জ্বলদর্চি

বাহাদুর চিত্রকর (পটশিল্পী, সংগ্রাহক, পটচিত্রী সংগঠক -- নয়া, পিংলা, পশ্চিম মেদিনীপুর) /ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ৩৬

বাহাদুর চিত্রকর (পটশিল্পী, সংগ্রাহক, পটচিত্রী সংগঠক -- নয়া, পিংলা, পশ্চিম মেদিনীপুর)

ভাস্করব্রত পতি

পেটে অভাবের বাজনা। সেই বাজনায় জ্যাজ, পপ বা রকের সুর মেলেনা। সেই বাজনায় চোখ দিয়ে জল চুঁইয়ে পড়ে। চোখের জলের বাষ্পন্নাত জগতেই পরিশীলিত হাতে তিনি এঁকে চলেন পটচিত্র। এঁকে চলেন বাংলার লৌকিক ঘরানার রূপ। টিকিয়ে রাখছেন বাংলার সংস্কৃতি।

লুপ্তপ্রায় সামগ্রী টিকিয়ে রাখার প্রয়াসে তিনি 'বাহাদুর'। বাহাদুর চিত্রকর। তাঁর হাতের বাহাদুরিতে মোহিত হতেই হয়। পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলার নয়াতে সাকিন। তিনি বড়লোক নন। সোনার চামচ মুখে দিয়ে তাঁর জন্ম হয়নি। কিন্তু মনের মনিকোঠায় তাঁর যে ভাবনার জারক রস সিঞ্চিত হয়, তা যে কোনো তাবড় তাবড় 'বড় মানুষ'দের তুলনায় অনেকগুণ বেশি অভিনন্দিত হওয়ার দাবিদার।
মেঠো বাড়ি। দরমার বেড়া। তাঁরই মাঝে তাঁর বড় হওয়া। আজ তিনি মেয়ে, জামাই, নাতনিদের নিয়ে সফল "বাবা"। কিন্তু একটা ম্রিয়মান লোকসংস্কৃতি তথা লোক শিল্পকলাকে বাঁচাতে তিনি এগিয়ে এসেছেন। নিজস্ব ক্ষমতা ও দক্ষতায় গড়ে তুলেছেন সংগ্রহশালা। একসময় বাবা মহম্মদ চিত্রকর টিন বিক্রি করতেন। মা বাহারজান চিত্রকর ছবি আঁকতেন। তাঁর অনুপ্রেরণাতেই হাতেখড়ি এই কাজে। আজ তিনি সফল পটুয়া।
বহু টাকা খরচ করে তাঁর সংগ্রহশালা নির্মিত হয়েছে। ভেঙে দিয়েছেন নিজের পুরোনো বাড়ি। নয়াতে নিজের ভিটেতেই গড়ে তুলেছেন বাহাদুরের সংগ্রহশালা। কিভাবে টাকা এসেছে তা তিনি জানেন না। কিন্তু মনের দৃঢ় বিশ্বাস আর অদম্য ইচ্ছাশক্তিকে প্রাধান্য করেই তিনি সফলতার দিকে এগিয়ে চলেছেন। কেউ কোনো সাহায্য করেনি এখনও। ড. শ্যামল বেরা বাহাদুর চিত্রকরের এই সংগ্রহশালা সম্পর্কে লিখেছেন, "পিংলার বাহাদুর চিত্রকর এখন আন্তর্জাতিক খ্যাতি পেয়েছেন। মস্কো ঘুরে এসেছেন কয়েক বছর আগে। প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী সহ অনেক শিল্পরসিক তাঁর কাজের প্রশংসা করেছেন। দিল্লীর রাজপথে বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামীদের পটচিত্র নিয়ে কাজ করেছেন যৌথভাগে। জার্মানির টমাস কাইজার বাহাদুরের কাছে বেশ কিছু ঐতিহ্যবাহী পট কিনেছেন। চরম দারিদ্র্যের মধ্যে লড়াই করে ক্লাস ফোর পর্যন্ত পড়াশুনা করেছেন। পট আঁকতে আঁকতে, পট নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় যেতে যেতে বাহাদুর একসময় বুঝলেন — দেশের ঐতিহ্যবাহী শিল্প, পটের সংগ্রহশালা না করলে সম্পদ সব হারিয়ে যাবে। শুরু হয় তাঁর পট সংগ্রহ। পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া অন্যান্য রাজ্যের পটুয়াদের পট আজ তাঁর সংগ্রহশালায়। এক সঙ্গে নানা ধরনের পট দেখতে হলে বাহাদুরের ‘পটচিত্র সংগ্রহশালা' বড় আশ্রয়।"
কি রয়েছে এই সংগ্রহশালায়? অসংখ্য পটচিত্র রেখেছেন সযতনে। ইতিমধ্যে তিনি সংগ্রহ করেছেন এমন কিছু পটচিত্র, যা কিনা একশো বছরের বেশি প্রাচীন। প্রায় বিবর্ণ এই পটচিত্রগুলি ভীষণ রকমভাবে প্রয়োজনীয় হয়ে উঠবে দুই প্রজন্মের পটচিত্রের অঙ্কনের ফারাক যোগাতে। সংরক্ষণাগারে এগুলি হয়ে উঠবে মুখ্য আকর্ষণ। এবং অবশ্যই বর্তমান সময়কালের শিল্পীদের পটচিত্রও গুরুত্ব সহকারে রাখা হয়েছে এখানে। এক ছাতের তলায় সবই দেখা যাবে বাহাদুরের বাহদুরিতে।
এখানে পটচিত্রের সঙ্গে আছে অসংখ্য পুঁথিপত্র, টেরাকোটার কাজ, পুরোনো দলিল দস্তাবেজ, ঢেঁকি, কাঁচের কাজ, ডোকরার কাজ, কাঠের কাজ, গেরস্থালীর পুরানো তৈজসপত্র, পুরোনো দিনের পাল্কী, গরুর গাড়ির চাকা সহ বহু পুরানো বইপত্রের সংগ্রহ। এছাড়াও এখানে মিলবে বায়োস্কোপ, বাদ্যযন্ত্র, ওড়িশার তালপাতার চিত্র, জৌপুতুল, কলের গান, দেশ বিদেশের স্টাম্প, বিভিন্ন ধরনের মুখোশ, বিহারের মধুবনী, রাজস্থানের মিনিয়েচার পেন্টিং ইত্যাদি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের টাকা তিনি সংগ্রহ করেছেন। রয়েছে অজস্র মুদ্রা। শতবর্ষ প্রাচীন শাড়ি, কাপড় পেয়েছেন অজস্র। অতি প্রাচীন দারুমূর্তি রেখেছেন অসংখ্য। কাঠের মুখোশ, হুঁকো, ডোকরার কাজ, বাদশাহী রেকাব, মদের পাত্র — এগুলি আজ দেখতে পাওয়া যায় না। কিন্তু পাড়ায় পাড়ায় পট দেখাতে গিয়ে বাহাদুর সেগুলিকে 'অমূল্য' সম্পদ মনে করে নিয়ে এসেছেন নিজের কব্জায়। তথাকথিত শিক্ষিত সমাজের চোখে এসব অবশ্য 'বাতিল সামগ্রী' হিসেবে গণ্য হয়।

জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


জ্বলদর্চি তিরিশ পেরিয়ে... 
এক সময় বায়োস্কোপে সিনেমা দেখানো হত। সেসব আজ অচল। প্রায় ৬ হাজার টাকা খরচ করে কেশপুর থেকে কিনে এনেছিলেন তা। নিজের আঁকা পটচিত্র সেই বায়োস্কোপে জুড়েছেন। মোবাইলে খুনসুটি করা এ প্রজন্মের ছেলে মেয়েদের বায়োস্কোপের মাধ্যমে লুপ্তপ্রায় পটচিত্র দেখানোর এবং গান শোনানোর এক অভিনব উপায় গড়েছেন তিনি। বাহাদুরের সংগ্রহশালায় ঠাঁই পেয়েছে তা।

'বাংলা নাটক ডট কম' নয়াতে গঠন করেছিল 'চিত্রতরু' ক্লাস্টার। বাহাদুর সেই ক্লাস্টারের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। তিনি জানান, এখানে একদিকে পটচিত্র, অন্যদিকে সংগ্রহশালা গড়ে উঠলে একসময় গোটা নয়ার চরিত্র বদলে যাবে। মানুষজন বাঁচতে শিখবে। দেশ বিদেশ থেকে লোকজন আসবে। 'সানসেট ইণ্ডাস্ট্রি' হিসেবে গণ্য পটচিত্র অঙ্কন পাবে বেঁচে থাকার দিশা। টিকে থাকার অক্সিজেন।
কলকাতার গৌড়ীয় মঠে চৈতন্যলীলার ওপর বড়সড় কাজ করেছেন তিনি। সেইসাথে নেতাজী সুভাষচন্দ্রের ১২৫ তম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে তাঁর জীবনী নিয়ে ১২০ ফুট বাই ৬ ফুট দৈর্ঘ্যের পট করেছেন ভারতের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থাপনায়। সেই পট এখন জাতীয় গ্রন্থাগারে রক্ষিত আছে। ভুবনেশ্বরের একটি কলেজে পৃথিবীর সৃষ্টি নিয়ে দীর্ঘ পটচিত্র এঁকেছেন তিনি।
নিজের বাড়িতে নিজের কাজের পাশাপাশি অনলাইনে পটচিত্র নিয়ে ক্লাস নেন এখন। কলকাতার ভারতীয় জাদুঘরেও ক্লাস নিয়েছেন এই বিষয়ে। আগ্রহীদের জন্য কালীঘাটের পট, সাঁওতালী পট ইত্যাদি নানা ধরনের পটশৈলীর প্রশিক্ষণের ক্লাস তিনি নিচ্ছেন। বাড়িতে বসেই টেক্সটাইলের উপর নানা ধরনের কাজ করছেন। করোনার সময় পূর্বাঞ্চলীয় সংস্কৃতি কেন্দ্র'র (EZCC) আয়োজনে নয়াতেই ২৬১ জন পটশিল্পী নিয়ে প্রশিক্ষণ এবং বিপণনের মতো দুরূহ কাজ সফলভাবে সম্পন্ন করেছেন। সম্প্রতি বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিবাজীপ্রতীম বসু এসেছিলেন তাঁর সংগ্রহশালায়। তিনি এখান থেকেই ঘোষণা করেছেন, খুব শিগগিরই বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পটচিত্র অঙ্কন বিষয়ক একটি সার্টিফিকেট কোর্স চালু করা হবে।
তিনি নিজের ভাবনায় যে 'ছাত' তৈরি করছেন, সেই 'ছাত' আজ বিশ্বজনীন। বাংলার হারিয়ে যাওয়া গৌরবের অনুসন্ধান এবং তাকে টিকিয়ে রাখার চেতনায় জারিত তাঁর ভাবনা। অতি শুভ তাঁর প্রয়াস। অতি নগণ্য তাঁর লোকবল। কিন্তু তিনি মানেন কবির কথা—'ছোট শিশু মোরা, তোমার করুণা, হৃদয়ে মাখিয়া লব'। আজ বাহাদুরের এই 'ছোট্ট শিশু'ই হয়ে উঠেছে নয়া'র মুখ। মেদিনীপুরের মুখ। গোটা পটুয়া পাড়ার মুখ।

Post a Comment

0 Comments