কড়া নাড়ে সংশয়
মিলি ঘোষ
নভেম্বর মাসের হরিদ্বার। ঠান্ডা নেহাৎ মন্দ নয়। রোজই প্রয়োজনীয় শীতবস্ত্র গায় চাপিয়ে অমিয় সরকার ভোর ভোর হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়েন গঙ্গার উদ্দেশ্যে। পায়চারি করতে করতে স্রোতস্বিনী গঙ্গাকে এক মনে প্রত্যক্ষ করেন। বোঝার চেষ্টা করেন, এই অবিরাম ছুটে চলার মধ্যে কী এত আনন্দ পায় নদী!
অমিয় সরকার রোজই দেখেন এক ভদ্রলোককে। বাঙালি বলেই মনে হয়। অনেকটা তাঁরই মতো পোশাক পরিহিত, হয়তো বা তাঁরই বয়সী। গঙ্গার স্রোতে রোজই যেন কী খোঁজেন।
ভদ্রলোক কাছাকাছি আসতেই ডান হাত তুলে বললেন অমিয়, "কলকাতা না কি?"
ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে গেলেন।
"তা বলতে পারেন। ওই ব্যারাকপুর অঞ্চলে।"
হাত জোর করে নমস্কার জানালেন অমিয়।
"আমি অমিয় সরকার। রিটায়ার্ড অ্যাডভোকেট।"
প্রতি নমস্কার জানিয়ে ভদ্রলোক বললেন, "শুভব্রত বসু। অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। কলেজে পড়াতাম। ইকনমিক্স।"
"একাই, না কি পরিবার এসেছে ?"
হাসলেন শুভব্রত, "আমি একাই।"
দুই অপরিচিত, একে অপরের যে বন্ধু হতে চেয়েছেন, তা ঠিক নয়। তবু, শিরশিরে উত্তুরে হাওয়ায় মেশা ভোরের স্বাভাবিক সতেজতার সঙ্গে কিছু উত্তাপ পাওয়ার আশায় হাত বাড়িয়েছেন পরস্পরের দিকে। কী সেই উত্তাপ নিজেরাও জানেন না। রোজকার কথাবার্তার শেষে একজনও বলেন না, কাল তাহলে এই সময়ে, এইখানে। তাঁদের আগামী বলে কিছু নেই। জীবনের এক দীর্ঘ সময় পার করে যা আছে, তা শুধুই বর্তমান।
হরিদ্বারে এসে খরস্রোতা গঙ্গা, অনেকটা শান্ত। নির্মল বলা যায়।
সেদিক থেকে চোখ না ফিরিয়ে অমিয় বললেন, "জানেন দাদা, আমি ছিলাম ঘোর নাস্তিক।"
"ছিলাম কেন ? হরিদ্বার কি আস্তিক বানালো আপনাকে ?"
"না। আমি এখন নো ম্যানস ল্যান্ডে।"
"ইন্টারেস্টিং!"
অমিয় সোজা শুভব্রতর চোখের দিকে তাকালেন।
বললেন, "প্রতিটি মানুষের জীবনই ইন্টারেস্টিং। আমরা ভাবি না, তাই...."
হাঁটতে হাঁটতে অমিয় তখন বলছেন, "আমার বাবা, মা, স্ত্রী, কন্যা সবাই এক দিকে। আর আমি অন্যদিকে। বাবা ছিল টিপিক্যাল রাইটার্সের কেরানি। আর মা আপাদমস্তক গৃহবধূ এবং পুরো মাত্রায় ধার্মিক। প্রায়ই ঘটা করে পুজো আচ্চা করত। আমি থাকতাম না। বেরিয়ে যেতাম বাড়ি থেকে। মা যত্ন করে নানারকম সুস্বাদু পুজোর প্রসাদ রেখে দিত। বাড়ি ফিরে সেসব আমি দিব্যি খেতাম।
মা বলত, 'একটু প্রণাম করে খেতে পারিস না ?'
'কাকে প্রণাম করব, খেতে ভালো লাগছে, তাই খাচ্ছি।'
খেতে খেতেই বলতাম, 'মিষ্টিটা কোন দোকান থেকে এনেছ, বাবা ? দারুণ টেস্ট। নাড়ুগুলো ফাটাফাটি হয়েছে।'
ওই যে আমি খুশি হয়ে খেতাম, মা'র বানানো নাড়ুর প্রশংসা করতাম, মা তাতেই আনন্দ পেত।
বাবা বেজার মুখে বলত, 'আমার জন্য সুগার ফ্রি।'
আমি অট্টহাসিতে ফেটে পড়তাম।
মা'কে বলতাম, 'তুমি, তোমার ঠাকুরকেও সুগার ফ্রি সন্দেশ খাওয়াচ্ছ ?'
বাবা হাসত।
যুক্তি ছাড়া আমি একটা স্টেপও ফেলতাম না।
মা'কে বলতাম, 'দেখেছ তো মা, আমরা নিজেরা যা খেতে ভালোবাসি বা যা আমাদের খাওয়া উচিত, তাই আমরা ঠাকুরের সামনে ধরি। ঠাকুর যে খায় না, সে তুমি নিজেও খুব ভালো করে জানো।'
মা মুখে কিছু বলত না। তবে তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, ঠাকুর খায়, আমরা দেখতে পাইনা।"
নদী তার নিজস্ব ঘরানায়, মৃদঙ্গের তালে তালে পা ফেলে চলেছে। আর কান পেতে শুনে নিচ্ছে মানুষের অন্তস্থলের খবর।
অমিয় সরকার সেদিকেই তাকিয়েছিলেন।
এবার বলা শুরু করলেন, "পড়াশুনার পাট চুকিয়ে কালে কালে আমি ডাকাবুকো আইনজীবী হয়ে উঠলাম। ক্রিমিনালদের নিয়ে আমার কারবার। কত সত্যকে মিথ্যা আর কত মিথ্যাকে সত্য করলাম, অর্থের বিনিময়ে।
আমার স্ত্রী অপ্সরা। শুধু নামে না, দেখতেও। সুন্দরী দেখেই বিয়ে করেছিলাম। কিন্তু, সে তো আর মূর্খ নয়। সবই বুঝত। মনে হয়, আমার টাকা ছুঁতে ও ঘৃণা বোধ করত। নিজের মনেই ঘর-সংসার, পুজো টুজো করত। আমাকে বিরক্ত করত না। অল্প দিনেই বুঝে গেছিল আমার নেচার। কত দামি দামি শাড়ি, গয়না কিনে দিয়েছি। ছুঁলই না কোনওদিন। সব বিলিয়ে দিত। কার মেয়ের বিয়ে, কার বাবার কঠিন রোগ, অপ্সরা সব দান টান করে দিত।
একমাত্র মেয়ে অদ্রিতাও খানিকটা মায়ের মতোই। দালাসে সেটল করেছে, তাও প্রায় আট বছর হয়ে গেল। ওখানেই চাকরি বাকরি করছে। একটা স্প্যানিশ ছেলের সঙ্গে থাকে। বিয়ে করেনি। নিজে থেকে একটাও ফোন করে না। আমি করলে কোনওরকমে হ্যাঁ, না বলে কাটিয়ে দেয়।"
" আপনার স্ত্রী কি ...."
"হ্যাঁ। কবেই তো সে পাড়ি দিয়েছে।"
আঙ্গুল তুলে ওপর দিকে দেখালেন অমিয়।
"কী হয়েছিল ?"
"সেরিব্রাল অ্যাটাক। কোনও সুযোগ দিল না।"
"ওহ্হো। খুবই দুঃখজনক।"
"আমি ঘরে-বাইরে ছড়ি ঘুরিয়েছি। আমার স্ত্রী যা সহ্য করেছে, মেয়ে কেন তা করবে ? মা'ই ছিল ওর বন্ধু। মা চলে যেতে আমার সঙ্গে আর থাকতে চাইল না। তবে নিজের সার্কেলে ও হ্যাপি। ওর ফ্রেন্ডস, কলিগস। সে ওর মা'ও। কাজের লোক, প্রতিবেশী, সকলের সঙ্গে ছিল গুড রিলেশন।"
বেশ কিছু সময় নীরবে পার করে অমিয় বললেন, "জানেন দাদা, আজকাল একটা প্রশ্ন আমাকে তাড়া করে বেড়ায়।"
"কী প্রশ্ন ?"
"ভগবান আছেন কি না, জানি না। কিন্তু একটা ব্যপারে আমার খটকা লাগে। এই যে কত নিরপরাধ মানুষকে আমি দোষী সাব্যস্ত করেছি, আজও তাদের অনেকে বিনা দোষে জেল খাটছে আর সত্যিকারের অপরাধীরা মাথা উঁচু করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এ এক ভয়ানক অপরাধবোধ। শাস্তি কি আমি পাচ্ছি না ? পাচ্ছি। কোনো অদৃশ্য শক্তি, আমাকে এই শাস্তি দিয়ে চলেছে! অথচ, আমার স্ত্রী, কন্যা তারা তাদের নিজ নিজ জগতে তো ভালোই ছিল। আমি যে'টুকু সময় বাড়িতে থাকতাম, ওদের দাবিয়ে রাখতাম। কিন্তু সে কতটুকু সময় ? বাড়িতেও নিজস্ব চেম্বারে অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করতে হতো। এতে ওদের কোনও আক্ষেপ ছিল না। বরং ওরা ভালো থাকত। অপ্সরা তো হাসতে হাসতে চলে গেল। আমি তো পারছি না। আমার এত ব্যাঙ্ক ব্যালান্স কী হবে, কাদের জন্য ? প্রয়োজনের অতিরিক্ত একটা টাকাও ওরা স্পর্শ করেনি কোনওদিন।
আজকাল এই বিষয়টা আমাকে ভাবায়, ঈশ্বর কি সত্যিই নেই, নাকি আছে ?"
শুভব্রত এতক্ষণ চুপ করে সব শুনছিলেন। এবার খুব নিচু স্বরে বললেন, "আমাকেও ভাবায়।"
অমিয় তাকাতেই শুভব্রত বললেন, "আছেন তো ক'দিন। পরে একদিন বলব।"
অমিয় অপেক্ষায় থাকেন, কবে শুভব্রত তাঁর ভাবনার ব্যাখ্যা দেবেন।
জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇
অবশেষে একদিন বললেন শুভব্রত, " আজ বলেই ফেলি। আসলে যা ফেলে এসেছি, তা নিয়ে নাড়াঘাটা করতে আর মন চায় না। তাই একটু সময় নিলাম।"
তারপর শুরু করলেন।
"শীর্ষ, আমার ছেলে। বারো বছর বয়সে মা'কে হারায়। শকুন্তলার দুটো কিডনিই ড্যামেজ ছিল। হার মেনেছে দশ বছর লড়াই করে। আমার সর্বস্ব দিয়েও ওকে বাঁচাতে পারিনি। শীর্ষ মানুষ হয়েছে ওর ঠাকুমার কাছেই। মা'কে আর সেভাবে পেল কই।
শীর্ষ আমার একাকিত্ব বুঝত। সঙ্গ দিত, কিছুটা বন্ধুর মতোই। তবে ঠাম্মা ছিল ওর প্রাণ। এমবিবিএস করে, স্পেশালাইজেশন করার সময় ঠাম্মাকে হারাল।
এরপর থেকে শীর্ষ কিছুটা মেজাজি হয়ে গেল। বাবা-ছেলের বন্ধুত্বে চিড় না ধরলেও মতবিরোধ লেগে থাকত।
আমারা ছিলাম ধর্মপ্রাণ পরিবার।"
শুভব্রতর কথার মধ্যিখানেই অমিয় বললেন, "ছিলাম!"
হাসলেন শুভব্রত। তারপর আবার শুরু করলেন।
"বাড়ির উঠোনে রাধা-গোবিন্দর মন্দির। রোজ অফিস যাবার আগে পুজো করে বেরোতাম। মা'ও করত। সুস্থ থাকতে শকুন্তলাও করেছে। আমার বিশ্বাস ছিল, দশটা বছর ধরে যুদ্ধ করার ক্ষমতা ঠাকুরই শকুন্তলাকে দিয়েছেন।
শীর্ষ একদিন বলল, 'কী লাভ হয়, এত পুজো করে, একে একে তো সবাই চলে গেল।'
'ঠাম্মার বয়স হয়েছিল। সবাইকেই একদিন যেতে হবে। কেউ তো অমর নয়।' আমি বোঝাই ছেলেকে।
'আর মা ?'
শীর্ষ'র প্রশ্নের কোনও উত্তর সেদিন দিতে পারিনি।
আমিও যে মনের জোর কিছুটা হারাইনি তা নয়।
তবু কাজের ফাঁকে ঠাকুরকে বলতাম, 'আমি আর কিচ্ছু চাই না। শুধু ছেলেটাকে ভালো রেখো।' কিন্তু ..."
শুভব্রত এরপর বেশ কিছুক্ষণ চুপ ছিলেন। অমিয়ও কিছু একটা আঁচ করে আর কিছু জানতে চাননি।
এরপর অমিয়'র হাত ধরে প্রায় ভেঙে পড়লেন শুভব্রত।
"ছেলেটাও চলে গেল, জানেন দাদা। বাইক একসিডেন্ট করল। বন্ধুর বাইকের পেছনে বসেছিল। হেলমেট ছিল, দুজনেরই। কিন্তু শীর্ষ ক্লিপটা লাগায়নি। বন্ধুটি মারাত্মক জখম হয়েও ফিরে এল। ফিরল না আমার ছেলেটা।
আর দেরি করিনি। সিংহাসনের যাবতীয় ঠাকুরের মূর্তি, ফটো সব একটা কাপড়ে বেঁধে পাতকুয়োর জলে ফেলে দিয়ে বেরিয়ে পড়েছি। জানি না, আমার গন্তব্য কী, কোথায়। তবে ওই বাড়িতে আর ফিরব না।
প্রথমে ভেবেছিলাম, বাড়ি রামকৃষ্ণ মিশন'কে দিয়ে দেব। পরে সিদ্ধান্ত পাল্টালাম।
ভাবলাম, এরাও তো একই বিশ্বাসে বুঁদ হয়ে আছে, যাতে আমি হাবুডুবু খেয়েছি এতকাল।
আমার এক বন্ধু আর তাঁর স্ত্রী নিজেদের প্রচেষ্টায় পথশিশুদের নিয়ে একটা ছোট স্কুল গড়ে তুলেছে। ওদেরই লিখে দিলাম সব কিছু।
নদীর ক্লান্তিবিহীন বয়ে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল দুই জোড়া ক্লান্ত চোখ। পৃথিবীর এক পাশের ঘুম ততক্ষণে ভেঙে গেছে। যেন, কোথাও কোনও দুঃখ নেই। গঙ্গার কলকল শব্দের সঙ্গে পাখির কলরব, মিলেমিশে একাকার।
হঠাৎ শুভব্রত গলা তুলে বললেন, " ওই আকাশ, এই মাটি,নদী, সবার কাছে আমার জিজ্ঞাসা, ঈশ্বর কি সত্যি আছে, না নেই ?"
জ্বলদর্চি তিরিশ পেরিয়ে 👇
0 Comments