জ্বলদর্চি

মহাভারতের কর্ণ : এক বিতর্কিত চরিত্র-১/দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

মহাভারতের কর্ণ - এক বিতর্কিত চরিত্র                                               
দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী
                                                
প্রথম পর্ব

 স্বয়ম্বর অনুষ্ঠান এমন কোন অভূতপূর্ব ঘটনা নয়, তবুও যে পাঞ্চাল নগরী জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছে তার কারণ - এই স্বয়ংবরের পণ ও পাত্রী, দুইই অসাধারণ। যাঁর স্বয়ম্বর তাঁর খ্যাতি ইতিমধ্যেই কিংবদন্তীতে পরিণত হয়ে দেশ থেকে দেশান্তরে বিস্তৃতি লাভ করেছে। অনন্যশ্রুত তাঁর জন্ম বৃত্তান্ত, অলোকসামান্য তাঁর রূপ ও গুন, কন্যা বিচিত্র,বিচিত্রতর তাঁকে লাভ করার শর্ত। ত্রেতা যুগের জনকনন্দিনী সীতার স্বয়ংবরের পরে এমন শর্ত আর কোথাও রাখা হয়নি। কে এমন বীর যিনি এমন পণ জিতবেন, আদৌ কেউ জিততে পারবেন কিনা - এই কৌতূহল নৃপতি থেকে রাজকুমার, ব্রাহ্মণ থেকে ক্ষত্রিয়, বৈশ্য থেকে শূদ্র সকলের। পাঞ্চালরাজ দ্রুপদ দেশ থেকে দেশান্তরে বার্তা পাঠিয়েছেন, আমন্ত্রণপত্র নিয়ে পাঞ্চালরাজের দূত পৌঁছে গেছে প্রায় সমস্ত রাজন্যবর্গের কাছে। এছাড়াও লোকমুখে সেই বার্তা ছড়িয়েছে অনেকগুণ বেশি। নিমন্ত্রিতেরাতো এসেছেনই, বহু অনাহুত ও রবাহুতরাও এসেছেন শুধুমাত্র কৌতূহল চরিতার্থ করতে। কে এই পাত্রী, কি তার জন্ম বৃত্তান্ত সেই বিষয়ে প্রথমে আলোকপাত করতে যেয়ে তার পশ্চাৎপটের ভূমিকা প্রথমে লেখার প্রয়োজন।      

পৃষতের পুত্র দ্রুপদ এবং ঋষি ভরদ্বাজ এবং ঊর্বশী ঘৃতাচীর পুত্র দ্রোণ, ঋষি অঙ্গিরার কাছে বাল্যকালে শাস্ত্র ও শস্ত্রশিক্ষা লাভ করেছিলেন। পরবর্তীকালে অবশ্য দ্রোণ পরশুরামের কাছেও অস্ত্রশিক্ষা লাভ করেছিলেন। শিক্ষালাভের পরে দ্রুপদ পিতৃগৃহে যেয়ে পাঞ্চাল রাজ্যের রাজা হন এবং ঋষি দ্রোণ আশ্রমিক জীবন যাপন করতেন। একদিন দ্রোণের পুত্র অশ্বত্থামা বন্ধুদের সাথে খেলা করতে করতে দেখলেন বন্ধুরা দুধ খাচ্ছে। তারও দুধ খাবার ইচ্ছা হতে তার বন্ধুরা তাকে পিটুলিগোলা জল খাইয়ে ছিলেন। দ্রোণের পত্নী কৃপী সন্তানের এই কষ্ট ও মনোবেদনা লক্ষ্য করে দ্রোণকে সে কথা জানাতে দ্রোণ তাঁর বাল্যবন্ধু রাজা দ্রুপদের কাছে গেলেন একটি দুগ্ধবতী গাভী লাভের আশায়, কারণ দ্রোণের আশ্রমে কোন দুগ্ধবতী গাভী ছিল না। রাজা দ্রুপদের কাছে যেয়ে তিনি তাঁকে বন্ধু বলে সম্ভাষণ করতে দ্রুপদ তাঁর বন্ধুত্ব অস্বীকার করে বলেছিলেন "বন্ধুত্ব হয় একই আভিজাত্যের মানুষের সাথে। রাজা কখনো দরিদ্র ব্রাহ্মণের বন্ধু হতে পারে না"। দ্রুপদের এই কথা শুনে দ্রোণাচার্য অন্তরে আঘাত পেলেন এবং তিনি তৎক্ষণাৎ সপরিবারে হস্তিনাপুরে যেয়ে শ্যালক কৃপাচার্যের গৃহে আত্মগোপন করলেন। হস্তিনাপুরে কুরু পিতামহ ভীষ্ম এই সংবাদ পেয়ে তাঁকে অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র ও মৃত পান্ডুর নাবালক সন্তানদের অস্ত্র শিক্ষার দায়িত্ব দেন। মহাবীর ভীষ্ম জানতেন দ্রোণও মহর্ষি পরশুরামের শিষ্য। দ্রোণ সাগ্রহে রাজপুত্রদের শিক্ষার দায়িত্ব নিলেন দ্বিবিধ উদ্দেশ্যে। প্রথম উদ্দেশ্য বালকদের যথাযোগ্য শিক্ষা দান করা এবং দ্বিতীয় উদ্দেশ্য রাজা দ্রুপদকে উপযুক্ত প্রতিদান দেওয়া। রাজা দ্রুপদের কাছে অপমানিত হওয়ার পরে তাঁর অন্তরে দ্রুপদের সেই তীক্ষ্ণ বাক্যবাণ গুলি সর্বদা কষাঘাত করত। বালকদের শিক্ষাদানের সময়ে আরও দুটি বালক তার কাছে এসেছিল শিক্ষালাভের জন্য। কিন্তু একজনকে তিনি নিষাদ পুত্র বলে শিক্ষাদানে অস্বীকৃত হন। সে ছিল নিষাদ রাজা হিরণ্যধনুর পুত্র একলব্য। তার প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা এখানে নিষ্প্রয়োজন। অন্যজন হলেন সুত অধিরথের পালিত সন্তান কর্ণ। কর্ণ সেখানে অবশ্য শিক্ষালাভ করেছিলেন জ্যেষ্ঠ কৌরব দুর্যোধনের মিত্র হিসেবে। দ্রোণ যখন কর্ণকে শিক্ষাদানে অস্বীকার করেন সেই মুহূর্তে জ্যেষ্ঠ কৌরব দুর্যোধন কর্ণকে মিত্রতার বন্ধনে আবদ্ধ করে অঙ্গরাজ্য দান করে তাকে অঙ্গরাজের স্বীকৃতি দেন এবং কর্ণ দ্রোণের কাছে শিক্ষা লাভ করেন।


জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


জ্বলদর্চি তিরিশ পেরিয়ে... 

শিষ্যদের শিক্ষালাভ পর্ব শেষ হতে গুরু দ্রোণাচার্য তাদের কাছে গুরুদক্ষিণার দাবি করলেন। গুরুদক্ষিণা দানের কথায় দ্রোণাচার্য বলেছিলেন পাঞ্চালরাজ দ্রুপদকে যুদ্ধে পরাজিত করে বন্দি করে হস্তিনাপুরে তার কাছে নিয়ে আসার জন্য। রাজসভায় দ্রুপদের অপমানের জ্বালা, তাঁর শাণিত বাক্যবাণ তাকে ক্ষুব্ধ করেছিল। গুরুর আদেশ পেয়ে কর্ণসহ তাঁর একশত পাঁচ জন শিষ্য সসৈন্যে ধাবিত হল পাঞ্চাল রাজ্যের উদ্দেশ্যে। সেখানে ভীষণ যুদ্ধের পরে অর্জুন পাঞ্চালরাজকে পরাজিত করে বন্দী করলেন এবং পাঞ্চালরাজকে হস্তিনাপুরের নিয়ে এসে গুরু দ্রোণাচার্যের পদতলে গুরুদক্ষিণা স্বরূপ অর্পণ করলেন। পাঞ্চালরাজকে পরাজিত করে বন্দী করে নিয়ে আসার জন্য গুরু দ্রোণাচার্য শিষ্যদের প্রতি বিশেষত অর্জুনের প্রতি সন্তুষ্ট হলেন। দ্রুপদের নিকট পূর্ব অপমানের প্রতিশোধ নিয়ে দয়াপরবশ হয়ে অর্ধেক রাজত্ব ফিরিয়ে দিয়ে বললেন "রাজা দ্রুপদ, আপনি অকৃতজ্ঞ হয়ে বলেছিলেন সমানে সমান না হলে বন্ধুত্ব হয়না, তাই আপনাকে অর্ধেক রাজত্ব ফিরিয়ে দিয়ে বন্ধুত্ব রক্ষা করলাম।" 

দ্রুপদ এই অপমানের জ্বালা ভুলতে পারলেন না। অস্ত্র বা বাহুবলে দ্রোণকে পরাস্ত করা তাঁর অসাধ্য ছিল। তিনি অর্ধেক রাজত্ব নিয়ে ফিরে এসে অপমানের জ্বালা ভুলতে না পেরে বিষন্ন মনে গঙ্গাতীরে ভ্রমণ করতে করতে একদিন সন্ধান পেলেন ব্রহ্মর্ষি তেজসম্পন্ন উপযাজ নামক এক ব্রাহ্মণের। তিনি তাঁর কাছে সমস্ত ঘটনা নিবেদন করে প্রার্থনা করলেন এক পুত্রের জন্য যে দ্রোণকে বধ করতে পারবে এবং তার জন্য তিনি ব্রাহ্মণকে দশ কোটি গাভী দান করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিলেন। সমস্ত ঘটনা শোনার পরে উপযাজ বললেন "মহারাজ আমার পার্থিব জিনিসের প্রতি কোন লোভ লালসা নেই, আপনি আমার অগ্রজ যাজের কাছে আপনার প্রার্থনা নিবেদন করলে আপনি হয়তো আপনার প্রার্থিত বস্তু লাভ করতে পারবেন।" রাজা দ্রুপদ যথারীতি যাজের কাছে যেয়ে বলার পরে তিনি রাজি হলেন পুত্রেষ্টি যজ্ঞ করার জন্য এবং বললেন উপযাজকেও সেই যজ্ঞে প্রয়োজন যিনি যজ্ঞের মন্ত্র অভিমন্ত্রিত করবেন। উপযাজ রাজি হলেন। যথানিয়মে ব্রহ্মর্ষি দ্বয়ের যজ্ঞের আহুতি প্রদানের  পরে সেই যজ্ঞের থেকে উদ্ভূত হলেন এক পুত্র ও এক কন্যা। পুত্র অগ্নিবর্ণ ঘোরাকার, কিরীট বর্মধারী, হস্তে খড়্গ ও তীর ধনুক। কন্যার গাত্র শ্যামবর্ণা, নয়নযুগল পদ্মপত্রের ন্যায় বিশাল,  কুঞ্চিত কেশদাম ঘনমেঘের ন্যায় গাঢ় নীলবর্ন, নখসমূহ তাম্রবর্ণ, ভ্রুযুগল টানা টানা, সঘন জঘন, পীনপয়োধরা। সেই সময়ে দৈববাণী হলো "এই পুত্রের হাতে হবে দ্রোণবধ এবং সর্ব নারীর শ্রেষ্ঠা এই কণ্যা হবে কুরুবংশ তথা সমগ্র পৃথিবীর ক্ষত্রিয় নিধন কারক। জন্ম মুহূর্তে পুত্রের আস্ফালন দেখে রাজা তার নাম রাখলেন ধৃষ্টদ্যুম্ন এবং যজ্ঞ থেকে উত্থিত বলে কন্যার নাম রাখলেন যাজ্ঞসেনী। দ্রুপদ রাজার কন্যা বলে তার আর এক নাম হলো দ্রৌপদী। কৃষ্ণবর্ণা বলে কৃষ্ণা, পাঞ্চাল রাজকন্যা বলে পাঞ্চালী ইত্যাদি।    
                                     (পরবর্তী সংখ্যায় দেখুন)

Post a Comment

0 Comments