নূতন শিক্ষা নীতি ২০২০ (NEP- 2020) - কিছু প্রশ্ন
পর্ব - ৪
অধ্যাপক সজল কুমার মাইতি
বিদ্যালয় বা স্কুল শিক্ষা
আমাদের নূতন শিক্ষা নীতিতে (NEP 2020) বিদ্যালয় বা স্কুল শিক্ষা বিষয়ে যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। সেজন্য এই বিষয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সেই সকল সিদ্ধান্তগুলির কিছু উল্লেখযোগ্য অংশ আলোচনা করা যাক। এবারের আলোচ্য বিষয় - মূল্যায়ন সংস্কার।
মূল্যায়ন সংস্কার
নতুন শিক্ষানীতিতে মূল্যায়ন বিষয়ে আমূল সংস্কারের প্রস্তাব আনা হয়েছে। সমষ্টিগত মূল্যায়ন থেকে নিয়মিত ও গঠনমূলক মূল্যায়নের প্রস্তাব করা হয়েছে। এই পদ্ধতি অধিক যোগ্যতা ভিত্তিক, শিক্ষা ও উন্নয়ন প্রসারী এবং উচ্চতর দক্ষতা - যেমন বিশ্লেষন, ব্যাখ্যামূলক চিন্তন ও ধারনামূলক স্পষ্টতা- এই সকল বিষয়ে অধিক উপযোগী। দশম ও দ্বাদশ শ্রেনীর বোর্ড পরীক্ষা চলতে থাকবে, কিন্তু সংস্কার চলতে থাকবে যাতে এইসব পরীক্ষার জন্য কোন কোচিং নেওয়ার দরকার না হয়। বোর্ড পরীক্ষা নতুন রূপে নিতে হবে যার মাধ্যমে বৌদ্ধিক উন্নয়ন সম্ভব হয়। অন্তঃক্ষমতা পরীক্ষার দ্বারা এই সকল বিষয় অনেক সহজ করা সম্ভব। সকল ছাত্রকেই এই পরীক্ষা দেওয়ার জন্য যেকোন স্কুলকে বছরে দুবার সুযোগ দিতে হবে। একটি হবে মূল পরীক্ষা এবং দ্বিতীয়টি যদি দরকার পড়ে তবে রেজাল্টের উন্নতির জন্য। প্রতিটি ছাত্রকে এই পরীক্ষা দিতে হবে তৃতীয়,পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে। উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ এই পরীক্ষা পরিচালনার দায়িত্বে থাকবে।
উদ্দেশ্য নিয়ে খুব একটা বিশেষ বলার নেই। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে রূপায়ন নিয়ে। বছরের পর বছর উপযুক্ত শিক্ষক ও পরিকাঠামোর অভাবে ভোগা স্কুলগুলির অবস্থা দেখে এই আশ্বাসবাণীতে খুব একটা ভরসা রাখা যায় না। কোচিং এর প্রয়োজনীয়তা দূর করার কথা বলা হয়েছে, কিন্তু বাস্তব তো ঠিক উল্টো কথা বলে।
একটি জাতীয় মূল্যায়ন কেন্দ্র, PARAKH (Performance Assessment, Review, and Analysis of Knowledge for Holistic Development) প্রতিষ্ঠা করা হবে। এর কাজ হবে ভারতের প্রতিটি স্কুল বোর্ডের ছাত্র মূল্যায়ন ও পরীক্ষা ব্যবস্থার মূল্যায়নের জন্য নিয়ম নীতি প্রনয়ন, মান নির্ধারণ ও নির্দেশিকা প্রস্তুত করা। এর অন্য কাজগুলি হল State Achievement Survey ( SAS) এর কাজের দিক নির্দেশ করা, National Achievement Survey (NAS) এর কাজ পরিচালনা করা, শিক্ষার ফল লাভপ্রাপ্তির ওপর নজরদারি করা, স্কুল বোর্ডগুলিরকে মূল্যায়ন ধারার পরিবর্তনের জন্য সাহায্য ও উৎসাহিত করা যার ফলে একবিংশ শতাব্দীর জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করা সম্ভব হয়।
পরীক্ষা ব্যবস্থায় কিছু পরিবর্তন অবশ্যই আসবে, কিন্তু গুনগতমানে কতটা উন্নতি হবে সে কেবল সময়ই বলবে।
ন্যায্য ও সবার জন্য শিক্ষা
নূতন শিক্ষা নীতির (NEP 2020) লক্ষ্য হল এটা নিশ্চিত করা যাতে কোন শিশু তার জন্ম ও পটভূমির জন্য লেখা পড়ার ও জীবনে প্রতিষ্ঠাসম লাভের সুযোগ থেকে বঞ্চিত না হয়। বিশেষ জোর দিতে হবে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া শ্রেণির ছাত্রদের জন্য। এই ব্যাপারে যে বিষয়গুলি বিবেচনা করতে হবে, সেগুলি হল: লিঙ্গ চিহ্নিতকরন ( বিশেষকরে মহিলা ও তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিদের), সামাজিক সাংস্কৃতিক চিহ্নিতকরন ( যেমন - তফশিলি জাতি ও উপজাতি, অন্য পিছিয়ে পড়া জাতি এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়), ভৌগোলিক চিহ্নিতকরন ( যেমন - গ্রাম থেকে আসা ছাত্র, ছোট শহর থেকে আসা এবং উচ্চাকাঙ্খী জেলা থেকে আসা), বৈকল্য ( শিক্ষায় বৈকল্য ও অন্তর্ভুক্ত ) এবং আর্থ সামাজিক অবস্থা ( যেমন - পরিযায়ী সম্প্রদায়, স্বল্প আয়ের পরিবার, বিপজ্জনক অবস্থায় থাকা শিশু, পাচারের শিকার ও পাচারের শিকারের সন্তান, অনাথ ও শহরের শিশু ভিক্ষুক এবং শহরের গরীব )।
এই মহতী উদ্দেশ্য সফল করার জন্য প্রয়োজন অধিক আন্তরিক প্রয়াস। আমরা এই বিষয়ে অনেক পিছিয়ে আছি। সংঘবদ্ধ আন্তরিক প্রয়াস এই উদ্দেশ্য পূরণে সফলতা যেমন আনতে পারে, তেমন দেশের অগ্রগতি ও নিশ্চিত করতে পারে।
পৃথক লিঙ্গ অন্তর্ভুক্তিকরণ ফান্ড
একটি পৃথক লিঙ্গ অন্তর্ভুক্তিকরণ ফান্ড তৈরি করা হবে একটি বিশেষ শিক্ষা অঞ্চলের পিছিয়ে পড়া জায়গা ও দলের জন্য।
বৈকল্য যুক্ত শিশুদের সক্ষম করে তুলতে হবে যাতে তারা ভিত্তিমূলক শিক্ষা থেকে উচ্চ শিক্ষা অব্দি নিয়মিত স্কুল শিক্ষা প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহন করতে পারে। বিভিন্ন বৈকল্যে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বিশেষ শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে এবং যেখানে দরকার উপযুক্ত সম্পদ কেন্দ্র ও তৈরি করা দরকার বিশেষকরে যারা বহু বৈকল্য বা গুরুতর বৈকল্যের শিকার তাদের সাহায্যের জন্য। স্কুল ও স্কুল পরিসর এমনভাবে তৈরি করতে হবে যাতে প্রতিটি বৈকল্যযুক্ত শিশুকে তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী সাহায্যের ব্যবস্থা থাকে এবং প্রতিটি শিশু যাতে শ্রেণিকক্ষ শিক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। সাহায্যকারী যন্ত্রপাতি ও উপযুক্ত টেকনোলজি যুক্ত যন্ত্রাংশ তৈরি রাখতে হবে যাতে শিশুদের সাহায্য করা যায় যার ফলে তারা শ্রেণিকক্ষ শিক্ষায় তাদের অন্য সহযোগীদের সঙ্গে অংশগ্রহণ করতে পারে। এরজন্য উপযুক্ত শিক্ষক ও নিয়োগ করতে হবে।
প্রতিটি রাজ্য জেলায় " বাল ভবন" নির্মানে উৎসাহ প্রদান করা হবে। এগুলি বিশেষ ডে বোর্ডিং স্কুল হিসেবে কাজ করবে। এখানে কলা সম্বন্ধীয় বিষয়, পেশা সম্বন্ধীয় বিষয় ও খেলা সম্বন্ধীয় বিষয়ে ছাত্ররা যাতে অংশগ্রহণ করতে পারে তার ব্যবস্থা থাকতে হবে। স্কুল পরিকাঠামোর অব্যবহৃত অংশ সামাজিক, চিন্তনমূলক কাজ ও সম্প্রদায়ের বিভিন্ন কাজের জন্য ব্যবহৃত হবে। এবং স্কুল সময়ের পরও যাতে সামাজিক সংহতি বজায় থাকে সেজন্য ও এই অব্যবহৃত অংশ ব্যবহার করা হবে। এইগুলিকে "সামাজিক চেতনা কেন্দ্র" হিসেবে ও ব্যবহার করা হবে।
এই বিষয় ও মহৎ সে ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন উঠতে পারে না। কিভাবে বাস্তবায়ন করা যায় তা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। আর্থিক প্রয়োজন কিভাবে সমাধান করা যাবে তাও সন্দেহের ওপরে নয়।
শিক্ষক নিয়োগ ও পেশাগত পথ
স্কুলে শিক্ষক নিয়োগ করা হবে একটি বলিষ্ঠ ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। পদোন্নতি হবে মেধা ভিত্তিক এবং বিভিন্ন সূত্র থেকে সময় ভিত্তিক কার্যমূল্যায়নের এক পদ্ধতি কার্যকর করা হবে। শিক্ষকদের জন্য শিক্ষা প্রশাসক ও শিক্ষক শিক্ষাদাতা হওয়ার প্রগতির পথ থাকবে। একটি National Professional Standards for Teachers (NPST) বা শিক্ষকদের জন্য জাতীয় পেশাগত মান তৈরি করা হবে জাতীয় শিক্ষক শিক্ষা পর্ষদ (NCTE) দ্বারা ২০২২ সালের মধ্যে। এই কাজে NCTE বিভিন্ন উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, NCERT, SCERT গুলি, বিভিন্ন অঞ্চল ও স্তরের শিক্ষক ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা পরামর্শদাতা সংস্থাগুলির সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্তে পৌঁছবে। এই পেশাগত মান ২০৩০ সালের মধ্যে পর্যালোচনা করা হবে ও পরিবর্তন করা হবে এবং এর পরে প্রতি দশ বছর অন্তর পর্যালোচনা করা হবে।
জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇
স্কুল পরিচালন
স্কুল পরিচালনার জন্য প্রতিটি স্কুলের পরিসর বা ক্লাস্টারকে স্কুল পরিচালনার একটি একক হিসেবে গন্য করা হবে এবং বিভিন্ন সম্পদ যাতে সেখানে পাওয়া যায় তা নিশ্চিত করতে হবে। এই সব সম্পদের মধ্যে পরিকাঠামো -যেমন - শিক্ষামূলক লাইব্রেরি এবং মানব সম্পদ অর্থাৎ কলা ও সংগীত শিক্ষক এবং এর সঙ্গে এক বলিষ্ঠ পেশাদার শিক্ষক সম্প্রদায়।
মান নির্ধারণ ও স্কুল শিক্ষার মূল্যায়ন
স্কুলের কার্যপরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের বিষয় পৃথক সংস্থা দ্বারা পরিচালিত হবে যাতে স্বার্থের দ্বন্দ্ব পরিহার করা যায়। এর মূল উদ্দেশ্য হল যাতে প্রতিটি স্কুল ন্যূনতম পেশাদার ও গুনমান বজায় রেখে চালিত হয়। এর জন্য প্রতিটি রাজ্য একটি স্বাধীন সংস্থা সারা রাজ্যের জন্য রাজ্য স্কুল মান অধিকার ( State School Standards Authority) প্রতিষ্ঠা করবে। রাজ্যগুলির SCERT স্কুলগুলির জন্য স্কুল মান নির্ধারণ ও মূল্যায়ন কাঠামো ( SSAAF) গঠন করবে অন্যান্য সকল স্বার্থগোষ্ঠীর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে। সরকারি ও বেসরকারি সকল স্কুলের মূল্যায়ন হবে একই মানদন্ডের ভিত্তিতে এবং একই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। প্রতিটি কাজ হবে স্বচ্ছতার সঙ্গে যার ফলে সরকারি স্কুলের সঙ্গে বেসরকারি স্কুল ও উৎসাহিত হয়।
প্রস্তাবগুলি যদি সত্যিই বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়, তাহলে আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার আভূল পরিবর্তন হবে। তবে এত বছরের অভিজ্ঞতা কিন্তু অন্য কিছু বলে। গুনমানের উন্নয়ন থেকে অবনমন অধিক চোখে পড়ে।
বৃত্তিমূলক শিক্ষা
২০২৫ সালের মধ্যে স্কুল ও উচ্চ শিক্ষার শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৫০% বৃত্তিমূলক শিক্ষার অধীন আসার সম্ভাবনা। প্রতিটি মাধ্যমিক স্কুলে বৃত্তিমূলক শিক্ষা সংবদ্ধ করা হবে আগামী এক দশকের মধ্যে ধাপে ধাপে। মাধ্যমিক স্তরের স্কুলগুলি ITI, পলিটেকনিক ও স্থানীয় শিল্পের সঙ্গে সহযোগিতা করবে। প্রতিটি ছাত্র কমপক্ষে একটি বৃত্তিমূলক শিক্ষা গ্রহণ করবে এবং অন্যান্য বৃত্তিমূলক শিক্ষা শেখার ও সুযোগ থাকবে। ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণির মধ্যে প্রতিটি ছাত্রকে একটি দশ দিনের স্কুল ব্যাগ শূন্য ট্রেনিং এর ব্যবস্থা থাকবে যাতে স্থানীয় দক্ষ ছুতোর, কুমোর, মালী ও শিল্পীর তত্ত্বাবধানে হবে। এমনকি স্কুল ছুটির দিনগুলিতে ও ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণির মধ্যে ছাত্রদের বৃত্তিমূলক শিক্ষার ইন্টার্নশীপের সুযোগ থাকবে। এছাড়াও অনলাইনে বৃত্তিমূলক শিক্ষার সুযোগ পাওয়া যাবে।
বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রস্তাব আমাদের মতো বিশাল জনবহুল দরিদ্র দেশের পক্ষে বড়ই উপযোগী। যত শিগগির ও সুচারুরূপে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় করা দরকার। এর সঙ্গে সঙ্গে উদ্যোগপতি তৈরি প্রয়াস ও যুক্ত হওয়া দরকার। যাতে আমরা " Job seeker to job giver" এর সংখ্যা বাড়াতে পারি। ( চলবে)
সজল কুমার মাইতি।
প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান, বানিজ্য বিভাগ, হুগলী মহসীন কলেজ। পূর্বতন অধ্যাপক, গোয়েঙ্কা কলেজ অফ কমার্স এ্যান্ড বিজনেস অ্যাডমিনিষ্ট্রেশন, কলকাতা। চৌত্রিশ বছরের অধিক কাল ইউ জি ও পি জি শিক্ষা দানের অভিজ্ঞতা। বতর্মানে পশ্চিমবঙ্গের সরকারি কলেজের বানিজ্য বিষয়ে সিনিয়র সার্ভিসের একমাত্র অধ্যাপক।
জ্বলদর্চি তিরিশ পেরিয়ে 👇
0 Comments