বাংলা প্যারোডি কবিতা, পর্ব -- ১
ছাতা আবিষ্কার
ভাস্করব্রত পতি
কেনু কহে, "শুন গো ছেনু পাল,
ভেবেছি আমি কালিকে গভীর রাত্রে।
বেরুব বাহিরে যখন দুপুর কাল —
লাগিবে কেন সূর্যের তাপ গাত্রে?
খেয়ে তোমাদের বাড়ছে শুধু ভুঁড়ি,
রাজার প্রতি কিছুই নাহি লক্ষ্য।
মাসের শেষে বেতন কাঁড়ি কাঁড়ি,
ক'রছ কেবল অনায়াসে ভক্ষ্য!
শীঘ্র এর করিবে প্রতিবিধান,
নইলে সবার কাড়িয়া লইব প্রাণ।"
শুনিয়া ছেনু ভাবিয়া কাটায় রাত্র,
ভয়েই গায়ে এলো দারুণ জ্বর।
নিদ্রাহীন হইল পাত্র মিত্র,
পণ্ডিতেরা কাঁপে থর থর।
পাকশালেতে বন্ধ রসুই করা,
রাজবাড়িতে পড়ল কান্নাকাটি!
দুই চোখেতে অশ্রু দিয়ে ভরা,
কহিলা ছেনু, ধরিয়া রাজার পা-টি —
“যদি না রৌদ্র লাগিবে তব মাথে,
কেমন করিয়া ঘাম শুকোবে তাতে?"
শুনিয়া রাজা ভাবিয়া হলেন সন্দ,
কহিল শেষে, "কথাটি বটে খাঁটি!
কিন্তু আগে ঠেকাও দেখি রৌদ্র,
ভাবিও পরে ভাবার আছে যেটি।
রোদের অভাবে না শুকালে গায়ের ঘাম,
তোমাদের তবে পুষে রাখা নিষ্ফল।
কেন বা রাখিনু করিতে আমার কাম,
ডিগ্রিধারী বৈজ্ঞানিকের দল?
আগের কাজ আগেই সারো দেখি,
হচ্ছে মনে, তোমরা সবাই মেকি।"
রাজার কথায় সর্ষে দেখে চোখে,
আদর করে আনিল তবে ছেনু --
দেশে বিদেশে ছিল যত জ্ঞানী লোকে,
আসিল তাঁরা পাওয়ার আশায় ধেনু।
বসিল সবে বাজিয়ে ভেরী, তুর্য
ফুরায়ে গেল পাঁচশো খিলি তাম্বুল।
অনেক ভেবে কহিল, "গেলে সূর্য --
কেমন করে শুকোবে ভিজে চুল?"
কহিল রাজা, "তাই যদি না হয়,
বিজ্ঞানীরা তবে কেনই রয়?”
আবার সবাই ক'রল পরামর্শ,
কিনিল তাঁরা হাজার দশেক শাড়ি।
ঘিরিল তাঁরা লইয়া অর্ধবর্ষ —
যেথায় ছিল যত রাজার বাড়ি।
আঁধার হ'ল রাজার দুটি চোখ,
ছিলেন যখন নিজের খাটে শুয়ে!
অন্ধকারে ঠুকিয়া মরে লোক,
কান্না ওঠে রাজবাড়িতে ভয়ে।
কহিল রাজা "বাটারা রৌদ্রে মারি,
প্রাসাদের কী করিল দেখ ছিরি!"
তখন বেগে ছুটিয়া গিয়া কেহ,
আনিল তবে হাজার কুড়ি চর্ম —
মুড়িল তাঁরা রাজার নধর দেহ,
রচিল যেন যুদ্ধকালের বর্ম!
কেনু রাজা নাড়িতে নারে হাত,
চলিতে নাহি পারে সোজা ভাবে।
কোমরে ধরে কঠিন গেঁটে বাত,
কাঁদতে থাকেন চিকন মিহি রবে।
কহিল রাজা, "এমনি সব অন্ধ,
রৌদ্রে মারি করিল দম বন্ধ!"
আবার সবাই বসিল ফরাশ পাতি,
আইল যতেক আছিল গুণনিধি —
শুকাইল মুখ, ফাটিল বুকের ছাতি,
ভাবিল মনে, রাজারে রাখো বাঁধি।
কহিল, "গগন, তক্তা দিয়ে ঢাকো,
ত্রিপল টাঙায়ে ঠেকাবো রোদের তাত।"
কহিল কেহ, "টিনেতে জড়ায়ে রাখো,
রাস্তাঘাট ও বাগানবাড়ির ছাত!
ঘরের বাহিরে না যদি বেরোয় রাজা,
লাগিবে না তো রৌদ্র তাজা তাজা।"
কহিল রাজা, "কথাটি নহে মেকি —
কিন্তু মোর হচ্ছে মনে অন্য!
দিবসে যদি ঘরেই বসে থাকি,
সিংহাসনটা রইবে কার জন্য ?"
কহিল সবে, "দর্জি ডাকো অত্রে,
করুক জামা সূর্যিমামার গায়।
তপ্ত অংশু রইবে তাঁরই গাত্রে,
রৌদ্র তবে রবেনা দুনিয়ায়।"
কহিল সবে, "যবে সব ভন্ডুলে,
মনের মতো দর্জি নাহি এলে।"
রাজার সেপাই ছুটিল চারিধার,
লইয়া হাতে ধারালো নানা অস্ত্র!
মনের মতো দর্জি নাহি আর,
মেলে না কোথাও ন্যায্য মতো বস্ত্র!
তখন আইল বৃদ্ধ চূড়ামনি,
লাঠি ধরে কহিল ধীরে ধীরে --
"সমাধানের উপায় আমি জানি,
রাজা যদি অনুমতি করে।
ঢাকো তবে কেবল, মাথাই তোমার --
সূর্য ঢাকার নেই কোনো দরকার।"
কহিল রাজা, "হবে কি সমাধান?
ব্যর্থ যত আছিল বিশারদ।"
মন্ত্রী কহে, "ব্যাটার কাটো কান,
মুগুর দিয়ে ভাঙো দুটো পদ।"
রাজার মাথায় রচিল দারুন ঢাকনা,
বসিয়া বুড়া কালো কাপড় জুড়ি।
মন্ত্রী কহে, "আমারো ছিল জানা,
কেমনে বেটা করেছে সেটা চুরি।"
তখন হতে হইল ছাতার চল,
হাঁসিল ছেনু, বাঁচিল ধরাতল!!
জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇
জুতা আবিষ্কার
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কহিলা হবু,"শুন গো গোবু রায়,
কালিকে আমি ভেবেছি সারা রাত্র--
মলিন ধূলা লাগিবে কেন পায়
ধরণীমাঝে চরণ ফেলা মাত্র?
তোমরা শুধু বেতন লহ বাঁটি,
রাজার কাজে কিছুই নাহি দৃষ্টি।
আমার মাটি লাগায় মোরে মাটি,
রাজ্যে মোর একি এ অনাসৃষ্টি!
শীঘ্র এর করিবে প্রতিকার
নহিলে কারো রক্ষা নাহি আর।"
শুনিয়া গোবু ভাবিয়া হল খুন,
দারুণ ত্রাসে ঘর্ম বহে গাত্রে।
পণ্ডিতের হইল মুখ চুন,
পাত্রদের নিদ্রা নাহি রাত্রে।
রান্নাঘরে নাহিকো চড়ে হাঁড়ি,
কান্নাকাটি পড়িল বাড়িমধ্যে,
অশ্রুজলে ভাসায়ে পাকা দাড়ি
কহিলা গোবু হবুর পাদপদ্মে,
"যদি না ধুলা লাগিবে তব পায়ে,
পায়ের ধুলা পাইব কী উপায়ে!'
শুনিয়া রাজা ভাবিল দুলি দুলি,
কহিল শেষে, "কথাটা বটে সত্য--
কিন্তু আগে বিদায় করো ধুলি,
ভাবিয়ো পরে পদধুলির তত্ত্ব।
ধুলা-অভাবে না পেলে পদধুলা
তোমরা সবে মাহিনা খাও মিথ্যে,
কেন বা তবে পুষিনু এতগুলা
উপাধি-ধরা বৈজ্ঞানিক ভৃত্যে?
আগের কাজ আগে তো তুমি সারো,
পরের কথা ভাবিয়ো পরে আরো,'
আঁধার দেখে রাজার কথা শুনি,
যতনভরে আনিল তবে মন্ত্রী
যেখানে যত আছিল জ্ঞানীগুণী
দেশে বিদেশে যতেক ছিল যন্ত্রী।
বসিল সবে চশমা চোখে আঁটি,
ফুরায়ে গেল উনিশ পিপে নস্য।
অনেক ভেবে কহিল, "গেলে মাটি
ধরায় তবে কোথায় হবে শস্য?'
কহিল রাজা, "তাই যদি না হবে,
পণ্ডিতেরা রয়েছ কেন তবে?'
সকলে মিলি যুক্তি করি শেষে
কিনিল ঝাঁটা সাড়ে সতেরো লক্ষ,
ঝাঁটের চোটে পথের ধুলা এসে
ভরিয়ে দিল রাজার মুখ ও বক্ষ।
ধুলায় কেহ মেলিতে নারে চোখ,
ধুলার মেঘে পড়িল ঢাকা সূর্য।
ধুলার বেগে কাশিয়া মরে লোক,
ধুলার মাঝে নগর হল উহ্য।
কহিল রাজা, "করিতে ধুলা দূর,
জগৎ হল ধুলায় ভরপুর!'
তখন বেগে ছুটিল ঝাঁকে ঝাঁক
মশক কাঁখে একুশ লাখ ভিস্তি।
পুকুরে বিলে রহিল শুধু পাঁক,
নদীর জলে নাহিকো চলে কিস্তি।
জলের জীব মরিল জল বিনা,
ডাঙার প্রাণী সাঁতার করে চেষ্টা--
পাঁকের তলে মজিল বেচা-কিনা,
সর্দিজ্বরে উজাড় হল দেশটা।
কহিল রাজা, "এমনি সব গাধা
ধুলারে মারি করিয়া দিল কাদা!'
আবার সবে ডাকিল পরামর্শে;
বসিল পুন যতেক গুণবন্ত--
ঘুরিয়া মাথা হেরিল চোখে সর্ষে,
ধুলার হায় নাহিকো পায় অন্ত।
কহিল, "মহী মাদুর দিয়ে ঢাকো,
ফরাশ পাতি করিব ধুলা বন্ধ।'
কহিল কেহ, "রাজারে ঘরে রাখো,
কোথাও যেন থাকে না কোনো রন্ধ্র।
ধুলার মাঝে না যদি দেন পা
তা হলে পায়ে ধুলা তো লাগে না।'
কহিল রাজা, "সে কথা বড়ো খাঁটি,
কিন্তু মোর হতেছে মনে সন্ধ,
মাটির ভয়ে রাজ্য হবে মাটি
দিবসরাতি রইলে আমি বন্ধ।'
কহিল সবে, "চামারে তবে ডাকি
চর্ম দিয়া মুড়িয়া দাও পৃথ্বী
ধূলির মহী ঝুলির মাঝে ঢাকি
মহীপতির রহিবে মহাকীর্তি।'
কহিল সবে, "হবে সে অবহেলে,
যোগ্যমত চামার যদি মেলে।'
রাজার চর ধাইল হেথা হোথা,
ছুটিল সবে ছাড়িয়া সব কর্ম।
যোগ্যমত চামার নাহি কোথা,
না মিলে তত উচিত-মতো চর্ম।
তখন ধীরে চামার-কুলপতি
কহিল এসে ঈষৎ হেসে বৃদ্ধ,
"বলিতে পারি করিলে অনুমতি,
সহজে যাহে মানস হবে সিদ্ধ।
নিজের দুটি চরণ ঢাকো, তবে
ধরণী আর ঢাকিতে নাহি হবে।'
কহিল রাজা, "এত কি হবে সিধে,
ভাবিয়া ম'ল সকল দেশ-শুদ্ধ!'
মন্ত্রী কহে, "বেটারে শূল বিঁধে
কারার মাঝে করিয়া রাখো রুদ্ধ।'
রাজার পদ চর্ম-আবরণে
ঢাকিল বুড়া বসিয়া পদোপান্তে।
মন্ত্রী কহে, "আমারো ছিল মনে
কেমনে বেটা পেরেছে সেটা জানতে।'
সেদিন হতে চলিল জুতা পরা --
বাঁচিল গোবু রক্ষা পেল ধরা।
জ্বলদর্চি তিরিশ পেরিয়ে 👇
0 Comments