জ্বলদর্চি

প্রকৃতি উদার, সংস্কৃতি সংকীর্ণ /সন্দীপ কাঞ্জিলাল

প্রকৃতি উদার, সংস্কৃতি সংকীর্ণ 

সন্দীপ কাঞ্জিলাল


আমার বাড়িতে দৈনিক একটি খবরের কাগজ আসে। একদিন একটি বিজ্ঞাপনে স্বল্পবসনা নারীর ছবি ছিল। চতুর্থ শ্রেণীতে পড়া আমার নাতি, সেই ছবি দেখতে দেখতে আমাকে দেখে হঠাৎ লুকিয়ে ফেললো। তার চোখে মুখে এমন ভাব, যেন সে কিছু বড়ো অপরাধ করে ফেলেছে। এ সময় আমি কি করবো ভেবে উঠতে পারলাম না। তাকে কি সবটা বুঝিয়ে বলবো, না এটা দেখার জন্য তাকে বকাবকি করবো।
কারণ, ১৩৮৯ সালে বাংলায় একটি পত্রিকা প্রকাশিত হতো, নাম 'সম্বাদ রসরাজ'।প্রথমে সাপ্তাহিক ও পরে অর্দ্ধ সাপ্তাহিক রূপে পত্রিকাটি প্রকাশ পেত, প্রতি মঙ্গলবার ও শুক্রবার। এই পত্রিকাতে বিভিন্ন যৌন রসাত্মক কাহিনী,  এবং ছবি ছাপা হতো। এইসব রসালো বিবরণ কলকাতার মানুষ খুব মনোযোগ দিয়ে পড়তেন। তাতে পত্রিকার সংখ্যাও বেশ বিক্রি হতো। এই সম্বন্ধে ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন- "অশ্লীলতা ইহার পৃষ্ঠা কলঙ্কিত করিয়াছে"।এই পত্রিকা তখনকার দিনে বাড়িতে অত্যন্ত গোপনে রাখা হতো। যাতে ছোটোদের হাতে কিংবা নজরে না আসে। কারণ, এতে অল্প বয়সীরা অতি কম বয়সে যৌনতায় আকৃষ্ট হবে। তাতে তারা অল্প বয়সে যৌন সম্ভোগে লিপ্ত হবে। এতে সংসার সমাজ দেশের ক্ষতিসাধন হবে। ১৮৮৪ সালে সূর্যনারায়ণ ঘোষ "বৈজ্ঞানিক দাম্পত্য প্রণালী"- তে চাণক্য শ্লোক উদ্ধৃত করে লিখলেন- "সে মৈথুন বিফল সন্তান যাতে নয়" - তাছাড়া উৎপাদনের উদ্দেশ্য সাধনার্থ নরনারীর একান্ত মিলনই ইন্দ্রিয়সেবন নামে অভিহিত। ইন্দ্রিয় সেবনে শরীরের প্রত্যেক গ্রন্থি, প্রত্যেক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও স্নায়ু আমূল কম্পিত হয়, দৈহিক ও মানসিক বল বিশেষ খর্ব হয় এবং সেই সঙ্গে দেহের সারাংশ ক্ষয়িত ও দেহচ্যুত হয়। ইন্দ্রিয় সেবন মাত্রই ক্ষতিকর.... ইন্দ্রিয় সেবন কার্যে প্রচুর ঘৃণ্য পদার্থ শরীরে লেপিত হয়.... বস্তুত ইন্দ্রিয় সেবন প্রবৃত্তি শূন্য ব্যক্তির নিকট অতি জঘন্য কার্য্য।

জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


জ্বলদর্চি তিরিশ পেরিয়ে... 

তখনকার দিনে পরিবারের পরিসরে সন্তান উৎপাদনের জন্য স্বামী- স্ত্রীর মধ্যে যৌন সম্পর্কই একমাত্র বৈধ সম্পর্ক হিসেবে স্বীকৃত। বিয়ের আগে যৌন ধারণা এবং যৌনাঙ্গ সম্পর্কে ধারণা শুধু অন্যায় নয়, পাপও বটে। সন্তান উৎপাদনের জন্য স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যৌন সম্পর্কের প্রয়োজনীয়তা আছে। তবে এর মধ্যে সুখ ও আনন্দ খোঁজা উচিত নয়। শুধুমাত্র বংশরক্ষার তাগিদেই ঈশ্বর ঠকিয়ে কত জঘন্য কাজ মানুষদের নিয়ে করিয়ে নেয়, তার ঈয়ত্তা নেই। তাছাড়া এইদিকে বাল্য বয়স থেকে মন গেলে ধর্ম সাধনেও বিঘ্ন ঘটে। তাই যৌনাঙ্গ বিষয়ক ছবি, আলোচনা, সে যুগে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ছিল। সে সময় আহারকেও দুটি আলাদা শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছিল। পুষ্টিকর কিন্তু ইন্দ্রিয় উত্তেজক, এবং পুষ্টিকর অথচ ইন্দ্রিয় উত্তেজক নয়। শৈশবে দ্বিতীয় বিভাগের খাবার দেওয়া হতো। 
তখনকার দিনে এই ধারণার মূলে ছিল পুঁজিবাদের বিকাশ। পুঁজিবাদ কখনোই সম্ভব হতো না, যদি শরীরকে উৎপাদনের যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা না হতো। এই শরীরকে যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে হলে, সুস্থ সবল এবং ডিসিপ্লিনড্ একটা শরীর চাই। যে শরীরের মন অন্য কোনো দিকে থাকবে না, থাকবে শুধু শিল্প উৎপাদনের দিকে। যার ফলে সৃষ্টি হবে 'সারপ্লাস ভ্যালু'। যা পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটাবে। দার্শনিক ফুকো বলেছেন- "যৌনতা এমন এক শাসনক্ষেত্র যেখানে জীবনের উপর ক্ষমতা দুই ভাবে প্রয়োগ করা হয়- (১) শরীরের গঠন সম্পর্কিত রাজনীতি বা এনাটোমা- পলিটিক্স। (২) জনসমূহের জৈব রাজনীতি বা বায়ো- পলিটিক্স। শরীরের অনুশাসন ক্ষমতা শরীরকে দেখছে মেশিন হিসেবে। শরীরের শক্তিকে জোর করে টেনে বার করে এনে তার ব্যবহারযোগ্যতা বাড়ানো। তাই শরীরকে গঠন করতে হবে সুস্থ ও বলবান। এটি মানুষের অ্যানাটোমা পলিটিক্স। দ্বিতীয়ত হল বংশবৃদ্ধি, জন্ম, মৃত্যু, স্বাস্থ্যের মান, আয়ুষ্কাল বাড়ানো। তা যে উপায়ে বৃদ্ধি পাবে তা বায়ো-পলিটিক্স। তাই মানুষের শরীরে এনাটোমা পলিটিক্সের পর, আমরা দেখতে পাই মানুষ প্রজাতির বায়ো-পলিটিক্স।
আবার একটি ধারণা প্রচলিত বিপরীত লিঙ্গের মধ্যে, যৌন আকর্ষণটা হলো স্বাভাবিক। আর একই লিঙ্গের মধ্যে যৌন আকর্ষণ অস্বাভাবিক। পুরুষ হওয়ার মূল কথাই হলো শুধু নারীর প্রতি আকর্ষণ অনুভব করা, এবং শুধু ওই বিপরীত লিঙ্গের সঙ্গেই যৌন সম্পর্কে অংশগ্রহণ করা। তারা মনে করে এটাই প্রাকৃতিক নিয়ম। কোন জিনিসটা যে আসলে জৈবিকভাবে নির্নীত আর কোনটা একদল মানুষ কিছু মিথ তৈরি করে জোর করে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছে- সেটা আমরা আলাদা করবো কিভাবে? এর সোজা পদ্ধতি হলো, এই সহজ কথাটা মাথায় রাখা- 'প্রকৃতি উদার, সংস্কৃতি সংকীর্ণ'।
বাঁচার মানে যদি টেকা না হয়ে ফুটে ওঠা হয়, তবে তার জন্য চাই বিচিত্র এবং অব্যাহত সম্ভোগ। সম্ভোগ না করলে মানুষের দেহ-ই বা সরস হবে কি করে। মন-ই বা সমৃদ্ধ হবে কিসে। ভোগের স্থান তাই এত সম্মানের- কেননা ভোগ ছাড়া বিকাশ অসম্ভব। ভোগ্যবস্তু দেখলে যাদের মন ছি ছি করে ওঠে, তারা তো বেঁচে নেই, তারা আবার বিকাশের কথা ভাববে কি করে। তবে প্রত্যেক ব্যক্তির মধ্যে নানা রকমের বাসনা প্রবৃত্তি ক্রিয়া করে। একটির দাবি মেটাতে গেলে অন্যটি অবহেলা করতে হয়। এমনকি অনেক সময় অবদমিত করাও প্রয়োজন। কিন্তু কোনো কিছুকে স্থায়ীভাবে অবদমিত রাখা সম্ভব নয়। সে চেষ্টায় মনের দ্বার রুদ্ধ হয়ে যায়। ফলে বিভিন্ন প্রবৃত্তি ও বাসনার মধ্যে সুষ্ঠু সমাধানের বিশেষ প্রয়োজন। তাই নিজের চাহিদা প্রকাশ করার আগে নিজেকে সমৃদ্ধ করা দরকার। চাই প্রকৃতির সঙ্গে, যত বেশি সংখ্যক মানুষের সঙ্গে, সবকিছু বিষয় সম্পর্কে আত্মসমৃদ্ধি। আবার মনোবিদ ফ্রয়েড বলেছেন- মানুষ তার মনের সব খবর নিজেই পায় না। কেননা আমাদের মনের আসল দিকটার কথা, আমরা সব সময় নিজেদের কাছ থেকে লুকোতে ব্যস্ত। এই ভাবটার নাম নির্জ্ঞান। আসলে আমাদের মনের মধ্যে সদা সর্বদা এই নির্জ্ঞানকে সজ্ঞান চেপে রাখতে চায়। তাই মাঝে মাঝে সজ্ঞানকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য, নির্জ্ঞান ছদ্মবেশ ধারণ করে বাইরে বেরিয়ে এলে দুর্ঘটনা ঘটে। নির্জ্ঞান ও সজ্ঞানের এই লড়াই হলো মনোবিকার। 
আবার বিজ্ঞানী হকিংসের মতে - 'থিওরি অফ এভরিথিং' আবিষ্কৃত হলে আমরাও জানতে পারবো স্বাধীনতা বা ফ্রি-উইল একটা ইল্যুশন। একটা ভ্রান্তিবিলাস। আমরা নিতান্তই দাস। শুধু তাই নয় একটা মাত্র নিয়ম সবকিছু শাসন করলে, কিসের পর কি হবে তাও পূর্বনির্দিষ্ট। অর্থাৎ আমি এখন কি করবো বা পাঁচ মিনিট পরে কি করবো, তা-ও আগে থেকে ঠিক করা। এই 'থিওরি অফ এভরিথিং' প্রমাণিত হলে আমাদের দাসত্ব হবে চূড়ান্ত ও নির্লজ্জ। 
তাই শিশু বয়স থেকেই যৌনশিক্ষার সূচনা হওয়া উচিত। বিকাশ সাধনের শুরু থেকে শিশুরা সব কিছু বোঝার চেষ্টা করে, এবং তাদের শরীর হলো এসবের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। শিশুকে যৌনশিক্ষা দেওয়ার মানে কেবল এটা নয় যে, শারীরিক বিকাশ সাধন ও বাচ্চা তৈরির প্রক্রিয়া বোঝানো। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো শারীরিক স্পর্শের সীমা সম্পর্কে শিক্ষিত করে তোলা। কারা স্পর্শ করতে পারবে, এবং কারা পারবে না তার সম্পর্কে জানানো। সেক্সচুয়ালিটি এডুকেশন ফর এডভোকেটস ফর ইউথের পরিচালক 'নোরা জেলপারিন'   বলেন - শিশুরা শরীরের বিভিন্ন অংশ ও অনুভূতি সম্পর্কে বোঝার চেষ্টা করে। তাই শিশুকালে বয়স অনুসারে যৌন শিক্ষা দিতে পারলে মানুষের দ্বারা নিপিড়নের সম্ভাবনা কমে যাবে। কেউ কাছে আসলে জড়িয়ে ধরা উচিত নয় এমনকি পরিচিত কোনো মানুষ হলেও। শিশুদের বাল্যকালে বোঝানো উচিত কেউ জড়িয়ে ধরতে বা চুমু দিতে চাইলে, অনুমতি দেওয়া উচিত নয়। শারীরিক অঙ্গের সঠিক পরিভাষা শেখাতে অধিকাংশ পিতা-মাতাই অস্বস্তি বোধ করেন। তারা পেনিসের নাম জিজ্ঞেস করলে ছেলেদের শেখায়- এটা মানিক। কিন্তু এভাবে ইউফেমিজম বা শব্দের শ্রুতি মধুর পরিভাষা ব্যবহারের মাধ্যমে শিশুদেরকে এই বার্তা দেওয়া হয় যে যৌনাঙ্গের আসল পরিভাষা ব্যবহার করা উচিত নয় এবং শরীরের এসব অংশ নিয়ে লজ্জিত হওয়া উচিত। শিশুদেরকে শরীরের গোপনাঙ্গের মিথ্যে পরিভাষা না বলে, সঠিক পরিভাষা জানানো ভালো। সেই সঙ্গে এটাও তাদের জানাতে হবে, এগুলো ব্যক্তিগত অঙ্গ, যেখানে অনুমতি ছাড়া অন্য কারও স্পর্শ করার অধিকার নেই। শিশুকে গোপনাঙ্গের বিশদ বর্ণনা দেওয়ার দরকার নেই, কেবল সঠিক নামটা বলতে হবে এবং জানাতে হবে  যে এগুলো শরীরের অন্যান্য অংশের মতো স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক। এটাও বলতে হবে এসব অঙ্গ নিয়ে প্রশ্ন করতে লজ্জা বা দ্বিধার কিছু নেই। আমাদের মনে রাখতে হবে প্রকৃতিগতভাবে শিশুদের মনে, কৌতূহল খেলা করে। এই কৌতূহলের একটি অংশ হলো যৌনতা। শিশুকে তার নিজের গুরুত্ব বোঝাতে পারলে সে নিজেকে অন্যের হাতের পুতুল ভাববে না। তার সঙ্গে কেউ অমানবিক আচরণ করতে চাইলে, তার চেতনা স্বতঃস্ফূর্তভাবে জেগে উঠবে। তার প্রতি অপরের অশোভনীয় আচরণকে, তার সম্মানে আঘাত হিসেবে বিবেচনা করবে। মনে রাখতে হবে যেসব শিশু যৌনাঙ্গের সঠিক নাম বলতে পারে না, তাদের মধ্যে নিপীড়নের হার বেশি। 
তাই আমি ভাবলাম আমার নাতিকে যৌন শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলবো তার বয়স অনুযায়ী। যাতে সে জীবনে একজন পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে উঠতে পারে।

Post a Comment

0 Comments