ভীমতালের রূপসাগরে
ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়
দেবভূমি উত্তরাখণ্ডের গাড়োয়াল হিমালয়ের অলঙ্কার যদি হয় প্রাচীন চারধাম তো গাড়োয়ালের পাশেই উত্তরাখণ্ডের কুমায়ুন হিমালয়ের অলঙ্কার হল পাহাড়ের আনাচকানাচ জুড়ে একের পর এক তাল বা হ্রদ। দেবতার স্থান মাহাত্ম্যে ভরপুর গাড়োয়ালের মত পুজোআচ্চা বা ভক্তিরসের প্রাবল্যে অতটা হাবুডুবু নয় কুমায়ুন। তবে একই নির্জনতা, নিষ্কলুষ সে পাকদণ্ডী পথে সবুজের অভিযান অটুট। কুমায়ুন যেন আরও কমনীয় তার তালগুলির টলটলে জলের স্পর্শে।
ভীমতাল শহর টি নৈনিতালের চেয়েও পুরনো। নৈনিতাল থেকে এর দূরত্ব প্রায় ২২ কিমি। নৈনি লেক দেখবার পর সমুদ্রতল থেকে প্রায় সাড়ে চারহাজার ফুট উঁচুতে এত বিশাল জলাশয় দেখে উল্লসিত মন। আমরা চলেছিলাম একে একে উত্তরাখণ্ডের মনোরম শৈল শহর নৈনিতাল, বিনসর, মুন্সিয়ারি, কৌশানি হয়ে ভীমতালের দিকে। কৌশানি থেকে ভীমতালের দূরত্ব ১১৫ কিমি। রাস্তায় থামতে থামতে গেলে যেতে সময় লাগবে ঘণ্টা পাঁচেক।
হোটেলে গরম মশলাদার চায়ের সঙ্গে ছোলে বাটুরে, উত্তাপম, অমলেট সবরকমে কব্জি ডুবিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে নিয়েছিলাম তাই রক্ষে নয়ত ভীমতাল পৌঁছনোর আগে এত যে তাল বা প্রাকৃতিক হ্রদের রমরমা তা বুঝিনি। প্রকৃতির কোল আলো করে পাহাড়ের ভাঁজে, খাঁজে, আনাচেকানাচে ছয়লাপ ছোটো বড় হ্রদ।এখানে বলে তাল। মন বলে ডিজিটাল ক্লিক ক্লিক। ওদিকে পাহাড়ে সন্ধে নামে তাড়াতাড়ি। তবুও ফোটো তোলার লোভ সামলাতেই হয়। কারণ ভালোভাবে দেখতে গেলে গাড়ী থেকে নামতে হবে আর পাহাড়ের সবুজ প্রকৃতির কোল আলো করা সেই হ্রদের ছবি নিতে নিতেই সে যাত্রায় বড় দেরী হল।
যাত্রাপথ যেন সবুজ থেকে সবুজতর হতে লাগল। কৌশানির ঘন পাইনবন আর বরফে মোড়া পাঁচচুল্লী শৃঙ্গ ছেড়ে আসতে বড় কষ্ট হচ্ছিল।
কুমায়ুনের দ্বিতীয় বৃহত্তম জলাশয় ভীমতালের পথ যেন আরও নৈসর্গিক। রডোডেন্ড্রনের কচি কিশলয় সবে মাত্র উদ্ধত গ্রীবা উঁচিয়ে আকাশমুখী সেই মে মাসে। ওক, চির সবাই যেন শীতঘুম থেকে উঠে আলিস্যি কাটিয়ে পাতার সবুজ ডানা ঝাপটাতে ব্যস্ত। সবজে রঙের শ্যাওলার চাদর জাপটে ধরেছে সুউচ্চ আকাশমুখী প্রকাণ্ড গাছের কান্ডকে। মাঝেমধ্যেই সেখানে যত্রতত্র বাঁদরের হুটোপুটি আর পাখির ডাকে মাতোয়ারা একলা জঙ্গলমহল। আমাদের প্রথম পিটস্টপ রাণীখেতের আর্মি মিউজিয়াম। তারপরে আবারও চলা। দুপুর সূর্য মাথায় নিয়ে হাজির হলাম নল দময়ন্তী তালে। সেখানে নাকি মহাভারতের নল দময়ন্তীর বিয়ে হয়েছিল। এবার এগোই সাততালের দিকে। আরও সুন্দর। মোহময় সেই তাল আসলে ছোটো ছোটো সাতটি ইন্টারকানেক্টেড হ্রদের সমাহার। গোটা সাততালের ভরভরন্ত রূপ দেখে মোটেও তা বোঝা যাবেনা। সেখানে নেমে জল ছুঁয়ে আসি। হ্রদের পাড়ে দুদণ্ড বসে মাছ দেখি। গাছের ছায়ায়। কুমায়ুন হিমালয়ের ছত্রে ছত্রে রামায়ণ-মহাভারতের লোকশ্রুতি।
সাততালেও শুনলাম তেমনি। বনবাসের সময় শুধু যে রাম আর সীতার পায়ের ধুলো পড়েছিল সেখানে আর মহাভারতের রাজা নলের ছোট ভাই পুষ্কর যখন তাঁর রাজ্য থেকে নলকে রিক্ত ও নিঃস্ব অবস্থায় বিতাড়িত করে তখন নল আর দময়ন্তীর দাম্পত্য জীবনের বেশ কিছু বছর কেটেছিল এই সাততালে। নলরাজার প্রাসাদ তখন নিমজ্জিত হয় নল দময়ন্তী তালে। সাততালের নামেও সেই ছোঁয়া। রামতাল, লক্ষ্মণতাল, সীতাতাল, নলতাল, দময়ন্তীতাল, গরুড়তাল এবং শুখাতাল। কিন্তু এখন মিশনারিদের ট্রাস্টের অধীনে এই বিশাল জলাশয়। জলাশয়ের ধারে ক্রস এবং লেখা পড়ে জানতে পারলাম।
তারপরেই গাড়ী আমাদের নিয়ে গেল সোজা ভীমতালে। আমাদের হোটেলের ঘর লেক ফেসিং। লাঞ্চে স্যান্ডুইচ আর লস্যির গ্লাস হাতে নিয়ে প্রাণ ভরে তখন পান্না সবুজ জলের দিকে তাকিয়ে চোখ সার্থক করার পালা।
পান্না সবুজ টলটলে জলের সঙ্গে ঘন সবুজ অরণ্য মিলেমিশে একাকার ভীমতালে। হ্রদের মধ্যে একটুকরো দ্বীপ যেন জেগে আছে স্বমহিমায় । সেখানেও অ্যাকিউরিয়াম, ক্যাফে। ট্যুরিস্ট টানার মোক্ষম কায়দা এসব। অতএব বলাই বাহুল্য সেইখানে থিকথিকে ট্যুরিস্টের ভীড় জমে সন্ধেয়। বিশ্রাম নিয়ে প্রদোষের সূর্যাস্তের আলোয় হেঁটে ভীমতাল দেখতে বেরোই।
ঘুটঘুটে অন্ধকার আকাশে সেদিন প্রতিপদের একফালি চাঁদ মুখ ঢেকেছে। আগের দিন যে ছিল অমাবস্যায় ফলহারিণী কালীপুজো। তবে সেই আঁধারে গাঢ় কৃষ্ণবর্ণের নক্ষত্রখচিত আকাশের দিকে তাকিয়ে মন্ত্রমুগ্ধ আমরা। দূষণমুক্ত আকাশ যে শহরের মানুষের কাছে ব্রাত্য। তাই মনে হল সব পেয়েছির দেশে এসেছি।
কিছুদূরেই আবার নয়টি কোণা বিশিষ্ট নউকুচিয়া তাল। তা নিয়ে এক মজার গল্প আছে। যদি কেউ একই সঙ্গে একবারে এসে এই জলাশয়ের নয়টি কোণা দেখতে পায় তাহলে নাকি তার মনোস্কামনা পূর্ণ হয়। ভীমতাল হল এতগুলি হ্রদের মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন। যার নামকরণ মহাভারতের ভীমের নামানুসারে। কারণ জলাশয়ের তীরে অতি প্রাচীন প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বছরের ভীমেশ্বর মহাদেব মন্দির এখনও টিকে রয়েছে। পুরনো পাথরের মন্দিরের ছবি দেখে বর্তমানে গুচ্ছের রঙ চড়িয়ে বড় বেমানান হয়েছে বলে মনে হল আমার। লোকশ্রুতি অনুসারে, বিশ্বাস করা হয় যে পাণ্ডবদের নির্বাসনের (বনবাসের) সময় ভীম এই স্থানটিতে এসেছিলেন। এই প্রকাণ্ড সরোবর ভীমের হাতে বানানো... এমন বলেন কেউকেউ। সেখানে তাঁর পূজিত শিবলিঙ্গের থানেই বর্তমান মন্দিরটি সপ্তদশ শতাব্দীতে কুমায়ুন চন্দ রাজবংশের রাজার নির্মিত। ঘন সবুজ যে পাহাড়ের কোলে এই ভীমতাল সেই পাহাড়ের নাম হয়েছে হিড়িম্বা পাহাড়। সেসব হয়ত মানুষের মনগড়া। আদৌ সেখানেই ভীমের সঙ্গে হিড়িম্বার সাক্ষাত হয়েছিল কী না তার প্রামাণ্য তথ্য আমার কাছে নেই।
জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇
ভীমতালের বাজারী রাস্তার ধারে থরেথরে ফলের পসরা। সেখানকার মানুষজনের বড় অরুচি এসব ফলে। কিন্তু আমাদের কাছে তা মহার্ঘ্য। বড় সস্তায় আখরোট, আলুবখরা, আপেল, এপ্রিকট, পিচ, প্লাম কিনেও ফেলি সানন্দে। আবারও থামি লোকাল হ্যান্ডিক্রাফটের দোকানে। সেখানেও টুকটাক শপিং। ভীমতাল প্রদক্ষিণ করে সেখানকার আটপৌরে ম্যালের জনবহুল ট্যুরিস্টি কেনাকাটির জায়গায় হাজির হই। জনস্রোত আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে যায় গাড়ীর দিকে। উন্মত্ত জনতা ফ্রুট চাট আর গোলগাপ্পায় মহানন্দে মেতে উঠেছে অতিমারীর পরে। আকাশে উড়ছে হট এয়ার বেলুন। জলের ওপরে বোটিং। দূরের আইল্যান্ড জেগে উঠেছে ফুটফুটে আলোয়। মানুষের হ্যাঙআউটে। নৈনিতালের পরে ভীমতালেই সবচাইতে ভীড় যেন। ভীমতালের দিকে তাকিয়ে থাকলে আমার যেন দিকভ্রম হয়। সুবিশাল লেকের জলে আঁধার নামে। পুবপশ্চিম জ্ঞান হারিয়ে দিকভ্রান্ত হই আমি।
সেদিন ছিল কুবীর জয়ন্তী। ফেরার পথে কেবলই মনে হতে লাগল একটাই কথা। কুমায়ুনের তাল বা হ্রদগুলিই বোধহয় আক্ষরিক অর্থেই সেই রূপসাগর। সন্ত কুবীর যেখানে ডুব দিয়ে পেয়েছিলেন অনাবিল শান্তি।
সম্প্রতি ভারতের একমাত্র জ্যোতির্বিজ্ঞান পর্যবেক্ষণ চেন স্টারস্কেপস ভীমতালে একটি নতুন গবেষণা কেন্দ্র চালু করেছে। ভীমতালের উঁচু পাহাড়ের চূড়া থেকে আকাশের তারা খসা চাক্ষুষ দেখার অভিজ্ঞতা এবারে অধরা থেকে গেল। যাঁরা জ্যোতির্বিজ্ঞানী তাঁদের বড় পছন্দের শহর এই ভীমতাল।
জ্বলদর্চি তিরিশ পেরিয়ে 👇
0 Comments