জ্বলদর্চি

অজানা পথে (প্রথম পর্ব ) /মিলি ঘোষ

অজানা পথে (প্রথম পর্ব )

মিলি ঘোষ

  
ভদ্রলোক কী করতেন, ঠিক জানা যায় না। তবে দুই ছেলে মেয়েকে পড়াশুনা করিয়েছেন। ছেলে নিপুণ, প্রথম সন্তান। আহামরি কিছু না হলেও স্কুলের গণ্ডি, কলেজের গণ্ডি সবই টপকেছে নিতান্ত সাদামাটা ভাবে। তারপর কোথাও একটা কাজ জুটিয়ে বিয়ে পর্ব সেড়ে ফেলেছে। বোধহয় নিজের পছন্দেই। 
মেয়ে রাহীও পড়াশুনা করেছে খানিক। তবে, উচ্চ মাধ্যমিকে গিয়ে হোঁচট খেল। আর উঠে দাঁড়ায়নি। পড়াশুনায় ওখানেই ইতি। বলে তো, একটা সাবজেক্টে ব্যাক ছিল। সত্যি, মিথ্যা জানা নেই।

রাহী মোটামুটি রটিয়ে দিয়েছে, বাবা-মা অর্থের অভাবে আর ওকে পড়াতে পারেননি। বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন, ওই উচ্চ মাধ্যমিকের পরেই। এক বছর পরেই নাকি রাহীর মেয়ে হয়। রাহীর বয়স আর ওর মেয়ের বয়স সামনে এলেই বোঝা যায়, ওখানে কিছু গরমিল আছে। উচ্চ মাধ্যমিকের পরেই যে ওর বিয়ে হয়নি, সেটাও পরিষ্কার হয়ে যায়। কাজেই, সত্যিই রাহীর বাবা-মা অর্থের অভাবে আর পড়াতে পারেননি, নাকি রাহীই উনিশটিবার এইচএস-এ ঘায়েল হয়ে থামল শেষে, তা জানা যায়নি। তা ছাড়া রাহীর বাবার প্রায় চার কাঠা জমিতে একটা বাড়ি ছিল, যা আপাতত প্রমোটারের দখলে। কাজেই রাহীর বাবাকে গরিব বলা যায় কিনা, যারা ওঁকে দেখেছে, তারা বলতে পারবে।

রাহীর বক্তব্য অনুযায়ী ওর মা, মোটামুটি গুণবতী মহিলা ছিলেন। নানা রকম সেলাই টেলাই জানতেন। আর ছিল পড়াশুনার প্রতি অদম্য আকর্ষণ। নিজেও কিছুটা করেছেন। সে'যুগের পিউ পাশ। সেটা হয়তো মিথ্যা নয়। কারণ, নিজের ছেলে-মেয়েরা যাতে ঠিকঠাক পড়াশুনা করে, সেদিকে রাহীর প্রবল নজর আছে। হয়তো এই গুণটা, মায়ের থেকেই পাওয়া, নয় তো জীবন রাহীকে বাস্তবটা শিখিয়েছে।   

নিপুণ, কাজেকর্মে একেবারে নিপুণ না হলেও স্ত্রী ও একমাত্র কন্যাকে নিয়ে সংসারটা চালিয়ে নেয়। প্রমোটারের দেওয়া ভাড়া বাড়িতে ওর বাস। বাবার জমিতে ফ্ল্যাট উঠলে দু'তলাটা ও পাবে। 
ওর বৌ ব্লাউজে হুক টুক বসানোর কাজ করে হাত খরচা তুলে নেয়। সব সময় বরের কাছে চাইতে কি ভালো লাগে কারোর ? 
কিন্তু চাপে পড়ে গেল রাহী। যাকে সে বিয়ে করল বা যার সঙ্গে ওকে বিয়ে দেওয়া হলো, সে একটি চূড়ান্ত অলস প্রকৃতির মানুষ। কোনও কম্মই করে না। বাবার জমিতে ফ্ল্যাট একটা রাহীও পাবে। তবে দাদা নিজে দু'তলা নিয়ে, ওকে চার তলায় ঠেলেছে। তাই সই। রাহী তাতেই খুশি। ভাড়ার টাকা গুনতে না হলেও, রাহীকে প্রমোটার যে বাড়ি দিয়েছে, তা বাসের অযোগ্য। এদিকে সংসার টানাও দুরূহ হয়ে উঠল। বাধ্য হলো রাহী লোকের বাড়িতে বাসন মাজা, ঘর মোছার কাজ নিতে। নিজের বিদ্যার দৌড় তেমন নয়, যে তা দিয়ে চারজন লোকের সংসার চালানো যায়। খুব বেশি হলে বাংলা মিডিয়ামের বাচ্চাদেরকে পড়াতে পারবে। কিন্তু তাতে পয়সা কই ? তা ছাড়া, নামডাক না থাকলে লক্ষ্মী পুজোর পেশায় নিযুক্ত শিক্ষকদের পেছনে অযথা অর্থের অপচয় করতে কেই বা চায়! এর পরেও আর একটা ব্যপার আছে। তা হলো, মিউজিয়ামে রাখার মতো রাহীর হাতের লেখা। ওর হাতের লেখা দেখে যে কেউ ভাববে, ও কী করে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত গেল! কোন্ পরীক্ষকের এত সময় আছে, ওই হাতের লেখার কাঁটাজাল ভেদ করে উত্তর খুঁজে নেওয়ার! 

তবে,রাহীর মধ্যে এমন কিছু ব্যপার আছে, ওর মুখের দিকে তাকালে বা ওর সঙ্গে কথা বললে, ঠিক আর পাঁচজন কাজের লোকের মতো মনে হয় না। একে তো রাহী কিছুটা পড়াশুনা করেছে, তার ওপর একটা ভদ্র সভ্য আবরণ থাকায় সকলেরই ওর প্রতি একটা সহানুভূতি তৈরি হয়। 
প্রথম যে বাড়িতে রাহী কাজে ঢোকে, সেই বাড়ির ভদ্রমহিলা আগে থেকেই রাহীকে চিনতেন। চিনতেন মানে, ছোটবেলার বন্ধু, সমবয়সী। নাম পলি রায়। তিনি নিজে একটি প্রাইমারি স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষিকা, যে স্কুলে শিক্ষক সংখ্যা ৪, হ্যাঁ, চার। ওটা আট না। 
রাহী মাঝেমাঝে নিজের সমস্যার কথা পলিকে বলত। শুনে ক্ষেপে যেতেন পলি।
বলতেন, "সে কী রে! এমন কেন তোর বর ? কিছু বলতে পারিস না ?"
   "কত বলব? কারোর যদি লজ্জা না থাকে, কোনও দায়দায়িত্ব না থাকে, তাকে আর কী বলব ?"
   "দেখে কিন্তু একটুও মনে হয় না। কী ভদ্র!"
   "লোকের সামনে ওরকমই।"
এমন কথোপকথন দুই বন্ধুর মধ্যে মাঝেমাঝেই হয়। 

কিছুটা নিজের প্রয়োজনে আর কিছুটা রাহীর প্রতি সহানুভূতির কারণে পলি তাঁর বাড়িতে এবং স্কুলে রাহীকে কাজে ঢোকালেন। কাজ মানে, জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ। ভোর বেলা সবার আগে গিয়ে স্কুলের দরজা খোলা, ঘণ্টা বাজানো, শিক্ষকদেরকে চা, জল দেওয়া, বাচ্চাদেরকে লাইন করে স্কুল ছুটির পরে বের করানো, মিড ডে মিলের চাল এলে, সে পৃথিবী উল্টে গেলেও রাহীকে সেখানে উপস্থিত থেকে মালপত্র বুঝে নেওয়া, মাসে একবার মিউনিসিপ্যালিটিতে গিয়ে মিড ডে মিলের হিসেব দেওয়া ইত্যাদি সবই করতে হয়। এখানেই শেষ না। একজন দু'জন শিক্ষক মহাশয়, রাহীকে, "আমার ক্লাসটা যদি একটু নিয়ে নেন" বলে তাড়াতাড়ি বাড়ির পথও ধরেন।
এই অনুরোধটা যে আসলে আদেশ, রাহী বোঝে কি না, সে রাহীই জানে। তবে মনে মনে রাহী খুব খুশিই হয়। নিজেকে শিক্ষিকা শিক্ষিকা ভাবতে কোথাও সে একটা তৃপ্তি বোধ করে।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, বিনিময়ে রাহী কী পায় ?
 
এক মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে রাহীর কষ্টের সংসার। স্কুল থেকে যা দেয়, তাই নেয় হাত পেতে। তাই বলে দুশো টাকা ? হ্যাঁ, মাত্র দুশো টাকা নিয়ে রাহী স্কুলের চাকরি বজায় রাখল। স্কুলটি সরকারী হলেও, রাহীর নামে ওখানে কোনও পদ নেই। তাই রাহীর প্রাপ্য টাকা শিক্ষক শিক্ষিকারা নিজেদের মনিব্যাগ থেকেই দিয়ে থাকেন।  অর্থাৎ পঞ্চাশ টাকা করে তাঁদের প্রত্যেককে রাহীর জন্য দিতে হয়। তারপর ক্কচিত কোনও বছরে যদি পলি মনে করিয়ে দেন, রাহীর টাকাটা বাড়ানো দরকার বা রাহী যদি নিতান্ত সাহস সঞ্চয় করে পলিকে কিছু টাকা বাড়ানোর কথা বলতে পারে, তখন ওই 'পঁচিশ' টাকা করে বাড়িয়ে দেওয়া হয়। ১০০ টাকা বেড়ে রাহীর মাইনেও এক লাফে দেড় গুণ হয়ে যায়!  


জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


জ্বলদর্চি তিরিশ পেরিয়ে... 
টাকার অঙ্ক যে পরিশ্রমের তুলনায় নগণ্য, তা রাহী বুঝেও স্কুলের কাজে বহাল থাকে। পলির দিক থেকে, রাহীকে হাতের মুঠোয় রাখার একটা চেষ্টা প্রথম থেকেই ছিল। ভাবখানা এমন, তোর বিপদের সময়, আমিই তো পাশে থাকলাম। রাহীও পলির ব্যপারে উচ্ছ্বসিত। তার অন্যতম কারণ, ওই স্কুলের চাকরি। সেখানে অর্থ না থাকলেও সুখ আছে, অলীক আশা আছে। 
পলি কিছুটা নিজের স্বার্থে রাহীকে ধরে রেখেছেন। অনেক বছর আগে পলির স্বামী মারা গেছেন। এক ছেলেকে নিয়ে সংসার তাঁর। সঙ্গে আছে প্রচুর শারীরিক জটিলতা। অর্ধেক দিন স্কুলে যেতে পারেন না। তখন, বাড়িতে বসে কিছু দরকারি কাজ সেড়ে রাহীকে দিয়ে ফাইল স্কুলে পাঠিয়ে দেন। আর রাহীকে বুঝিয়ে যান, একদিন রাহীর ওই স্কুলে একটা সরকারী চাকরি হবে এবং সেই অনুযায়ী মাইনেপত্র সবই পাবে। রাহীও ছুটে চলে মরীচিকার পেছনে। 

তবে, রাহীর সংসার চলে না। নিরুপায় রাহী শুধু সন্তানদের মুখের দিকে চেয়ে আরো দু'তিনটে বাড়িতে কাজ নেয়। কিন্তু পলির খবরদারি চলতেই থাকে। কোনও বাড়িতে হয় তো রাহী বাসন মাজছে, এল পলির ফোন।
    "তুই এখনই স্কুলে যা। বাচ্চাদের ভুল ড্রেস পাঠানো হয়েছে। তুই চাবি নিয়ে গিয়ে ওগুলো সব নিয়ে আমার এখানে আয়।"
    "এখনই যেতে হবে ?"
    "হ্যাঁ, তুই এখনই যাবি।"
এবার যে বাড়িতে রাহী তখন কাজ করছে, তারাই বা যখন তখন এসব মানবে কেন ? 
তবু সব ফেলে রাহী ছোটে পরিমরি করে।

Post a Comment

1 Comments