কোন এক রূপ-কথার অচিনপুরে। এখন মনে পড়লে কিন্তু খুব হাসি পায়। হেসেও ফেলি নিজের অজান্তে। পিতৃবিয়োগের পর যখন আমি বছর পাঁচেকের শিশু, মা-এর কথায়ঃ তখন থেকেই একগুঁয়েমি ভাবটা আমার মধ্যে নাকি প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছিল। আমার মনে তখন...

- “আসুক সহস্র বাধা, বাধুক প্রলয়,”

আমি তো ডরাইব না, রহিব নির্ভয়-

বয়োজ্যেষ্ঠদের তিরস্কার-স্নেহ-ভালবাসা সবই পেয়েছি; শুধুমাত্র নিজেকে সব যায়গায় মানিয়ে নেবার অসীম দক্ষতায়। বিশেষ করে, মাতুলালয়ে প্রতিপালিত হয়ে আজ সমস্ত কিছু চোখ-কান খুলে দেখার সুবর্ণ সু্যোগ পাচ্ছি। প্রাণের সুধারস সঞ্চয় করবার প্রচেষ্টায় নিজেকে সঁপে দিয়ে অজানাকে জানার কৌ্তূহল কিছুটা হয়ত নিবৃত্ত করতে পেরেছি।
(ক্রমশ)।

জ্বলদর্চি তিরিশ পেরিয়ে... 

Post a Comment

2 Comments

  1. অসাধারণ জীবনের প্রেক্ষাপট! পরবর্তী লেখার অপেক্ষায় থাকলাম!👍

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ। আজকে আবার পোস্ট করলাম।।জানাবেন কেমন লাগল।

      Delete